spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতানির্বাচিত ২৫ কবিতা : ওমর বিশ্বাস

নির্বাচিত ২৫ কবিতা : ওমর বিশ্বাস

আলোকের মেলা

আয় ভেসে মেঘগুলো বৈশাখি রঙে

ডানা মেলা ঋতুরাজ জীবনের ঢঙে

আয় ছুটে ঝড় আয় ঝড় তোলা মনে

রঙধনু করে নেই জীবনের বনে।

নদী-নালা কলোরবে ছুটে চলে দূর

আমি যাব তার সাথে ঘুচাতে বিধুর

ঝড় আসে ঝড় আসে হৃদয়টা ঘিরে

ওই দেখ ঝড় আসে স্বপ্নের নীড়ে।

আকাশের সাদা-নীল বুকে আঁকি ছবি

নতুনের গান আর কল্পনা কবি

সবকিছু জীর্ণতা ধুয়ে মুছে ছাপ 

আয় ঝড় আয় বুকে দূরে ঠেলে পাপ।

ওই আসে ঝড় তুলে বোশেখের বেলা 

শুরু হয় নবরূপে আলোকের মেলা।

মোমের পাহাড়

আমি ভাঙি মিথ্যা বেসাতির আবেশ। অহম থেকে 

আসা মরীচিকাময় স্বপ্ন, চতুর্মুখী জোতিহীন

হীরক মোমের পাহাড়ের চূড়া গড়া অর্বাচীন

যত ঠুটা ফাটা অহমিকা। ভাঙি কালো আলো রেখে।

আমি আশা জাগানিয়া ঘুম দেখি রমনী ঘুমায়

ফুলের শরীরে গন্ধময় ভোর ধরে আসা কোনো

জলরং ঢেউখেলা। আর যাও আসেনি এখনো

পৃথিবীর নাড়ি নড়ে ওঠে তার প্রেমের চুমায়।

অন্য কোনো লেনাদেনা হবে ভেবে তুলে আনো যত

অন্বিষ্ট তিক্ততা অবসাদ– আকাশ জোছনা ওই ঘরে 

নেমেছিল দেখোনি। কী লাভ বলো মুখ বালুচরে

গুঁজে বীরত্ব খেলায়। উল্টো ছায়া সুখে ভালো কত? 

আমি দেখি করুণার বৃষ্টি আরো বাড়ে মেঘ রঙে

মগজের ভেল্কিবাজি নড়ে আত্মতৃপ্ত নানা ঢঙে।  

সেই নদী

যেই নদী বয়ে যায় এঁকেবেঁকে দূর

তার সাথে গান গায় জীবনের সুর

তার সাথে দেখা হলে কথা বলে মন

সেই হয় অবশেষে সঙ্গী প্রিয়জন।

সেই নদী ছুটে চলে ক্লান্তিহীন মুখ

আমি দেখি তার সাথে মিশে আছে সুখ

মায়াময় রংধনু অবারিত আলো

কষ্টেরও ঢেউগুলো করে তোলে ভালো।

তার কাছে জানা আছে দিবানিশি ভোর

তার কাছে কিছু নয় দুঃখ ব্যথা ঘোর

আঁধারের কালো থেকে আনে তুলে লগ্ন

স্বপ্নটাকে তুলে নিতে থাকে শুধু মগ্ন।

সেই নদী কলরবে মুখরিত রোজ

তার কাছে জেনে নেব জীবনের খোঁজ।

কাজী নজরুল ইসলাম

সব কিছু পিছু ফেলে যে ভূমে দাঁড়ানো যায়, তুমি

ছুঁয়ে গেছো তার চেয়ে বেশি আকাশের আবিরতা

তুমি ছুঁয়ে গেছো আরো শিকড়ের গভীর গাঢ়তা

অনুভবে উচ্চকিত করেছ আপন দেশভূমি।

দেখো চেয়ে দৃষ্টি ফেরে সোনালি আকাশ বারবার

বিদ্যুৎ তরঙ্গ তীব্র পুষ্পফোঁটা বারুদ বিজয়

অকৃত্রিম তৃষ্ণা ভরা বুকের আকুতি সে কী জয়

হাতে তুলে আনা তপ্ত সূর্যের হাসিতে জাগাবার।

যুদ্ধ ও ভালোবাসার সংগীতে ফেরানো উদ্দীপনা 

তুলে আনো তুমি অন্য কিছু ফসলের শিষ বিন্দু 

প্রেমের চুম্বন। তুলে আনা ছিন্ন অভিলাষী সিন্ধু

মানবতা জুড়ে থাকা আদিগন্ত মনের আল্পনা। 

রণাঙ্গনে পাথরের দেহ ভাঙা ঢেউ জয়ী তুমি

পুষ্পফোঁটাও। বিলায়ে আপনারে আপন ভূমি।

তোমার ভাষা কি

তোমার ভাষা কি– কাব্যে লিখে রাখা শরতের মন

দিয়ে দেব বলে কোন ঘ্রাণে অক্ষরের বিলি তুলে

দিগন্ত পর্যন্ত আমাদের কাশবনের সীমানা

জুড়ে দিয়ে একে যাই– স্বপ্নচূড়া আলোর জানালা।

মনে পড়ে শরতের সাদা পাখি সাদা ফুল দেখে 

বিস্মিত হয়েছিলাম–ভরারাত জোড়া অন্ধকার

আলোকিত হয়েছিল শিউলির ঘ্রাণ পেয়ে রাত্রি

কাশফুলের ছোঁয়ায়–ঋতুর কর্ষণে ত্রিভুবন।

আকাশেও তো দেখেছি গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুল আর 

ফুলের মিছিল– কতবার, অনেক অনেক দিন

তবু প্রথম যেদিন ভালোবাসার দিগন্তে দেখা 

প্রেম হয় মিতালীর জোছনার সাথে জীবনের।

তোমার ভাষা কি– বুঝে গেছি, লিপি বর্ণমালা কন্ঠস্বর

নির্ঘুম আকাশ দেব সাথে দেব আশ্বিনের রং।

হৃদয় পোড়ে চাঁদে

কেন প্রেম ভক্তি থেকে দূরে থাকো নিরর্থক নারী

রূপবতী প্রশংসায় লুকাতে দেখিনি মুখ আগে

আজ কেন অভিমানে রাতের নীলিমা ঢেকে দাও

প্রসন্ন মায়ার টানে সব পিছু ফেলে ডুবে যাও

ঝুঁকে পড়ো ঘরমুখী রাত বারান্দায় অনুরাগে

হয়েছ নয়নতারা মঙ্গল তৃষ্ণায় বিবি তারি।

চাঁদকে সুন্দরী বলে বিপদ এনেছি ডেকে যেন

চাঁদের হৃদয় খুঁড়ে কলঙ্কিনী তুলে আনি ফের

সে কলঙ্ক পথে যদি সাজো ফুলে রাশি রাশি ঢেড়

তাহলে কি খুশি হও- – না হলে সুন্দরী রাগো কেন?

রাতের নীলিমা দেখি ফেরি করে চোখের চিত্রালি

অন্ধরাতে সৌরভের ভেলা নিয়ে তোমার মিতালী।

হৃদয় পুড়েছে চাঁদে তুমি বোঝো শুধু কালোদাগ

আমি বলি তারে প্রেম–দীর্ঘ রজনীর অনুরাগ।

অনুভবের উষ্ণতা নিয়ে

প্রকৃতির উত্তাপের দেহ ভেঙে একটা কোমল অনুভ‚তি

সেই শুরু থেকে এই পৃথিবীর শরীরের ভিতর অদ্ভুতভাবে

নিয়মিত খেলা করে যাচ্ছে অবিরাম। সময় সময় পালা বদলে আসছে

নিজের ভিতর ভাঁজ খোলা পর্বগুলো একে একে– 

এই তো সেদিন বর্ষার ঢেউ ভেঙে উত্তর পাড়ার খোলা 

দরজার ফাঁক গলে চলে আসে আশ্বিনের প্রেম

এভাবেই বাড়ন্ত শরীর নিয়ে মেঘ আসে খোলা আকাশের টানে 

ছুটে চলে উর্ধ্বমুখী সৌন্দর্যের কোমল নরম ঋতু।

আামাদের কাছে শরতের চিঠি আসে

একটা প্রগাঢ় অনুভবের উষ্ণতা নিয়ে ছুঁয়ে দেখি

খোলা আকাশের বুক থেকে হৃদয়ের ভাঁজ খুলে

নেমে আসা সরোবর নদীর বুকের ভিতরটা

যেখানে টান লেগেছে নতুন কালের।

ধূসর আকাশ থেকে এক খাম আসে কার্তিকের কাছে–

এক ফালি ঘাম বারতা দিয়েছে, রাত জেগে জেগে চিঠির ভাষায় 

হয়েছে মিলিয়ে দেখা – জীবনের ঘাম – শূনতায় 

এই এক ফালি ঘাম মেঘবাড়ি থেকে আসা

মুড়ে দেয়া অস্তিত্বের ভোর – এসেছে পেলবতার নীল খামে

অনেক আনন্দ বেদনার ভাঙা গড়া মোমের বিনাশী চেতনায়

আলোক সম্ভারে জীবনের ধরাতলে

শরতের চিঠি আসে

শরতের কাছ থেকে তুলতে কি পেরেছি জীবনের পাঠ।

এখানে যে কলকাকলির ঘাম শুয়ে আছে উর্বর জমিনে

কাশফুলের হেলানো দোলনায় কত আরাম, তা

নীলশুভ্র মাথার উপর ভেসে থাকা ছাউনি জানে।

আজকাল তাদেরও গতিপথ এঁকেবেঁকে যায়

দূষণ দূষণ ভরা জলবায়ুর মাতম

জীবন পালাবদলে তবু শরত ঋতুর সান্নিধ্যের

ভিতর দিয়ে এগোয় সভ্যতার রং।

শিলা

নিঃশব্দে হেঁটে যায় শিলা

বাতাসে একটা দোলা রেখে যায় শব্দের

নুড়ি পাথরের শরীর ছুঁয়ে ছুটে চলা শিলার সাথে 

পানির কলকলানো ধ্বনিও হয় বড়ই নিঃশব্দময়

প্রত্যয়ের ভঙিগুলো বাতাসের ভিতর দুলে ওঠে

শব্দ দোলানো তালে শব্দও হাঁটে 

সাথে সাথে পায়ে পায়ে।

কেউ কেউ দাপটে ভূমি দালানকোঠা ভেঙে 

কাজের গতিবেগ জানানোর আকর্ষণ করে আশেপাশের মানুষের

চারপাশ ডেকে আনে।

শিলা তার পুরাই বিপরীত।

নিঃশব্দের ভিতর টেনে যাওয়া রেখায় 

প্রত্যয়ী শিলা হাঁটে সংগ্রামী শিলা

বোঝা যায় নিরহংকারী আত্মদীপ্ততাকে

শব্দের দাগ মনে লাগে

নুড়িভাঙা পায়ে হাঁটে শিলা।

শিলা! 

সে তো সূর্যের মতোই জীবনের জন্য কাজ করে যাওয়া এক নারী।

শিলাদের বুঝতে হৃদয় লাগে।

আষাঢ়

বৃষ্টির শিরায় ঢেউ তুলে যাক আষাঢ়ের প্রথম বাতাস 

ঘোরলাগা চাহনিতে এলোমেলো হয়ে যাক রূপের প্রকৃৃতি

বিন্যস্ত চাষাবাদের পুষ্টি বুঝে নিক হৃদয় খোরাক।

আষাঢ়ের ঘর থেকে মেঘ ডাকে

চাষের নিড়ানি ওঠে নড়েচড়ে। তৈরি হয় ভোরের হাওয়ায়

মমতা বৃষ্টির কল্পরূপ সমুদ্র ফেনার মতো

লুটে নিক মেঘবালিকার স্বপ্ন বিদ্যুৎ চমকে।

আষাঢ়ের হাত ধরে স্নিগ্ধতা আসবে

সৌন্দর্যের দ্যুতিরাশি নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়

হৃদয়ের লাঙল চলবে অফুরন্ত সম্ভাবনা আর চ লা আষাঢ়ে

পাগলা আঁধারে হোক অবিরাম খেলা বাদলের।

আষাঢ়ে আসুক মৌ জীবন-বারতা

কদম কামিনী কেয়া জুঁই — মাতাল সৌরভ

জীবন ঘ্রাণের উন্মোচন

সাড়া পড়ে যাক পালাবদলের অযুত মাতানো শিহরণ।

অস্বস্তিকর ভীতির মুখ থেকে

খুব বেশি কি অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল মানুষ!

এভাবে থমকে যেতে হলো!

একটা অস্বস্তিকর ভীতির মধ্যে হঠাৎ আটকে

ভয়ংকর এক গুপ্তঘাতকের হাতে এসে পরেছে পৃথিবী

সাতশ কোটি মানুষকে রাজপথ, ক্লাব, রেস্তোরাঁ,

জৌলুস, প্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে এক জীবাণু ভাইরাস করোনা 

সবাইকে তুলে দিলো গৃহে। সেই থেকে মানুষ আজ গৃহবন্দি। 

পৃথিবী জ্বরে আক্রান্ত। পৃথিবীর জ্ব¡র হয়েছে। 

জীবাণুস্ত্রর দখলে পড়ে এখন জ্বর কাশি সর্দি নিয়ে যাচ্ছে তাই অবস্থা।

বাতাসের আগে দৌড়ানোর প্রতিযোগীতায় নেমেছিল মানুষ

বিদ্যুৎচমকের আলোর ঝলকানি দেখার আগেই 

মানুষকে দেখতে হয়েছিল পৃথিবীর কুৎসিত কুৎসিত

ভয়ংকর কিছু অকল্পনীয় দৃশ্য!

গা শিহরিত হয়ে ওঠা কত নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে একের পর এক 

ভয়াবহ আর নিষ্ঠুরতম জঘন্যতায় বিবেকগুলো ক্রমে মরে যাচ্ছিল। মানুষ দেখছিল 

একের পর এক রাত্রি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা কান্নার আওয়াজ 

দিনের উত্তপ্ত সূর্যের উজ্জ্বলতার আলোকিত মানবিকতার ভিতর দেখছিল 

বিপরীতমুখ থেকে ধেয়ে আসা বিরুদ্ধ-বাতাসের কণ্ঠরোধ করা পাশবিকতা।

কতটা পথ বেশি গিয়েছিল মানুষ?

এগুলো কি বিজ্ঞানেরই আশীর্বাদ? 

নাকি প্রযুক্তির লাগামহীন উৎকর্ষের কাছে বেঁচে দেওয়া বিবেক?

যে রশি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল এই পরিণামের দিকে?

কীভাবে আটকে গেল ক্ষুদ্রতি ক্ষুদ্র অনুজীব করোনায়

হায় বিজ্ঞান, কল্পনা! কল্পনা!

২.

হে সাম্রাজ্যবাদের অধিপতিগণ! যুদ্ধ থামাওনি।

উসকে রেখেছিলে আগুনকে

উসকে দিয়েছে আগুনকে তার স্ফূলিঙ্গ ছড়ানোর জন্য

ওই আগুন সুপ্ত থাকেনি। সহ্য করতে পারেনি

মনুষ্যত্ব ও মানবিকতাকে ধ্বংস করা সেইসব বীর বাহাদুরদের

যারা এখন নিজ নিজ গৃহে স্বেচ্ছায় বন্দি। কোয়ারান্টিনে।

ওই আগুন তো সুপ্ত থাকে না। 

কে বলেছে আগুন নিয়ে খেললেও ও সুপ্ত থাকবে।

কী শিখলাম আমরা?

মিনিটে মিনিটে নিঃশ্বাস ফেলার আগেই শুনতে হচ্ছে মানুষের মৃত্যুর খবর।

কত অসহায় মানুষ! 

আমরা নিরীহ মানুষ সকল মানুষ ও আরশের অধিপতির কাছে 

ফরিয়াদ করে বলেছি ওই আগুন থামাও এখনি। 

হে মাবুদ! আমরা কতিপয় ক্ষমতাহীন মানুষ 

তোমার কালামের দোহাই দিয়ে থামতে বলেছিলাম

আমরা শক্তিহীন নিরীহ জনগণ বিশ্বটাকে শান্ত করতে পারিনি 

তবে আমাদের বিশ্বাস তোমার প্রতি আগের মতোই অটল।

আমরা কবিগণ অনেকবার থামতে বলেছিলাম 

ওরা অস্ত্র দিয়ে দমিয়ে রাখছিল বিশ্বটাকে  

তবে তোমার কাছে ফরিয়াদ তুমি থামাও ওই ভয়ংকর খেলা 

তুমিই পারো আগুনকে থামাতে

আগুনের নিয়ন্ত্রক তো তুমিই। 

হে মাবুদ! ক্ষমা করো। তুলে নাও ধ্বংস!

এবারকার মতো ক্ষমা করো। তুমিই বড় ক্ষমাশীল।

আমরা তোমার কতিপয় তুচ্ছ গোলাম 

গোটা পৃথিবীর মানুষের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাচ্ছি

এতে কোনো কোনো মানুষ আমাদের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললেও 

তুমি তোমার পৃথিবীকে অবাসযোগ্য রাখো 

তুমিই পারো তুমিই পারো

সবকিছু তোমার– তুমিই পরাক্রমশালী।

আমরা আবার তোমার কাছে একটা বাসযোগ্য পৃথিবী চাচ্ছি।

শীতের কুয়াশায়

তোমার স্মৃতি একটু রাখি শীতের কুয়াশায়

শীত বলল, আবারও সে হারিয়ে যাবে দূর-নীলিমায়

আমিও জানি আসবে না সে আর এমন করে

আসবে আবার নতুন ভোরে।

এ-পাড়া ও-পাড়া ঘুরে ঘুরে 

উঠানে যেমন একসময় ধানগুলো পড়ে থাকে কাবু হয়ে

বাড়ি বাড়ি যাবে বলে

সেও চলে যায়।

কখনো কখনো উঠান বিমর্ষ উঁকি দেয় সে পথে

ইস্ আর একটিবার যদি দেখা যেত।

ভেবো না, রোদ বলেছে এই শীতের শেষবেলায়

শীতের সাথে রস-গুড়-কুয়াশার ভোরের মতো

আনন্দ ভাগাভাগি করে নেবে

যাক, যাকে বলে বন্ধুত্ব।

আমিও কিছু স্বপ্ন তারার থেকে নিয়ে বুকের ভিতর রেখে দেবো।

ফুলের কাঁটায় বিদ্ধ দু’চোখ

দু’চোখে বিদ্ধ ফুলের কাঁটায় ভেঙে যায় ঘুম

বহুকাল ধরে নিদ্রিত দেহ পায় না কোনোই সাড়া

আজ বুঝি সব আগের মতোই আছে

কে-বা রাখে তার খোঁজ।

গেছে ক্ষয়ে রূপ পাহাড়ের দেহ যতটুক

বদলেছে কিনা পৃথিবীরই বা কতটুক

কোথাও অনেক কোথাও অল্প 

হয়ত-বা গেছে মেঘে মেঘে বেলা বেশ

জমেছে ধুলিরা, কেঁপেছে বিশ্ব 

বোঝেনি ঝাপসা চোখের আবেশ।

২.

মোমের মতোন গলে গলে বড় জমেছে পাপের ঘর

রূপালি দুপুরে ঝুমুর ঝুমুর নূপুরে 

আকাশের দিকে বোকা চোখে চেয়ে

সবাক পৃথিবী নীরবেই কাঁদে দিন কাটে তার মিলে ঝিলে।

শীত আসে শীত যায় 

বর্ষায় ভিজে গোটা গাঁও

ঘুমাও ঘুমাও কালের চাকায় পিষ্ট হয়ে 

জীবন ঝর্ণা নদী তরঙ্গ শুধু যায় লড়ে।

বৃষ্টিকন্যারা

বৃষ্টিকন্যারা এসেই দৌড়ে পালালো

– কোথা থেকে এসেছ তোমরা?

– সাত আসমানের মেঘ ফুঁড়ে নেমে এসেছি

বানের ঢল হয়ে

– তারপর

– যদি পার বুঝে নিও আমাদের

রোদের ঘরে হানা দেব

তারপর, কেউ জানে না 

আর কেউ জানে না কোথায় যাবো ।

বৃষ্টিকন্যারা আসল গেল

কত কিছু দিয়ে গেল

কত কিছু বলে গেল।

সারিঘাট

সারিঘাট থেকে দুই পাশের টিলার অস্তিত্ব দেখতে দেখতে

চোখ চলে যাচ্ছিল সৌন্দর্যের গভীর থেকে গভীরে

যতদূর চোখ যায় দৃষ্টি যায় আরো ঘন থেকে ঘন

সবুজের ভিতর দিয়ে গহীনে

চোখের দৃষ্টি সীমানা ছুঁয়েছে

চোখ গেছে বরাবর সীমান্তের দিগন্তে।

আমার প্রিয় মাতৃভূমিকে আগলে রাখা সীমানা ছুঁয়ে

দেখে নিচ্ছিলাম নিসর্গের অপূর্ব সৌন্দর্য

কোনোভাবে হৃদয় দিয়ে এ দৃশ্যের পুরো সৌন্দর্যকে উপভোগ করা যায় না

সৌন্দর্যের যে অভিভূত করার ক্ষমতার কাছে 

ওপাশেরও বিস্তৃত ভালোবাসা আছে

সেই বোধ বারবার ঝরে পড়ছিল সারি ঘাটের স্বচ্ছ পানির ভিতর।

ঐ তো সীমান্ত, আগে পড়ে আছে লালখান টি স্টেট

আর একটু বেশি সৌন্দর্যের বিচ্ছুরণে অন্ধ হতে হবে প্রকৃতির কাছে

হাত বাড়াও, চোখ মেলে দাও

কথা হোক মনের সাথে মনের

যে চোখ দেখেনি সে দেখুক।

সারিঘাটের সারি নদী থেকে নীল স্বচ্ছ পানির ভিতর ফুটে উঠছিল

আত্মার আর্তনাদ– এতো স্বচ্ছ স্ফটিক জলের ধারা 

আমরা কজনই বা তার খোঁজ রাখি।

আমার স্বদেশ সবুজ

(সবুজ পানি সারিঘাটের বুকে বিছানো সবুজ গালিচার পথ)

কখনো নীল স্বচ্ছতায় দৃষ্টি চলে যায় দূর

সবুজ থেকে ক্রমাগত সবুজে–

এরাই তো মিশে আছে আত্মার ভিতর।

সারিঘাটের নদীর কলধ্বনি

স্বচ্ছ পানি টলটলায়মান নৃত্য

স্থির তলদেশের দৃশ্য দেখে দেখে কার না ভালো লাগবে 

গভীর দেশে পাথরের সাথে কথোপকথন।

রোদ

রোদ আসে রোদ

রোজ আসবে রোদ

রোদের তাপে পুড়ে পুড়ে তাপিত রোদ্দুর

সূর্যের কোমল রশ্মি শরীরে পোড়ে

তাপে উত্তপ্ত বৃষ্টির কণা।

আদর থেকে বিরহে

বিরহ থেকে স্নেহে

অবশেষে ভোরের হাত ধরে সন্ধ্যা

মায়ের কোলে অবুঝ শিশুর নেতিয়ে পড়া ঘুম।

রোদে পুড়ে পুড়ে ফর্সা চামড়া বাদামী হয়

ভেজা কাপড় রোদে পুড়ে ঝরঝরে পত্রপল্লব

লাউডগা পুঁইয়ের বেড়ে ওঠা

লতাগুল্মের নির্ভরতা 

চুষে নেয় মৃত্যুর দাঁত।

বিকিনির শরীরের রোদ পুড়ে সানবাথ

তেজগাঁও রেললাইনের বস্তিগুলো 

সুশৃঙ্খল সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকে

রোদের অপেক্ষায়।

শিশিরের উপর খালি গায়

ঠকঠক কাঁপে কুয়াশা

রোদ আসবে রোদ।

তোমার ক্ষমতা তোমার ভালোবাসা

যিনি প্রবল প্রতাপন্বিত ও আপন সত্তায় আপনি প্রশংসিত

সূরা ইবরাহীম : আয়াত ২ 

রাত্রিকে বিদীর্ণ করো তুমি রাত্রিকে ভাঙতে ভাঙতে 

নিকষ আলোময় সৌন্দর্যে ফুটে ওঠো আপন মহিমায়

তুমি রাতের বুকে অসীম ভারী পাহাড় পুঁতে তুলে ধরো

মাটির আনন্দ– তুমি প্রবল প্রতাপান্বিত মহান

যে দিকে ঘোরে চোখের দৃষ্টি শূন্যতাও যেন বিশাল

সমুদ্র হয়ে এক একটি নিশানা ওড়ায় বিশ্বের বুকে।

আর সেই সমুদ্রের বুক থেকে উদ্গমিত হয়

এক একটি পরমাণুর পাহাড়

পাহাড়গুলো ক্রমে ক্রমে গ্রহ হতে নক্ষত্র

নক্ষত্রগুলো কী যেন হতে হতে তোমার প্রশংসায় 

লুটে পড়ে আপনাআপনি 

যদিও তার পিছনে

তোমার ছুঁয়ে দেয়া শক্তির অসীম ডানার ঝাপটানি 

তামাম পৃথিবী ওলটপালট করে 

তোমার ক্ষমতা তোমার ভালোবাসা অফুরাণ।

তাহলে প্রশংসা তো তোমারই হবে

তাবৎ বিশ্বের জড় অজড়ের সমস্ত প্রশংসাই

পরমাণু পরিমাণও বাদ যাবে না 

তারাও জড়ো হয় তোমার প্রশংসায়

তুমি মহান প্রশংসাময়

আপন সত্তায় আপনি প্রশংসিত।

তুমি রাত্রি ভাঙো দিন আনো

তুমি পাহাড় চিরে জীবন বীজ ঝর্ণা বহাও

সমুদ্র থেকে খাদ্য জীবিকা। 

তুমি রাত্রির মতো আলোময় দিনের মতো আলোকজ্জ্বল

তোমার ক্ষমতা তোমার ভালোবাসা অফুরান।

চলো নদী দেখি

চলো নদী দেখি

নদীগুলো আমাদের সমুদ্রের কাছে নিয়ে যাবে।

যেদিন সোনালি ভোরে শর্ষের ফুলগুলো তোমাকে

ঢেকে রেখেছিল ফুলরঙে 

তোমার উজ্জ্বলতায় জড়িয়ে ডুবেছিল

ঈষৎ অনুজ্জ্বল চারপাশ 

চলো হেঁটে দেখি শুভ্র বেলাভূমি।

ফুলরঙ ফুলবউ যেন চারদিক ঘুরে ঘুরে নববধুর 

দৃপ্তিময় পদচারণায় মুখরিত করেছিল

আমার হৃদয়ের চারপাশ কী চমৎকার ধূমায়িত

চায়ের আয়েশ জুড়িয়ে ডুবে যাচ্ছে 

ডুবে যাচ্ছে তোমার প্রতিটি আঙ্গিক।

চলো নদী দেখি

নদীতে পানি যেভাবে যায়

সব কিছু চলুক সেভাবে।

চলো নদীর পারদে মেপে নেই চলাচল।

উৎসুক কম্পার্টমেন্ট 

পশ্চিমা লীয় ট্রেনটি দেখলেই গেট ফেলানো লাইনে অপেক্ষার 

বিচ্ছিরি রকম কষ্টকর নিঃশ্বাসগুলো

ট্রেনের বগির ভিতর কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে কেটে যায়।

শহরের ভিতর দিয়ে যান্ত্রিক সাপটি ছুটে যায় প্রতিদিন দিগন্তমুখী গন্তব্যে

আবার ফিরে আসে ঘরে ফেরা বালকের মতো।

এমনিভাবে কখনো কখনো ঝিকঝিক করতে করতে শহরের প্লাটফরমে ট্রেন এসে দাঁড়ালে

আমি ট্রেনের দুলুনীতে ঝিমিয়ে পড়া আলেয়াকে টিকিট নম্বর ধরে খুঁজে বের করে 

খুব সন্তুর্পণে মৃদু স্বরে জাগিয়ে বলি, এসো নামবে।

প্রতিদিন আমাদের শহরের ভিতর দিয়ে ট্রেন আসে যায় শত ট্রেন

যানজট ঘোলা করা দাঁতগুলো বের করে বিদ্রুপের সাথে চোখের সামনে দিয়ে নাচতে নাচতে 

চলে যায় ট্রেনগুলো। রাস্তাগুলোকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে হুইসেল ছাড়া বাদড়ের মতো 

ডানে বামে দেমাগী ভাব দেখিয়ে চলে যাওয়ার খটমট আচরণ

সেসব কি সব সময় ভালো লাগে? শুধু আলেয়ার ফিরে আসার অপেক্ষাটুকুই 

এমন বিশ্রি দেমাগ সহ্য করে যায়। আমি শুধু 

আলেয়ার ট্রেন ভেবে এড়িয়ে যেতে পারি কষ্টকর অপেক্ষা 

যার কোনো মানে আর এখন শহরে থাকার মধ্যে অবশিষ্ট নেই।

আমি বিদ্রুপগুলোকে ভুলে যেতে পারি

আমি তো জানালার পাশে বসা আলেয়াকে দেখতে থাকি

তার ফিরে আসা আর প্রস্থানের সাক্ষী খোলা জানালাগুলোতে 

প্রতিদিনের উৎসুক ভিড় করে থাকে কিছু একটা খুঁজে ফেরা চিনচিন আশা নিয়ে

ট্রেন চলে যায়– আমাদের কথা চলে হৃদয়ে হৃদয়ে

চোখে চোখে। 

আচ্ছা, শহরের ভিতর কেন ট্রেন স্টেশন 

এখানে স্টেশন থাকায় নাগরিক জীবনের কত সমস্যাই না হয়।

পরীক্ষার্থীদের নাক মুখ একাকার করে হলে ঢোকা

চাকরির ইন্টারভিউ উৎকণ্ঠাকে তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি করে তোলা

রোগীর প্রাণবায়ুর সাথে সাথে এম্বুলেন্সের চিৎকার

ডেটিং এর তাড়া এসব নিয়েই তো 

পুঁজিবাদী হারকিপটে সুবিধাভোগীদের শহর আমাদের জীবনের চলমানতা।

ট্রেন তো আলেয়ার আরামদায়ক ভ্রমণের সন্ধি মাত্র।

শহরের বাইরে ট্রেনের প্লাটফরম থাকবে কোলাহল মুক্ত এলাকায়

সেখানে অপেক্ষামান যাত্রীদের ভিড়কে আরো গতিশীল করে তুলবে অভ্যর্থরা 

আর ট্রেনে তুলে দিয়ে বিদায়ের হাত নাড়াতে নাড়াতে ঘরে ফেরা প্রিয়জন 

যেখানে আলেয়ার এক হাতে বইপত্র আর লাগেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা 

অন্য হাতে বুকের ভিতর আমার কবিতার ডাইরি চেপে অপেক্ষা 

চারদিক যাত্রীদের স্বরগোল ছাড়া কিছু থাকবে না।

একটা সাপ কখনো যেন বিদায়ের হাত নাড়তে নাড়তে ছুটে চলে

আমি সাপের পা দেখার মতো কম্পার্টমেন্টের ভিতর প্রশান্তি বা পরিতৃপ্তি যাই বলি না কেন

খুঁজতে থাকি। মেঘের গুঞ্জরিত বেণী বেয়ে কলতানমুখর নদীর প্রতিচ্ছায়া 

মিতালীর ডানায় তুলে নেবে আমাদের দৃষ্টির টান 

তোমাকে দেখা কবিতার মতো। 

রোদের খোঁপা খুলেছে

ডাহুক, ঘুুঘু, দোয়েলের ডাক আকাশে মিলিয়ে যায়

সুর সংগীতের তরঙ্গমালা। চেতনার শিল্পীরা তুলে আনে

সঙ্গোপনের সুখ অনুভবে। ঘুম আসে রাতের চোখে। 

রাত জেগে শুনে যায় পাখিদের সুরকন্ঠ, চাঁদের নেশা ভরা মোহমায়া

রাত ঘুমে থাকে পাথরের মতো

রাত ঘুমে থাকে নদীর মতো

ঠিকানায় নোঙর ফেলে পঙ্ক্তিমালা।

গতরাত মÍে গেছে গতকাল। চিরনিদ্রায় সংগীতের সাথে গেছে

সকালের নেপথ্যে আটকা পড়ে দীর্ঘশ্বাস, জানালার আঁচল জুড়ে

উথলে ওঠে সাদা মেঘ কারুতার মমতা – প্রত্যাশিত ক্রেতাদের বাহারী পণ্য

রোদ নেবে রোদ – প্রভাতের প্রথম মিষ্টিমমতামাখা রোদ থেকে 

সকাল দুপুর বিকালের সুরভি

যেটুকু যেমন ইচ্ছেমতো

কবিতার অনিবার্য শব্দরাশির আশ্চর্য বুননের মতো।

আমাদের গ্রামের বাড়ির রোদ থেকে শহরের বাসস্থানের রোদ

একটু আলাদা। সাইবেরিয়ার রোদে শীতের ঢল নামে

গ্রামের ব্লাউজহীন বাংলার নারীর গায়ে রোদ পোড়ায় আর

হাতাকাটা রমণীর শহুরে শরীরে রোদ পোড়ে

রোদের রূপ আছে, আধুনিক, গ্রাম্য অবলা 

মধ্যবর্তী সরল নদীর মতো বিশুদ্ধ

সন্ধ্যাতারা, গোধূলিরা মিলে বেণীবাঁধে, বেঁধে দেয় খোপার চিত্রালি

আজও গতকালের রাতের মৃত্যুতে রোদের খোঁপা খুলেছে।

নরম বাতাসে রঙের মেদুর

বাউল হবে – হইও না

নগরের শরীরে খুঁটে খুঁটে ঘেটে ঘুটে

দেখে নাও জলজ্যান্ত বাউলের আত্মা।

বাউল হবে –- হইও না

গ্রামীণান্তর দু’চোখ পড়ে থাকে উতলা

জীবনকে দর্শন খোয়াড়ে দেখবে ভেবে।

বাউল হবে

সব কিছু ছেড়ে গেলেই রূপসীর তত্ত্ব তালাশ

এই তো –

হইও না

রাতের শরীরে সূর্যের উত্তাপ আছে

দেখে নিও।

বাউলনগরে গেলেই বাউল হওয়া যায় না

নরম বাতাসে রঙের মেদুর বাউলকে ডাকছে।

নদী বলে তাকে চিনি

আমি নদী নামে এক নদী চিনতাম

লোকমুখে তার কথা শুনে শুনে 

তার কাছে নিজে চলে গেছি ভাবতাম।

বেশকিছু সুখ দুখ কথা জেনে তার

জানা আর বোঝা এক করে মালা গাঁথি

ছোট নয় কিবা বড় খুব বেশি

তাকে নিয়ে যাই ভাবতাম।

নদী চলে নদী জোয়ারের রূপ ধরে

ফুলে ওঠে তার দারুন অহঙ্কার।

নদী তার নাকে পরে নেয় নাকফুল

শাড়ি ঢাকে দেহ

সবুজের সাথে লাল সাদা ছোপছাপ – 

যেতে যেতে নদী পথে ছাড়ে কোমলতা

দেহ থেকে ফসলের বিষ

আজকাল খুব মনে পড়ে তাকে

ভেবে ভেবে তারে ছুঁয়ে দেখি মন বলে

ফুল করে তুলে রাখতাম।

দেখা নেই তার, হৃদয়ের নীড়ে আছে

স্রোতে জাগে স্মৃতি কী দারুণ অবয়বে

গড়ে ওঠে ওই বাগানের ডালিগুলো

বলে যায় তারে ভালোবাসি এখনও

হবে দেখা তার জানতাম।

তাকে যেই দেখি, নাই দেখা হয় যেন

আধো আধো নয় একেবারে ক্ষীণ দেখা

জ্বলে ওঠে সেই না দেখা তৃ া আরো

ছুঁয়ে দিতে চাই, পেয়ে নিতে চাই সব 

নদীর কী রূপ নদীর কি ছলাকলা

আজ শুধু তাই জানতাম।

আজকাল হেলাফেলা, গুণ নয়

রূপই আসল সাথি ভাবা মায়াবীনি –

ভেবে ভেবে তার রূপ বুঝে নেই

কথা শুনে তার গুণ বুঝে নেই

বুঝে নেই তার সঙ্গোপনের ছবি,

ওই ক্ষীণ দেখা বলে দেয় চাঁদ

পাগল হয়েও কিছু দেখে নাই – কবি

নদী বলে যাকে চিনতাম।

পৌঁছে গেছি শুদ্ধতম পথে 

আমি যেদিকে দেখছি বীজফেঁপে  

আশার পূর্ণিমা আলো গোপন রহস্য ঘেরা

ফসলের ঘ্রাণে তীক্ষè হতে হতে কোনো এক স্বপ্নের গভীরে 

নিয়ে যাচ্ছে-

আমি যাচ্ছি-

শিহরিত, বিচলিত কিছুটা আবার 

স্বপ্নদ্রষ্টা কবি হয়ে পিছনে পিছনে

সেই ফসলবিদীর্ণ অপার কাক্সিক্ষত সদ্য জাগা আলেয়ার পিছে

মরুর প্লাবনে ধোয়া শুদ্ধতম মসৃন পথের

বুকে আমার পা রেখে। আমার বিশ্বাস 

আর নিশ্বাসের পৃথিবীকে পূর্বে দেখা 

শরীরী শ্লোগান থেকে নির্ঝর জ্যোতির সাথে।

আমি যাচ্ছি – যেখানে আশ্চার্য দূতিও তোমার ধ্যান ছুঁয়ে 

আমৃত্যু তৃষ্ণার শিশু হতে চায়

একটু স্পর্শের পূত কামনাদিগন্ত পথে 

বায়ু ভাঙা গতি নিয়ে দাম্ভিভ¢ক অহঙ্কারও গলে যায়

মোম ও বরফ গলা সৃষ্টি সুষমার তলে।

আমি অনুভব করি 

আমি এক পরম পুরুষর নির্ভয় হাত ধরে

হাঁটছি হাঁটছি – 

আমি হাঁটতে হাঁটতে মৃত্যুবসত পেরিয়ে

খোলসছাড়া বীজবিদীর্ণ

উম্মোচিত সৃষ্টিরহস্যেও সেদিকেই পৌঁছে গেছি।

সবাই প্রান্তে এসে দাঁড়ায়

এটাই নিয়ম – বাতাসের পাকে ঘুরতে ঘুরতে মানুষ একসময় প্রান্তে এসে দাঁড়ায়

তবু তার নিশ্বাস নেবার সময় নেই। বাতাস তো সময়ের সাথে ব্যস্ততার গতি নিয়ে 

পিছনে ঘুরে দাঁড়াতে জানে না। তাকে সামনের দিকেই অগ্রসর হতে হয়। তাও

মানুষ যদি বোঝে! থমকে দাঁড়ালে তো ভালো না হলে চমকে দাঁড়াতে হবে।

আলো-অন্ধকারের নিমতান্ত্রিক চক্রযানেই তো সে এ পর্যন্ত এসেছে

এখন তার পিছন সে জেনে গেছে যাকে অতীত বলে

এখন এসে যেখানে দাঁড়ালো তার মুহূর্তটুকু সে জানে Ñ এটাই তার বর্তমান। 

সামনের টুকু? 

অসীম! অনন্ত অনন্ত! 

কেউ জানে কেউ জানে না।

কেউ মানে কেউ মানে না

এর মাঝে বেঁচে থাকলে একটুকরা ভবিষ্যৎ আপেলের মতো ঝুলে থাকবে

এটাই বিশ্বাস!

ওহে, ওমর বিশ্বাস! এটাই ভবিষ্যৎ!

কেউ যদি তিনকাল বলতে পারতো 

তাহলে না একজন পরিপূর্ণ অতিমানব হতে পারতো হয়ত

যদি তার সামনে পথ আসে

পদক্ষেপের সুযোগ আসবে কি না সে জানে না।

অতঃপর! 

কেউ জানতে চেষ্টা করে কেউ করে না

সামনের পথগুলো জন্য সে অন্ধ, বোবা, বধির

মুর্খ! মুর্খ! মুর্খ!

তার সে সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই

দুইকালের বা সন্তুষ্টি অর্জন করা হলো কই?

এজামানায় তিনকাল বলে কিছু নেই মরণ ছাড়া 

তাকে আসতে হয়েছে পাহড়ের মতো সময়ের ভিতর দিয়ে

তাকে আসতে হয়েছে উত্তাল সমুদ্রের ভয়ার্ত রূপ আর গর্জনের ভিতর দিয়ে

আসতে হয়েছে কঠিন মরুভূমির ডেরা পেরিয়ে

আসতে আসতে শান্ত কোমল সমুদ্র পেয়েছে যে তাকে চলার পথে প্রেরণা জুগিয়েছে

তার পথে চাঁদ ছিল, জোছনার বাহারী রূপের মনভোলা কোমলতা ছিল

ভয়ংকর ঝড়-ঝঞ্জার বিক্ষুব্ধ বেলা ছিল

একটু আশা ছিল এই পৃথিবীর মায়ার

এর মধ্যেই কেউ ক্লান্ত কেউ ক্লান্তি নিয়ে ছুটবে সামনে তার প্রস্তুতি নিচ্ছে

তাই তো সবমিলিয়ে সবাই আমরা দুইকালে দাঁড়িয়ে।

এর ভিতরে মানুষে মানুষে ভালোবাসা, খুনাখুনি, হিংসা-দ্বেষ, প্রেম

রাগ-অনুরাগ, স্মেহ-মমতা, হানাহানি, হৃদয়ে-হৃদয়ে জানাজানি

আরো আরো সব আকাশের গায়ে সমুদ্র আছড়ে পড়ার মতো জড়িয়ে আছে।

এই নিয়ে মর্তের পান্থরা একসময় প্রান্তে এসে দাঁড়ালো

যেখানে দাঁড়িয়েছে এর থেকে আপাতত গন্তব্য আর কতদূর জানা নেই।

মানুষ ঠিকই একদিন প্রান্তে এসে দাঁড়াবে 

তারপর সব তার সামনে ঝকঝকে রৌদ্রের মতো আলোময় হয়ে উঠবে।

এটাই বিশ্বাস! এটাই বিশ্বাস!

ওহে, ওমর বিশ্বাস! 

ফেরা

শেষমেষ গন্তব্যের ট্রেন ধরতে পারলে খুশি

অবশেষে কোনো এক সময়ের দেহ থেকে বেরিয়েই 

ঘরে ফেরা যাবে। ক্লান্ত দেহের একটু অবসন্ন বিশ্রামের হাত ধরে

বাড়ি দেখা প্রশান্তির আনন্দ জড়িয়ে বোঝা যাবে গন্তব্যের সুখ- 

প্রতিটি স্বপ্নের এক একটা গন্তব্য থাকে

প্রতিটি মানুষ এক একটা লক্ষ্যের অভিমুখী 

আমার নীড়ে ফেরানো তীক্ষè দৃষ্টিতীর রাতে ফেরা ট্রেনের আরামদায়ক  

টায়ারে শরীরটাকে এলিয়ে ভাবছে গন্তব্যের সূর্যোদয় আর গোধূলির রঙের 

আতিথিয়েতার কথা। নানা রংধনু চোখের চাহনি

সবই তো কাক্সিক্ষত কলি ও কাকলির কলতান।

এখনি সময় রক্তস্রোতে উ তার আধার প্লাবনে 

বারবার সর্বহারা ছায়াপথ থেকে বেরিয়ে অপার্থিব গন্ধের 

উপলব্ধিতে নিজেকে জড়ানোর– বিধ্বস্ত তুষারপাতে

অবশেষে নীলিমার পথ ধরে রুপালি জোছনার কথোপকথনের।

শেষমেষ মাস্তুলের দাঁড় আর সাদা পতাকার নিশান উড়িয়ে

সে পথের দিকে দৃষ্টি ছুঁড়ে আমিই তো আত্মনিবেদনে সঁপে দিয়েছি তৃষ্ণাকে।

ঘুরে দাঁড়াবে মানুষ পাখিরা জানে

কতটা কষ্টে ছিল পাখিরা!

কতটা স্বস্তি ফিরে এসেছে প্রাাণিকুলে!

বোঝাই যায় পাখিদের চিকচিকে চোখ দেখে

চোখের ভাষায়। প্রাণিদের শরীরের ভঙিমায়।

মানুষের পদচারণার শূন্যভিড়ে তাদের আনন্দ দেখে 

ঘর থেকে বেরিয়ে বারবার ঘরে ফেরার মধ্যে 

মুক্তডানায় ঘুরেফিরে ফিরে আসা নীড়ের গৃহলতায়

ঘরমুখো উৎসবে। মানুষের সড়কে হেঁটে হেঁটে 

মানুষকে অভিশপ্ততার হাত থেকে বাঁচানোর আকুলতায়। 

তারা কি মানুষকে বোঝানোর জন্য নেমে এসেছে রাজপথে

বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে সড়কে সড়েেক?

তবু তারা শৃঙ্খলিত–

মানুষের প্রতি করুণার দৃষ্টি নিয়ে তাকায়নি!

মানুষ কি শেকলবন্দি ছিল আধুনিকতার নামে?

যে মানুষ তাদের স্বাধীন আকাশকেও কলুষিত করেছিল 

এই তো কিছুদিন আগেও।

মানুষ কি ফিরিয়ে দেবে পাখিদের কাছে পাখিদের আবাস?

মানুষ কি ক্ষমা চাইবে পাখিদের কাছে তাদের ভুলের

মানুষ কি তার সড়ক ছেড়ে দিতে পারবে পাখিদের জন্য

যেভাবে পাখিরা তাদের আকাশ ছেড়েছিল।

না, পাখিরা বাধ্য হয়েছিল আকাশ ছাড়তে।

কই তবু পাখিরা বিদ্রোহ করেনি তো।

আজও পাখিরা পরাজিত মানুষ দেখে বিদ্রæপ করে না।

তাহলে আমরা কি পাখিদের কাছে শিখব?

শিখতে পারি না?

করোনা কি সেই কথাও বলেনি? 

কতটা কষ্টে ছিল পাখিরা?

পাখিদের মতো মাছেরা – মাছেদের জগত

পাখিদের মতো প্রাণিকুল – প্রণিদের জগত।

এই সৌরজগৎ বিভ্রান্ত হয়েছিল মানুষের কাছে – বলো হয়নি?

হ্যাঁ, হয়েছে। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি

বলতে পারি উদয়-অস্তকে একই বিন্দুতে কল্পনা করে

মানুষ নিজেদের ফানুস উড়াতে চেয়েছিল ইচ্ছেমতো পৃথিবীতে পৃথিবীকে নিয়ে।

মানুষ শোনেনি সৃষ্টিকর্তার ধর্ম 

সেই উদয়-অস্তের মালিকের কথা 

যাকে ঈশ্বর ঈশ্বর বলে তুলে রেখেছিল কপালেরও উপর 

মাথারও উপর যাতে চোখ উঁচু করে ওই ঈশ্বর দেখা না লাগে।

ঘুরে দাঁড়াবে মানুষ পাখিরা জানে তবু

হায়! মানুষ বড় অসহায় 

আজ স্বস্তি পাখিদের

মাছেদের

আজ মানুষ বড় বিপদে

প্রাণিকুল তাই বুঝিয়ে গেল।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ