ড. ফজলুল হক তুহিন
ক।
জীবনাদর্শ আর সাহিত্যাদর্শের সফল সম্মিলনে মহৎ সাহিত্যের জন্ম। মহৎ সাহিত্যের স্রষ্টা মহৎ ব্যক্তিত্বের অধিকারি। এই সম্মিলন সব সময় নাও ঘটতে পারে। বিরল সৃজনী প্রতিভার পক্ষেই সামঞ্জস্য রক্ষা করা সম্ভব। বিশ্বসাহিত্যে এই ধরনের নজির হাতে গোনা কয়েকজনের মাঝে সীমাবদ্ধ। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের পরেই কবি ফররুখ আহমদ মহৎ সাহিত্যের নির্মাণশিল্পী। মহৎ সাহিত্যের প্রধান লক্ষ্য মানবমুক্তি। মানবমুক্তির উদ্বোধন মানেই মানবতার মুক্তি। মানবতার মুক্তি ফররুখ আহমদের আজীবনের আরাধ্য বিষয় ও বিবেচনা। আমরা এই লেখায় মহান কবির মূল ভাবের অন্বেষায় আগ্রহী।
খ।
উনিশ শতকে কলকাতাকেন্দ্রিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজে এক ধরনের নবজাগৃৃতি ভাবাদর্শ, চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে নবাব সিরাজ উদ্দৌলার (১৭৩৩-৫৭) পতনের মধ্য দিয়ে ইংরেজ রাজত্বের সূচনা। অতঃপর ১৭৯৩-এ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, ১৮০০-তে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা, ১৮১৭-তে হিন্দু কলেজ স্থাপন, ১৮২০-এ লাখেরাজ সম্পত্তির বাজেয়াপ্ত, ১৮৩৫-এ রাজভাষা হিসেবে ফারসির পরিবর্তে ইংরেজির প্রবর্তন, বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে দূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটায়। একদিকে দেশের শিল্প বাণিজ্য ধ্বংস এবং ভূমি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, ইংরেজ রাজশক্তির মুখাপেক্ষী ও স্থিতিশীল নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি, শিক্ষিত অশিক্ষিতের মধ্যে নতুন শ্রেণিভেদের গোড়াপত্তন; বাঙালির সাহস, উদ্যম এবং সৃজনশক্তির হানি ও বাংলার পল্লীসভ্যতার বিনাশ, মুসলমান সামন্তব্যবস্থা ধ্বংস ও হিন্দু মধ্যবিত্ত স¤প্রদায়ের স¤প্রসারণ, শিক্ষিত বাঙালি মানসের নির্বিচারে ইউরোপের আদর্শ গ্রহণ, প্রাচ্যদেশের সমস্ত পুরোনো ঐতিহ্য-সাধনা-সিদ্ধিকে ইউরোপের মাপকাঠিতে বিচার প্রভৃতির রূপান্তর ইতিহাসে সম্পন্ন হয়।
অপরদিকে বাংলার জাগরণ যখন অর্ধ-শতাব্দী অতিক্রম করে বিংশ শতাব্দীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন বাঙালি মুসলমানের মাঝে এক ‘সার্বত্রিক জীবন-পিপাসা’ জেগে ওঠে। চিন্তা, ভাবুকতা, মনস্বিতা, জিজ্ঞাসা, সন্ধিৎসা ইত্যাদির মতো জাগরণী উৎসমুখ বাঙালি মুসলমানের মানস-চেতনায় খুলে যায়। এই জাগরণের ধারা ‘কোহিনূর’, ‘নবনূর’, ‘মোহাম্মদী’, ‘বাসনা’, ‘বঙ্গীয়-মুসলমান-সাহিত্য-পত্রিকা’, ‘সওগাত’, ‘মোসলেম ভারত’, ‘ধূমকেতু’, ‘লাঙল’, ‘শিখা’, ‘নওরোজ’, ‘জয়তী’, ‘বুলবুল’ প্রভৃতি পত্রিকার মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। শুধু সাহিত্যিক নয়, সমাজ-সংস্কারক, ইতিহাসসন্ধানী, পণ্ডিত, সংগঠক-সম্পাদক, নারী জাগরণকামী, ভাবুক, ঐতিহ্যসন্ধানী– সকলে মিলে বাঙালি-মুসলমানের জাগরণের ক্ষেত্র তৈরি করেন। আর ‘মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি’ (১৮৬৩, কলকাতা), ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ (১৯১১, কলকাতা) ও ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ (ঢাকা: ১৯২৬)– এই তিনটি সংস্থা এই রেনেসাঁর সহায়ক শক্তিরূপে কাজ করেছে।
উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে বাঙালি মুসলমান সমাজে যে নবজাগরণের স্রোতধারা প্রবাহিত হয়, তা চূড়ান্ত ও এককেন্দ্রিক স্পষ্টতা পায় বিশ শতকের বিশের দশকে। কাজী নজরুল ইসলাম এই জাগরণের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তিরিশ দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২১) এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হলে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নতুন প্রজন্মের সমন্বয়ে ঢাকাকেন্দ্রিক মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠে। তারা ইউরোপের রেনেসাঁসের প্রভাবে ও মানবতাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠা ও ‘শিখা’ পত্রিকা প্রকাশ করেন– বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের উদ্দেশ্যে। এই তিরিশ দশকেই রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের রোমান্টিক স্বপ্নকল্পনা এবং জাগরণমূলক ধারার অনুপ্রেরণায় কাব্য রচনা করেন শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫২), আবদুল কাদির (১৯০৬-৮৬), সুফিয়া কামাল (১৯১১-৯৯), গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪), বেনজীর আহমদ (১৮৮৩-১৯৮৩), মহীউদ্দিন (১৯০৬-৭৫), মঈনুদ্দীন (১৯০১-৮১) প্রমুখ। এ-দশকে অন্য একটি কাব্যধারা লোকসংস্কৃতিকেন্দ্রিক পটভূমিতে নির্মিত; এই ধারার স্রষ্টরা হলেন জসীমউদ্দীন (১৯০৩-৭৬), বন্দে আলী মিয়া (৯০৬-৭৯), রওশন ইজদানী (১৯১৭-৬৭) প্রমুখ।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক পর্যন্ত, বহুদিনের স্থবিরতার পর পৃথিবীর কাব্য আন্দোলনের আধুনিকতম বিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলাতে এতো দ্রুত বাংলা কবিতাকে অগ্রসর হতে হয়েছে যে, বিশেষ কোনো বাধা এ ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সুযোগ পায়নি। এ ক্ষেত্রে চল্লিশ দশকের কবিদের ভূমিকা অগ্রণী। এই দশকের উল্লেখযোগ্য কবি হলেন আহসান হাবীব (১৯১৭-৮৫), ফররুখ আহমদ (১৯১৮-৭৪), আবুল হোসেন (জ. ১৯২২) ও সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-২০০২)।
গ।
ফররুখ আহমদের কবিপ্রতিভার উত্থান চল্লিশের দশকে। চল্লিশের দশক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে ক্রান্তিকালরূপে চিহ্নিত। এই সময়ে বাংলা, ভারতবর্ষ এবং সমগ্র বিশ্ব ভয়াবহ সংকট, সংঘর্ষ ও রক্তপাতে উত্তাল। ইতিহাসের এক ঘোরতর সংকটকালে পৃথিবীজোড়া যুদ্ধ, শহর-ভর্তি বুভুক্ষ-মানুষের মৃতদেহ, মন্বন্তর, ঘৃণ্যতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, আত্মঘাতী রক্তপাত, ছিন্নমূল উদ্ভ্রান্ত মানুষ, উচ্ছৃঙ্খল সমাজবন্ধন; এক কথায়, মানবিক মূল্যবোধ এবং মানব-সম্পর্কের এক শোচনীয় অমাবস্যায় বোবা দুঃস্বপ্নের জগৎ ছিলো। এই সময়ে রচিত কবিতা সে কারণে নানা দিক থেকে বিশেষত্বপূর্ণ। তিরিশের কবিদের থেকে এই দশকের কবিরা পৃথক হয়ে যায় মূলত বিষয়বস্তু নির্বাচন ও শব্দ চয়নের সাহসী আধুনিকতার গুণে।
স্মরণীয়, ১৯২৯-এ জাতীয় কংগ্রেসের লাহোর-অধিবেশনে নবনির্বাচিত সভাপতি জওহরলাল নেহরু ‘পূর্ণ-স্বরাজ’ বা স্বাধীনতার দাবি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন। সারাদেশে অসহযোগ ও আইন-অমান্য আন্দোলন আরম্ভ হয়। এদিকে খিলাফত-আন্দোলন বন্ধ হয়ে গেলে ১৯৩০-এ মোহম্মদ আলী জিন্নাহ আইন-অমান্য আন্দোলনে যোগদান করতে অসম্মত হন। তিনি কংগ্রেসের আন্দোলনকে হিন্দু আন্দোলন বলে অভিহিত করেন এবং গোল টেবিল বৈঠকে সদস্যদের বলেন, ভারতীয় মুসলমান সর্ব-ইসলামী আদর্শে উদ্বুদ্ধ, শুধু ভারতীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত নয়। তিনি মুসলমান সসম্প্রদায়ের জন্যে ‘চৌদ্দ-দফা’ উপস্থাপন করেন। এ-সময় (১৯৩০) বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি-দার্শনিক মহম্মদ ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮) উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে মুসলমানদের জন্যে একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করেন। ইকবালের বাণী মুসলমান সমাজে নতুন উদ্দীপনা ও উৎসাহের সৃষ্টি করে। ১৯৩৫-এ ভারত সরকার আইন পাশ হলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ এই আইনের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিধানগুলি সমর্থন করেন এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ নিজস্ব মত প্রকাশ করেন যে, ভারতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নয়, একটি স্বতন্ত্র জাতি । তিনি ভারতে দ্বি-জাতিতত্ত্বের অবতারণা করেন। অতঃপর ১৯৪০-এ মুসলিম লীগের লাহোর-অধিবেশনে জিন্নাহ্ ‘পাকিস্তান’ নামে একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবি পেশ করেন। এভাবেই ‘দ্বি-জাতিতত্ত্ব ও একটি আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
ঘ।
বিশের দশকে যে-দ্বার খুলে দিলেন কাজী নজরুল, বাঙালি-মুসলমান আপন সাহিত্য-সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্র প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো। তিরিশের দশককে শিল্পী কামরুল হাসান বলেছেন: ‘বাঙালি-মুসলমানের যুগ’। নজরুল ও জসীমউদ্দীনের মতোই ফররুখ আহমদ মূলত মানবতাবাদী, মানবপ্রেমিক; কবি মানবতাকে সরাসরি স্পর্শ করেন ইসলামের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জীবনাদর্শের মধ্য দিয়ে। ইসলামের পুনরুজ্জীবনে কবি সিন্দাবাদের অভিযাত্রাকে প্রতীকায়িত করেছেন তাঁর প্রথম ও শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৪) কাব্যে।
ফররুখ আহমদের সাহিত্যিক জীবনের দুটি অংশ: এক. কলকাতায়, দুই. ঢাকায় ব্যাপ্ত। কলকাতার জীবনেই কবি খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৪৮ সালে কবি স্থায়ীভাবে চলে আসেন ঢাকায়। ১৯৪৮-৭৪ পর্যন্ত প্রায় তিন দশক কাব্যচর্চা করেছেন কবি ঢাকায়। কবি ‘রেনেসাঁ সোসাইটি’র উৎসাহী সদস্য ছিলেন, চল্লিশের দশকে ‘আইরিশ লিটারারি রিভাইভ্যাল’-এর আদলে বাংলা সাহিত্যকে বাঙালি মুসলমানের নিজস্বতায় স্বাক্ষরিত করতে চেয়েছিলেন। এঁদের একটি লক্ষ্য ছিলো পুঁথিসাহিত্যের পুনর্জন্ম দান। ফররুখ আহমদ পুঁথিসাহিত্যকে আধুনিকতায় রূপান্তিরিত করেন। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন বাংলার রেনেসাঁরই এক বিশাল মাইলফলক। ভাষা-আন্দোলনের আগেই ফররুখ পরিষ্কার ঘোষণা করেছিলেন ‘পাকিস্তান: রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ প্রবন্ধে: বাংলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। প্রবহমান বাংলার এই রেনেসাঁসের এক প্রধান ব্যক্তিত্ব কবি ফররুখ আহমদ।
ঙ।
ফররুখ আহমদ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কবি ও মৌলিক কবিপ্রতিভা। সর্বোপরি তাঁর রচনাভঙ্গি, কাব্যভাষা অত্যন্ত মৌলিক ও সৃজনশীলতার পরিচয়ে সমৃদ্ধ। নতুন নতুন শব্দ, রূপক, প্রতীক, উপমার ব্যবহারে তিনি অদ্বিতীয়। কাজী নজরুল ইসলামের পর মুসলিম কবি হিসাবে ফররুখ আহমদই শ্রেষ্ঠ প্রতিভার দাবীদার। কবি ইসলামিক ভাবধারার অনুসারী হলেও তাঁর মতাদর্শ কখনই কবিসত্তাকে সংকীর্ণতায় আবদ্ধ করতে পারেনি। সেজন্যে তাঁর কবিতায় মানবমুক্তির বাণী সোচ্চার হয়। ১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষের পটে লেখা তাঁর বিখ্যাত ‘লাশ’ কবিতা আরো একবার চুয়াত্তরের বাংলাদেশে উচ্চারিত হয়।
পৃথিবী চষিছে কারা শোষণে, শাসনে
সাক্ষ্য তার রাজপথে জমিনের পর
সাড়ে তিন হাত হাড় রচিতেছে মানুষের অন্তিম কবর।
কবি ছিলেন একজন অনমনীয় ব্যক্তিত্ব এবং প্রখর আত্মমর্যাদাবোধের অধিকারি। সেই ব্যক্তিত্ব এবং আত্মমর্যাদা বোধকে অক্ষুণœ রাখার জন্য তাঁকে আমৃত্যু দুঃসহ দারিদ্র সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু কখনও কর্তৃত্বের দয়ার কাছে হাত পেতে নিজেকে খাটো করেননি। ১৯৫৮ সালে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গাত্মক কবিতা লিখে ক্ষমতার রোষানলে নিক্ষিপ্ত হন কবি। আবার ১৯৬৬ সালে দেশপ্রেমের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব দেয়া হলে কবি প্রত্যাখান করেন। কিন্তু কি আশ্চর্য, তাঁর এই মহৎ ত্যাগকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে কবিকে অপমান করা হয়।
চ।
ফররুখ আহমদের ও চল্লিশের দশকের শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’। শব্দ, ছন্দ, কাব্যভাষা ও বিষয়–সব মিলয়ে ‘সাত সাগরের মাঝি’ এমন একটি অসাধারণ গ্রন্থ, যা কেবল জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘অর্কেস্ট্রা’র সঙ্গে তুলনা করা যায়।
উত্তরাধিকারসূত্রে ইকবালের অনুপ্রেরণা তাঁর কাব্যে এসেছে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে। দিগন্তে সমুদ্রের ব্যাপ্তি, সিন্দাবাদের দুঃসাহসী অভিযাত্রার অনিশ্চয়তা, মানবমুক্তির আলোকিত বন্দরে পৌঁছানোর আকুলতা ও দৃঢ় সংকল্প কবির মাঝে কাজ করেছে জীবনাদর্শের প্রতি একনিষ্ঠ অঙ্গীকার থেকে। এই আদর্শবোধের তাগিদে তাঁর কাব্যে এমন একটা বলিষ্ঠতা উপস্থিতি, যা একমাত্র মহাকাব্যিক প্রকরণের সঙ্গেই তুলনীয়। ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যের অধিকাংশ কবিতা আদর্শিক ভাব, ঐতিহ্য ও জাতীয় জাগরণমূলক। ‘সিন্দবাদ’, ‘বার দরিয়ায়’, ‘দরিয়ায় শেষ রাত্রি’, ‘পাঞ্জেরী’ ও ‘সাত সাগরের মাঝি’ একাধারে ইসলামী ঐতিহ্য ও জাতীয় জাগরণমূলক, তেমনি সমুদ্র অভিযান বিষয়ক। এই অভিযাত্রার লক্ষ্য শাসনে-শোষণে নিপিড়িত গণমানুষের মুক্তির নিশান ওড়ানো।
এখানে এখন রাত্রি এসেছে নেমে,
তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ-তোরণ,
এখানে এখন প্রবল ক্ষুধায় মানুষ উঠছে কেঁপে,
এখানে এখন অজস্র ধারা উঠছে দু’চোখ ছেপে
তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজ-তোরণ।
ফররুখের কবিতায় সামদ্রিক চিত্রকল্প বাংলা কবিতায় সিন্দাবাদকে আবিষ্কার ও তার প্রতীকী ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়েছে। টেনিসনের ‘ইউলিসিস’-এর মতো ফররুখেরও কৃতিত্ব সামুদ্রিক অভিযাত্রার মাধ্যমে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো। এই মহাবিপদসঙ্কুল যাত্রা অতীত জীবনের রোমা কর অভিজ্ঞতা, সাফল্যগাথা, উত্তেজনা ও আবিষ্কারের পথে। অন্যদিকে ড্রামাটিক মনোলগ ফরম, জাগরণী বাণী, নতুন চিত্রকল্প ও প্রতীক নির্মাণ এবং রোমান্টিক ভঙ্গিতে কবি বাস্তব জগৎ অতিক্রম করে স্বপ্নের জগত সৃষ্টির প্রেরণায় উজ্জ্বল।
এই পথযাত্রার শক্তি সংগ্রহ করেছেন কবি আধুনিক শিল্পের অন্যতম সম্পদ ঐতিহ্য ও ইতিহাস থেকে। জীবন ও সমাজের সাথে একাত্ম হয়ে কবি ঐতিহ্যকে উপলব্ধি করেন। মানব মুক্তির লক্ষ্যে কবি সর্বমানবিক উপলব্ধির আলোকে ইতিহাস ও ভূগোলের সড়কে চলেছেন এবং অবশেষে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছেন হাজার রজনীর দুর্বিনীত সফর। তাই তাঁর কবিতায় অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একসঙ্গে কথা কয়ে উঠেছে। এলিয়টের ইতিহাস ও ঐতিহ্যচেতনার অনুপ্রেরণা কাজ করেছে কবির মাঝে।
ছ।
মানবমুক্তির পথে ফররুখ আহমদের আদর্শিক রূপকল্প ‘সিরাজাম মুনীরা’ (১৯৫২) কাব্যে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশিত। ‘সাত সাগরের মাঝি’তে কবির প্রবল রোমান্টিকতা দৃশ্যমান, ‘সিরাজাম মুনীরা’তে আদর্শিকতার জয়গান রণিত। মহাকবি ইকবালকে ‘সাত সাগরের মাঝি’ উৎসর্গ করা যেমন, মওলানা আবদুল খালেককে ‘সিরাজাম মুনীরা’ উৎসর্গ করাও তেমন তাৎপর্যপূর্ণ। ‘সাত সাগরের মাঝি’তে যা ছিলো রূপক ও প্রতীক আশ্রয়ী; যেন তারই বাস্তব ভিত্তিভূমি রচিত হলো ‘সিরাজুম মুনীরা’য়। মূলত ‘সিরাজাম মুনীরা’ কাব্য ‘সাত সাগরের মাঝি’র পরিপূরক; কবিভাবনার সঠিক উত্তরণ, যথার্থ ও সুস্পষ্ট পরিণতি বলে অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ‘সাত সাগরের মাঝি’র যাত্রা ঐতিহ্যের পথে; ‘সিরাজাম মুনীরা’র আবেদন ইতিহাস থেকে আহরিত জীবনাদর্শের মাধ্যমে; উভয় কাব্যের অভিপ্রায় একই: গণমানুষের মুক্তি।
মানবমুক্তি পণ নিয়ে তুমি ওঠো দুর্গম শিলা শিখরে,
প্রতি পাথরের প্রাকার পারাতে আহত তোমার রুধির ঝরে,
হে বীর! সেখানে পাথরের মত অটল তোমার পদক্ষেপ,
শিলা পার হয়ে পীড়িতের বুকে ঝর্ণাধারার দাও প্রলেপ।
মহানবী স. ও খোলাফায়ে রাশেদীন এবং যুগে যুগে যে সকল ইসলামী সাধকের জন্ম হয়েছে, তাঁরা কেবল কোন একটি বিশেষ কাল বা অ লের জন্যই নয়, দেশ-কাল-পরিবেশ নির্বিশেষে সকল মানুষ, বিশেষত সকল মুসলমানের চিরসম্মানিত ও পরশ শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। মুসলমানদের প্রাত্যহিক কর্ম, চিন্তা-চেতনা ও সামাজিক আচার ও অনুষ্ঠানে তাঁদের অমলিন জীবনধারা অনুপ্রেরণা যোগায়। ‘সিরাজাম মুনীরা’ কাব্য মহৎ জীবনাদর্শের সর্বজনীন আবেদনের সাথে সাথে কাব্যশিল্প হয়ে উঠেছে। কবি দূর অতীতের রোমান্টিক জগৎ থেকে বাস্তবের জীবন ও জগতে প্রবেশ করেছেন; যখন স্বদেশে আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন প্রক্রিয়াধীন।
জ।
আপাদমস্তক রোমান্টিক ফররুখ আহমদ পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি এসে ক্রমশ ধ্রুপদী সাহিত্যের প্রতি অত্যন্ত অনুরাগী হয়ে ওঠেন। তখন তাঁর প্রিয় কবি মিলটন, মধুসূদন ও এলিয়ট। মহাকাব্যিক আয়তনের কাব্য লিখবেন বলে ‘হাতেম তা’য়ী’ (১৯৬৬) সৃষ্টি করেন। কবি আবারো ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে নায়ক হিসেবে নির্বাচন করেন হাতেম তা’য়ীকে। এলিয়টের কাব্যনাটকের দিকে এ-সময় কবি গভীরভাবে ঝুঁকে পড়েন। ‘নৌফেল ও হাতেম’ (১৯৬১) তারই উজ্জ্বল উদাহরণ। ক্লাসিকতার দিকে এই ঝোঁক থেকে ফররুখ লেখেন তাঁর উত্তরকালীন সনেটগ্রন্থ ‘মুহূর্তের কবিতা’ (১৯৬৩), কাব্যনাট্য ‘নৌফেল ও হাতেম’, মহাকাব্য ‘হাতেম তা’য়ী’। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতোই ফররুখ এক আঙ্গিক থেকে ফিরেছেন অন্য প্রকরণে– গীতিকবিতায়, সনেটে, কাব্যনাট্যে, মহাকাব্যে। ফররুখের কবিতায় গীতলতার সঙ্গে ছিলো প্রবল নাটকীয়তা, এই নাট্য-স্বভাবের কারণে ফররুখ লিখেছিলেন তাঁর কাব্যনাট্য ‘নৌফেল ও হাতেম’। এমনকি মাইকেলের মতো প্রহসনও লিখেছেন কবি– ‘রাজ রাজড়া’। হাতেমের অভিযাত্রিক ও মানবতাবাদী চরিত্র কল্যাণব্রতী ফররুখকে আকর্ষণ করেছে প্রবলভাবে। কাব্যনাট্যে ফররুখকে মনে হয় অনেকখানি এলিয়টীয় ভঙ্গিতে প্রকাশিত।
ফররুখ আহমদের একমত্র পূর্ণাঙ্গ কাব্যনাট্য ‘নৌফেল ও হাতেম’। এই কাব্যনাট্য কবির একটি দুঃসাহসিক সৃজনকর্ম। এই নাটকের কাহিনী ও চরিত্র পরিকল্পনায় কবি পুঁথি সাহিত্যের আশ্রয় নিয়েছেন। প্রাক-ইসলামী যুগের ইয়েমেনের শাহজাদা হাতেম তা’য়ী মানবসেবা ও পরোপকারিতায় এক কিংবদন্তিতুল্য অসাধারণ ব্যক্তি ছিলেন। প্রেম, সেবা ও শাশ্বত সত্যের অনিবার্য প্রতীক এই মহান ব্যক্তি পুঁথিসাহিত্যের নায়ক হিসাবে যেমন জনপ্রিয় ছিলেন, ফররুখ আহমদের মনোরাজ্যেও তেমনি তিনি ছিলেন একান্ত কাক্সিক্ষত স্বপ্নের পুরুষ। এই নায়কের জীবনাদর্শের কাব্যরূপ সৃজনেরর মাধ্যমে কবি বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
কবি ও সমালোচক আবদুল কাদির ‘হাতেম তায়ী’কে ফররুখ আহমদের ‘সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘মহাকাব্য’ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সমুদ্রের সাত সফরের নায়ক সিন্দাবাদ ফররুখ আহমদের প্রথম কাব্যজীবনের নায়ক আর সাত সওয়ালের উত্তরদাতা হাতেম তা’য়ী তাঁর শেষ কাব্যনায়ক। এই দুই নায়কই অভিযাত্রিক। এই দুই নায়কের অভিযাত্রার মূল অন্বিষ্ট ছিলো জনগণের মুক্তি। ‘হাতেম তা’য়ী’ কাব্যগ্রন্থের শেষে আছে হাতেম তা’য়ীর অসাধারণ মোনাজাত। এই প্রার্থনা মানবিকতার বোধে উজ্জীবিত, যা প্রকৃতপক্ষে ফররুখ আহমদের ‘হাতেম তা’য়ী’ কাব্যগ্রন্থেরই শুধু নয়, সমগ্র কবিতার মর্মকথা:
মুক্তি পায় যেন সে আউলাদ
সকল বিভ্রান্তি, পাপ, অত্যাচার, অবিচার থেকে।
বহু খণ্ডে বিখণ্ডিত মানুষের বিচ্ছিন্ন সমাজে
সকল বিভেদ মুছে করে যেন শান্তির আবাদ
সকল বিশ্বাসী প্রাণ–ইনসানে কামিল। আর যারা
পড়ে আছে লুণ্ঠিত ধূলায়, নির্যাতিত সেইসব
মজ্লুমান পায় যেন বাঁচার অকুণ্ঠ অধিকার;
সব মানুষের সাথে জীবনের পূর্ণতার পথে
চলে যেন সে মিছিল কেবলি সম্মুখে।
মানবতার উদ্বোধনী যে-সুর ‘লাশ’, ‘পাঞ্জেরী’ কবিতায় শোনা যায় প্রথম কাব্যগ্রন্থে, সেই সুর আবারও বেজে ওঠে মহাকাব্যে। প্রথমে অভিযাত্রিক সিন্দাবাদ, শেষে কল্যাণব্রতী হাতেম তা’য়ীর প্রতীকে এবং মাঝখানে মুহাম্মদ স.-এর জীবনাদর্শের রূপকল্পে কবি আরাধ্য মানবমুক্তির পথকে কাব্যরূপ দিয়েছেন। নিছক শিল্পের জন্য শিল্প, আনন্দ-বিনোদনের জন্য কাব্যনির্মাণের বিপক্ষে কবির অবস্থানের কারণে মহৎ জীবনাদর্শের প্রতি কবির কমিটমেন্ট এতো জোরালো। ফলে কবির সমস্ত কবিতার কেন্দ্রে মানবমুক্তির শিখা প্রজ্জ্বলিত।
ঝ।
রচনাকালের দিক থেকে ‘হে বন্য স্বপ্নেরা’ (১৯৩৬-৫০) ফররুখ আহমদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। বাম রাজনীতির সাথে সংযুক্তিকালীন লেখা এই বইয়ে কবির তারুণ্য ও নাগরিকতার পাশাপাশি মানবিকতাবাদের অঙ্কুরোদগম ঘটে। আবার অত্যন্ত মূল্যবান কাব্য ‘মুহূর্তের কবিতা’য় কবি মাতৃভূমির প্রাকৃতিক ভূগোলে সন্দীপ্ত হয়ে স্বদেশের মানুষের মঙ্গলবোধে উজ্জীবিত। অন্যদিকে শিশুসাহিত্যের বিশাল জগতের কেন্দ্রে আছে কবির মুক্তি আকাক্সক্ষা। কবি অজস্র ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছেন দুই হাতে, স্বনামে ও অজস্র ছদ্মনামে, এর মূলে আছে শাসকশ্রেণির শোষণের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত ক্রোধ ও প্রতিবাদ। আদর্শবাদীর উজ্জ্বল ক্রোধ। আদর্শবাদ কবিতার ক্ষতিও করে– আবার আদর্শ ছাড়া মহৎ কবিতাও সম্ভব নয়। এটা এক আশ্চর্য কূটাভাসিক প্রক্রিয়া। এই আদর্শবাদের কারণেই কবি চল্লিশের দশকের চারিত্র অনুযায়ী অ-ব্যক্তিক মানবিকতায় সঞ্জীবিত।
ঞ।
ফররুখ আহমদের কবিতা নিয়ে অগ্রজ, সমকালীন ও অনুজ সাহিত্যিকবৃন্দ সপ্রশংসিত ও যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন*। কিন্তু পরবর্তীকালে, বিশেষভাবে আশির দশকে কয়েকটি বিতর্ক সৃষ্টি করে কিছু ভুঁইফোড় উগ্র বাম মৌলবাদী সমালোচক; যখন বাংলাদেশে আদর্শবাদী রাজনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটে। বিতর্কগুলি তথ্যনির্ভর ও যুক্তিযুক্ত তো নয়ই, বরং বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যমূলক। যেমন:
১. ফররুখ আহমদের কবিতায় অঙ্কিত প্রাকৃতিক ভূগোল বাংলার নয়, ইরান-তুরানের, তথা মধ্যপ্রাচ্যের। এই অভিযোগের জবাবে বলা যায়: অভিযোগকারিরা ফররুখ আহমদের ‘মুহূর্তের কবিতা’ ও শিশুসাহিত্যের পাঠ নেয়নি। এই দুই কাব্যজগতে প্রকাশিত বাংলাদেশের জীবন্ত প্রকৃতির চিত্ররূপগন্ধময় স্পর্শ নিলে এই অভিযোগ আর ওঠে না। তাছাড়া কবিতার প্রয়োজনে কবি বিশ্বজগতের সবখানে দরকারি উপাদান সংগ্রহে ভ্রামণিক ও সংগ্রাহক হবেন, এটাই কবিতার স্বধর্ম।
২. ফররুখ আহমদের কবিতা পাকিস্তান আন্দোলন ও ইসলামী আদর্শের অনুসারী। কে না জানে পাকিস্তান আন্দোলন এ-দেশের আপামর জনসাধারণের প্রাণের আন্দোলন। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক, শেখ মুজিবর রহমানসহ সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা এই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। আবার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর স্বপ্নভঙ্গের ক্রোধে কবি প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। আর ইসলামী আদর্শ তো এ দেশের মানুষের লালিত ও পালিত জীবনাদর্শ। সে দিক থেকে বলা যায়, ফররুখ আহমদ এ-দেশের গণমানুষের মুক্তির কবি।
৩. ফররুখ আহমদ অপ্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার এবং মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যের যথেচ্ছ অপপ্রয়োগ করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারে যে সাফল্য দেখিয়েছেন, ফররুখ আহমদ সেই ধারাকেই এগিয়ে নিয়েছেন। বাংলার গ্রামগঞ্জে প্রচলিত ও পুঁথিসাহিত্যবাহিত আরবি-ফারসি শব্দাবলি কবি প্রয়োগ করে জনসমাজকেই প্রতিনিধিত্ব করেন। অন্যদিকে হাতেম তা’য়ীর গল্প এবং আরব্যোপন্যাসের কাহিনী লোকসংস্কৃতির অংশ, বিশ্বজনীন ও বিশ্বব্যাপী সমাদৃত, বাংলার জনসমাজেও সমানভাবে চর্চিত। কাব্যের প্রয়োজনে কবি বিশ্বঐতিহ্য মন্থন করবেন, এটাই স্বাভাবিক। যেসব কবি অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দ, রামায়ণ-মহাভারত আর গ্রিক পুরাণ বাংলা কাব্যে ব্যবহার করেন, তাদের সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকার মধ্যেই কুতর্কের মাজেজা নিহিত।
৪. আধুনিকতার বিচারে, বিশেষভাবে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার অভাবে ফররুখ আহমদকে ‘আধুনিক কবি’ হিসেবে স্বীকারে অনেকেই দ্বিধাসংশয়গ্রস্ত। রবীন্দ্রনাথের মতে, যা চিরকালীন ও শাশ্বত, তা-ই আধুনিক। সেই দিক বিবেচনা করলে বলতে হয় ফররুখের কবিতা চিরকালীন মানবিকতায় উজ্জীবিত ও শিল্পিত। অতএব ফররুখ নিঃসন্দেহে আধুনিক কবি।
ট।
মৃত্যুর একচল্লিশ বছর পরও ফররুখ আহমদ বাংলা কাব্যে প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন আপন কাব্যশক্তি, মৌলিকতা, ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধতার জন্য। কবির এই দায় জীবনাদর্শ ও কাব্যাদর্শের সার্থক সম্মিলনে মানবমুক্তির অঙ্গীকারে উজ্জীবিত। সমস্ত কবিপ্রতিভা ও সৃজনীশক্তি কবি ব্যয় করেন নবজাগরণের গান গেয়ে, গণমুক্তির লক্ষ্যে। সমকালীন অজগর অন্ধকার যখন জীবনের সবকিছু গ্রাস করে নিয়েছে, তখন আবার প্রয়োজন ফররুখের মতো আদর্শবাদী কালজয়ী প্রতিভার। মানবতাবাদী এই কবির কণ্ঠে তাই এখনো ধ্বনি-প্রতিধ্বনি শোনা যায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো: তবে তুমি পাল খোলো, তবে নোঙ্গর তোলো;/ এবার অনেক পথশেষে সন্ধানী!/ হেরার তোরণ মিলবে সম্মুখে জানি।/ তবে নোঙ্গর তোলো;/ তবে তুমি পাল খোলো,/ তবে তুমি পাল খোলো
তথ্যসূত্র:
আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত: ফররুখ রচনাবলী ১ ও ২ : বাংলা একাডেমী, ১৯৭৯।
সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় : কবি ফররুখ আহমদ: নওরোজ কিতাবিস্তান, ১৯৬৯।
আবদুল মান্নান সৈয়দ: ফররুখ আহমদ: জীবন ও সাহিত্য: বাংলা একাডেমী, ২০০২।
মুহম্মদ মতিউর রহমান: ফররুখ প্রতিভা : হেরা পাবলিকেশন্স, ২০০৮।
শাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত: ফররুখ আহমদ: ব্যক্তি ও কবি : ইফা, ১৯৮৮।
সদরুদ্দিন আহমেদ: ফররুখের নির্বাচিত কবিতার নিগূঢ়পাঠ : আখতারা প্রকাশনী, ২০০৬।
মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ: বাংলা কাব্যে ফররুখ আহমদ : তাঁর শক্তি ও স্বাতন্ত্র্যের স্বরূপ : ফররুখ একাডেমী, ২০০৩ ।
শাহাবুদ্দীন আহমদ: কবি ফররুখ আহমদ: তাঁর মানস ও মনীষা: বাংলা সাহিত্য পরিষদ, ১৯৯৪।
- ফররুখ আহমদ জীবৎকালে চরটি পুরস্কার পেয়েছেন: প্রেসিডেন্ট পুরস্কার, প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬০), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬০), ‘‘হাতেম তা’য়ী’’ গ্রন্থের জন্য আদমজী পুরস্কার (১৯৬৬), ‘পাখির বাসা’ গ্রন্থের জন্য ইউনেস্ক পুরস্কার (১৯৬৬)। প্রাইড অব পারফরমেন্স পাওয়ার পর ১৯৬১ সালে ঢাকার সাাহিত্যিক ও শিল্পী-সংস্কৃতিসেবীরা ফররুখ আহমদের সম্মানে একটি সংবর্ধনার আয়োজন করেন। মুহম্মদ আবদুল হাই-এর সভাপতিত্বে ঢাকা হলে অনুষ্ঠিত এই সংবর্ধনায় ফররুখ আহমদের সাহিত্যকৃতি নিয়ে আলোচনা করেন কবি সৈয়দ আলী আহসান, নাট্যকার মুনীর চৌধুরী, কবি আহসান হাবীব, কবি আবুল হোসেন, সামসুল হুদা চৌধুরী প্রমুখ। ফররুখ আহমদের কবিতা আবৃত্তি করেন শামসুর রাহমান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, বদরুল হাসান, সালমা চৌধুরী, শবনব মুস্তারী প্রমুখ। আবদুল আহাদ পরিচালিত ও ফররুখ-রচিত সংগীত-বিচিত্রায় অংশ নেন আবদুল লতিফ, ফরিদা ইয়াসমিন, আফসারী খানম, বিলকিস নাসিরুদ্দিন, রওশন আরা বেগম, ফজলে নিজামী প্রমুখ। অনুষ্ঠানে ফুলের তোড়া ও মানপত্র উপহার দেয়া হয়। মানপত্র পাঠ করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
কবি ফররুখ আহমদকে জানতে পাঠ করুন:
কবিতা :
সাত সাগরের মাঝি, ২. সিরাজাম মুনীরা, ৩. মুহূর্তের কবিতা, ৪. কাফেলা, ৫. হে বন্য স্বপ্নেরা,
দিলরুবা, ৭. হাবেদা মরুর কাহিনী, ৮. নির্বাচিত কবিতা।
মহাকাব্য :
হাতেম তা’য়ী
কাব্যনাটক :
নৌফেল ও হাতেম
ব্যঙ্গ কবিতা :
১. অনস্বার, ২. বিসর্গ, ৩. ঐতিহাসিক-অনৈতিহাসিক কাব্য, ৪. হাল্কা লেখা, ৫. তসবির নামা, ৬. রস রঙ্গ, ৭. ধোলাই কাব্য।
গান :
১. রক্ত গোলাব, ২. মাহফিল (হামদ ও নাত) , ৩. কাব্য-গীতি
নাটক :
রাজ-রাজাড়া
শিশুসাহিত্য :
১. পাখির বাসা, ২. হরফের ছড়া, ৩. নতুন লেখা, ৪. ছড়ার আসর, ৫. ফুলের জলসা, ৬. চিড়িয়াখানা, ৭. কিস্সা কাহিনী, ৮. আলোক লতা।
গল্প :
ফররুখ আহমদের গল্প
[ কবি ফররুখ আহমদ এর ৯৭ তম জন্মদিন উপলক্ষে ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় লেখক ফোরাম’ আয়োজিত সেমিনারে পঠিত ]