১. আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোন টি? কবে প্রকাশিত হয়েছিলো? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিলো?
* আমার প্রথম প্রকাশিত বইটি গল্পের। তিনটি গল্প নিয়ে একটি পুস্তিকা আকারে সেটি বের হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। বইটির নাম – ‘আমি আর পিপি’। কিশোর বয়স থেকে কবিতা লেখার চেষ্টা চালালেও ওই ১৯৭৭ সালে আকস্মিকভাবে ওই তিনটি গল্প লিখেছিলাম।
আমার কবিতার প্রথম বই – ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’ বের হয়েছিল ১৯৮০ সালে। এই বই প্রকাশের তোড়জোড় শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সাল থেকে। নিবিড় মনোযোগ, দরদ ছিল আমার ও আমার বন্ধুদের ওই তৎপরতায়, এই অভিজ্ঞতা, এই অনুভূতি। ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’ কাব্যগ্রন্থটির চারবার সংস্করণ হয়েছে।
২. সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?
* এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না, বা এনিয়ে বলার হক নেই আমার। তবে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের কাল থেকে বাংলা কবিতার যে প্রবাহ, সেই স্রোতে নদীকিনারের ছেলের দলে আমিও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।
৩. এ যাবৎ সর্ব মোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন-কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?
*আমার কাব্যগ্রন্থগুলির সংখ্যা এ পর্যন্ত- ৬।
১) জলপাই কাঠের এসরাজ (প্রথম প্রকাশ: ১৯৮০)
২) এভাবে কাঁদে না ( প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৬)
৩) গোপনে হিংসার কথা বলি (প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৮)
৪) সূর্যাস্তে নির্মিত গৃহ (প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৮)
৫) সোনার বুদ্বুদ ( প্রথম প্রকাশ:২০১০)
৬) আগুনের অবাক ফোয়ারা (প্রথম প্রকাশ: ২০২০)
—————-
প্রকাশিতব্য গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি ( রচনাকাল: ২০২০…)
—————————–
ছড়ার বই
ঝিকিমিকি ঝিরিঝিরি
ছড়া ৫০
আমপাতা জামপাতা
রঙিন ছড়া
খেলাচ্ছড়া
———————–
এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে আমার
নির্বাচিত কবিতা (অফবিট প্রকাশন)
কবিতা সমগ্র (সপ্তর্ষি প্রকাশনী)
শ্রেষ্ঠ কবিতা (দে’জ
—————–
আমার গল্পের বই
পার্টি বলেছিল ও সাতটি গল্প (বোধশব্দ)
———————–
প্রবন্ধ/গদ্যের বই
কবিতা সহায় (পত্রলেখা)
সাত পাঁচ ( পত্রলেখা, বোধশব্দ দুটি সংস্করণ)
ফুল ফল মফস্সল( পরম্পরা প্রকাশন)
——————————
৪. সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।
* আমার এ পর্যন্ত শেষ বইটি, ‘আগুনের অবাক ফোয়ারা’ কাব্যগ্রন্থটি বের হয়েছে ২০২০ সালে, বোধশব্দ প্রকাশনী থেকে। এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি করোনা অতিমারির পূর্বেই প্রস্তুত হলেও, বইটির মুদ্রণ তৎপরতা করোনা উপদ্রবের ভিতরেই হয়েছে। এরপর ২০২১ সালে দে’জ থেকে আমার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশিত হয়েছে। আগামী জানুয়ারিতে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হবে।
৫. আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি-লেখক বলেন? কেন?
* আমরা, যাদের লেখালিখির সূচনা হয়েছে গত শতাব্দীর সত্তরের বা সাতের দশকে, তাই আমাদের ৭০এর দশকের কবি লেখক বলা হয়। আমি কৈশোরে ১৯৬৮-৬৯ সালে কবিতা লেখার চেষ্টা শুরু করি।
৬. আপনার সমকাল নিয়ে বলুন।
* ১৯৪৭-এর দেশভাগ ও স্বাধীনতা আমি দেখিনি। তবু বাংলাভাগে পূর্ববঙ্গীয় মহাপরিবারের দেশান্তরে এই পশ্চিমবাংলা ছিন্নভিন্ন অবস্থান ও জীবনযুদ্ধ দেখেছি। অনটন দেখেছি। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ, ১৯৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আমার বাল্যস্মৃতি চলচ্চিত্রের মত সচল ও স্পষ্ট। গোটা বিশ্বকে আলোড়িত করা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় আমার সদ্য তরুণ বয়সে ঘটেছে। বিপ্লব বাসনার নকশালবাড়ি আন্দোলন, তার অগ্নি উদ্গীরণ, তার অসফলতার রক্ত, অশ্রু এবং ভস্ম সবই আমাদের ওপর দিয়ে গিয়েছে। জরুরি অবস্থা, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধীর হত্যা এসব আমাদের কালে ঘটেছে। বাংলাদেশেও সপরিবার মুজিব হত্যা, সেনা শাসন, গণ অভ্যুথ্থানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, আমাদের বাংলাকেও ভাবিয়েছে। সোভিয়েতের পতনও তো আমাদের সময়েই ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সরকারের পর বামফ্রন্টের ক্ষমতাসীন হওয়া, বামফ্রন্টের অবসান, সিঙুর নন্দীগ্রামের ঘটনা, তারপর এই করোনা অতিমারি -এসব বড় বড় ঘটনা মিলিয়েই আমাদের কাল। অনেক কিছুই দেখে গেলাম তো!
৭. সাম্প্রতিক কালে কারা ভালো লিখছে বলে মনে করেন?
* কাকে বলে সাম্প্রতিককাল, এ নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন আছে। আবার আমার ‘সাম্প্রতিক কাল’ আর আপনার ‘সাম্প্রতিক কাল’ এক নাও হতে পারে। তাই এ তালিকা আমি তৈয়ার করতে পারব না।
৮. কোথায় আছেন? কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।
* আমি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার শ্রীরামপুর শহরে থাকি। শ্রীরামপুর কলকাতার নিকটবর্তী শহর। ট্রেনে, গাড়িতে আধঘণ্টা,পৌনেএক ঘণ্টার দূরত্ব। শ্রীরামপুর শহরেই আমার জন্ম। আমার বাবা বাংলা ভাগের কারণে তৎকালীন পূ্র্ববঙ্গের বরিশালের গৈলা ফুল্লশ্রী গ্রাম থেকে এসে শ্রীরামপুরে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করতেন। আমার মা যশোর জেলার কালিয়া গ্রামের। শ্রীরামপুরে ভাড়া বাড়িতে আমার শিশুকাল কাটে। এরপর আমার বাবা শ্রীরামপুরে নিজের বাড়ি করেন। পরে দেড় দশক আগে আমিও একটি গৃহনির্মাণ করেছি। শ্রীরামপুর রেলস্টেশনের সন্নিকটে এই বাড়িটিতে আমি ও আমার স্ত্রী দুজনে থাকি। আমাদের কন্যার বিবাহ হয়েছে গতবছর কলকাতার বেহালায়।
আমার মা বাবা কাকা কাকিমা কেউ বেঁচে নেই। মামারা কেউ নেই। একটি কেবল মাসি, অতিবৃদ্ধা আছেন বেঙ্গালুরু শহরে, কর্ণাটকে।
আমরা ছিলাম তিন ভাই , এক বোন। আমি বড়, মধ্যম ভাইটি বছর তিনেক আগে অকালে মারা গিয়েছে। আমার ছোট ভাই স্ত্রী পুত্রসহ হাওড়ার সাঁতরাগাছি শহরে আছে। আমার বোনটির বিয়ে হয়েছিল শ্রীরামপুরের অদূরে কোন্নগরে। সে স্বামীগৃহে রয়েছে। তার ছেলেটি প্রযুক্তিবিদ্, সে চাকরিসূত্রে রয়েছে বেঙ্গালুরু শহরে।
আমার গ্রন্থসকল আমারই সন্তান, পুত্রকন্যাবৎ। তাদের পরিচয় পূর্বেই দিয়েছি।
৯. আপনি কি কখনো বাংলাদেশে এসেছেন? আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাচ্ছি।
* বহুবার আমি বাংলাদেশে গিয়েছি। প্রথমবার ১৯৮৬ সালের আগস্টে আমি ঢাকায় পৌঁছোই দুটি উদ্দেশে, ১). বরিশালে দেশের বাড়ির ভগ্নস্তূপ দর্শন ও ২) বাংলাদেশের তৎকালীন কবিতার হাল হদিশ পাওয়া। ওই সফরে আমার দুটি উদ্দেশ্যই হাসিল হয়েছিল। এর পর বারবার গিয়েছি। কবিতার কারণে, সাংবাদিকতার কারণে। সাংবাদিকতার কারণে কিছু ঘটনার সময়ে গিয়েছি। গত নির্বাচনটি ছাড়া, আগের নির্বাচনগুলিতে গিয়েছি। এ বছরও কয়েক মাস আগে আমি সাতক্ষীরা, পাবনা, যশোর, টাঙ্গাইলে গিয়েছি। ঢাকা যাওয়া হয়নি এবার।
১০. বাংলাদেশের সাহিত্য পড়েন? আপনার প্রিয় বা পছন্দের বাংলাদশী সাহিত্যিক কে-কে বা কারা? কেন?
* বাংলাদেশের বইপত্র, পত্রিকা সংগ্রহ করার বিষয়টি এখন পশ্চিমবঙ্গে বাড়লেও, একেবার সহজ হয়েছে তা নয়। হাতে এলে, পড়ি। তরুণদের লেখা ফেসবুক, নেটে পড়ার বিষয়ে আমার মনের বাধা রয়েছে, আমি অভ্যস্থ নই। আমি মুদ্রিত গ্রন্থ, পত্রিকাপাঠে অনায়াস। সে যাকগে্।
জীবনানন্দ-উত্তর বাংলা কবিতা প্রয়াত আল মাহমুদকে আমি বাংলাভাষার একজন শ্রেষ্ঠ কবি মনে করি। এরপর আমি আমার অনুজ বন্ধু মাসুদ খানের কবিতায় আকৃষ্ট, যিনি এখন কানাডায় আছেন। তার পরের চঞ্চল আশরফের দিকেও আমার নজর রয়েছে। তরুণদের কবিতাও আমি যেটুকু ইতিউতি পাই পড়ি।
গদ্য সাহিত্য নিয়ে আমি মতামত দিতে পারলাম না। আমি অধিকারী নই। অনেক তো পড়িনি।
১১. বাংলাদেশ এবং ভারতীয় বাংলা সাহিত্যের মিল ও তফাৎ — কোথায়? কি-কি?
* আমার মতে, সাহিত্যের রাষ্ট্রনৈতিক বিভাজন হয় না। লেখক কবিরা দেশের নন, ভাষার। ইংল্যান্ড আমেরিকার বহু বহু দূরত্ব থাকলেও এলিয়ট ও হুইটম্যান ইংরেজি ভাষার কবি। বাংলা ভাগ হয়ে দ্বিখণ্ড হয়েছে। ভাষা ভাগ হয়নি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও আল মাহমুদ বাংলা ভাষার কবি।
তবে কিনা, রাষ্ট্রগত কারণে রাজনৈতিক -সামাজিক ক্ষেত্রে দুটি দেশের কারণে হাজার সমস্যাতেও পশ্চিমবঙ্গের সমাজক্ষেত্রটি সুস্থির, গভীর শিকড়ে আসীন। বাংলাদেশের সমাজ অস্থির, উদ্বেগপূর্ণ। কে না জানে, অস্থিরতাই সাহিত্যের জননী। তাই বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাষা সচল, গতিপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গে সাহিত্য ভাষা ধীরে প্রবাহমান। কিন্তু দুয়ে মিলেই বাংলা সাহিত্য।
১২. এই দুই দেশের সাহিত্যিক মেলবন্ধন উন্নয়নে কোন-কোন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনার মনে হয়?
* এসব উদ্যোগ, পদক্ষেপে কিচ্ছুটি ঘটে না। বাংলাভাষায় যাঁরা লেখালিখি করেন, তাঁরা সবাই আমাদের স্বজন।
১৩. আপনি কখনো কি কোন পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।
* আমি লিটিল ম্যাগাজিনের জাতক। ১৯৭২ ও ১৯৭৪ সালে আমি ‘বাইসন’ নামে একটি পত্রিকা বের করি। ওই পত্রিকার আমি সম্পাদক নই, প্রচারক হিসেবে আমার নাম ছিল। রেলে যাঁরা হকারি করেন, তাঁদের কয়েকজন আমার বন্ধু ছিলেন। তাঁরা ট্রেনে ট্রেনে ওই পত্রিকা বিক্রি করেছিলেন।
এরপর ৮০-র দশকে ‘শত জলঝর্ণার ধ্বনি’ নামে একটি কবিতা সংকলন আমি সম্পাদনা করেছি।
১৪. লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।
* লিটল ম্যাগাজিনের সংজ্ঞা আমি বলতে পারব না। তবে সে বাধার দেওয়াল ভাঙবে। বাজার ও বিনোদনের সাহিত্যকে চূর্ণ করবে। তরুণ লেখক কবিদের আবির্ভাবে ঝলমল করবে লিটিল ম্যাগাজিন।
১৫. অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন চর্চাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
* আগেই বলেছি অনলাইন, ওয়েব, নেটে গ্রন্থ, পত্রিকাপাঠে আমার অভ্যাসগত অস্বস্তি আছে।
আমি মুদ্রিত গ্রন্থ, মুদ্রিত পত্রপত্রিকায় বিশ্বাসী এক প্রাচীন কালের পড়ুয়া মানুষ।
১৬. আগামী দিনের সাহিত্য কেমন হবে? আপনার কল্পনায়।
* পৃথিবীর শেষদিনটিতেও নিজের কথাটি, আপনকথাটি লিখবে কেউ।