কাজী জহিরুল ইসলাম
৪৯ বছরের এক ছোটো কিন্তু বর্ণাঢ্য জীবন যাপন করেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। চট্টগ্রামে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, ফরেন সার্ভিসে চাকরির সুবাদে দেশের বাইরেই কাটিয়েছেন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। অস্ট্রেলিয়াতে যখন পোস্টিং তখন ফরাসী কূটনীতিক আন মারির সঙ্গে পরিচয়, প্রণয় এবং বিয়ে। হৈ চৈয়ের মধ্যে থেকেও যেন নেই, যেন এখানে নয়, অন্য কোনোখানে, নিজেতেই মগ্ন, এই ঘোরই আকৃষ্ট করে। অনেকের ভেতরে থেকেও যেন স্বনির্মিত এক দ্বীপে তার বাস, একা। পার্টির কোলাহল তাকে ছুঁতেই পারছে না। কে এই মগ্ন যুবক? এই কৌতুহলই আকৃষ্ট করে ফরাসী তরুণীকে। কাছে যান, কথা বলেন এবং প্রেমে পড়েন।
এ-কথা সত্যি যে লাল সালুর জন্যই তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং এই উপন্যাসের কারণে তিনি কিছুটা সমালোচিতও। শুধু সাহিত্য নয়, যারা তার জীবনকে পাঠ করেননি তাদের মধ্যে ওয়ালীউল্লাহকে ভুল বুঝবার এবং ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করবার যথেষ্ঠ অবকাশ তৈরি হবে৷ এটিই স্বাভাবিক। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ইসলাম বিদ্বেষী ছিলেন না মোটেই৷ বরং মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ ছিল তার। আধুনিক এবং মুক্ত চিন্তার মানুষ ছিলেন তিনি। মুসলিম দেশগুলোর প্রতি পশ্চিমাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধেই ছিল তার অবস্থান। তিনি আবিস্কারের চেষ্টা করেছেন কেন মুসলিম বিশ্ব পিছিয়ে আছে, কেন মুসলমানদের প্রতি পশ্চিমাদের নেতিবাচক মনোভাব, অথচ মুসলমানদের রয়েছে কত গৌরবোজ্জ্বল অতীত। একজন খাঁটি মুক্তচিন্তার মানুষের মতোই তিনি মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার কারণগুলো শনাক্ত করেন এবং সেগুলোকে উপজীব্য করেই নির্মাণ করেন তার সাহিত্যের চৌহদ্দি।
২৩ বছরের আন মারি এবং ৩১ বছরের ওয়ালী, তখনই তাদের পরিচয়। বিয়ের পর ১৬ বছরের সংসার। ১৯৭১ সালে মারা যান সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। এই ১৬ বছরে কেমন দেখেছেন লেখক স্বামীকে? সেইসব তিনি লিখেছেন “ওয়ালী, মাই হাজব্যান্ড, অ্যাজ আই স হিম” নামক এক রচনায়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটি ইংরেজি রচনাবলীর পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়েছিল, সেটির ভূমিকা হিসেবেই রচনাটি লিখেছিলেন আন মারি। শিবব্রত বর্মনের অনুবাদে লেখাটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে প্রথমা, অবশ্য এর আগে লেখাটি প্রথম আলোর ঈদসংখ্যা ২০০৩-এ ছাপা হয়। ইংরেজি রচনাবলীটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশ হোক এটি আন মারি চেয়েছিলেন এবং তিনি নিজে এর কো-এডিটর হবার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু কোনো এক রহস্যজনক কারণে সেটি আর প্রকাশ হয়নি।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে আন মারি লিখছেন, ‘ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে নয়, সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ও মুসলমান হিসেবে গর্ব বোধ করত। ও অক্লান্তভাবে মুসলিম বিশ্বের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে যেত। পশ্চিমা দেশগুলো যখন বর্বর ছিল, তখনকার মুসলিম সভ্যতার উৎকর্ষের প্রসঙ্গ উল্লেখ করত।’
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার স্ত্রীর সঙ্গে অত্যন্ত খোলামেলাভাবে নানান বিষয় নিয়ে কথা বলতেন। তারা দুজন সার্থক স্বামী-স্ত্রীর পাশাপাশি ছিলেন একে অন্যের যোগ্য বন্ধু। ফরাসীরা আরবদের সব সময় ইউরোপীয়দের জন্য পথের কাঁটা মনে করত। এই বিষয় নিয়ে বিতর্কে ওয়ালীউল্লাহ সব সময় আরবদের পক্ষ নিয়ে নানান যুক্তি উপস্থাপন করতেন। তিনি মুসলিম সেনাপতি সালাদিনের মহত্বের কথা বলতেন। আরব দৃষ্টিকোণ থেকে ক্রুসেডের ভিন্ন মাহাত্ম্য তুলে ধরতেন। এসব থেকেই প্রতীয়মান হয় যে তিনি ধর্মানুরাগী না হলেও মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন না মোটেও। বরং ধর্মান্ধতা কীভাবে ধর্মের ক্ষতি করছে সেটিই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনা শ্লেষ-প্রধান হলেও ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন রোমান্টিক, স্নেহবৎসল। কন্যা সিমিন এবং পুত্র ইরাজকে প্রচুর সময় দিতেন। দুই সন্তানের নামও তিনি নিজেই রাখেন। এই প্রসঙ্গে আন মারি লেখেন, “ওয়ালীর বাংলা লেখালেখির একটা বড়ো অংশ শ্লেষাত্মক হলেও সে মানুষটা মোটেও বিষণ্ন বা নৈরাশ্যবাদী ছিল না। বরং উল্টো। ও ছিল সুরসিক। মানুষের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ, তাদেরকে বাড়িতে দাওয়াত দেওয়া, ওয়াইনের গ্লাস ঘিরে তুমুল আড্ডা জমানো, চড়ুইভাতি, সন্তানদের সঙ্গে খেলাধুলা ইত্যাদি ভীষণ পছন্দ করত ও।”
আন মারি এবং ওয়ালী দাপ্তরিক কাজের প্রয়োজনে বা অন্য কোনো কারণে অল্প সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন হলেই দুজন দুজনকে চিঠি লিখতেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সেইসব চিঠি নিছক কুশল বিনিময়, প্রেম-ভালোবাসার কথা, সাংসারিক বা দাপ্তরিক কথায় পূর্ণ থাকত না। তার প্রতিটি চিঠিতেই বড়ো কোনো দর্শন বা বিশ্বজনীনতা উঠে আসত। ১৯৫৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর আন মারিকে লেখা এক চিঠিতে ওয়ালী লেখেন, “আজ সকালে একটা শিশু আমার ঘরে এসে এটা-সেটা এলোমেলো করে দিল। পরে আমি সেসব গোছানোর সময় মনে মনে বললাম: সময়ের ধ্বংসযজ্ঞ একটি শিশুর ধ্বংসযজ্ঞের মতো, কেননা উভয়ই নিজের অজান্তে এ-কাজ করে। নিজের মন্তব্য নিজেরই ভালো লাগল। আমি কল্পনা করলাম সময় শিশুর মতোই চিন্তাভাবনা না করে মানুষকে অগোছালো করে দিয়ে যাচ্ছে। যা হোক, শিশুদের আমি পছন্দ করি। তবে সময় কী তা জানি না। একটা বড়ো সংখ্যার মতোই এটি বিমূর্ত।”
একই চিঠিতে তিনি নাচ সম্পর্কে লেখেন, “নাচ হল নিরবচ্ছিন্ন গতি, ছন্দোময়, নিরন্তর। নাচের এই সারবস্তুটি ব্যালেতে অনুপস্থিত। ব্যালে খুব বেশি একঘেয়ে এবং সুনির্দিষ্ট প্রকাশভঙ্গিতে বাঁধা। এ যেন একটি খাঁচার চার দেয়ালের ভেতর পাখির ওড়া। এ-খাঁচা যতদিন না ভাঙা যাচ্ছে, ব্যালেও ততদিন নিশ্চল থাকবে আর পাখিটিও পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে না।”
সকলে যা ভাবে ওয়ালীউল্লাহ সেইসবের মধ্যে একটি ভিন্ন ভাবনা জুড়ে দিয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতেন। ব্যালে বা নাচ সম্পর্কে ওয়ালীর মন্তব্য থেকে আমরা তা স্পষ্ট অনুমান করতে পারি। আন মারি নিজেও তা বলেছেন। “কর্মক্ষেত্রে যেসব মানুষের সংস্পর্শে ও এসেছে – ওর সহকর্মী, স্টাফ, সাংবাদিক বা অন্য কেউ, তারা সবাই ওকে পছন্দ করত এবং ওর প্রশংসা করত। সবার ব্যাপারে ও এত মনোযোগী আর আন্তরিক ছিল যে, সবার মন জয় করে ফেলত অনায়াসে। খুব ভালো সঙ্গ দিতে পারর ও। সুবক্তা ছিল, বিশ্বাসযোগ্য করে গল্প বলতে পারত। ওর সঞ্চয়ে সব সময় মজাদার কোনো বক্তব্য থাকত, সবচেয়ে ব্যাতিক্রমী মন্তব্যটি ছুড়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল ওর।”
১৯৫৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পিআইএর প্লেনে করে ঢাকা থেকে করাচি যাচ্ছেন। প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তিনি বলেন, “সূর্য ডুবছে। আর মিনিট বিশেকের মধ্যে সূর্য দেখা যাবে না। আমার মনে হয়, এত উঁচু থেকে তাকালে পৃথিবীটা এক রহস্যময় সৌন্দর্য ধারণ করে।…আমি ভয়ানক বিষাদক্লিষ্ট। এ এক অদ্ভুত যন্ত্রণা। আতোয়াঁ দ্য স্যাঁত এক্সুপেরির কথা মনে পড়ে আমার। হয়তো এই নীরব বিস্মৃতি, শূন্যতা, নীরবতম নীরবতার কাছে আসার জন্যে, একে বোঝার জন্যে বা হয়ত একে জয় করার জন্যই তিনি আকাশে উড়েছিলেন। আন্দেজের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়ও কি তিনি এমনই ভয়ানক বিষণ্ন বোধ করেছিলেন?… পৃথিবীটা এমন অপূর্ব। অদ্ভূত ব্যাপার হলো, এই উপলব্ধি কাউকেই আনন্দ দেয় না। এ এমন এক বিদঘুটে উপলব্ধি যা মন খারাপ করে দেয়। আমারও সেই অনুভূতিই হচ্ছিল। এ সৌন্দর্য উপলব্ধির পাশাপাশি বিষণ্নতার কারণ কি এটাই যে, এর ফলে মানুষ এ কথাও বুঝতে পারে, এ সৌন্দর্য ফেলে চলে যেতে হবে হবে? কেন?”
সব কিছুতেই তার একটি ভিন্ন ভাবনা ছিল। এই ভিন্ন চিন্তা মানুষের ভাবনার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। সেই আলোড়ন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। ভিন্ন চিন্তাকে যে দেশ সবচেয়ে বেশি প্রশ্রয় দেয় সেটি হচ্ছে ফ্রান্স। ফ্রান্সের নারীকে তিনি জীবন সঙ্গী করেছেন, সে-দেশেই বসত গেড়েছেন। কাজেই ভিন্ন চোখে পৃথিবীকে দেখার স্বাধীনতা বাঙালি লেখকদের মধ্যে তার চেয়ে বেশি আর কারই বা ছিল? এমন না যে তার সব ভিন্ন চিন্তাই নতুন দরোজা খুলে দেয় কিংবা প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য। যেমন আকাশ থেকে দেখা পৃথিবীর সৌন্দর্য সকলের মনকে বিষণ্ন করে তোলে না। রবীন্দ্রনাথ যখন পারস্য ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন, আকাশ থেকে দেখা পৃথিবীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন। অনেকেই আকাশ থেকে দেখা পৃথিবীর মনোমুগ্ধকর বর্ণনা দিয়েছেন। নাচ সম্পর্কে তার বক্তব্যটিও ততটা গ্রহণযোগ্য নয়। নাচের মধ্যে তিনি বিহঙ্গের স্বাধীনতা খুঁজেছেন যে কারণে ব্যালে নৃত্যকে তিনি একঘেয়ে এবং নিশ্চল বলেছেন। কিন্তু ব্যালে নৃত্যের মধ্যে যে ডিসিপ্লিন আছে, ভারসাম্য রক্ষার কসরত আছে সেই মাহাত্মটি তার চোখে পড়েনি বা দেখলেও তাতে আপ্লুত হননি। ভারসাম্য রক্ষার কসরতের মধ্যে অতি সুনিপুণভাবে মিশে আছে নিখুঁত শিল্প। তার ভিন্ন মতকে নানানভাবে আমরা খণ্ডন করতে পারি একথা সত্য কিন্তু তা সত্বেও চিন্তার জগতে এই ভিন্নমতের একটি অপরিসীম গুরুত্ব আছে। যুগ যুগ ধরে মানুষ আকাশ, মাটি, প্রকৃতি, অরণ্য, পাখি, সমুদ্র, দেশ, সমাজকে যেভাবে দেখেছে তার চেয়ে ভিন্ন দৃষ্টি, ভিন্ন চোখের প্রতীক্ষাই আমরা করি, হোক না সেটা অদ্ভুত, আজগুবি কিংবা অগ্রহণযোগ্য।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মানবিক বোধ খুব তীব্র ছিল। মানবিক গুণাবলী সমৃদ্ধ মানুষের অনুসন্ধান শুধু নিজের সাহিত্য-কর্মে নয়, অন্যের সাহিত্য ও কাজের মধ্যেও খুঁজে বেড়াতেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার স্ত্রী আন মারিকে সব সময় বলতেন তিনি একজন পরিচ্ছন্ন মানুষের কথা লিখতে চান। মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষই তার সেই কাঙ্ক্ষিত পরিচ্ছন্ন মানুষ। ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর স্ত্রীকে লেখা এক পত্র থেকে উদ্ধৃত করছি।
“এলুয়ারকে (আশা করি এ লোকটির ঘন ঘন উল্লেখে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়নি) নিয়ে তার ভূমিকায় ক্লদ রয় বলেছেন, তিনি একটি ছাড়া এলুয়ারের সব কটি গুণের কথা বর্ণনা করেছেন। সেই গুণটি হলো তার সদাশয়তা। পল এলুয়ার একজন ভালো মানুষ। তিনি বলেছেন, দুর্ভাগ্যবশত সদাশয়তা নামক সদগুণটি আজ এমনই মূল্য হারিয়েছে যে, এটি নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামায় না। স্টাইল বা সাহিত্যেও এটির দেখা পাওয়া ভার। তিনি বলেছেন, পল এলুয়ার তার আশপাশের সবাইকে নির্ভার, আশ্বস্ত ও বদান্য বোধ করাতেন। আজ কোথাও কার্যত কোনো ভালো মানুষ নেই। আরাগঁই হোন, আর ক্লদেল বা মিশো বা মঁএরলঁ হোন, কেউই সদাশয় মানুষ নন।
…গ্যাব্রিয়েল পেরির ওপর চমৎকার একটি কবিতা লিখেছেন পল এলুয়ার। পেরি হিউম্যানাইট পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, ১৯৪১ সালের ১৫ ডিসেম্বর জার্মানরা তাকে গুলি করে হত্যা করেছিল। ঘুষ সেধে এবং নির্যাতন চালিয়েও পেরিকে তার আদর্শ পরিত্যাগ করাতে রাজী করানো যায়নি। বন্ধুদের উদ্দেশে লেখা তার শেষ চিঠিতে তিনি লিখেছেন: আমার বন্ধুদের জানিয়ে দাও, আমি আমার জীবনের আদর্শের প্রতি অবিচল থেকেছি। আমার দেশবাসীকে জানিয়ে দাও, আমি মরতে যাচ্ছি, যাতে করে ফ্রান্স বেঁচে থাকে। ফলাফল ইতিবাচক। আমাকে যদি আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে হয় আমি একই পথ বেছে নেব।”
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নিজেই তার লালসালু এবং চাঁদের অমাবশ্যা উপন্যাস দুটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। সেই ইংরেজি থেকে আন মারি উপন্যাস দুটি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেন। লালসালুর ইংরেজি অনুবাদ করার সময় তিনি কিছু অংশ নতুন করে লিখেছিলেন। এই দুটি উপন্যাসের মূল চরিত্র সম্পর্কে আন মারি লেখেন, “দুটির নায়ক চরিত্রের মধ্যে আমি মিল খুঁজে পাই এবং কিছুটা কম মাত্রায় কেরায়া গল্পটির মধ্যেও এ মিল পাওয়া যায়।”
তিনি পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে চাকরি করেছেন, জাতিসংঘেও ৩ বছর কাজ করেছেন কিন্তু এই সব কিছুর ওপরে সব সময় গুরুত্ব দিতেন লেখালেখিকে। নিজেকে লেখক ছাড়া আর অন্য কিছু ভাবতেন না। বিষয়টি আন মারির বক্তব্যেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি লেখেন, “ও সবচেয়ে বেশি পছন্দ করত লিখতে। আমার মনে হয় ওর খ্যব ভালো লাগত শুধু লিখেই জীবিকা নির্বাহ করতে পারলে।”
১৯৫৪ সালের ৫ নভেম্বরের চিঠিতে তিনি স্ত্রীকে লেখেন, “কারো জন্যে কাজ করাটা আমি ঘৃণা করি। আমি স্বাধীন থাকতে চাই। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? তুমি যে কেন এখানে নেই, থাকলে তোমার সঙ্গে কথা বলতাম (অনেক বিষয়ে যেগুলো লিখতে পারছি না) এবং সিদ্ধান্ত নিতাম। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব অনিশ্চয়তায় ভুগছি। ভবিষ্যতে কি করব জানি না; কেননা এখন যা করছি তা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য কোনো সুযোগ এখন খোলা নেই।”
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং আন মারির মধ্যে সাহিত্য-কর্ম নিয়ে কত গভীর আলোচনা হত তা এক চিঠি থেকেই বোঝা যায়। তিনি স্ত্রীকে লেখেন, “তুমি খুব প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন তুলেছ, তা হলো, আমি যে গ্রাম আর তার মানুষজন নিয়ে লিখি, গোর্কি ওদের যতটা কাছ থেকে জানতেন, অতটা জানাশোনা কি তাদের নিয়ে আমার আছে?… গ্রামের লোকদের নিয়ে লিখতে গেলে আমাকে কেন গ্রামের মানুষ হতেই হবে? এটা অঅত্যাবশ্যকীয় নয়। অন্যদিকে গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো কী শুধু সেটাই নয়, তাদের ইতিহাস, তাদের সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ বিষয়ে আমি ওয়াকিবহাল। আমি তাদের গোটা জীবন বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে পারি, আর সেটা পারি আমি গ্রামের মানুষ নই এবং গ্রামে বসবাস করি না বলে। ওদের মধ্যে বসবাস করলেও গুটিকয়েক গ্রামবাসীর জীবনের আক্ষরিক এবং ফটোগ্রাফিক বিবরণ তুলে ধরা আমার লক্ষ্য হতো না। বরং আমি যাদের চিনতাম, তারা যে এক বৃহৎ সামাজিক-অর্থনৈতিক বুনোটের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ সেটা বোঝানোই আমার লক্ষ্য। (আমার কথা বুঝতে পারছ?)। আমার লেখা বই, আমার নাটক, আমার গল্পগুলো ব্যক্তি অভিজ্ঞতার ফটোগ্রাফিক প্রতিফলন নয়, বরং এগুলো তার চেয়ে বেশি কিছু। অন্তত আমি সেটাই মনে করি। আমি যখন ধর্মীয় কুসংস্কার, মোল্লাদের হাতে গরীব মানুষের শোষণকে আক্রমণ করি, আমি তখন গোটা ব্যবস্থাটাকেই আক্রমণ করি।”
নিজের লেখা শেষ বাক্যটিই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্যকর্মের মূল বক্তব্য।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৬ ডিসেম্বর ২০২২।