spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যবরিশাল শহরের কোথায় হাঁটতেন জীবনানন্দ?

লিখেছেন : আমীন আল রশীদ

বরিশাল শহরের কোথায় হাঁটতেন জীবনানন্দ?

আমীন আল রশীদ

জীবনানন্দ দাশ, শিল্পী তাপস কর্মকার

পারিবারিক সাংস্কৃতিক আবহের পাশাপাশি বরিশালের সবুজ প্রকৃতিই জীবনানন্দকে ‘কবি’ হয়ে উঠতে সহায়তা করে। ‘প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ সহজ’—এরকম লাইন লেখার জন্য ধান-নদী-খাল ও বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠের সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক থাকতে হয়।

ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশ (বাল্যস্মৃতি, ময়ূখ, ১৩৬১-৬২) লিখেছেন, ‘যারা বরিশালে গিয়েছেন তারা জানেন বরিশালের নদীর তীর কী অপূর্ব সুন্দর। সেখানে স্টিমার জেটিতে বাঁধা আছে, সেই অংশটি পার হয়ে গেলেই রাস্তার ধার দিয়ে ঝাউ-এর সারি চলে গেছে। বর্ষাকালে জ্যোৎস্না-আলোকে নদীর জলকে মনে হয় যেন রূপালি শাড়ি আর তার পাশ দিয়ে লাল কাঁকরের রাস্তা যেন সেই শাড়ির প্রান্ত। অথবা ধরুন যদি কোনো জ্যোৎস্নারাত্রিতে খালের পার দিয়ে যে পথ লাখুটিয়ার দিকে প্রসারিত  হয়ে গেছে, সেই পথ দিয়ে চলেন, দেখতে পাবেন, সান্দ্রনিবিড় পল্লবছায়া পথের উপর আল্পনা এঁকে দিয়েছে। শ্মশানভূমি ছাড়িয়ে লাশকাটা ঘর অতিক্রম করে—যেখানে কয়েকটা রাবার গাছ আছে, তাও ছাড়িয়ে আরও দূরে চলে যান, দেখতে পাবেন ভাঙা মন্দির, ভাঙা অট্টালিকা। জ্যোৎস্নার আলোতে অনেক জিনিস দৃষ্টিগোচর হয়, আবার অনেক জিনিস অস্পষ্টই থাকে। সেই নির্জন পথ দিয়ে চলতে চলতে আপনার হয়তো মনে হবে আপনি হয়তো বর্তমান সময়কে অতিক্রম করে কোনো অতীত যুগে চলে এসেছেন। তার স্বপ্ন, তার স্মৃতি হয়তো আপনাকে আনন্দ দেবে, হয়তো পীড়িত করবে। ছাত্রজীবনে এবং কর্মজীবনের প্রারম্ভে এই পথ ধরে আমি ও দাদা কতদিন হেঁটেছি এবং কত নিরুপমা বিভাবরীতে অতীত যুগে চলে যাবার এই ইলিউশন হয়েছে অথবা স্বপ্ন দেখেছি।’

লাকুটিয়া (এখন অফিসিয়াল বানান এটি) সড়কটি বরিশাল শহরের নতুন বাজার মোড় থেকে উত্তর দিকে চলে যাওয়া একটি সরু রাস্তা। এখন পিচঢালা পথ। এই পথের পুবদিকেই বরিশালের শ্মশানভূমি। এখন যেখানে হিন্দুদের দাহ করা হয়, সেটি অপেক্ষাকৃত নতুন শ্মশানভূমি। প্রতি বছর এখানে দ্বীপাবলি হয়। মৃত স¦জনদের আত্মার শান্তি কামনা করা হয়। জীবনানন্দের সময়ের শ্মশানঘাটটি খুঁজে পাওয়া কঠিন। কারণ এখানে জনবসতি হয়ে গেছে।

১. লাকুটিয়া সড়ক, বরিশাল; ২. বরিশাল শহরের রাস্তায় জীবনানন্দ দাশ

সেই লাশকাটা ঘর

বরিশাল মহাশ্মশান

অশোকানন্দ দাশ যে লাশকাটা ঘরের কথা বলছেন, সেটি জীবনানন্দের বহুল পঠিত এবং আলোচিত ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায়ও আছে। 

‘শোনা গেলো লাশকাটা ঘরে 

নিয়ে গেছে তারে;

কাল রাতে ফাল্গুনের রাতে আঁধারে

যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ

মরিবার হলো তার সাধ।’

আপাতদৃষ্টিতে জগৎ-সংসারে একজন সুখী মানুষ—যার স্ত্রী-সন্তান আছে, স্বচ্ছলতা আছে, তিনি কোনো এক বিপন্ন বিস্ময়ের ঘোরে জ্যোৎস্না রাতে এক গাছা দড়ি হাতে অশ্বত্থের ডালে ঝুলে পড়েন।

অশোক বরিশাল শহরের মহাশ্মশান সংলগ্ন যে লাশকাটা ঘরের কথা লিখেছেন, ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় জীবনানন্দ হয়তো সেটির কথাই বলেছেন। কেননা কবি যা-ই লিখুন না কেন, তার মাথায় কোনো একটি বাস্তব ঘটনা বা স্থান-কাল-পাত্রের মিল থাকতে পারে। কিংবা তিনি কোনো ঘটনার দ্বারা অনুপ্রাণিত বা অনুরণিত হয়ে লিখতে পারেন। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার প্লটও তিনি বরিশাল মহাশ্মশান সংলগ্ন লাশকাটা ঘর থেকেই পেয়ে থাকতে পারেন। কেননা অশোকানন্দের জবানিতেই আমরা পাচ্ছি যে, তারা দুই ভাই লাকুটিয়ার পথ ধরে অনেক দূর হেঁটে যেতেন এবং সেই পথেই ছিল একটি লাশকাটা ঘর। হয়তো তার সামনেই কোনো মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন। তারপর হয়তো ওই মৃতের গল্পটি শুনেছেন, যা তিনি নিজের মতো লিখেছেন। 

‘কোনো নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;

বিবাহিত জীবনের সাধ

কোথাও রাখেনি কোনো খাদ

সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধু

মধু-আর মননের মধু 

দিয়েছে জানিতে।’

অশোকানন্দ বাল্যস্মৃতিতে (প্রাগুক্ত) লিখেছেন, ‘প্রায় ছোটবেলা থেকেই বরিশালের উপকণ্ঠে শ্মশানভূমির পাশ দিয়ে আমরা দুজন হেঁটেছি, অবাক হয়ে কখনো বা লাশকাটা ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখেছি। কখনও আরও দূরের পাল্লা, শহর ছাড়িয়ে গ্রামের পথে। বর্ষাকালে নদীর তীরে কত সন্ধ্যায় হেঁটেছি, নদী যখন স্ফীত হয়ে পথকে ছুঁয়ে দিচ্ছে—অথবা শীতকালে নদীর রেখা যখন বহুদূর সরে গেছে, নদীর মধ্যে ধান ক্ষেতের মধ্যে নেমে গেছি, যেসব ধান ক্ষেত রাত্রির নীরবর মুহূর্তে অন্ধকারে স্নান করে শীর্ণা নদীর সঙ্গে কথা বলে। নদীর ওপারে দেখেছি সবুজ অন্ধকার।’  

ঝামা সুরকির লাল রাস্তা

১. কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে ঝাউ গাছের সারি; ২. বরিশাল স্টিমার ঘাট

বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর উত্তরপাড়। অর্থাৎ নদীর যে পাড়ে শহর; বর্তমানে সেই পাড়ে নদীলাগোয়া একটি সড়কের নাম বান্দ রোড। জীবনানন্দের সময়ে এটি ছিল বরিশাল শহররক্ষা বাঁধ। বাঁধের উপরে লাল সুরকির একটি রাস্তা ছিল। রাস্তার দুপাশে ছিল মেঘশিরিশ ও বোতলব্রাশ গাছ। জীবনানন্দ এই পথে হাঁটতেন। হেঁটে হেঁটে যেতেন নদীর তীর অব্দি। ‘ক্ষণিকের মুক্তি দেয় ভরিয়া’ শিরোনামের একটি গল্পের শেষটা এরকম: ‘স্টিমার ঘাটের দিকে চলেছে বিরাজ (গল্পের নায়ক)। স্টিমার ঘাট, স্টেশন ছাড়িয়ে দূরে আরো দূরে ঝাউগাছের বাতাসে নদীর ধারে সবুজ ঘাসের ওপর সাইকেলটা কাত করে ফেলে বিরাজ ঘাসের নরম ঘ্রাণ ও রঙের কোলে হারিয়ে গিয়েছে।’

এখনও কীর্তনখোলার উত্তর পাড়ে, অর্থাৎ স্টিমার ঘাটের তীরে যে নদীরক্ষা বাঁধ, সেখানে প্রচুর ঝাউগাছ চোখে পড়ে। বাঁধের ওপারে টিনের একতলা দোতলা অসংখ্য ঘরবাড়ি। নদীর এই অংশ দিয়ে শহরের ভেতরে ঢুকে গেছে ভাটার খাল। বাঁধটিকে কংক্রিটের ব্লক ফেলে টেকসই করাই শুধু নয়, মানুষের হাঁটার উপযোগী করা হয়েছে। নির্ধারিত দূরত্বে টাইলস ও কংক্রিট দিয়ে বানানো হয়েছে বসার জায়গা। রয়েছে প্রচুর বাদাম গাছ, যার নিচে বিশ্রাম নেয়া যায়। এই পথ ধরে একটু পশ্চিমে হাঁটলে ডিসি পার্ক। যেখানে চোখে পড়ে বিশাল বিশাল সব ঝাউ গাছ। জীবনানন্দের সময়ে নদী তীরের এই জায়গাটি ছিল লাল সুরকির রাস্তা। এখন কংক্রিট ও টাইলসের পথ।  

বরিশালের পটভূমিতে লেখা উপন্যাস ‘বাসমতীর উপাখ্যান’-এর একটি বর্ণনা: ‘বাসমতীর নদীর পাড়ে বেড়াতে যান ছাতুকাকা রোজ বিকেলে। নদীর কিনার দিয়ে ঝামা সুরকির নীলচে লাল রাস্তা চলে গিয়েছে তিন-চার মাইল উঁচু উঁচু ঝাউগাছ রাস্তার পশ্চিম কিনার জাঁকিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত বাঁক ঘুরে ঘুরে নিরালা বীথির মতন সব। হাতের কাছে নদী পুবের আকাশ ঘেঁষে, উত্তর-পুবে তাকালে নদীর জল বেশি দেখা যায় না। ইস্টিমার, জেটি, গাধাবোট, গ্রিনবোট, পানসি ডিঙি, জেলে নৌকো, পালোয়ারি, হাটুরে, বজরায় ছেড়ে ফেলেছে সব।’   

নির্জন পথই যার প্রিয়

বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের পুরোনো ভবন; এই ভবনে জীবনানন্দ ক্লাস নিতেন

অধ্যাপক হেরম্ব চক্রবর্তী বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন: ‘মাঠের পাশে বাঁকা পথ ধরে কলেজের পিছন দিক দিয়ে কলেজে যেতেন; ক্লাশে শান্তগম্ভীর ভঙ্গিতে পড়াতেন, অবসরকালে কষ্টিপাথরের মূর্তিটির মতো বিশ্রামকক্ষের কোণে বসে থাকতেন। তারপর সেই নিরালা পথটি ধরে ফিরতেন নিজের নির্জন গৃহে। সন্ধ্যার প্রাক্কালে ডুরান্ডাঘেরা দূর্বাশ্যামল প্রাঙ্গণে আনতদৃষ্টিতে দ্রুত পরিক্রমা ছিল তার নিত্যকর্ম। এমন অনুত্তাপ নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রা আমি কদাচিৎ দেখেছি।…. তাকে দেখে মনে হয়েছে যে, জীবনের কোন নিভৃত ক্ষেত্রে কোন গোপন বেদনাভরা অপরিস্ফূট পীড়ন তিনি অনুভব করতেন।’ (জীবনানন্দকে যেমন দেখেছি, হাওড়া গার্লস কলেজ পত্রিকা, পৃষ্ঠা ১৭)।

গবেষক গৌতম মিত্র জানাচ্ছেন, সর্বানন্দ ভবনের একদিকে ব্রজমোহন কলেজের রাস্তা কলেজ রোড, আর অন্যদিকে অক্সফোর্ড মিশন। জীবনানন্দ দাশ প্রতিদিন সন্ধ্যায় এই দুই সীমানার মধ্যের কয়েকশো মিটার পথ পায়চারি করতেন। মাঝেমধ্যে উল্টোদিকে হাসপাতাল রোডের ওপর অবস্থিত একটি মর্গের সামনের কালভার্টে গিয়ে বসতেন। 

বরিশাল শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা সরু খাল এবং শহরের পাশে কীর্তনখোলা (জলসিড়ি) নদীর তীর ধরে দুই ভাই হাঁটতেন। যদিও শহরের ভেতরের অনেক খালের এখন আর অস্তিত্ব নেই। সামান্য যা আছে সেগুলোর অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। কিন্তু তারপরও বরিশাল শহরের ভেতরে এখনও প্রচুর পুকুর আর ঘন গাছপালা চোখে পড়বে। বিশেষ করে স্টিমার ঘাট থেকে ক্লাব রোড বা সরকারি কমর্কর্তাদের বাস ভবনের সামনে লেক সংলগ্ন নিরিবিলি পথগুলো যে কারোর ভালো লাগবে। বরিশাল শহরের অলিগলির ভেতরেও একধরনের নস্টালজিক ব্যাপার আছে। অনেকটা পুরনো কলকাতার মতো। যে কলকাতা শহর ছিল জীবনানন্দের অত্যন্ত প্রিয় এবং যে শহরেই তার মৃত্যু হয়েছে।   

আমীন আল রশীদ, সাংবাদিক ও জীবনানন্দ গবেষক।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on কাজী জহিরুল ইসলাম এর কবিতা
এড. শাহানারা স্বপ্না on লেট ফ্যাসিজম
Adv. Shahanara on যুদ্ধশিল্প
নয়ন আহমেদ on যুদ্ধশিল্প