কাজী জহিরুল ইসলাম
প্রথমে ভেবেছিলাম সুলতান ও তার শিল্পকর্ম নিয়ে লিখতে বসার আগে তাকে নিয়ে অতীতে যেসব লেখালেখি হয়েছে সেগুলো পড়ে নিয়ে বসব। পরে এই চিন্তাটি বাদ দিয়েছি। বাদ দিয়েছি এজন্য যে আমার মত একজন শিল্পমূর্খ অতি দ্রুত বিজ্ঞজনদের মতামত দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়তে পারে। তার চেয়ে বরং আমি লিখি আমার মত করে। না হয় আমার লেখাটি শিল্পমূর্খের দৃষ্টিতে শিল্পের এক অদ্ভুত প্রতিচ্ছবিই হল। হয়ত এই লেখাটি শিল্পের কোনো কাজেই লাগবে না কিন্তু একজন মূর্খের দৃষ্টিতে সুলতানের শিল্পকর্ম কীভাবে উঠে আসে তা জানার আগ্রহ কারো কারো হতেও তো পারে।
আমার ক’জন শিল্পী বন্ধু আছেন যাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সখ্য গড়ে উঠেছে। তাদের কারো কারো সঙ্গে দিনের পর দিন, ঘন্টার পর ঘন্টা আর্ট নিয়ে কথা বলেছি। তাদের একজন শিল্পী কাজী রকিব। রকিব ভাই প্রায়শই আমাকে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প-শিক্ষা নেই এমন মানুষ যখন ছবি আঁকেন তখন আমি অধিক আগ্রহ নিয়ে সেইসব ছবি দেখি। আমি দেখতে চাই তাদের শৃঙ্খলমুক্ত রঙ ও রেখা ক্যানভাসে কী ধরনের তরঙ্গ তোলে। প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান কল্পনার স্বাধীনতাকে নিয়মের শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলে, বৈচিত্রের অন্তহীন সম্ভাবনা সীমিত হয়ে পড়ে।
রকিব ভাইয়ের এই উৎসাহ আমাকে সবসময় সাহস যোগায়। সেই সাহসের ওপর ভর করেই আজ সুলতানের মত একজন বড়ো শিল্পীর কাজ নিয়ে লিখতে বসেছি। সুলতানের আঁকা সকল ছবি দেখে নিতে পারলে ভালো হত কিন্তু সেই সুযোগ আমার নেই। অনলাইনে ঘাঁটাঘাঁটি করে যতটুকু পারা যায় দেখেছি। আমি যতবার সুলতানের আঁকা ছবি দেখেছি তার চেয়ে বেশি তার নিজের মুখাবয়বের ছবি বা প্রতিকৃতি দেখেছি। আমার কেবলই মনে হয়েছে তিনি নিজেই ঈশ্বরের আঁকা এক মহৎ শিল্পকর্ম। ঈশ্বর নিজেই এক অসাধারণ পোর্ট্রেট এঁকে তাতে প্রাণ সঞ্চার করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন এবার তুমি ঋণ শোধ করো, আঁকো তোমার দৃষ্টির আলো।
নানান ধর্মে ঈশ্বরের অনেকগুলো গুণবাচক নাম আছে, শিল্পী নামটি আছে কিনা আমার জানা নেই। আমার মনে হয় ঈশ্বরের সবচেয়ে প্রধান গুণবাচক নাম হওয়া উচিত ছিল শিল্পী। সেই নামের প্রতিভূ যারা এই পৃথিবীতে বিচরণ করেছেন, করছেন এবং ভবিষ্যতে করবেন তাদেরই একজন শেখ মোহাম্মদ সুলতান। খুব কম বয়সেই সুলতান তার প্রতি অর্পিত দায়িত্বটি টের পেয়েছেন।
নড়াইলের পুত্র সুলতানকে মাঝে মাঝে মনে হয় লালনের উত্তরসূরী। লালন যেমন মানবদেহের অবয়বের মধ্যে প্রকৃতি, বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম ও শান্তি খুঁজেছেন উচ্চারিত গানের বাণী, সুর ও ছন্দের ভেতর দিয়ে, সুলতানও রঙ ও তুলির আঁচড়ে, কখনো বা শ্রেফ পেন্সিল বা কয়লা ঘষে ঘষে, শূন্যতার গভীর থেকে তুলে এনেছেন অবয়ব এবং অবয়বের ভেতরেই নির্মাণ করেছেন দেশ, সমাজ, দ্বন্দ্ব, মিলন, প্রকৃতি, নিমগ্নতা।
সুলতানের ছবির দিকে তাকালেই মনে হয় এ শুধু ছবি নয়, আমি পাঠ করছি একের পর এক রঙের কবিতা। একটি কবিতা থেকে আমরা শব্দ, ছন্দ, বিষয়, বক্তব্য অনায়াশেই খুঁজে বের করতে পারি, কাউকে তা আঙুল দিয়ে দেখিয়েও দিতে পারি, যা দেখাতে পারি না কিন্তু উপলব্ধি করতে পারি তা হচ্ছে প্রাণ। সুলতানের ছবির সর্বত্র সেই কাব্যিক প্রাণ উপস্থিত।
নড়াইল জেলার মাসিমদিয়া গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক-পরিবারে ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট তার জন্ম। পিতা শেখ মেসের আলী কৃষিকাজ ছাড়াও বাড়তি আয়ের জন্য রাজমিস্ত্রীর কাজ করতেন। ছেলেকে পড়াবার তেমন সামর্থ্য ছিল না। ৫ বছর ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে পড়েই তাকে বাবার সঙ্গে যোগালীর কাজ শুরু করতে হয়। কিশোর লাল মিয়া হয়ত কোনো বাড়ির একটি সাদামাটা দেয়াল নির্মাণে পিতাকে সাহায্য করছিলেন, এগিয়ে দিচ্ছিলেন ইট, সিমেন্ট-বালুর সঙ্গে পরিমান মত জল মিশিয়ে তৈরি করছিলেন গাঁথুনি দেবার মশলা কিন্তু প্রকৃতি ঠিক এই সময়টাতেই তার বোধের ভেতরে নির্মাণ করছিল রঙের ইমারত। লাল মিয়া ক্রমশ হয়ে উঠছিল সুলতান। অতিসভ্য এক আর্ট ক্লাসের চৌহদ্দির ভেতরে নয়, সুলতান তৈরি হচ্ছিল খোলা আকাশের নিচে একজন গতরখাটা মানুষ হিসেবে, কৃষি-জমিতে ঢেউয়ের মতো ছুটে চলা লাঙলের রূপালি ফলায়, রোদেলা মাঠে, হেমন্তের বাতাসে দুলতে থাকা সোনালি ধানের শীষে। আর এ-কারণেই সুলতানের ছবিতে সভ্যতার রূপকার হিসেবে উদ্ভাসিত হয় পেশিবহুল কৃষক। সুলতান কী এঁকেছেন? তিনি এঁকেছেন বাংলার গ্রাম, কৃষি, গতরখাটা মানুষের জীবন ও অর্থনীতি। তার অঙ্কিত প্রতিটি আঁচড় উঠে এসেছে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। কৃষকের জীবন, শ্রমিকের জীবন, তাদের অভিব্যক্তি তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলবার জন্য সুলতানকে কারো কাছ থেকে অভিজ্ঞতা ধার করতে হয়নি। ছুটি নিয়ে গ্রামে যেতে হয়নি দেখার জন্য লাঙলের ফলা কতখানি গভীরে ঢুকে স্পর্শ করে মাটির প্রাণ। সুলতানের ছবিতে প্রাণ আছে, নির্লিপ্ততা আছে, আবার আগুনও আছে। যেমন আগুন ছিল নজরুলের কবিতায়। আগুনে পুড়তে পুড়তে বেড়ে ওঠে যে জীবন সেই জীবনের একটি ভাষ্য তার ছবিতে উজ্জ্বল। সুলতানের ছবিতে যে বলিষ্ঠ কৃষক দেখা যায়, কৃষকের সারা দেহে যে পেশী দেখা যায় তা হচ্ছে দ্রোহ। কৃষক শ্রেষ্ঠ, কৃষকই সভ্যতার স্রষ্টা এই বোধ তিনি নাগরিক মানুষের চিন্তার ভেতরে দ্রোহের ভাষায় ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছেন। তার কিষানীরা হৃষ্টপুষ্ট, ভরাট বুক ও চওড়া নিতম্বের অধিকারী। তাদের বাহুতে বাজু, পায়ে খাড়ু, যা প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধির প্রতিনিধিত্ব করে।
ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল পরিদর্শনে আসেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মূখার্জী। তার স্কেচ এঁকেই শিশু সুলতান শিল্পী সত্ত্বার জানান দেন। মাত্র অষ্টম শ্রেণির বিদ্যা নিয়েই কোলকাতা আর্ট স্কুলে পড়তে যান। ভর্তি পরীক্ষায় প্রথমও হন কিন্তু কম বয়স এবং প্রবেশিকা সনদ না থাকায় তৈরি হয় জটিলতা। তৎকালীন প্রখ্যাত শিল্প-সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর হস্তক্ষেপে শেষমেশ তিনি ভর্তি হবার সুযোগ পান। কিন্তু প্রকৃতি যাকে নিজ হাতে গড়বে বলে ঠিক করে রেখেছে, আর্ট কলেজের নিয়ম তাকে বাঁধে কোন শৃঙ্খলে। তৃতীয় বর্ষে উঠেই সুলতান আর্ট কলেজ ছেড়ে দেন। শুরু হয় বোহেমিয়ান জীবন। দেশে দেশে ঘোরেন আর ইচ্ছে মত ছবি আঁকেন। চারদিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দাবানল। এর ভেতরেই চলছে তার এক ভূখণ্ড থেকে অন্য ভূখণ্ডে ছুটে চলা। ছবি আঁকেন, সেইসব ছবি বেঁচে দেন সৈনিকদের কাছে। এ-দিয়েই চলে তার ক্ষুৎপিপাসার সামান্য আয়োজন। কাশ্মীরের শ্রীনগরে কিছুকালের জন্য থিতু হন। সুন্দরের পূজারী যে শিল্পী, শ্রীনগরের নয়নাভিরাম পাহাড়ি ভেলি, ঝকঝকে নীল আকাশ, স্বচ্ছ জলপ্রপাত কি তাকে ডেকে বলবে না “তিষ্ঠ ক্ষণকাল”?
৪৭-এর আগস্টে দেশ ভাগ হয়ে গেল। তিনি ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে। সঙ্গে করে কিছুই আনতে পারেননি। শ্রীনগরে আঁকা কাজ সব শ্রীনগরেই রয়ে গেল। এভাবে নিখিল ভারতের পথে পথে তিনি রোপণ করেছেন তার শিল্পবৃক্ষ। রোপণ যার আশৈশব নেশা তার শ্রেষ্ঠ ছবির নাম ” প্রথম বৃক্ষরোপণ” খুবই স্বাভাবিক। দেশভাগের আগের বছর ১৯৪৬ সালে সিমলায় তার প্রথম প্রদর্শনী হয়। ২২/২৩ বছরের এক অখ্যাত তরুণের প্রদর্শনী। কিন্তু এই প্রদর্শনী তার নামের সঙ্গে শিল্পীর মর্যাদা পাকাপোক্ত করে ফেলে। তার ছবিতে এমন এক জাদুর ছোঁয়া আছে যা দেখামাত্রই বোদ্ধা/মূর্খ সকলেই একবাক্যে মেনে নিত, এইত আমাদের শিল্পী। সুলতান যেন সকলের অন্তরে লালন করা ছবিটিই ভাসিয়ে তুলতেন ক্যানভাসে।
দেশভাগের পর কিছুদিন পূর্বপাকিস্তানে থেকে তিনি চলে যান করাচীতে। ১৯৫০ সালে পাকিস্তান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি আমেরিকার নিউইয়র্ক, শিকাগো, বোস্টন এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে বেশ কিছু প্রদর্শনী করার সুযোগ পান। এ-সময়ে তিনি জাতিসংঘেও এসেছিলেন। এ-খবরটি জানার পরে আমি জাতিসংঘের আর্কাইভ বিভাগে যোগাযোগ করি এবং কোনো ছবি বা বক্তব্য পাওয়া যায় কিনা সেই চেষ্টা করি কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় কিছুই খুঁজে পাওয়া গেল না। আমি অনুমান করছি হয়ত জাতিসংঘে তার আগমন ব্যক্তিগত ভিজিট বা পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধির মাধ্যমে ঘটেছিল, সচিবালয়ের আমন্ত্রণে বা সচিবালয় কর্তৃক আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানে নয়। নিউইয়র্কে যে কয়দিন ছিলেন সেই সময়ে তিনি সেভেন ট্রেনে চড়ে ইস্ট রিভারের নিচ দিয়ে ম্যানহাটন থেকে কুইন্সে গিয়েছেন, সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি বিশ্বখ্যাত ফটোশিল্পী নাসির আলো মামুনের কাছে। তিনি আরো বলেছেন, জানালার পাশে একটি কয়েন রেখে দেখেছি সেটি কাঁপতে কাঁপতে পড়ে যায়নি। কোনো ধরনের কম্পন ছাড়া, রেলগাড়ি ঝমাঝম টাইপের শব্দ ছাড়া, কী করে এতো মসৃণ গতিতে ছুটে চলে রেলগাড়ি তা দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন।
নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহন শেষ না করলেও উত্তর প্রজন্মকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানের প্রতি তার আগ্রহ ছিল ব্যাপক। কৈলাশটিলা জমিদার বাড়ির পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি পরিস্কার করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নন্দনকানন প্রাইমারি স্কুল এবং নন্দনকানন ফাইন আর্টস স্কুল। তিনি নড়াইলে শিশুস্বর্গ এবং যশোরে চারুপীঠ প্রতিষ্ঠা করেন। শিশু এবং অবুঝ বন্য প্রাণীদের প্রতি ছিল তার গভীর মায়া। তিনি একটি চিড়িয়াখানাও গড়ে তোলেন। সুন্দরী কাঠ দিয়ে নিজেই শিশুদের জন্য একটি বড়ো নৌকা তৈরি করেন। তিনি চাইতেন সেই নৌকায় চড়ে শিশুরা নৌভ্রমণ করবে। নদীর সঙ্গে শিশুদের যোগাযোগ ঘটবে, আশপাশের প্রকৃতি দেখবে, খোলা আকাশ দেখবে। মনের ভেতরে শিশুরা ধারণ করবে আকাশের ঔদার্য্য।
প্রচলিত শিক্ষাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আর্ট কলেজ ছেড়েছেন এবং ছবি আঁকার ক্ষেত্রেও তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো নিয়ম কানুন মেনে চলতেন না। ঢাকার চারুকলা ইন্সটিটিউটের সাবেক ডিন, শিল্পী মতলুব আলী আমাকে একবার বলেন, বড়ো বড়ো ক্যানভাসে ছবি আঁকতেন। কি-যে আঁকছেন প্রথমে কিছুই বোঝা যেত না। হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কি যেন আঁকছেন। কিছুক্ষণ পরে এখানে ওখানে কিছু ঘাস গজিয়ে উঠলো। এরপর দেখি সেই ঘাসের মধ্যে বিশাল এক পা, এরপর এক বলিষ্ঠ কৃষক। আর ওই যে শুরুতে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কী যেন আঁকছিলেন, সেগুলো ঘাসের মাঠে ফুটে উঠলো এক একটা উজ্জ্বল ফুল হয়ে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এ যেন ছবি আঁকা নয়, প্রকৃতির মধ্যে ঘাস গজাচ্ছে, ফুল ফুটছে, এবং এর মধ্যে কোত্থেকে এসে দাঁড়াল এক বলিষ্ঠ কৃষক। অদ্ভুত ব্যাপার। সব যেন জীবন্ত।
১৯৭৯ সালের কথা। সারা দেশে শুরু হয়েছে ভ্রাম্যমান শিল্প-প্রদর্শনী। আয়োজন বিস্তৃত হয়েছে পদ্মাপাড়ের রাজশাহীতে। ওখানকার আয়োজক রাজশাহী আর্ট কলেজ। শিল্পী এস এম সুলতান সেই আয়োজনের উদ্বোধক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এক অসাধারণ ভাষণ দেন। তিনি বলেন, আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন দেশ স্বাধীন হয়েছে কিছুকাল আগে, এখন দেশ গড়ার কাজে মন দেওয়া দরকার। কৃষি উৎপাদন বাড়ানো দরকার , শিল্প উৎপাদন বাড়ানো দরকার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা দরকার। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মত মৌলিক চাহিদা মেটানোর কাজে মনোযোগ দেওয়া দরকার। এই সময়ে শিল্পের কি দরকার? এই চিন্তা খুবই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু আমরা দেশ গড়ার কাজ করতে করতে যখন ক্লান্ত হয়ে যাবো তখন আমাদের একটু বিশ্রাম নেবার দরকার হবে। সেই বিশ্রামের জায়গাটাই হচ্ছে শিল্প। শিল্প আমাদের মনের শক্তি যোগাবে, আমরা চাঙ্গা হয়ে পুনরায় দেশ গড়ার কাজে মন দিতে পারব। রাজশাহী আর্ট কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক শিল্পী কাজী রকিব সেই অনুষ্ঠানের একজন মূল আয়োজক ছিলেন, পাশে দাঁড়িয়ে সুলতানের এই অসাধারণ বক্তৃতা তিনি শোনেন।
রকিব ভাই আমাকে আরো একটি ঘটনা বলেন, যা থেকে শিল্পী এস এম সুলতানের সামাজিক দায়বদ্ধতার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। একটি রাস্তা ভেঙে পড়েছে নালার ভেতর, তার ওপরে নির্মিত বাশের সাঁকোটিও ভাঙা। এস এম সুলতান আর্ট কলেজের শিক্ষকদের বলেন, আসেন আমরা সাঁকোটি মেরামত করি। তিনি সবাইকে নিয়ে নালার পানিতে নেমে পড়েন সাঁকো মেরামত করতে। নালাটি যে লোকের জমিতে তিনি একজন ধনী ব্যক্তি, কাজটি তিনিই লোক দিয়ে করাতে পারতেন। দায়িত্বহীনতার কারণে তিনি তা করাচ্ছেন না। কিন্তু শিল্পীদের এভাবে পানিতে নেমে যেতে দেখে তিনি ছুটে আসেন এবং তাদেরকে অনুরোধ করেন উঠে আসতে। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, এখানে তিনি একটি কালভার্ট তৈরি করে দেবেন। ঠিক ঠিকই সেখানে একটি কালভার্ট তৈরি হয়ে যায়।
শিল্পী এসএম সুলতান ছিলেন নজরুলের মত একজন স্বাধীনচেতা মানুষ। জীবনকে তিনি যাপন করেছেন নিজের মত করে। ইচ্ছে হলে ছুটে গেছেন গ্রামে, ইচ্ছে হলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। কিছুদিন তিনি শাড়ি পরে থাকতেন, চুড়িও পরতেন। সেই সময়টাকে তিনি বলতেন রাধাকাল। হয়ত নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীকে দেখার চেষ্টা করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন না থাকলেও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। এ-প্রসঙ্গে শিল্পী রাগীব আহসানের কাছ থেকে শোনা একটি গল্প বলি।
অনেকেই জানেন শাহবাগের বিখ্যাত আর্ট স্টোর “রেখায়ন” এর মালিক ছিলেন রাগীব আহসান। সেখানে আড্ডা জমে উঠত ঢাকার সব বিখ্যাত শিল্পী, লেখক, সাংবাদিকদের। ১৯৭৫ সালে রাগীব আহসান গড়ে তোলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ। এটি ছিল সিনেমা মুভমেন্ট। তখন সারা দেশে অনেক মুভি ক্লাব গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের কোনো সিনেমা হলে তখন বিদেশি সিনেমা দেখানো হত না। চলচ্চিত্র সংসদের কর্মীরা বিভিন্ন দূতাবাসে ঘুরে ঘুরে বিখ্যাত সব বিদেশি ছবি জোগাড় করতেন এবং প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতেন। জার্মান কালচার সেন্টারের পরিচালক ছিলেন তখন হাগেন শুলজ। তিনি থাকতেন সেরাটনে। সন্ধ্যায় ধানমণ্ডির অফিস থেকে হেঁটে হেঁটে ফিরতেন সেরাটনে, পথে যাত্রাবিরতি নিতেন রেখায়নে। ডালপুরি, চা খেতেন, আড্ডা দিতেন বাঙালিদের সঙ্গে। তার বিদায় অনুষ্ঠানে দাওয়াত পান রাগীব আহসান। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে কালো আলখাল্লা পরা এক সুদর্শন পুরুষ এসে ঢোকেন। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন আগন্তুকের দিকে। রাগীব তাকে চিনতে পারেননি, হাগেনকে জিজ্ঞেস করেন, ইনি কে? হাগেন বলেন, তুমি কেমন শিল্পী ওকে চেনো না? ওর নাম সুলতান। বিখ্যাত শিল্পী। সুলতান ঢোকেন সুলতানের মতোই। ইংরেজিতে কুশল বিনিময় করেন সকলের সঙ্গে, সাহেবী কায়দায় হুইস্কি নেন, পান করেন এবং এক সময় চলে যান।
সুলতানের চলা-ফেরায় যে সুলতানী একটা ব্যাপার ছিল তা বহুমাত্রিক লেখক হাসনাত আবদুল হাই তার “সুলতান” উপন্যাসে উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তান থেকে ফেরার পর তাকে বিমান বন্দরে রিসিভ করার জন্য শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন দুজন শিল্পীকে পাঠান। তারা যখন তাকে রিসিভ করে বাইরে নিয়ে আসেন, রাস্তায় নেমে তিনি একজন ভিক্ষুককে ১০০ টাকার নোট তুলে দেন। তারা নিষেধ করলে তিনি বলেন, আমি সুলতান, নামের মর্যাদা রাখতে হবে না। আমি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখেছি আঁকায়ও এই সুলতানী ব্যাপারটার ষোলো আনা উপস্থিতি আছে। ‘চর দখল’ ছবিটি খেয়াল করুন। মনে হচ্ছে যেন দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি। একটা রাজকীয় ব্যাপার আছে ছবিটাতে। সুলতানের নারীদের দেখুন। মুখের আদল, দেহের উচ্ছাস, ব্লাউজহীন বক্ষ থেকে উঁকি-ঝুঁকি মারা ভরাট স্তনের আভাস এইসবে একটি সমৃদ্ধ গ্রামীন জীবনের আভিজাত্য উদ্ভাসিত হয়। এমন কী তাঁর গরুগুলোও যেন রাজবাড়ির অঢেল সমৃদ্ধির ভেতরে যত্নে বেড়ে ওঠা গবাদি। সুলতান তার চলায়, বলায়, আঁকায় ও আচরণে প্রকৃত অর্থেই ছিলেন একজন সুলতান।
আহমদ ছফার সঙ্গে রাগীব আহসানের ছিল নিবিড় সখ্য। সুলতানের সঙ্গেও ছফার ঘনিষ্ঠতা ছিল। ছফা-সূত্রে সুলতানের কিছুটা ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পান রাগীব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে থাকেন তখন আহমদ ছফা। বইমেলার আগে আগে সুলতানকে তিনি এখানে নিয়ে আসেন। রাগীব বলেন, আপনাকে ছবি আঁকতে হবে, বইমেলায় প্রদর্শনী করব। সুলতান বলেন, কাগজ নিয়ে আসো। রাগীব আহসান তখন ২২X২৮ সাইজের ২০টি আর্ট বোর্ড এনে দেন। সুলতান বেশ কয়েকদিন খেটে ২০টি ছবি আঁকেন। চাইনিজ ইঙ্ক এবং কালো মার্কার দিয়ে আঁকা সবগুলো ছবিই ছিল গ্রামের ল্যান্ডস্কেপ, কৃষি যন্ত্রপাতি, কৃষান-কৃষানী, গবাদী পশুর। আহমদ ছফা মেলায় একটি স্টল নেন। সেখানে ছবিগুলো প্রদর্শন করা হয়। অনেক বিখ্যাত শিল্পী এসেছিলেন, দেখেছেন কিন্তু তাচ্ছিল্যই করেছেন বেশি।
মানবদেহে আঁকা এলোমেলো পেশী দেখে আমি নিজেও ভেবেছি এনাটমির কোনো ব্যাকরণেই তো এসব পড়ে না। তা না পড়ুক, ছবিগুলোর দিকে তাকালে আমি যে প্রশান্তি পাই, সেই প্রাপ্তিটুকুই এসব ছবিকে শিল্পে উত্তীর্ণ করেছে। আমার বিবেচনায় মাইকেলেঞ্জোলো ছিলেন দানবীয় ক্ষমতাসম্পন্ন একজন শিল্পী। সুলতানকেও আমার সেই গুণসম্পন্ন শিল্পী মনে হয়েছে। বিশাল কর্মযজ্ঞ করবার ক্ষমতা ছিল তার কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য না পাকিস্তানের, না বাংলাদেশের, কোনো সরকারই তাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারল না। এতো বড়ো মাপের একজন শিল্পীকে ঠিকমত কাজে লাগাতে হলে তাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হয়। বিশাল স্টুডিও দিতে হয়, কাজগুলো ঠিকমত ডিসপ্লে করবার জায়গা এবং লোকবল দিতে হয়, যাতে শিল্পী ঘুরে ঘুরে নিজের কাজ দেখতে পারেন এবং নতুন কাজের পরিকল্পনা করতে পারেন। ভারতবর্ষের পথে পথে তিনি বহু এঁকেছেন। সেইসব ছবি বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে, বেহাত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও নিজের আঁকা ছবি ডিসপ্লে করার সমস্যায় ভুগেছেন তিনি। বারবার ট্রাকে করে এখানে-ওখানে নিয়ে যেতে হয়েছে।
তার ছবিতে ফুটে উঠেছে গ্রামীন জীবন এবং তা সমৃদ্ধ। দারিদ্র উঠে আসেনি। এমন পেশীবহুল কৃষক বোধ করি কেউ দেখেননি। একবার রাগীব আহসান জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি তো শুকনা-পাতলা মানুষ, ছবিতে এতো পেশীবহুল মানুষ আঁকেন কেন? তিনি জবাবে বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ মেনি মাসলস’ এরপর একটু থেমে বাক্যটি শেষ করেছিলেন, ‘ইন মাই মাইন্ড’ বলে।
বাংলাদেশের কিংবা ভারতের কোনো শিল্পীর সঙ্গেই সুলতানের কাজকে মেলানো যায় না, তিনি এশিয়ার একজন স্বতন্ত্র শিল্পী। তবে তার কাজের সঙ্গে ইতালিয় শিল্পীদের কাজের সাজুজ্য পাওয়া যায়। আমার কাছে তাকে মনে হয় ভিঞ্চি, রাফায়েল, মাইকেলঞ্জোলোর সহোদর।
৮ জুন ২০২২। হলিসউড, নিউইয়র্ক।