মজিদ মাহমুদ
তিনি বাঙালি নন। বাংলা ভাষায় কোনো সাহিত্যও রচনা করেননি। তবু ইংরাজের উপনিবেশকালে বাঙালির নতুন চিন্তনের সূচনা তিনিই করেছিলেন। কম-বেশি তাঁর প্রদর্শিত পথ ধরে বাঙালির বুদ্ধির মুক্তির সূচনা হয়েছিল। মধ্যযুগের গুটি কেটে বেরিয়ে এসেছিল বাঙালির সাহিত্য চিন্তা। ছত্রখান হয়ে পড়েছিল হাজার বছরের অচলায়তন। হ্যামিলনের বাঁশির টানে হিন্দু বাঙালির সংরক্ষিত দুর্গ থেকে বের হয়ে এসেছিলেন তাদের আদরের সন্তানেরা। ঘরের টান, পিতা-মাতার আদর উপেক্ষা করে চিন্তা ও যুক্তির সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন। আর কখনোই তাদের পুরোপুরি ঘরে ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। আদিপুরুষের মিথ্যার পাপে পিতামাতার স্নেহ বর্জন করে নিজেদের জীবন দিয়ে পরিশোধ করেছিলেন ইঁদুর নিধনের ঋণ। তাই তাঁর শিষ্য ও প্রশিষ্যদের হাতেই তৈরি হয়েছিল নব্যবাংলার সাহিত্য ও জাতীয়তাবাদি আন্দোলন। সুরের টানে ভেসে আসা তাঁর এই শিষ্যদের এমনকি প্রশিষ্যদেরও কেউ বলতেন, ‘ইয়ং-বেঙ্গল’ আবার কেউ বলতেন ‘ডিরোজিয়ান’। হ্যাঁ, সত্যিই তাদের গুরু ছিলেন ফিরিঙ্গি ডিরোজিও। পুরো নাম হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও।
আজ থেকে দুশ বছর আগে কোলকাতায় এক পর্তুগিজ ফিরিঙ্গি পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা ফ্রান্সিস ডিরোজিও জে স্কট এন্ড কোং নামে এক সওদাগরী অফিসের প্রধান হিসাবরক্ষকের কাজ করতেন। ইংরাজ আমলে এদেশে পর্তুগিজরা ফিরিঙ্গি বলে পরিচিত। তবে ডিরোজিওর মা সোফিয়া জনসন একজন ভারতীয় ইংরাজ খ্রিষ্টান। সাত বছরের ভিভিয়ানকে রেখে তার মা মারা গেলে বাবা দ্বিতীয়বার দার গ্রহণ করেন। ইংরাজ শাসনামলে পর্তুগিজদের দাপট কমলেও ডিরোজিও পরিবার ছিলেন অর্থবিত্তের সুবাদে ব্যতিক্রম। আর্থিক বিবেচনায় পরিবারটি কোলকাতায় গণ্যমান্যদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবু পাঁচ ভাই বোনের কেউই চব্বিশ বসন্ত অতিক্রম করতে পারেননি। প্রত্যেকেই ছিলেন ট্র্যাজেডির অকাল প্রয়াত নায়ক। এমনকি আমাদের ক্ষণজন্মা ভিভিয়ান ডিরোজিও বেঁচেছিলেন মাত্র বাইশ বছর। কিন্তু এই বিষ্ময় বালক সময়কে জয় করেছিলেন। সময়ের ওপর এমনভাবে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন যে দুশ বছরের ইংরেজ শাসনের ক্ষত ইতিহাসের বিষয় হলেও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে তার উপস্থিতি সদাজাগ্রত।
এমন প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয় যে, কে এই ফিরিঙ্গি বালক? তাঁর দুশতম জন্মদিন কি এখনো আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ? এ কথা সত্য, ফিরিঙ্গিরাই প্রথম ইউরোপিয়ান- যারা ভারতে এসেছিলেন। ডিরোজিওর দেশীয় পূর্বপুরুষ ভাস্কো দা গামা ১৪৯৮ সালে উত্তমাশা হয়ে ভারতে এসেছিলেন ব্যবসায়িক ধান্দায়। তাঁর পথ ধরে পরবর্তীকালে এদেশে ইউরোপীয় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা সুগম হয়েছিল। কালিকট বন্দরে গামার পদবিক্ষেপের পর থেকে পর্তুগিজদের আর থামিয়ে রাখা যায়নি। গয়ায় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠাসহ জলপথের দস্যুগিরি ভারতে তাদের অজনপ্রিয় করে তোলে। তবু ডিরোজিও জন্মের তিনশ বছর আগে থেকে তাদের অনেকেই এদেশে বসবাস ও বিয়ে শাদির মাধ্যমে নিজেদেরকে ভারতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তোলেন। বিশেষ করে ইংরাজ ও ওলন্দাজ শক্তির কাছে পর্তুগিজ শক্তির পরাজয়ের পর থেকে তারা ভারতকেই নিজেদের দেশ ভাবতে শুরু করেন। আর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তর থেকে বহুজাতির আগমন এবং বসবাসের মধ্য দিয়ে ভারত এক মিশ্র সংস্কৃতি ও সৌন্দর্য গড়ে তোলে। বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ, বাংলা ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক গদ্য চর্চা ফিরিঙ্গিদের হাতেই শুরু হয়েছিল। পর্তুগিজ মনুয়েল দ্য আসামপসু বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ রচনা করেন।
ইংরাজ হিসাবে উইলিয়ম ক্যারি, হ্যালহেড কিংবা মিশনারিদের বাংলা ভাষার উৎকর্ষের ক্ষেত্রে অবদান কিংবা প্রায় একই সময়ে অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউমের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার ফলে এদেশবাসী উপকৃত হয়েছিলেন। কিন্তু ভারতীয়দের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও তাঁদের কাজ মূলত ইংরাজ জাতির বলবৃদ্ধির পক্ষে নিয়োজিত ছিল। তাছাড়া তাদের জন্ম যেমন ভারতে নয়, তেমন নিজেদেরকে তারা ভারতীয় বলেও দাবি করেননি। তাঁদের কাজ পরিচালিত হয়েছিল ইংরাজ কিভাবে সুশাসক হিসেবে এদেশে তাদের অবস্থান আরো সুদৃঢ় করতে পারে। কিংবা যিশুর সুললিত বাণী প্রচারের মাধ্যমে স্বর্গের পথ প্রশস্ত করা। কিন্তু ফিরিঙ্গি ডিরোজিও যেমন এদেশে জন্মেছিলেন, তেমন এদেশকেই নিজের দেশ হিসেবে দাবি করেছেন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এ দেশ ছেড়ে তিনি কোথাও যাননি। তার সকল দুঃখ ও ক্ষোভ; সম্মান ও ঘৃণা এদেশকে কেন্দ্র করেই পল্লবিত হয়েছিল। কোলকাতার ১৫৫ নং লোয়ার সার্কুলার রোডে জন্মগ্রহণ করার পরে কিছুদিন ভাগলপুর মাসিমার কাছে বসবাস ভিন্ন তার সংক্ষিপ্ত জীবনের পুরোটাই কোলকাতার কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু ইয়ং ক্যালকাটানদের মনে তিনি যে সুরের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন তা অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে সবখানে ছড়িয়ে গিয়েছিল। এমনকি এখনো সে আগুন নিভেছে সে কথা বলা যায় না।
একটি প্রশ্ন অস্বাভাবিক নয় যে, ডিরোজিও এমনকি করেছিলেন যে দুশ বছর পরেও তিনি প্রাসঙ্গিক। যে ফিরিঙ্গি সমাজে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, বাংলা এমনকি ভারতীয় সমাজে কখনো তারা মূল ধারার সঙ্গে মিলিত হতে পারেননি। তাছাড়া সেদিনের সেই রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপট আপাতভাবে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ডিরোজিও সময়কালে সারা ভারতবর্ষ একটি যুগসন্ধি অতিক্রম করছিলে। তাঁর জন্মের মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে ইংরাজ এদেশের মসনদ দখল করলেও তখনো ভারত শাসন চলছিল অতীতের পরাক্রান্ত মোগল সম্রাটের নামে। ডিরোজিওর সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্মকালটি ছিল ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহেরও সিকি শতাব্দী আগে। তখনো হিন্দুদের সতীদাহ প্রথা রোধ কিংবা বিধবা বিবাহর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়নি। রামমোহনের জন্ম ডিরোজিওর আগে হলেও কলকাতা কেন্দ্রিক তাঁর হিন্দু সমাজের শুদ্ধি অভিযান শুরু করতে সময় লেগেছিল। চতুর্বর্গের এক অচলায়নের মধ্যে ডিরোজিওর জন্ম হয়েছিল যেখানে সূর্যের আলো ঠিকমত পৌঁছতে পারেনি। এমন ঘুমন্ত জাতিকে কিশোরোত্তীর্ণ এক তরুণ এমন এক হেঁচকা টানে জাগিয়ে দিয়েছিলেন, যা ধাতস্থ হতেও প্রবীণ নিয়মের কণ্ডলীদের অনেক সময় লেগেছিল। সমাজে এমন শোরগোল শুরু হয়েছিল– শ্রী চৈতন্যের পরে হিন্দু সমাজ যা বহুকাল দেখেনি। সবার ধারণা, এই বুঝি ধর্ম যায়, জাত যায়। সমাজে এমন সব ভৃগুদের আবির্ভাব হয়েছে, যাদের পদাঘাতে দেশের ধর্ম ঐতিহ্যের বন্ধন সব ফুঁৎকারে শেষ হয়ে যাবে।
একটু বাড়িয়ে বললে, নব্যবাংলার তরুণদের জন্য ডিরোজিও তাই করেছিলেন, প্রাচীন গ্রিসে সক্রেটিস যা করেছিলেন। সক্রেটিস নামে জগদ্বিখ্যাত যে দার্শনিকের কথা আমরা জানি, তিনি মূলত টিকে ছিলেন তার সুযোগ্য ছাত্রদের যৌক্তিক কর্মকাণ্ড ও লেখনির মাধ্যমে। সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তিনি তরুণদের বিভ্রান্ত করছেন, গ্রিসের ঐতিহ্যবাহী দেবতাদের নামে কলঙ্ক লেপন করছেন। তরুণরা নৈতিকভাবে অধঃপতিত হচ্ছে। এমনকি সমাজের নিয়ম শৃঙ্খলার জন্য যা ভয়াবহ হুমকির কারণ হতে পারে। সক্রেটিসকে তৎকালীন গ্রিসের শাসনতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষ তরুণদের এসব শিক্ষা থেকে বিরত হবার পরামর্শ দেন। কিন্তু এই মহান দার্শনিকের কাছে যা সত্য বলে প্রতিভাত হয়েছে, তিনি তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। এই অপরাধে অশতিপর প্রবীণ দার্শনিককে জীবন দিতে হয়েছে। কিন্তু সক্রেটিস বেঁচে ছিলেন তার সেই ছাত্রদের মধ্যে- সমাজের দৃষ্টিতে তিনি যাদের বিভ্রান্ত করেছিলেন। অথচ সক্রেটিসকে সেদিন যারা সমাজ রক্ষার ধূয়ো তুলে হত্যা করেছিলেন, সেই জগদ্দল সমাজ তাদের রক্ষা করতে পারেননি।
সক্রেটিসের মতো ডিরোজিও ছিলেন মূলত শিক্ষক। এবং একজন শিক্ষকের পক্ষে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে একটি সমাজের আমূল পরিবর্তন করা সম্ভব, যা তিনি দেখিয়েছেন। ডিরোজিওর বিরুদ্ধেও হিন্দু কলেজ কর্তৃপক্ষ এমন সব অভিযোগ আনে যে, তার কারণে তরুণরা অধঃপতিত হতে চলেছে। উচ্চ বংশীয় ছাত্রদের আচার ব্যবহার আপত্তিকরভাবে পরিবর্তন হচ্ছে, পানসভায় যাচ্ছে এবং হিন্দুধর্ম বিরোধী প্রচরণায় লিপ্ত হচ্ছে। এই অভিযোগে ডিরোজিওকে প্রাণ দিতে না হলেও মিথ্যা কলঙ্কের বোঝা নিয়ে তাঁকে হিন্দু কলেজ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর কাল শিক্ষাদানের মাধ্যমে তিনি যে একটি নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, পরবর্তীকালে বাঙালির চিন্তা চেতনায় এবং সাহিত্য রচনায় তারা গভীর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন। এই আলোচনার আগে এই মহান শিক্ষক সম্বন্ধে কিছু তথ্য উল্লেখ করতে চাই।
ডিরোজিও জন্মেছিলেন ১৮০৮ কিংবা ১৮০৯ সালের এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে। তবে ঐতিহাসিক আর সি মজুমদারও ১৮০৮ সালের কথা বললেও ডিরোজিও গবেষকরা ১৮০৯ সালে তাঁর জন্মের ব্যাপারে একমত হয়েছেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ডিরোজিও পিতার দিক দিয়ে পর্তুগিজ কিন্তু মায়ের দিক দিয়ে ইংরাজ। অবশ্য কবে, কখন, কোথা থেকে তাঁর পূর্বপুরুষ ভারতের কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন সে ব্যাপারে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি।
ডিরোজিও নিজে যেমন শিক্ষক ছিলেন, তেমন গুরুমশায়ের কাছ থেকেই তিনি পেয়েছিলেন এই ধন্বন্তরী বিদ্যা। তাঁর গুরু ছিলেন স্কটল্যা-বাসী ড্রামন্ড সাহেব। ডিরোজিওর চেয়ে তাঁর শিক্ষকও যে খুব বড় ছিলেন এমন নয়। ডিরোজিও জন্মের বছর চারেক পরে সে এ দেশে এসে ধর্মতলায় মনের সুখে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। এবং তিনিও ছিলেন একজন জাত কবি, জাত শিক্ষক ও জাত সাংবাদিক। অন্যসব রীতি মাফিক শিক্ষকের সঙ্গে ড্রামন্ড সাহেবের একদম মিল ছিল না বলে জানা যায়। ছাত্রদের অভিনব শাস্তিদানকালে ডিরোজিও তার ছাত্র হিসেবে বন্ধুত্বের স্বাদ পেয়েছিলেন। মানুষ যে সর্ব-ক্ষেত্রে শৃঙ্খলিত নয়, তিনি তাঁর শিক্ষকের কাছে জেনেছিলেন। ছাত্রদের সঙ্গে তিনি দর্শন ও সাহিত্য নিয়ে আলাপ করতেন এবং ইংরেজি ভাষার বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি কবিতা ছাপতে দিতেন বলেও জানা যায়। এমনকি তিনি নিজেই একখানি সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ৫৬ বছর বয়সে ১৮৪৩ সালে ডিরোজিও‘র মৃত্যুর প্রায় একযুগ পরে তিনি মারা যান। এখনো কলকাতায় সার্কুলার রোডে তার কবর রয়েছে এবং যার স্মৃতি ফলকে লেখা রয়েছে a successful teacher of youth in this city. ডিরোজিওর মতো ছাত্রের শিক্ষকের এ দাবি অস্বীকার করার মতো উপায় আমাদের নেই। সুতরাং এ কথা বলা যায়, ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের যে শিক্ষা দিতে পেরেছিলেন– তাঁর প্রেরণার উৎস ছিলেন মূলত এই মহান শিক্ষক। ড্রামন্ডের স্কুলে ডিরোজিও ছ‘বছর বয়স থেকে চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত যে শিক্ষা নিয়েছেন, সেই শিক্ষাকে নিঃসন্দেহে সম্পূর্ণ শিক্ষা বলা যায় না। কিন্তু তিনি জ্ঞান অন্বেষণের যে প্রেরণা লাভ করেছিলেন তা ছিল মুক্ত বুদ্ধির দ্বারা তাড়িত। শিক্ষক জীবনে ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের সেই যুক্তি, সত্য, সাম্য, মৈত্রীর পথে পরিচালিত করতে পেরেছিলেন।
ডিরোজিও এমন একটা সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যা একই সঙ্গে হিন্দুর কালচালিত বিশ্বাস এবং ইংরাজের ভেদনীতি ও কুশাসনের ফলে ভারতীয় জনজীবন অবমানবে পরিণত হয়েছিল। ভারত চতুর্বর্ণের নিগরে বন্দি হলেও ইউরোপের আলোকপ্রাপ্তির যুগে ইংরাজদের অনেকে প্রথম পর্যায়ে আমেরিকার পাশাপাশি এদেশে কৃতদাসদের বাজার গড়ে তোলে। ক্রীতদাসের কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে এ দেশকে ব্যবহার করে। ডিরোজিওর ‘এন্ড এজ দ্য সেøভ ডেপার্টস’ কিংবা ‘দ্য ম্যাস রিটার্নস’ কবিতা থেকে দাসজীবনের দুর্বহ চিত্র আমরা অনুভব করতে পারি। তৎকালে ইংরাজের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে বিনয় ঘোষের বর্ণনা অনেকটা এরকম : ‘১৮০৬ সালে আদালতের সংবাদে দেখা যায়, মুর, জেমস, বয়ার নামে সাহেবরা মানুষ হত্যার অপরাধে মাত্র এক বছরের সাজা পান। এ ধরনের অপরাধে শ্বেতাঙ্গ সাহেবদের এক সপ্তাহের সাজাও দেয়া হতো। অথচ চুরির অপরাধে কানাই মিস্ত্রিরির হাত পোড়াবার আদেশ দেয়া হয়।’ এক সময় চাবুক মেরে ইংরাজরা অপরাধীদের প্রকাশ্য প্রাণদণ্ড দিতো। এমনকি এসব দণ্ড তাদের কাছে যথেষ্ট মনে না হলে অপরাধীকে বেত্রাঘাত করে কামানের মুখে বসিয়ে উড়িয়ে দেয়া হতো। এ দেশের জাতপাতের মেকি ধর্ম আর শাসক ইংরেজের এই সব বর্বরতার বিরুদ্ধে ডিরোজিওর তরুণমন সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাই তিনি প্রশ্ন তোলেন, এদেশে ইংরাজের ক্ষমতার উৎস কেবল সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগ। ইংরেজ এ দেশে তার শাসন সুদীর্ঘ করতে চাইলে তাদের মানবিকতা, ন্যায় বিচার, সুশাসন ও শিক্ষা বিস্তারের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। এ সময়ের কোলকাতার আরো জীবন্ত চিত্র পাওয়া যায় ১৮২৩ সালে প্রকাশিত ভবানী চরণের ‘কলিকাতা কমলালয়’ কিংবা ১৮২৫ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘নববাবু’ বিলাস গ্রন্থে।
শিক্ষা জীবন শেষ করে চৌদ্দ বছরের ডিরোজিও প্রথমে সওদাগরী অফিসে কেরানির চাকরিতে যোগ দেন। কিন্তু কেরানীর জীবনের একঘেয়েমী দুরন্ত স্বাধীনতার পুত্র ডিরোজিওকে দু বছরের বেশি ধরে রাখতে পারেনি। তাঁর এই চাকরি এবং শিক্ষকতায় যোগদানের এই মধ্যবতী সময়ে তিনি কিছুদিন ভাগলপুর তার মাসিমার কাছে কাটান। ভাগলপুর পর্বটি ডিরোজিও জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ এ জন্য যে, এই নৈসর্গিক পরিবেশে বেকার তরুণের মনে কবিতা প্রেরণার সৃষ্টি হয়। এ সময় বেশ কিছু কবিতা তিনি লিখে ফেলেন এবং যুভেনিস ছদ্মনামে ইন্ডিয়া গেজেটে তাঁর কয়েকটি কবিতা ছাপাও হয়। সম্ভবত তিনি বছর খানেক ভাগলপুর ছিলেন। ‘সমাচার দর্পন’-এর খবর অনুসারে তিনি ১৮২৬ সালের মাঝামাঝি হিন্দু কলেজের চতুর্থ শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
ডিরোজিও যোগদানের মাত্র বছর কয়েক আগে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং এটিই ছিল বাংলা তথা ভারতবর্ষের প্রথম কলেজ যেখানে ইংরেজি পড়ানো হতো। তখন পর্যন্ত এদেশের রাষ্ট্রীয় কাজ-কর্ম এমনকি অফিস আদালতের ভাষা ছিল ফারসি। ইংরেজের প্রাসাদ লাভের জন্য সে সময় ইংরেজি শিক্ষার নব্য প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেও অভিজাত শ্রেণিকেও এ ভাষা শেখার প্রতি খুব একটা আগ্রহী করে তুলতে পারেনি। তবে মনে রাখতে হবে, কলেজের নাম হিন্দু হলেও কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের অধিকাংশ ছিলেন ইংরাজ। (হিন্দুমানে হিন্দুস্থানও হতে পারে। তবে এ কলেজে কোনো মুসলমান ছাত্র পড়তে পারতেন না একথা সত্য। পরে অবশ্য কলেজের নাম বদল করে প্রেসিডেন্সি কলেজ করা হয়।) উচ্চবিত্তের ছেলেদের ইংরাজি শিক্ষার মাধ্যমে কিছু রোজগার এবং একটি ইংরাজ অনুগত শ্রেণি তৈরি ছিল এ কলেজের মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠার খুব অল্পদিনের মধ্যেই এটি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং সরকারও এ কলেজের মাধ্যমে ইংরাজ জাতির লব্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞান হিন্দুস্থানের মানুষের কাছে তুলে ধরতে চেষ্টা করে। আর সেদিক দিয়ে ডিরোজিওর চেতনার সঙ্গে কলেজের উদ্দেশ্য পরিপন্থী ছিল না। ১৮২৬ সালে ডিরোজিও কলেজে যোগদানের সময় এ কলেজে ছাত্রের সংখ্যা ছিল প্রায় তিনশত জন। ডিরোজিও কলেজে যোগদানের পর থেকে কলেজের ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলেও তার পদচ্যুতির আগে ছাত্র সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে। এর প্রধান কারণ হিন্দু সমাজের চোখে ডিরোজিও মারাত্মক অপরাধের শিকার হন।
ডিরোজিও’র আগে এবং পরে হিন্দু কলেজে অনেক শিক্ষক ছিলেন। তাদের পাণ্ডিত্য কিংবা গুণ ডিরোজিওর চেয়ে নানা দিকে বেশি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবু আমরা কেউ তাদের কথা জানি না। কিন্তু ডিরোজিও এবং তাঁর অনুসারী বখে যাওয়া ছাত্ররা ছাড়া হিন্দু কলেজের ইতিহাসের উজ্জ্বল কোনো দিক আমাদের কাছে প্রতিভাত হয় না। হিন্দু কলেজে ডিরোজিও’র শিক্ষাদান সংক্রান্ত তাঁর এক প্রশিষ্য লাল বিহারী দে বলেছেন, ‘হিন্দু কলেজের তরুণ ছাত্ররা বেকন, লক, বাকলে, হিউম, রীড, স্টুয়ার্ট প্রমুখ পাশ্চাত্য দার্শনিকদের শ্রেষ্ঠ রচনার সঙ্গে ঘনিষ্ট পরিচয় লাভ করেন। এই পরিচয়ের ফলে তাদের গতানুগতিক চিন্তার মধ্যে এক বৈপ্লবিক আলোড়নের সূত্রপাত হতে থাকে। প্রত্যেক বিষয়ে তারা প্রশ্ন তর্ক করতে আরম্ভ করেন। তার ফলে তাদের অনেক প্রচলতি বদ্ধমূল ধারণার মূল নড়ে যায়, বহুকালের অচল আস্থার স্তম্ভ টলমল করে ওঠে। এই নতুন শিক্ষার অপ্রতিদ্বন্দ্বী গুরু ছিলেন ডিরোজিও। ডিরোজিওর প্রধান লক্ষ্য ছিল জ্ঞানানুসন্ধিৎসা জাগিয়ে তোলা। ১৮৩৪ সালের লেখায় রেভারেন্ড লালবিহারী দে বলেন, ডিরোজিওর ক্লাসের সঙ্গে একমাত্র প্লেটো ও আরিস্তলের ‘আকাডেমির তুলনা করা যায়।’
ছাত্রদের চেয়ে শিক্ষকের বয়সে মাত্র তিন চার বছর বড় হওয়ায় ছাত্ররা মূলত শিক্ষককে তাদের সহযোগী হিসেবেই পেয়েছিলেন। যার ফলে শিক্ষার প্রাচীনতার সকল পদ্ধতি ভেঙ্গে পড়ে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ছাত্ররা শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব, পাণ্ডিত্য ও বন্ধুত্বের সংস্পর্শে আসতে থাকে। তরুণ ছাত্ররা কেবল তাদের শিক্ষক ডিরোজিওর কাছে শিখতে এসেছে এমন নয়, তারা বলতেও এসেছিল। ডিরোজিওর শিক্ষার অভিনবত্ব এখানে। শিক্ষক ছাত্র মিলে তাঁর পাঠদান প্রক্রিয়া এগিয়ে চলে। ক্লাশকক্ষ বিষয়ের আয়তন ধারণ করতে না পারলে অনায়াসে তা বাইরে চলে আসতে পারত। গাছতলা এমনকি তরুণ শিক্ষকের বসতভিটা তাঁর ছাত্রদের পীঠস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। এহেন কোনো বিষয় ছিল না যা এই শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্ররা আলাপ করতে পারতেন না, তর্ক করতে পারতেন না। সক্রেটিসের কাজ কেবল উত্তরের ভেতর থেকে প্রশ্ন বের করে আনা। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে হিন্দু কলেজকে অতিক্রম করে ডিরোজিও আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে চলে আসেন। তাঁর বৈঠকখানায় স্থান সংকুলান না হওয়ায় শিগগির মানিকতলার শ্রীকৃষ্ণ সিংহের বাগানবাড়িতে এই সিম্পোজিয়াম স্থানান্তরিত হয়। এমনকি তার এই সভার নাম দেয়া হয় একাডেমিক অ্যাসোসিয়েসন। এবং অল্পদিনের মধ্যেই এই অ্যাসোসিয়েসন সারা কলকাতায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। এমনকি প্রবীণরাও এই সভায় যোগদান করার লোভ সংবরণ করতে পারতেন না। আর এই সভার আলোচনা প্রতিধ্বনিত হতো- ‘যাবতীয় ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে, নৈতিক ভণ্ডামী ও নোংড়ামির বিরুদ্ধে, বিচারবুদ্ধিহীন শাস্ত্র বচনের বিরুদ্ধে, প্রাণহীন চিরাচরিত আচার অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে, জাতিভেদ ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীক আর্থনীতিক ও মানসিক জড়ত্বের বিরুদ্ধে এমনকি মধ্যে মধ্যে দেবতার অস্তিত্বের বিরুদ্ধে পর্যন্ত।’
কারা ছিলেন ডিরোজিওর ছাত্র? হিন্দু কলেজে ডিরোজিওর ছাত্রের বাইরেও তাঁর এই এসোসিয়েশনে সমাজের গণ্যমান্য অনেকেই আসতেন। কিন্তু তাঁর প্রতিভাবান ছাত্রদের মধ্যে আমরা যাদের কথা জানি, তারা হলেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রাধানাথ শিকদার, রাধানাথ মিত্র প্রমুখ। ছাত্ররা নিজেদের বক্তব্যে সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বিষয় হলে ‘রবাটসন ও গিবন, রাজনৈতিক বিষয় হলে অ্যাডাম স্মিথ ও জেরেমি বেন্থাম, বৈজ্ঞানিক বিষয় হলে নিউটন ও ডেভি, ধর্মীয় বিষয় হলে হিউম ও টমাস পেইন, আধ্যাত্মিক বিষয় হলে লক, রীড, স্টুয়ার্ট ও ব্রাউন প্রমুখ মনীষীদের রচনা থেকে অবলীলায় আবৃত্তি করতেন।’ প্রসঙ্গক্রমে এ কথা তো সত্য, আজকের দিনে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কোলকাতাতেও এমন একটি আড্ডার কথা তরুণরা জানে না। আজ শিক্ষক ও তরুণ শিক্ষার্থী ইঁদুর দৌড় থেকে মুক্ত হতে পারছেন না। ডিরোজিওর নেতৃত্বে এসব তরুণ কেবল উচ্ছৃঙ্খল আলোচনার মধ্যেই নিজেদের প্রতিভাকে সীমাবদ্ধ রাখেনি। তারা তাদের যুক্তির পক্ষে কলমকে শাণিত করে তুলেছিলেন। প্রকাশ করেছিলেন ‘পার্থেনন’ নামে তাদের মুখপত্র। তরুণ ডিরোজিও ও তাঁর ছাত্রদের কর্মকা-ে হিন্দু সমাজ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা এই বিদ্বৎসমাজের পত্রিকা প্রকাশ এমনকি তাদের পুত্রদের কলেজে পাঠাতেও বাধা দিতে থাকেন। তাদের প্রধান অভিযোগ ছিল ডিরোজিও তাদের ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছেন। এর ফলে ১৮২৯ সালের পরে বিদ্যালয়ের ছাত্রের সংখ্যা দারুণ ভাবে কমতে থাকে। ডিরোজিওর শিক্ষা ইংরাজ-খ্রিষ্টান এমনকি অগ্রসরমান হিন্দু শিক্ষকদের খুব বেশি মাথা ব্যাথার কারণ না হলেও কলেজের ছাত্র সংখ্যা হ্রাস পাওয়া এবং স্থানীয় হিন্দুদের বিক্ষোভের ফলে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ডিরোজিওকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৩১ সালের ২৩ এপ্রিল হিন্দু কলেজের পরিচালকদের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে যে সব আজগুবি অভিযোগ আনা হয় তা– এ ধরনের যে কোনো মামলার জন্য আজো সত্য। হিন্দু কলেজের অন্যতম অধ্যক্ষ উইলসন ডিরোজিওর চিঠির উত্তরে তিনটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। (উইলসন ছিলেন ডিরোজিওর প্রতি সহমর্মিতাপূর্ণ।) ১. আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন? ২. পিতামাতার আদেশ পালন করা কিংবা শ্রদ্ধাভক্তি করা নৈতিক কর্তব্য মনে করেন? ৩. ভাইবোনের বিয়ে সামাজিক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করেন?
এ সব সারবত্তাহীন মিথ্যা অভিযোগে ডিরোজিও হতভম্ভ হয়ে যান। কিন্তু এ সব প্রশ্নের তিনি যে জবাব দেন তা গ্রিসের জুরিদের সামনে সক্রেটিসের বক্তব্য কিংবা পরবর্তীকালে নজরুলের রাজবন্দির জবানবন্দির মতো স্মরণীয়। এই স্বল্প পরিসরে ডিরোজিওর জবাবগুলো তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে তাঁর বক্তব্য থেকে জানা যায়, তিনি ঈশ্বরে অবিশ্বাস করেন এমন কথা তাঁর ছাত্রদের কখনো বলেননি। তবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্ব নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা যাবে না এ কথা তিনি মনে করেন না। তিনি বলেন, বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তো সব ধরনের লোকই পৃথিবীতে আছে, শিক্ষক হিসেবে আমি কেবল তাদের দৃষ্টিভঙ্গি-গুলো খোলামেলা আলোচনা করেছি।
পিতামাতাকে মান্য করার ব্যাপারে উত্থাপিত প্রশ্নে ডিরোজিও রীতিমত অবাক হয়ে যান। এমন একটি অস্বাভাবিক এবং বিকৃত ও হীন প্রচারে মানুষ কিভাবে আনন্দ পায় তা নিয়েও তিনি সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, আমি যদি পিতৃহীন না হতাম তাহলে আমার পিতাই এ প্রশ্নের উত্তর দিতেন। তাছাড়া আমরা ডিরোজিও জীবন পাঠ করতে গিয়ে দেখেছি, তিনি কেবল পিতামাতার প্রতি নন, এমনকি তাঁর বিমাতা এবং ভাইদের প্রতি কি অসম্ভব দায়িত্ব পালন করেছেন। এমনকি তাঁর মৃত পিতার উইলকে তিনি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছেন।
ভাইবোনের বিয়েকে তিনি রীতিমত কদর্য বলে উল্লেখ করেছেন। এবং এমন একটি আজগুবি বিষয় নিয়ে তাঁর মতো একজন শিক্ষক কিভাবে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন সে ব্যাপারেও তিনি বিস্মিত হয়েছেন। তিনি আরো বলেন, একজন লোক ধর্ম না মানলে সেই সমাজ তাকে নাস্তিক কিংবা নরাধম বলতে পারে। কিন্তু কাউকে হেয় করার জন্য কোনো সভ্য সমাজ এ ধরনের বানোয়াট অভিযোগ আনতে পারে তা তিনি ভাবতে পারেননি। এবং তিনি শেষ পর্যন্ত বলেছেন, ও ধস হড়ঃ ধ মৎবধঃবৎ সড়হংঃবৎ ঃযধহ সড়ংঃ ঢ়বড়ঢ়ষব.
কলেজ থেকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত হওয়ার মাত্র আট মাসের মাথায় কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র বাইশ বছর বয়সে তিনি মারা গেলেন। কিন্তু নব্যবাংলার তরুণদের মধ্যে তিনি যে আগুন জ্বালিয়ে গিয়েছিলেন তা সহসা নিভলো না। আর এই প্রজ্জ্বলিত আগুনের পরশমণিই তাঁর প্রধান কৃতিত্ব। তাঁর পথ ধরেই ঊনিশশতকের বাঙালির চিন্তার জগতে, সাহিত্যের জগতে এক অভাবনীয় জাগরণ ঘটেছিল। ডিরোজিওর সামগ্রিক কর্মকা- থেকে প্রত্যক্ষভাবে নতুন দিনের হিন্দুসমাজ উপকৃত হয়েছিল। কিন্তু ভাষা সাহিত্য ও চিন্তার এই মিছিলে দেরিতে হলেও মুসলমান সমাজও উপকৃত হয়। তবে এখানে এ বিষয়টি উল্লেখযোগ্য, ডিরোজিওর কাছে হিন্দু মুসলমান কিংবা তাঁর নিজের সাম্প্রদায়িক বোধও আলাদা মর্যাদা কিংবা অপকৃষ্টতা পায়নি। ডিরোজিও ছিলেন, সম্পূর্ণ সংস্কার মুক্ত, ধর্ম ও সাম্প্রায়িক চেতনামুক্ত এই মাটির পৃথিবীর আদরের সন্তান। ডিরোজিওর কবি জীবনের মধ্যে আমরা সেই সত্য লক্ষ্য করি। ডিরোজিও কবি ছিলেন। মাত্র আঠার বছর বয়সে তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। কিন্তু সংগ্রামশীল ঝড়ো জীবনের তুলনায় আমাদের কাছে কবিতা তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাছাড়া তাঁর লেখার ভাষা ছিল ইংরেজি। যে কারণে বহুকাল তাকে দেশীয় কবি বলে স্বীকার করা হয়নি। তবু এ দেশে প্রথম দেশাত্মবোধক কবিতা তাঁরই রচনা। তাঁর ‘ঞড় ওহফরধ সু হধঃরাব ষধহফ’ প্রথম অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে পল্লব সেনগুপ্ত, রমাপ্রসাদসহ অনেকেই তাঁর কবিতা অনুবাদ করেছেন। তাঁর ফকির অফ জিংগিরাসহ অনেক কবিতায় তৎকালে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের সুর ধ্বনিত হয়েছে। মুসলিম সমাজ সন্বন্ধে তিনি তেমন জানতেন বলে মনে হয় না। জানা সম্ভবও ছিল না। কারণ এই তরুণ গুরুত্বে স্বল্প জীবনে ইংরেজ নীতির ফলে তখনো মুসলমানরা পটভূমিকায় আসতে পারেনি। তবু তিনি যেমন দেশাত্ববোধক কবিতার প্রথম রচয়িতা তেমন অসাম্প্রদায়িক কবিতা রচনাতেও।
ডিরোজিওকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করার ফলে তাঁর ছাত্র কৃষ্ণমোহন ও দক্ষিণারঞ্জনসহ অনেকেই দ্বিগুণ উদ্যোমে তাদের দলবল নিয়ে বাইরের জগতে ঝড় তুলতে থাকেন। এমনকি তারা এমন সব অর্বাচীনসুলভ কাজ করতে থাকেন যা রীতিমত বিব্রতকরও বটে। যেমন, হিন্দুর দেব দেবতা ও জাতপাতের বিরুদ্ধে কথা বলতে বলতে তরুণ মনে জোশ এসে গেলে তারা প্রকাশ্যে গোমাংস ভক্ষণ, মদ্যপান এমনকি গরুর হাড় পর্যন্ত ব্রাহ্মণের বাড়িতে নিক্ষেপ করতে ছাড়তো না। হিন্দু কলেজে পড়–য়া এক তরুণের ব্রাহ্মণ পিতা কালিঘাটে পূজা করতে গিয়ে তরুণকে সাষ্টাঙ্গে প্রমাণ করতে আদেশ দেন। কিন্তু ডিরোজিওর ছাত্রটি অস্বীকার করে এবং মাকালিকে ‘গুডমনিং ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করে। কিন্তু এই তরুণদের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল সত্যবাদিতা। তাদের দ্বারা কোনো ভাবেই মিথ্যা বলানো সম্ভব হতো না। আর যুক্তি দ্বারা সব কিছু পরখ করে নিতে চাইত।
ডিরোজিওকে যারা সেদিন বহিষ্কার করেছিলেন আজ আর আমরা তাদের কথা জানি না কিংবা জানলেও ডিরোজিওর কারণেই জানি। এমনকি কক্ষচ্যুৎ এই অখ্রিষ্টান বালকটিকে ঈশ্বরও যিশুর মতো যুক্তিহীন নিষ্ঠুর মানুষের সমাজে বেশিদিন থাকতে দেননি। কিন্তু তরুণদের মনে যে সত্যবাদিতা, যুক্তিবাদিতা, সাহিত্যপ্রীতি ও দেশপ্রেমের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন তা অচিরেই ফলবতী হয়ে নিষ্প্রাণ বাংলাদেশের সকল ক্ষেত্রে এক গতির সঞ্চার করেছিল। প্যারীচাঁদ মিত্র, মধুসূদন দত্ত থেকে শুরু করে অনেকেই তাঁর চিন্তার ঘরানার মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। এমনকি এই অবিমৃশ্যকারিতার যুগেও একজন প্রকৃত শিক্ষকের মানসপটে ডিরোজিও হবার স্বপ্ন জেগে থাকে। বাংলাদেশ এখনো চিন্তার অচলায়তন ভাঙতে পারছে না। সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রের বহুমুখী স্বার্থের নিগড়ে তা বন্দি। ডিরোজিওর মতো স্বল্প আয়ুর অফুরন্ত মুক্তপ্রাণ শিক্ষক ছাড়া এই সঙ্কট নিরসনের আর কি কোনো উপায় আছে?