🍁
তৈমুর খান
🍁
মানুষের চেতনা কতদূর বিস্তৃত হতে পারে তা নির্ভর করে একজন মানুষের উপরেই। আমরা যে আজ বর্তমান আছি এই থাকাতেই প্রমাণ হয় আমাদের আদি যুগে কোনো উৎস ছিল। অর্থাৎ আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন। তাঁদের চেতনাই আমরা বহন করে নিয়ে চলেছি। বিজ্ঞানের আবিষ্কার জীবনযাত্রার মান পাল্টে দিয়েছে। সভ্যতার পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু মানবচেতনা ভাবনার বহুস্তরীয় প্রেক্ষাপটকে আরও বিস্তীর্ণ করেছে। অতীত ইতিহাস থেকে, প্রাচীন মিথ ও পুরাণের নানা গল্পকথায় আখ্যানে তার চেতনাকে প্রবাহিত করেছে। সেখানেই আছে স্মৃতির সরণি। বহু জন্মান্তরের পথ। নিজের বহু মুখ ও বহু জীবনের রূপান্তর। এই উপলব্ধি থেকেই বেলজিয়ান চিত্রশিল্পী এবং লেখক ইউক্লে (ব্রাসেলসে) বসবাসকারী এরিক পেভারনাগি (জন্ম ১৯৩৯) লিখেছেন:
“We are what we remember. If we lose our memory, we lose our identity and our identity is the accumulation of our experiences. When we walk down the memory lane, it can be unconsciously, willingly, selectively, impetuously or sometimes grudgingly. By following our stream of consciousness we look for lost time and things past. Some reminiscences become anchor points that can take another scope with the wisdom of hindsight. (‘Walking down the memory lane’ : Erik Pevernagie)
অর্থাৎ আমরা যা মনে রাখি তাই। আমরা যদি আমাদের স্মৃতি হারিয়ে ফেলি, তাহলে আমরা আমাদের পরিচয় হারিয়ে ফেলি এবং আমাদের পরিচয় হল আমাদের অভিজ্ঞতার সঞ্চয়। আমরা যখন স্মৃতির গলিতে হাঁটছি, তখন তা হতে পারে অজ্ঞানভাবে, স্বেচ্ছায়, বেছে বেছে, অবিবেচকভাবে বা কখনও কখনও বিরক্তিকরভাবে। আমাদের চেতনার প্রবাহ অনুসরণ করে আমরা হারিয়ে যাওয়া সময় এবং অতীতের জিনিসগুলি সন্ধান করি। কিছু স্মৃতিকথা নোঙর পয়েন্ট হয়ে যায় যা পশ্চাৎদৃষ্টির জ্ঞানের সাথে অন্য সুযোগ নিতে পারে।
স্মৃতির গলিতে হাঁটছি, মনে হল আদি মানুষ আদম-হবার কাল থেকেই এই হাঁটার মধ্যে বিরাম নেই। নাসিম-এ-আলমের কবিতায় এই হাঁটাই মূল বিভাব। এই হাঁটার মধ্যেই জীবন আছে, প্রেম আছে, ঘরকন্না আছে, সংসার আছে, সুখ-দুঃখ, অভাব-অভিযোগ, আনন্দ-কষ্ট এবং ঘুম-জাগরণ সবই নিহিত। এই হাঁটার মধ্যেই মনে হল কবিতা আছে এবং কবিতার ছন্দও আছে। নাসিম সময়কে খণ্ডিত করেননি, মৃত্যুতে জীবকেও শেষ বলে ভাবেননি। বরং প্রবহমান জন্মান্তর তাঁর কবিতায় বসতি স্থাপন করেছে। মিশরীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা, গ্রীক সভ্যতা, বাইজান্টাইন সভ্যতা প্রভৃতি সভ্যতার মানুষের মধ্যেও তিনি নিজের জন্মান্তর উপলব্ধি করেছেন। সেই জন্মান্তরের বহুমুখী জীবনধারার চেতনায় বহুমুখী প্রজ্ঞা নিয়েই তিনি ন’য়ের দশকের নাসিম এ আলম। বাংলা কবিতায় এই ইতিহাস চেতনা নতুন কিছু নয়, কিন্তু কবি যখন সেই ইতিহাসকে তাঁর চেতনা প্রবাহে সঞ্চারিত করেন, তখন তা জীবন্ত হয়ে ওঠে। পাঠকও কবির বোধের সঙ্গে সেই অতীতের জীবনধারায় পৌঁছে যান এবং অদ্ভুত এক আত্মবিক্রিয়ায় নিষিক্ত হয়ে উঠেন। এখানেই নাসিম-এ-আলম অনন্য ও অসাধারণ। ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘আবার বেদুইন লিখিত’ কাব্যে নাসিম লিখেছেন:
“সুমেরীয়রা যে পানপাত্র ব্যবহার করত
রুটি ও খেজুরসহ দুপুরের খাওয়া শেষে
ওদের বিশ্রাম ছিল অলিভ ফুলের সুন্দরতা।
পথ হাঁটি, হাঁটি যব ও বাদাম খেতের পাশে
নিকটে পাহাড় ভ্রমে পিরামিড নীরব হয়ে আছে
পশ্চিম দিগন্তে লাল রেখার সূত্রে
সেমেটিক সভ্যতার ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শোনা যায়
ওদের অশ্বগুলি সাদা, প্রিয় রং গভীর খয়েরি।
মধু ও দুগ্ধ প্রবাহিনী দেশ—এখানেই থেকে যাব
বাড়ির সামনে যব খেত, আঙুর লতায় ঘেরা ছোট্ট উঠোন
আমার বেদুইন শিশু ঘুমোচ্ছে
জল আনতে গেছে মেয়ে
পিরামিড শীর্ষ থেকে উড়ে যাচ্ছে চিল মরুদ্যানের দিকে।”
সুমেরীয় সভ্যতার শুধু বিবরণ নয়, সেখানেও পথ হাঁটার অবিশ্রাম গতি কবির। তাই ‘পথ হাঁটি’ ক্রিয়াটি বর্তমান কালের উত্তম পুরুষের ক্রিয়া হিসেবেই ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ সর্বদায় তা সচল। এখানকার কৃষি সভ্যতাকেও গ্রহণ করেছেন। তারপর সেমেটিক সভ্যতার ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শুনেছেন। সাদা অশ্বগুলি এবং প্রিয় গভীর খয়েরি রংও দেখেছেন। সেই মধু ও দুগ্ধ প্রবাহিনীর দেশে কবি থেকে যেতে চেয়েছেন। বাড়ির সামনে যব, আঙুর ক্ষেত ঘেরা উঠোন। কবির বেদুইন শিশু ঘুমাচ্ছে আর জল আনতে গেছে মেয়ে। সময়কে নিরীক্ষণ করেছেন বলেই পিরামিড শীর্ষ থেকে মরুদ্যানের দিকে কাকের উড়ে যাওয়াও মনে রেখেছেন। মরুসংস্কৃতি, সুমেরীয় সংস্কৃতির মধ্যেও কবির চেতনা প্রবাহিত। এভাবেই ইতিহাসে গতিসঞ্চার ঘটেছে জীবনের। সুতরাং অন্যান্য কবিদের মতো শুধু ইতিহাস চেতনাকে গ্রহণ করেই কবি ক্ষান্ত হননি, সেই যুগ এবং সময়কেও, সেই জীবন ও যাপনকেও আত্মস্থ করেছেন। এই কাব্যের আরেক অংশ লিখেছেন:
“সেন্ট মার্কের বিখ্যাত গির্জার কাছে
অন্ধ ভিখারির লাঠি স্পর্শ করলাম
বন্দর শহর আলেকজান্দ্রিয়া শান্ত স্বভাবের
পাদ্রিরা এলেন যেদিন সকালে রোদ উঠল
মরুদ্যানের ঘোড়াগুলি তৎপর ঘাসে,উটের দৃষ্টিতে
বহুদূর কোনো যাত্রী দলের অপেক্ষায়, সুসংবাদ সমাগত।”
এইসব কবিতাগুলিতে আমাদের কোনো অতীত জীবনের অবিচ্ছেদ্য জন্মান্তরকে আত্মদর্শনের পথে এনে দাঁড় করান। তখন মনে হয়, আমরা সেদিনও ছিলাম, আজও আছি। জীবনানন্দ দাশের মতো ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি’ একথারই অভিব্যক্তি প্রতিধ্বনিত হয়।আমরা প্যাপিরাসের যুগে, মমির যুগে, ক্লিওপেট্রার যুগে, বাইজান্টাইনের সেনাদলের সঙ্গে, কাফ্রি ক্রীতদাসের সঙ্গেও ছিলাম। আমরা ধু-ধু বালির স্তূপের উপর দিয়েও হেঁটেছিলাম।
এই অতীতচারী বিস্তৃত প্রান্তর জুড়েই সীমাহীন জন্মান্তর ঘুরে ফেরা কবি নাসিম-এ-আলম। তাঁর সমস্ত কাব্যগ্রন্থগুলিতেই এই বৈশিষ্ট্য বিরাজমান। একে একে আমরা হাতের কাছে পেয়েছি :
১.আইরিশ কলোনিতে সন্ধ্যা,১৯৯৫
২. ময়ূর ক্লান্ত মানে বর্ষা শেষ হল,১৯৯৭
৩.লিটিল ম্যাগাজিন ও অন্যান্য কবিতা,২০০০
৪.চাঁদ সদাগর ফিরে আসবে,২০০৫
৫.দ্রোহকাল,২০১০
৬. ধুলোর নির্জনে লেখা,২০১৬
৭. আবার বেদুইন লিখিত,২০১৮
৯. বাসমতী ধানের অগ্রহায়ণ ও ঝুমকোলতা,২০২২
৮. জন্মান্তরের কবিতা(সম্পাদিত কবিতা সংকলন)
এছাড়া একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ:
স্বাধীনতা পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ ও সাহিত্য,২০২১
নাসিম-এ-আলম জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ১ লা জুন ১৯৬৬ সালে, বীরভূম জেলার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় খ্যাত লাভপুর সংলগ্ন কীর্ণাহারের নিমড়া গ্রামে। পিতা ও মাতার নাম:নূরুল আবসার ও ফাতেমা খাতুন। মা ছিলেন বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সাহিত্যিক আব্দুর রহমান এর কন্যা। সেইদিক দিয়ে নাসিম গৃহপরিবেশে একটি সাহিত্যিক আবহাওয়ায় বড় হওয়ার সুযোগ পান। মাতামহের বিশাল লাইব্রেরি এবং বই ও পুঁথি নাসিমের কাছে একটা সাহিত্য জগতের ঠিকানা এনে দেয়। মূলত লেখার প্রেরণা এখানেই। ন’য়ের দশকেই ‘দেশ’ পত্রিকায়’ ‘গাছ-বউ’ এবং ‘চর্যাপদের হরিণা’ কবিতা দুটি প্রকাশিত হলেই বাংলা কবিতার পাঠক তাঁকে সহজেই চিনতে পারে। সেই সময় কবি শুভশ্রী রায়ের সঙ্গেও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কবিতাই যেন নবদম্পতির জীবনের সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করে। কিন্তু দাম্পত্য জীবনে নানা অন্তরায় দেখা দেয়। সমাজ দুই অসম সম্প্রদায়ের বিবাহ কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। শুরু থেকেই শুরু হয় দূরত্ব। আর দূরত্ব বাড়ানোর কারিগরেরও অভাব নেই। সুতরাং এক বছরের মধ্যেই তা চরম বিচ্ছেদের রূপ নেয়। পরবর্তী সময়ে নাসিম সুরুচি সম্পন্না উচ্চ শিক্ষিতা এবং কবি ফেরদৌসি বেগমকে বিবাহ করেন। এই ফেরদৌসি এসেই নাসিমের জীবনকে পূর্ণ করে দেয়। সৃষ্টিতে পুনরুজ্জীবন অর্থাৎ জোয়ার আসে। গদ্য, কবিতা ও ‘কবিতা উৎসব’ নামে একটি অনিয়মিত সাময়িক পত্র সম্পাদনায় ফেরদৌসিকে সর্বদা পাশে পান। ফেরদৌসি একদিকে তাঁর কবিতার পাঠক এবং সমালোচকও। সংসার সামলে একমাত্র সন্তান রওনক আলমকে আদর যত্নে যেমন বড় করতে থাকেন, তেমনি নাসিমের কবিতাকেও মনোযোগ সহকারে পাঠ করে ভালো-মন্দ মতামত দিতে থাকেন। সংসার হয়ে ওঠে কবিতাময়। স্নেহে আদরে ভালোবাসায় পূর্ণতা পায়। নাসিম এবং ফেরদৌসি দুজনেই ভীষণ আতিথ্য পরায়ণ। বারবার তাঁদের বাড়ি গেলেও কখনো বিরক্তি প্রকাশ কেউ দেখেছেন বলে মনে হয় না। সেবা-যত্নে আহারে-বিহারে সর্বদা ভরিয়ে দিয়েছেন। কাছে থেকেছেন, ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছেন তাঁদের গ্রামের চারিপাশ, ন্যারোগেজের রেললাইন, তারাশঙ্করের স্মৃতিধন্য স্থানগুলি এবং ফাঁকা মাঠের উদাসীন ঘাসবন। অনেকক্ষণ বসে থাকা, পাখিদের ওড়াউড়ি দেখা, হাটুরে মানুষের বাড়ি ফেরা, আবার সন্ধ্যায় ফিরে এসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে মাতামহ আব্দুর রহমানের গল্পে মশগুল হওয়া কতই না ভালো লাগার মুহূর্ত। একসঙ্গে অনেক ক’জন নাসিমের বাড়ি এলেও ফেরদৌসি হাসিমুখে একাই দশ হাতে যেন তাঁর কাজ সামলে নেন। অতিথিরা বুঝতেই পারেন না তাঁর কষ্ট কিনা। ২০২২ এর ২৪ শে অক্টোবর দীর্ঘ রোগভোগের পর নাসিমের মৃত্যু যে কতখানি শূন্য করে দিয়েছে আজ তা বোঝা যায় ফেরদৌসিকে দেখেই। প্রথম জীবনে নাসিম সেচ দপ্তরে চাকরি পেয়েই কলকাতা মুখি হয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই ফিরে আসেন গ্রামে। সিউড়ি হয় তাঁর কর্মস্থল। বাসে যাতায়াতের পথে জানালার ধারে বসেই লিখে ফেলেন কবিতা। প্রায় প্রতিদিনই কবিতা কিংবা গদ্য একটা না একটা লেখা হয়েই যায়। গদ্যগুলি বেশিরভাগই কাঞ্চন সরকার সম্পাদিত সিউড়ি থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক নয়াপ্রজন্মে’ প্রকাশিত হয়। কখনো কখনো তা কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক কলমের সহ-সম্পাদকীয় বিভাগে। কখনো আনন্দবাজারেও। অজস্র লিটিল ম্যাগাজিনসহ বিখ্যাত বাণিজ্য পত্রিকাগুলিতেও নাসিমের কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে।
কলকাতায় অবস্থানকালে অথবা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন নাসিম যে কবিতাগুলি লিখেছিলেন তা প্রথমদিকের কাব্যগুলিতে স্থান পায়। আইরিশ কলোনির সন্ধ্যায় নাসিম যেমন নিজেকে আবিষ্কার করতে থাকেন, তেমনি গ্রাম বাংলার বর্ষা ঋতুকেও ততটা সমীহ করেন। একদিকে বিশ্বচৈতন্যের অনুভাবনা ও আত্তীকরণ, অন্যদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভেতর অনুগমন তাঁর চলার গতিকে নির্ধারণ করে। ময়ূর তাঁর জীবনচেতনারই উদ্দাম সৌন্দর্যের প্রতীক। তার উচ্ছ্বাস ও ছন্দবিন্যাস আত্মজাগরণের অভিক্ষেপ হয়ে দেখা দেয়। এক মুক্তিকামী চেতনার সাবলীল প্রয়োগ দেখতে পাই এই সময়ের কবিতাগুলিতে। ‘লিটল ম্যাগাজিন ও অন্যান্য কবিতা’ কাব্যে কবি লিখেছেন:
“চাকরি নয়—কবিতা দাও, অমরত্ব দাও
ছুঁয়ে দেখি মগ্ন শেকড়, শরীর বাগান থেকে
তুলে আনি অলৌকিক ফুল,
সন্ধ্যা সাতটায় কফিহাউসে ডানা মেলছে
সোনালি ডানার চিল”
কবির কাছে চাকরি নয়, কবিতাই কাম্য। যে কবিতা অমরত্ব দেবে। তাই মগ্ন শেকড়ের সন্ধানে ঈশ্বরের বাগান থেকে অলৌকিক ফুল তুলে আনেন। কবিতা তো ঈশ্বরের বাগান থেকেই আসে। ঐতিহ্যপূর্ণ কবিতার আড্ডা কফিহাউসে ডানামেলার সুযোগ পায়। ‘সোনালি ডানার চিল’ কথাটির মধ্যেই মুক্ত আকাশে উড়ানের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। সেই উড়ান নিয়েই কবি কলকাতায়। এই কাব্যেই কবি নিউটনের মুখে ভাষা বসিয়েছিলেন ‘একটি আপেল কেন মাটিতে পড়লো!’ মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কারের মুহূর্ত লগ্নটিকে তুলে এনে কবি প্রেমে পড়ার আকর্ষণটিকেই বোঝাতে চাইলেন। আবার হৃদয়ের উচ্ছ্বাসে প্রেমের মগ্ন উচ্চারণ গীতিকবিতার জন্ম দেয়। সেই কথাটি বোঝাতে চাইলেন ‘কেন ঐ গীতি কবিতার গালে ছিল নীল তিল’ লিখে। গীতিকবিতা যে প্রেমিকা, তিলের উল্লেখে তার শরীরী উদ্ভাসকেও সামনে আনলেন। যৌবনাবেগ ও জিজ্ঞাসার মধ্যেই তাঁর চলন শুরু হল। ব্যাগের মধ্যে কবিতার পাণ্ডুলিপি আর মনের মধ্যে প্রেমের ক্ষুধা নিয়ে তরুণ গড়ুরের মতো কবির শব্দটংকার স্থাপিত হল। এই কাব্যে লিখলেন:
“পৌষমেলা শেষ এবার অভিমন্যু হব
আর তোমায় ছাড়ব না উত্তরা
তোমাকে প্রশ্ন করব অভিজ্ঞ শিক্ষকের মতো
ছাতা খুলে যাবে
শহরের যত বৃষ্টি ছুটে যাবে উত্তরে, পূর্বে ভিন্নপথে
যেন ‘গড়শ্রীখণ্ড’ থেকে বৈরাগী বাতাস
ছুটে যাবে শাহফরিদের দরগা অবধি….”
কবি ভক্ত হয়ে উঠলেন, সাধক হয়ে উঠলেন। বৈরাগী বাতাস হয়ে নিজেকে নিক্ষেপ করলেন। প্রেম যেন কবিতায় এসে প্লাবন সৃষ্টি করে দিল।
যে ‘গাছ-বউ’ কবিতা লিখে গাছের মধ্যে মনুষ্য প্রবৃত্তির জাগরণকে উত্তাল করে তুলেছিলেন, এই কাব্যে সেই গাছকেই দেখলেন ‘মানুষ-গাছ’ হিসেবে। গনেশ পাইনের ছবিতে মিছিলের মানুষ ‘মানুষ-গাছ’ হয়ে গেল। গাছের কান্না, গাছের মর্মরধ্বনি, গাছের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলেন। এখানেও মনুষ্যচেতনার সঞ্চার কবিতাকে অনন্য করে তুলল। অন্যদিকে ‘তুতেন খামেনের মমি’ কবিতা সিরিজের কবিতাগুলিতেও কবি ফিরে গেলেন নির্জন পিরামিডের যুগে, স্তব্ধ লোককথায়। এলিজাবেথের পালঙ্কের সূচিশিল্পে। মমিজীবনের রহস্যে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করলেন। মেষপালক হয়ে, মরু-তৃষ্ণায় নিজেও কাতর হয়ে চেয়ে রইলেন ইহুদি বণিক হয়ে।
‘ধুলোর নির্জনে লেখা’ কাব্যে আত্মজীবনের ছায়া আরও গভীর হয়ে পড়ল। গাছপালা, মাঠঘাট, নিজের গ্রাম ও কোপাই নদী, শীতের নরম রোদে অজস্র পাখির উড়ান, বিস্তীর্ণ বিল, সবুজ ঘাসের ডাঙা, অসীম নিস্তব্ধতা এই কাব্যের কবিতায় বারবার ফিরে এল। একদিকে রাঙামাটির বাউল, জয়দেব-কেন্দুলির হাতছানি, সবুজ গমের খেত, কীর্ণাহার স্টেশন, শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা,লাঙলহাটা বিল, অন্যদিকে নিজের জীবনের ভাঙাগড়া উত্থানপতন কবিতাযাপনের ভেতর ও বাহিরে গভীর টানাপোড়েনর সৃষ্টি করেছে। পলায়নবাদী চেতনা থেকে ফিরে এসে তাই কবিতার পাশে বসেছেন:
“একদিন কুড়ি কি একুশ বছরে
আটকে ছিলাম ক্রিকেট মাঠে
পালাতে পারিনি যেহেতু বোকা ছিলাম
ব্যর্থ ছিলাম তাই সংগ্রহ করেছি বিষ,
যেহেতু বিষই জীবন… একটা নাতিদীর্ঘ পাহাড়
ওপারে সূর্যাস্ত, খয়েরি রঙের সন্ধ্যা…
নতুন করে বাঁচতে শিখি তরুণ কবি।”
নতুন করে বাঁচতে শেখার মধ্যেই কবিতাই যে কবির আশ্রয় তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু নাগরিক বাতাসে শ্বাস নিতে নিতে কবি বুঝতে পেরেছেন:
“হাঁটছি মরুভূমি পেরিয়ে অক্ষরবৃত্ত পেরিয়ে
হাঁটছি জুরাসিক যুগের প্রান্ত ঘেঁষে ঘেঁষে
খুঁজছি কোন যুগে মানুষের ডানা ছিল।”
ডানাওয়ালা মানুষ, উড়ন্ত মানুষ অতিক্রম করতে পারে জীবনের বহু অন্তরায় এই বিশ্বাস নিয়েই কবি গতি চেয়েছেন। ধুলোর নির্জনে সহজ স্মৃতির পথে লক্ষ্মীশাল ধানের ঘ্রাণ নিয়ে বিষণ্ন মেয়েটির নকশিকাঁথা বোনার আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারেননি। পোড়া জীবনের রঙে কাব্যের প্রচ্ছদ যে প্রগাঢ় হয় তা উপলব্ধি করেই নকশিকাঁথা পেতে রেখেছেন, সেখানেই বসতে বলেছেন আত্মীয়-স্বজনদের। আন্তরিকতায় নিবেদিত প্রাণ ধুলোর নির্জন আত্মকথার নিবিড় সংশ্লেষে গরীয়ান হয়ে উঠেছে।
‘চাঁদ সদাগর ফিরে আসবে’ মঙ্গলকাব্যের এই নায়কের মধ্য দিয়েই কবি এক দৃঢ়তার সম্মোহনের দেখা পেয়েছেন। বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী পরোক্ষভাবে দেশের অর্থনীতি জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে। সংকটময় মুহূর্তে প্রয়োজন, যিনি ফিরে এসে পুনর্বার এই দেশকে সুখ-ঐশ্বর্যে ভরিয়ে দিতে পারবেন। কবি সেই সংকটের মুহূর্তকেই নিরীক্ষণ করে লিখলেন:
“রাত্রির সঙ্কট শুরু মনসামঙ্গলে
কবিরা সন্দেহপ্রবণ, কবিরা ভীষণ খুঁতখুঁতে
চাঁদ সদাগর ঠিক কবি মন নিয়ে
চেয়ে চেয়ে দেখছেন ডুবে যাচ্ছে বাণিজ্য তরণী
কেউ ফিরবে না
না সন্তানেরা না বাণিজ্যে স্নাতক তার তরুণ ম্যানেজার।”
সবাই ডুবে গেলেও, চাঁদ সদাগর নিঃস্ব হয়ে পড়লেও দেবতার কাছে মাথা নোয়াবেন না—এরকমই দৃঢ় চরিত্রের ব্যক্তিত্বই দেশের জন্য প্রয়োজন। তিনিই তো একটা যুগের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রয়োজনীয়তার কথাই কবি উচ্চারণ করেছেন। অবশেষে সন্তান বাৎসল্যে মনসাকে পুজো দিতে স্বীকৃত হলে সবকিছুই ফিরে আসে। কবি লিখলেন ‘জীবন যেমন হয় বয়সের শেষপ্রান্তে ঈশ্বর সমর্পণ’… হয়তো এই সমর্পণই ছিল কল্যাণ কামনার। এই কাব্যে জেরুজালেমের প্রাচীন উপকথা থেকে পথের প্রান্তে বেদুইন তাঁবু মরুবাসী জীবনের প্রণয় পর্বও সামিল হয়েছে। মিশরীয় পিরামিডের ছায়ায় নিজেকে কবি
আবিষ্কার করেছেন। লিখেছেন:
“রসুল তোমার সঙ্গে আড়ি
ধর্ম নয় আমি চলেছি উটের দলে
দূরে আরও দূরাগত বালুকা সময়ে সঙ্গে যুবাইর
বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী—সুদূরের তৃষ্ণা তবু জাগে
আছে পাতার মর্মরস্তূপে, হাটেগঞ্জে মগ্ন খেলাঘর
খেলাঘর সকলই ক্রীড়ার মতো বলেছো রসুল
ওই সন্ধ্যার দীপ, ভূমধ্যসাগরের বুকে জেগে থাকা গৃহ
পিরামিডে মিশে যায়, চাঁদের মাস্তুল ছুঁয়ে
সময়ের পারে পারে শিশুর হাসির মতো
ওই ঘুম। পিরামিড প্রশ্ন করে।”
সেই অতীতে আরবিয়ানদের উটের পিঠে ব্যবসা-বাণিজ্য করার ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেইসঙ্গে নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) জীবন ও বাণী কবি মনে রেখেছেন। তাই পার্থিব বিষয় আসক্তিকে খেলার বস্তুর মতোই ভাবতে বলেছেন। কল্পনা বা রোমান্স সুউচ্চ মিনারের মতো হলেও তার সৌন্দর্যকে নামিয়ে এনেছেন মৃতদেহের কবর অর্থাৎ পিরামিডে। তাই পিরামিড প্রশ্ন করেছে শিশুর হাসির মতো সত্য আর সরলতায় ভরা ওই ঘুম যা মৃত্যু,যা জীবনের সমাপ্তির ঘোষণা। কবির চেতনায় সেই আধ্যাত্মিক দর্শনের প্রভাবও পড়েছে। ইসলামীয় দর্শনের জীবনধারাকে যেমন কবি এড়াতে পারেননি, তেমনি বৈষ্ণবীয়-বাউলতত্ত্বের এবং সুফিবাদের ভাবনাকেও দূরে সরাতে পারেননি। তাঁর সমস্ত কাব্যচেতনাতেই এসবেরই সংমিশ্রণ ঘটেছে। তাই লোককথা,পিরামিড সমস্তকেই ‘পালক আশ্রিত’ বলেছেন। রণ-রক্ত-বিজয়-উল্লাস কোনো সফলতা এনে দিতে পারে না। যুদ্ধের পর কৃষি খেতেই ফিরে যেতে হয়। তরমুজ খেতের পরিচর্যা করতে হয়। কবি লিখেছেন:
“এখানে সাম্রাজ্য নয়,জাদুঘরের প্রাচীনতা আকাঙ্ক্ষা আমার
লিপিতে লেখা সাধকের উপদেশ
নক্ষত্রের ক্ষয়ে পড়া ঠাণ্ডা পাথর
পরিত্যক্তা রাণীমার মখমলের জুতা ও আচ্ছাদন
মোজেসের মায়াবী লাঠিটি…”
জাদুঘরের প্রাচীন নিদর্শনগুলির মধ্যেই কবি তাঁর পূর্বজন্মের স্বাক্ষর খুঁজে পান। প্রাচীন পয়গম্বরদের বাণী অনুসরণ করেন। প্রাচীন সাম্রাজ্যের রাণীমার মখমলের জুতো মোজেসের মায়াবী লাঠি কবির কাছে কাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে। কবি শুনতে পান মাটির মসজিদ থেকে স্তব্ধ বিকেলে আজান আসে। মায়াবী দরবেশ রুবাইয়াৎ পড়ছেন। দাসপ্রথা, সতীদাহ যুগ থেকে পদাবলী যুগের মধ্যে দিয়ে গীতিকবিতার যুগে তিনি পৌঁছান। তারপর হ্যারিপটারের রহস্য ঘনীভূত হয়ে ওঠে। এখানেও তাম্রসভ্যতা আর খাজুরাহো নগরীর কাহিনি অনুধাবন করতে করতে চেয়ে থাকেন আকাশে পাখির উড়ানের দিকে। নিজের মুখ মিলিয়ে যায় সেইসব অতীত অলৌকিক মুখের ভিড়ে। আত্মঅনুসন্ধানে ইতিহাস, দর্শন, আধ্যাত্মিকতা এবং একান্ত নির্জনতাও কবির কবিতায় গভীরভাবে রেখাপাত করে। তাই কবিতার সূত্র নির্ণয় করতে তিনি লিখেছেন:
“প্রতিটি ক্যালকুলাস সূত্র—প্রতিটি কৃষ্ণগহ্বর
প্রতিটি নক্ষত্রলোক, প্রতিটি ব্যর্থপ্রেম
প্রতিটি হাহাধ্বনি
প্রতিফোঁটা চোখের লোনাজল
কবিতার সূত্র মেনে চলে।”
সুতরাং কবিতা যে সত্য অন্বেষণ, সত্য জীবনবোধ, সত্য আবেগ তা অস্বীকার করা যায় না। নাসিম এখানেই তাঁর কবিতাকে রেখেছেন। এখানেই তাঁর জীবনবোধকে নির্মাণ করেছেন।
‘বাসমতী ধানের অগ্রহায়ণ ও ঝুমকোলতা’ মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগেই প্রকাশিত জীবিত অবস্থায় এটিই তাঁর শেষকাব্য। কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে তিল তিল করে মৃত্যুবরণ করেছেন নাসিম আর এই কাব্যের কবিতাগুলির এক একটি শব্দ সাজিয়েছেন, এক একটি চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন। একবার বলেছেন ‘কাফনগীতিকা গেয়ে শুরু হবে বিবাহ উৎসব’. আরেকবার বলেছেন ‘সন্ধ্যার উপাসনা সাঙ্গ হলে আলবিদা,/ এ জন্মের মতো আসি ঝুমকো লতা।’ স্বাভাবিকভাবেই জীবনদীপ নিভে আসার মর্মান্তিক মুহূর্তটি সর্বদা তিনি অনুভব করেছেন। তাই পার্থিব জীবন এবং অপার্থিব জীবনের সেতু হয়ে উঠেছে এই কাব্যের অনুভবনা। কখনো প্রেমের স্মৃতির সরণিতে কবি পথ হেঁটেছেন তো কখনো মধ্যরাতে দোজখের ডাক পেয়েছেন। ফেরেশতারা কাফন নিয়ে অপেক্ষা করেছে। অথবা কবরের হাতছানি অমোঘ হয়ে উঠেছে। তাই ‘ঝুমকোলতা’-র কাছে আশ্রয় চেয়েছেন। বাসমতী ধানের ঘ্রাণে উজ্জীবনের যে আকাঙ্ক্ষা তাকে জাগ্রত করেছেন। অন্য কবিদের মধ্যেও ঝুমকোলতার আবির্ভাব টের পেয়েছেন। অবিশ্রাম ঝুমকোলতাকে আশ্রয় করেই বহুমুখী জীবনবৃত্তীয় ক্রিয়াকে অনুধাবন করেছেন। তাই কবিতায় লিখেছেন:
“বাইবেলের পাতা থেকে খসে গেল নিনেভ নগরী
অথচ তোমার উথাল-পাথাল এই নগরীর আলো-অন্ধকার,
গানের শরীর পাতাবাহার, তারার শরীরে যত হিমযুগ,
আমাদের যাযাবর মেষপালকের জীবন,
অথচ প্লেগ এল, এল শকুন ডানায় ভর করে,
পালিয়ে এলাম ঝুমকোলতা তোমার হাত ধরে।
হৃদয়ের থেকে দূরে নয় পলায়ন
দু’জনে নিঃস্ব হয়ে জেরুজালেম
এলাম কিংবদন্তির কাছে,অলিভ সুন্দরতায়
তুমি বলেছিলে বেঁচে আছি এই তো অনেক,
তোমার বিশ্বাস সবুজের লিথোগ্রাফ
তুমি অরণ্য ফেরত
তুমি হাওয়া দেওয়া শস্যখামার
মিনহাজউদ্দিনের উপন্যাসে বর্ণিত হিব্রুগানের স্বরলিপি।
ফিনিশীয় শিল্পের চিরন্তন কারুকাজ।”
তখন বহু যুগ আগের সেই জীবনকেই আমরা দেখতে পাই, যখন লেখা হচ্ছে বাইবেল। বারবার পাল্টে যাচ্ছে মানুষের জীবনদর্শন। এই সময়ই যাযাবর মেষপালক হয়ে জীবন কাটিয়েছেন। প্লেগের ভয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। তারপর প্রাচীন নগরী জেরুজালেম ঘুরে সবুজের লিথোগ্রাফ বিশ্বাস করে অরণ্য থেকে ফিরে হাওয়া দেওয়া শস্যখামারে উত্তরণ ঘটেছে। মিনহাজ উদ্দীনের উপন্যাসে হিব্রুগানের স্বরলিপিতে বর্ণিত হয়েছেন, অথবা ফিনিশীয় শিল্পের কারুকাজে ফুটে উঠেছেন। কবিতার পরবর্তী অংশেও সেমেটিক সভ্যতার পরবর্তী সিরিয়ার কোনো দূরগ্রামে বসবাস করেছেন। মৃগয়ায় কস্তুরী হরিণী হিসেবে পেয়েছেন ঝুমকোলতাকে। সামান্য রুটি ও মধু সংগ্রহ করে, দুঃখে পরাজয়ে মাটির গহনায় জীবন যাপন করেছেন। প্রথম সন্তানের শোকাবহ মৃত্যু সহ্য করেছেন। তারপর কবি লিখেছেন ‘ঝুমকোলতা যথাযথ ভাসমান শ্যাওলা-জীবনে।’
এই শ্যাওলাজীবন অনন্ত অশেষ ঝুমকোলতায় পরিপূর্ণ। মহাপ্রলয়ে, নতুন জীবনে, জলের সারল্যে, নীলের মগ্নতায় বিপুলা পৃথিবীতে একফোঁটা এই যাযাবর জীবন। আমেরিকান ইতিহাসবিদ, কলামিস্ট, ঔপন্যাসিক, কবি, শিল্পী এবং সম্পাদক আবেরজানি (জন্ম ১৯৫৭) ‘ডানাওয়ালা স্বপ্নের নদী’-তে বলেছেন: “The death of a dream can in fact serve as the vehicle that endows it with new form, with reinvigorated substance, a fresh flow of ideas, and splendidly revitalized color. In short, the power of a certain kind of dream is such that death need not indicate finality at all but rather signify a metaphysical and metaphorical leap forward.”
(Author-Poet Aberjhani, The River of Winged Dreams)
অর্থাৎ একটি স্বপ্নের মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে একটি বাহন হিসাবে কাজ করতে পারে যা এটিকে নতুন রূপ, পুনরুজ্জীবিত পদার্থ, ধারণার একটি নতুন প্রবাহ এবং দুর্দান্তভাবে পুনরুজ্জীবিত রং দিয়ে দেয়। সংক্ষেপে, একটি নির্দিষ্ট ধরনের স্বপ্নের শক্তি এমন যে মৃত্যু মোটেই চূড়ান্ততার ইঙ্গিত দেয় না বরং একটি আধিভৌতিক এবং রূপকভাবে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
নাসিম-এ-আলম-এর ক্ষেত্রেও তাই দেখতে পাই। একজন মেয়ের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটলেও পরের জন্মে তা পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। একটি ঘোরের মধ্যদিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তা যে রূপক এবং আধিভৌতিক তা তাঁর লেখার মধ্যেই বোঝা যায়। ঝুমকোলাতার অসুখ হয়, ঝুমকোলতার শরীর থাকে না, কিন্তু ঝুমকোলতার মৃত্যু হয় না:
“একটা কৃষিজীবন ছিল আমার ঝুমকোলতার
খেতে খেতে বীজ বোনা, জল সেচ দেওয়া
হলুদ ধানশিষ আমাদের নবান্ন উৎসব
মাঠে মাঠে লক্ষ্মীশাল, বাসমতীর ঘ্রাণ
মানুষ ফুরিয়ে যায়, ফসলের এই ঘ্রাণ
ফুরোয় না কখনও জানে ঝুমকোলতা।”
ঝুমকো লতার ব্যাপক অর্থ, চিরন্তন জীবনমহিমার রূপকীয় রূপ কবি বারবার উল্লেখ করেছেন। ঝুমকোলতা সেই আবহমানকালের প্রেমিকা সত্তা, যুগে যুগে বিভিন্ন মানুষের সৃষ্টিতত্ত্বেই তার প্রেরণা উপলব্ধি করেন স্রষ্টারা। অর্থাৎ সৃষ্টির উৎসমূলে যে প্রেম, সেই প্রেমই শেষকথা তা বলাই বাহুল্য। জীবনানন্দ দাশের কালিদাস সত্তা যেমন উপলব্ধ হয়েছে, তেমনি বিদেশি সাহিত্যের পল ভালেরি, শেলী, কিটস, রবার্ট ফ্রস্টও জেগে উঠেছে। সময় এবং সময়ের ইতিহাস হয়তো একটা যুগের জন্ম দিয়েছে; কিন্তু প্রেম তো চিরন্তন, তা সর্বযুগেই প্রবহমান হয়ে উঠেছে। নাসিম এই কাব্যের কবিতাগুলিতে সেই প্রেমকেই উপলব্ধি করেছেন। প্রেমিকা হিসেবেই তাঁর ঘরকন্নায়, সৃষ্টিতে অতীত থেকে বর্তমানে বহুস্বরের সমন্বয় এনে দিয়েছে। চেতনাপ্রবাহের এই ব্যাপ্তি পরম স্রষ্টার আদিম আবেগ থেকেই বাহিত ও অনুরঞ্জিত। একে অস্বীকার করার কারও সাধ্য নেই। ‘জীবন হয়েছে এক প্রার্থনার গানের মতন তুমি আছ বলে প্রেম’ জীবনানন্দ দাশ এটা উপলব্ধি করেছিলেন বলেই ‘বনলতা সেনে’ লিখেছিলেন ‘থাকে শুধু মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’ জীবনের সব লেনদেন ফুরালেও বনলতা সেন কখনো ফুরিয়ে যায় না। নাসিমের কাছেও ‘ঝুমকোলতা’ও তেমনি:
“সঙ্গে আছ চিরকালই ভাবি
সঙ্গ ছাড়া সেও খোঁজে গৃহ
গোপন রাখি ঝুমকোলতার নাম
দুপুর রাতে হঠাৎ মনে হল।”
প্রেম কি বিচ্ছেদের মধ্যেই দূরত্ব রচনা করেছে? তাই মিস্টিক চেতনায় কবি তাঁর মধ্যেই তাকে জায়গা করে দিয়েছেন। আসল নাম গোপন রেখে ‘ঝুমকোলতা’ বলে ডেকেছেন। দুপুররাতে একাকিত্ব জীবনের ভার অসহ্য মনে হলে তাকে শোনাতে চেয়েছেন কষ্টের উপলব্ধি। কবি মানস চক্ষে দেখতে পেয়েছেন:
“জ্বর এসেছে জীবনানন্দের,নবান্নের ছায়াঘেরা
কার্তিকের নিভৃতে শুনি ভোমরার গুনগুন
হিজলের বাঁকা ডালে চাঁদ উঠবে কবির ইচ্ছায়,
রূপসী বাংলার পাণ্ডুলিপি শেষের পর্যায়ে
ঝুমকোলতা দেখে নিচ্ছে অসংখ্য কমা-হাইফেন
জটিল হাতের লেখায় বাসমতীর সুঘ্রাণ, মেঠো
ইঁদুরের মতো মরণের ঘোরে খুদের গন্ধ লেগে আছে।
ঝুমকোলতা চা করছে বারবার কবির জন্যই শুধু
চা-চিনি-দুধের মিশ্রণে জীবন মাপের মুগ্ধতা
নক্ষত্রের নীরবতা নাটোরের নির্জন ঘরে।”
কে এই ঝুমকোলতা তা আর জানতে কারও বাকি থাকে না। কবির প্রেমিকা, মননের সঙ্গী, কখনো তা ধারণামাত্র। কখনো তার রূপ স্ত্রীর মধ্যেও ফুটে ওঠে। কখনো স্বপ্নে। কখনো চেতনায় কবির নান্দনিক ভাবনায়। যে কবির হাত দিয়ে করিরই পরিচর্যা করে। কখনো তা অন্যের হাতে ঝুমকোলতার হাত দেখা যায়। প্রেমের মধ্যেই এই কাব্যে মৃত্যুর আবহাওয়াও রচনা করেছেন। তাই দূরত্বও আত্মসমর্পণের পর্যায় হয়ে উঠেছে। সহিষ্ণু ও সম্মোহন একইসঙ্গে দেখা দিয়েছে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নিঃসঙ্গতা শতবর্ষে জাদুবাস্ততার জন্মের কথা উল্লেখ করেছেন। চর্যাপদ রচনার কালে, সুফি সাধকের সাধনার সময়, শাহনামা, আরব্যরজনী রচনার সময়, সক্রেটিসের বিষপানের সময় তখনো ঝুমকোলতা ছিল, কিন্তু কোথায় ছিল? কবি কেন দেখা পাননি সেই সময়? কবি ২৭ বছর বয়সেও ঝুমকোলতাকে পাননি কেন? এইসব প্রশ্ন নিজের মধ্যেই ফিরে এসেছে। তারপর কবি লিখেছেন:
“যখন প্রথম কবিতা লিখেছিলাম
আর ছাপা হয়েছিল কৃত্তিবাসে
যেদিন দ্রাবিড় জলভূমি থেকে ফিরে এসেছিল
সব বাণিজ্য তরণী, তখন কোথায় ছিলে?”
ঝুমকোলতা কেন লুকিয়ে ছিল, কেন আসেনি, আজ যখন এসেছে, তখন কবি মৃত্যু শয্যায়, ঝুমকোলতা কবির আরোগ্য দিক, বাঁচিয়ে তুলুক। কবিকে ধ্বংসের হাত থেকে ফিরিয়ে আনুক। এই আকুতি নিয়েই তিনি লিখলেন:
“বেঁধে রাখো ঝুমকোলতা
এ মাটি ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।”
কিন্তু কিছুতেই ঝুমকোলতা কবিকে ইহজন্মে আর আশ্বাস দিতে পারেনি। শস্যসম্মোহনে জীবনের প্রাচুর্যকে সমন্বিত করেছেন।এই জীবনই কবি চেয়েছিলেন যে জীবন কৃষকের আত্মার ভেতর বিরাজ করে। কবির সংসার তেমনই তো হওয়ার কথা ছিল:
“দীর্ঘদিন যে সত্য বলিনি
আজ বলি অভাবই আমার স্বাধীনতা
আমার ঈদ, শারদীয়া, নবান্ন উৎসব
আমার সন্তান আর ঝুমকোলতা
আমার বাসমতী সংগ্রহ
হলুদ তাঁতশাড়ি, মায়ের হাসিমুখ,
ভ্রমর গুঞ্জন করে, গাছে গাছে পাখিদের শিস
শহরে যাব না এই অহংকারে
ঝুমকোলতা ভাত চড়িয়েছে
শুদ্ধতম মাটির উনুন।”
ঝুমকোলতা অবশেষে গ্রামজীবনের ঘরকন্নায়
মাটির উনুনে ভাত চড়িয়েছে। কবি লিখলেন শুদ্ধতম মাটি। তখনই বোঝা যায় বাসমতী তো জীবনের রসদ। হলুদ তাঁতশাড়ি ঝুমকোলতার জন্য। মায়ের হাসিমুখ তো মাতৃবৎসল সন্তানের একমাত্র কাঙ্ক্ষা। মাটির জীবন তথা ধুলোর জীবন তথা সরল জীবন তথা অনাড়ম্বর জীবনই কবির স্বপ্ন ছিল।
কবির ভাবনা বহুস্তরীয় দৌড়ের ভেতর এক মুক্তি রচনা করেছে। সেখানে পার্থিব-অপার্থিব, বাস্তব-পরাবাস্তব, সক্রিয়তা এবং স্বয়ংক্রিয়তার পর্যটন। প্রাচীন সাহিত্য থেকে আধুনিক সাহিত্যের গল্প উপন্যাসে, প্রাচীন ইতিহাস থেকে বর্তমান রাজনৈতিক জীবনে এক অবাধ যাতায়াত লক্ষ করি। বাসমতীর সর্বব্যাপী অবস্থানেই কবি সভ্যতার বিচিত্র রূপ খুঁজে পান। অরণ্যজীবন থেকে নগরজীবনে তথা গ্রাম্যজীবনেও কবির অবস্থান। অনন্ত মমিজীবনের স্তব্ধতায় নিজেকে আবিষ্কার করেন। ‘কবিতার দিগন্তে অসম্ভব বেদনা নির্মাণ’ চলতে থাকে। সুরিয়ালিজমের কাল শেষ হলে ভোররাতে অবসন্ন শহর জুড়ে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। হরিণের শিঙের মতো বেঁচে থাকা সান্ধ্য হাসপাতাল দেখতে পান। সব বাস্তবতা অতিক্রম করে যায় কবির বোধ। সিলভিয়া প্লাথের জেগে ওঠা মৃত্যু ক্ষুধা কবিও অনুভব করেন। পিকাসোর জলরঙে আঁকা ছবিতে ঝুমকোলতার অগ্নিশিখাময় দুটি চোখ দেখতে পান। কবির মনে হয়: ‘পৃথিবীর সব কিছু মৃত’ সবকিছু অতীত নৈঃশব্দ্যে মিশে যাবে।প্রেমিকারাও নুনের পুতুল সমুদ্রে বিলীন হবে। রঁমা রঁলার সংরক্ষিত অশ্রু কবিকে অশ্রুর সওদাগরে পরিণত করে। রবার্ট ফ্রস্টকেও দেখতে পান দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে। মপাসাঁর সাথেও ঝুমকোলতা ছিল। হ্যাঁ ঝুমকোলতা, যার অজস্র নাম, অজস্র ডাকনাম। কত নারীর মধ্যেই ঝুমকোলতা বিরাজ করে। কবির মৃত্যুর পর এই ঝুমকোলতাই কবির কবিতা সমগ্র প্রকাশ করবে। কবিতা পাঠ করবে। কবিতার মূল্যায়নও করবে।
হৃদয়ের অনেক রক্তক্ষরণ নিয়ে স্মৃতির সরণিতে শেষবারের মতো কবি দাঁড়ান। কত ঋণ থেকে গেল সকলের কাছে। সাধারণ মানুষ, দিন-আনি দিন-খাই মানুষ, টিউশন-টিচার, স্কুল-শিক্ষক, কাজের মাসি, প্রেসের মালিক, বান্ধবীর মা, কারখানার শ্রমিক যারা এক সময় কবিকে ভালোবাসতেন, আশ্রয় দিতেন তাদের কাছে কবি যেন শেষ বিদায় নিয়েছেন। শেষ প্রণাম জানিয়ে লিখেছেন:
“প্রণাম রাখি ধুলোমাখা জীবন
প্রণাম রাখি ছায়াঘেরা যত গ্রাম
প্রণাম নিও অন্তিমের ঐ আগুন।”
হয়তো মৃত্যু ঘনিয়ে আসার পূর্ব মুহূর্তে শেষ প্রণাম করার সুযোগ তিনি পাবেন না। তাই কবিতাতেই এই প্রণামের ঘোষণা করলেন। প্রণামের শব্দগুলিও কান্না ভেজা হয়ে রইল। বাংলা কবিতার পাঠক কি জন্মান্তরের এই কবির স্বর শোনার জন্য আবার অপেক্ষা করবেন না?