মুসা আল হাফিজ
এটা নতুন করে বলার দরকার নেই যে, ইতিহাসকে বৈজ্ঞানিক আকার দিয়েছেন ইবনে খালদুন। ইতিহাসের মুক্তি তিনি নিশ্চিত করেন ভুল ও স্থুল পরিক্রমা থেকে। ইতিহাসচর্চায় তিনি নতুন দিগন্ত তৈরী করেন। জ্ঞানের উৎস হিসেবে ইতিহাসের স্বীকৃতি, অবস্থান ও কাঠামোকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। তার সময় অবধি মানুষের ইহলৌকিক বিদ্যায় ইন্দ্রিয় ও প্রজ্ঞাকে দুটি উতস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হতো। কিন্তু ইবনে খালদুন এখানে যোগ করেন তৃতীয় এক উতস; ইতিহাস।
এটা ইবনে খালদুনের দাবিমাত্র ছিলো না। এর পথ ও প্রক্রিয়াকে তিনি প্রামাণ্য ও প্রজ্ঞাপুর্ণ সম্পন্নতা দেন। জ্ঞানতত্ত্বের ইতিহাসে এ ছিলো এমন এক ঘটনা, যার গর্ভে নিহিত ছিলো বহু বিপ্লব। ইতিহাসকে তিনি ব্যক্তি, বংশ, ধর্ম বা কালের পরিপ্রেক্ষিতে সীমায়িত না রেখে সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করেন। এটা করেন তখনও, যখন তিনি বর্ণনা করছেন বার্বার বা বিশেষ রাজবংশের ইতিবৃত্ত।
ইবনে খালদুনের তত্ত্বীয় বিনির্মাণে ভেঙে গেলো পুরনো কাঠামো। অবশ্য এই নির্মাণের পথ তৈরী হচ্ছিলো আগ থেকেই। ইবনে খালদুনের চিন্তার বিকাশে আত-তাবারি (৮৩৩-৯২৩ খ্রি.) ও আল মাসউদী (মৃ. ৯৫৭ খ্রি.) , ইবনে মিশকাওয়াহ (৯৩২-১০৩০) ও ফখরুদ্দীন রাযীর (১১৪৯-১২০৯) প্রভাব ছিল প্রচুর । কিন্তু আত্মীকরণের মাধ্যমে একে পরিগঠিত করে সম্পূর্ণ নিজের সৃষ্টিসামর্থ্যে উদ্ভাসিত করে সম্পন্নতা দানের কৃতিত্ব ইবনে খালদুনেরই। তার তত্ত্বের মর্মে নিহিত ছিলো নতুন জগত ও মানবজ্ঞানের প্রস্তাব। তবে এর নানামুখী ফলাফল সামনে আসতে লেগেছে দীর্ঘতর সময়।
ইবনে খালদুনের মুকাদ্দিমার অভিঘাতে ইতিহাস এমন এক জায়গায় চলে গেলো , যেখানে যে কেউ ইতিহাস লিখলেই তা আর ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে না। যে কোনো তথ্য উপস্থাপন করলেই তাকে ইতিহাস বলা যাচ্ছে না। বরং ইতিহাস লিখতে হবে পদ্ধতিগতভাবে। এমন পদ্ধতি, যা যুক্তি, বস্তুগত বাস্তবতা ও যথার্থতার উপর প্রতিষ্ঠিত।
একগুচ্ছ ঘটনা ও সন-তারিখের জটলার নাম ইতিহাস নয়।বরং ইতিহাসের প্রধান উপজীব্য হলো প্রকৃতি ও সমাজ, ভূমি ও ভাবনা, আবহাওয়া ও মানসগঠন, ব্যক্তি ও রাষ্ট্র, মর্ম ও কর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং সমাজ ও প্রকৃতির পরিবর্তনের গতিধারা। যার সাথে যুক্ত আছে চিন্তার আবর্তন, প্রাকৃতিক গতিশীলতা ও জীবনযাত্রার বিবর্তন, বৃক্ষ, বাতাস, পশু, পরিবেশ ও মানুষের সামাজিকতার জীবনী; কৌমবোধ ও কৌমচর্চার অধ্যয়ন।
রাষ্ট্র তৈরী করে মানুষ। সমাজও মানুষের তৈরী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সমাজ তৈরীর প্রক্রিয়া আর রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া সব সময় এক নয়। রাষ্ট্র সাধারণত সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের অভ্যুত্থানের ফসল। ফলে ইতিহাস শুধু রাষ্ট্রকে অধ্যয়ন করে না। যারা রাষ্ট্র তৈরী করলো, শাসন করলো , তারা যেমন ইতিহাসের আলোয় থাকবে, তেমনি থাকবে সকল মানুষের মুখের বলি দাগ। সকল ভাঙাচুরা চেহারা, সুসজ্জিত চেহারা কিংবা আবছা আড়ালে হারাতে থাকা চেহারা হাজির থাকবে ইতিহাসের চিত্রপটে। প্রত্যেকেই পাবে আপন গুরুত্ব। প্রত্যেকের জীবিকা, জ্ঞানচর্চা, মননের ভাষা ও ভাষ্য, পেশা ও জীবনযাত্রার রূপ ও রঙ আর আবেগ -অনুভূতি ও শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ বইতে থাকবে ইতিহাসের স্রোতে। সকল শ্রেণীর গঠন ও ক্ষয়, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনকে অধ্যয়ন করবে ইতিহাস।
ফলে ইতিহাস আর রাজ-রাজড়াদের শাসন-প্রশাসন আর কর্মকাণ্ডের দহলিজ থাকছে না, কেবল বীরপুরুষদের গাঁথাকাব্য হয়ে যাচ্ছে না, বরং ইবনে খালদুনের হাত দিয়ে তা হয়ে যাচ্ছে বৈজ্ঞানিক অন্তর্দৃষ্টির এমন এক প্রকল্প, যা ব্যাপকতর অভিজ্ঞতা ও ব্যবহারিক বৃদ্ধির অধিকতরো পরিপক্বতাকে চিত্রায়িত করে। যা কেবল জীবন কাহিনী বলে না, জীবনের স্বরূপকেও খনন করে। যা কেবল কালের ঘটনাপঞ্জী হাজির করে না, বরং কালের সার, সুর ও স্বভাবকে উদঘাটনের মৌল ধারণা ও গভীরতর উপলদ্ধিকেও অধ্যয়ন করে।
ইতিহাস এমন রূপময়ী, যাকে সকলেই নিজের বউ বানাতে চায়। পরাজিত যেমন চায়, তেমনি চায় বিজয়ী জন। হত্যাকারী যেমন চায়, তেমনি চায় নিহতও। মানুষ মরে যাবার পরেও ইতিহাসের উপর নিজের দাবি ত্যাগ করতে রাজি হয় না। সকল জাতির দৃষ্টিতে ইতিহাস হোক একান্ত তার। প্রত্যেকেই যদি ইতিহাসকে একান্তভাবেই নিজের বানাতে চায়, তাহলে তো ইতিহাস শত রকমের হয়ে যাবে। মানে ইতিহাস হয়ে যাবে প্রত্যেকের বর্তমান স্বার্থের দৃষ্টি দিয়ে দেখা অতীত, আজ ও আগামী কালের সুবিধার হাত দিয়ে রচিত গতকাল । তাহলে এই রচিত বিবরণে জাতী ও সম্প্রদায় সমূহের স্বার্থ ও সুবিধার দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে, কিন্তু সত্যমূল্য কতটা থাকবে?
ইবনে খালদুন চান, ইতিহাসকে তার সত্যমূল্যের উপর দাঁড় করাতে। যাতে আরোপিত মিথ্যার হাত ও দাঁত থেকে তার মুক্তি ঘটে, উত্তরণ নিশ্চিত হয়। কাজটা সহজ নয় মোটেও। প্রত্যেক ক্ষমতাবানরা ইতিহাসে নিজের মহিমামণ্ডিত ছবি আঁকতে চায়, সেখানে তাদের যতটুকু কলঙ্ক আছে, ততটুকু কলঙ্কিত পোর্ট্রেট অঙ্কণ করতে হবে সত্যের প্রয়োজনে। কিন্তু তা তো মোটেও সহজ জিনিশ নয়। ইবনে খালদুন একে সহজ করতে চান। কীভাবে তা হবে? ইতিহাসের নিজস্ব শক্তি দিয়ে। কীভাবে নিশ্চিত হবে সেই শক্তি? ইবনে খালদুন দেখান ইতিহাসের মর্মমূলে সেই শক্তি নিহিত আছে। তাকে ঢেকে রাখে কতিপয় দোষ ও দূষণ। বস্তুনিষ্টতার নির্দয় অপারেশনেই সেই দোষ ও দূষণের অপনোদন ঘটবে।
বস্তুনিষ্ঠতাকে ইতিহাসের প্রকৃত লেখক বানাবার জন্য ইবনে খালদুন ইতিহাসের দুই মুখদর্শন করেন। এক মুখ জাহেরী, আরেক মুখ বাতেনী। জাহেরী রূপটা মূলত চর্চিত হচ্ছিলো ইসলামপূর্ব অতীতে। জাহেরী ইতিহাস রাষ্ট্রের কাজ-কর্ম, সরকারের স্তুতি, উন্নয়নের রাজভাষ্য ইত্যাদি বাখান করে। সে অতীতের গল্প শোনায়; রাজার গল্প, রাজ্যের গল্প, যোদ্ধার গল্প, যুদ্ধের গল্প, জয়ের গল্প, কাউকে দেয় অবিরল প্রশংসা , কারো জন্য বরাদ্ধ রাখে নিন্দা; চরিত্রহনন, শাসকদের বংশ,পরিবার, তাদের জীবন ও রাজকেন্দ্র ইত্যাদি ঘুরে-ফিরে হাজির হয় জাহেরী ইতিহাসে, প্রচারমাধ্যম কাজ করে, সাজানো ভাষ্য বিস্তার করে সংখ্যা ও সালের হাত ধরে। জাহেরী ইতিহাসকে শাসন করে কল্পনা ও সরকারী ন্যারেটিভ।
এখানে গরহাজির থেকে যায় লোকায়ত জীবন, ঘটনার পেছনের ঘটনা, সম্ভাব্য কারণ ও প্রেক্ষিত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা ও অনুঘটক সমূহ, ভৌগলিক , পরিবশেজাত, অর্থনৈতিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক আবর্তনের ভেতর-বাহির এবং ধর্মীয় ও চিন্তানৈতিক ক্রিয়া ও প্রক্রিয়া সমূহ। ক্ষমতাসীনরা যে মানুষের প্রান্তে ফেলে রাখে , জাহেরী ইতিহাস তাদের দেখতে পায় না। সমাজের জীবনযাত্রা যে সব প্রসঙ্গ , অনুষঙ্গ, ভাব ও স্বাভাবের মধ্য দিয়ে গতিমান, তার ক্রমপ্রবাহকে উপেক্ষা করে জাহেরী ইতিহাস। এখানে সবই ঘটে রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে। রাষ্ট্র হয়ে উঠে সরকার। সরকার হয়ে উঠে ব্যক্তি।
ইবনে খালদুন প্রস্তাব করেন বাতেনী ইতিহাস। প্রকল্প হাজির করেন এর। এটি হচ্ছে সামগ্রিক ইতিহাস। যা মানবকর্ম ও ইতিহাসের অন্তর্নিহিত সত্যসন্ধান করবে। জীবনকে যতকিছু প্রভাবিত করে, তার সমগ্রকে নিয়ে আলোকপাত করবে। ইতিহাসকে ইবনে খালদুন দর্শনের মৌলিক এক শাখায় পরিণত করেন এবং ইতিহাস দর্শনের গোড়াপত্তন করেন।সমাজতত্ত্বের পাঠ পরিক্রমার শুরুতে তিনি হাজির করেন নৃতাত্তিক বিশ্লেষণের প্রজ্ঞা, যা আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
প্রাণী ও জগতের উদ্ভব থেকে শুরু করে মানব সমাজের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, সভ্যতার সৃষ্টি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ তিনি হাজির করেন প্রথমবার। কাজটি করেন নিজেরই উদ্ভাবিত অবিকল্প শাস্ত্রীয় পদ্ধতিতে । ইবনে খালদুনের আগে -পরে যদিও আল ইজির (মৃ. ১৩৮২ খ্রি.)তুহফা , আল-কাফিজির (মৃ. ১৪৭৪ খ্রি.) আল মুখতাসার ফিল ইলম ও আস সাখাবির (১৪২৮-১৪৯৭) আল-ইলান গ্রন্থ এ ধারায় কিছু ঝলক প্রদর্শন করেছে, তবুও ইবনে খালদুনের হাত ধরেই তা প্রকৃত ও পদ্ধতিগত বিকাশ লাভ করে।
তার মতে ইতিহাস শুধু ঘটনার সমষ্টি নয় বরং তা এমন এক বিজ্ঞান, যা নিয়ে বহুমুখী ও বহুস্তরী গবেষণা জরুরী । তিনি ইতিহাস বিশ্লেষণ প্রয়োগ করেছেন সমাজতত্ত্বে। তার ইতিহাস লিখন ও পঠন প্রক্রিয়া সমাজবিজ্ঞানকে উপহার দেয় স্বরূপ তত্ত্ব(Phenomenology),নব-নির্মাণ(Deconstruction) প্রক্রিয়া। যা জ্ঞান ও শাস্ত্রচর্চার ইতিহাসকে বদলে দিয়েছে গভীরভাবে । শাস্ত্র চর্চাকে শিখিয়েছে নব নব শাস্ত্র সৃষ্টির এ্যালগরিদম।
ইতিহাস রচনা, বিশ্লেষণ ও পুনর্গঠনের জন্য তিনি আবিষ্কার করেন নতুন পদ্ধতি । এই পদ্ধতি এমন সব মৌলিক তত্ত্ব দ্বারা কাঠমোবদ্ধ, যা পরবর্তীতে সামাজিক বিজ্ঞানের স্থাপনা গড়ে দিয়েছে। ইবনে খালদুন জানতেন তার অন্তর্দৃষ্টি বিশ্বের জ্ঞানকাণ্ডে নতুন শেকড় ও ডালপালা যুক্ত করবে। তার ডিসিপ্লিনে নতুন ভিত্তির খোঁজ পাওয়া যাবে এবং এর বিষয়বস্তু আগ্রহের নতুন দরোজা উন্মোচন করবে, এ ঘোষণা তিনি দিয়েছিলেন।
ইবনে খালদুনের পথ, পাথেয় ও গন্তব্য ছিলো সুস্পষ্ট। পথ ছিলো যে কোনো কালের যে কোনো সমাজকে বিশ্লেষণ। পাথেয় ছিলো সমাজের অবস্থা, বৈশিষ্ট্য, সময়ে সময়ে যেসব ঘটনা বা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং যেসব অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার প্রশ্নই উঠে না- এই তিনিটি অবস্থাকে আলাদাভাবে নীরিক্ষণ করা , তার মধ্যে আন্ত:সংযোগ পরীক্ষা করা , তাতে নিহিত সম্ভাবনা ও বিবেচনা সমূহকে বাস্তবতার নীতিতে পরখ করার বৈজ্ঞানিক ক্রমধারা। যে ধারায় অবর্তমান বস্তু, বিষয় বা ঘটনাকে বর্তমান বিষয়ের মতোই ময়নাতদন্ত করা সম্ভব।
এক্ষেত্রে অনুমান নির্ভর ধারণার পেছনে হাঁটতে রাজি ছিলেন না তিনি। বরং পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে তিনি গুরুত্ব দেন। ঘটনা প্রবাহের বিশ্লেষণ তার চোখ গড়ে দেয়, যে চোখ দিয়ে তিনি যে কোনো কালের ব্যক্তিমানুষ ও সম্মিলিত মানুষকে অধ্যয়ন করেন । ইবনে খালদুনের সেই চোখ এতো তীব্র ও তেজিয়ান, যেন মনে হবে আজকের ঘটনাকেও তিনি দেখছেন , বিচার করছেন এবং সমস্যার সুরাহা প্রস্তাব করছেন।
বাস্তবসম্মত বিচারক্ষমতা তার মধ্যে অনন্য বিভুতি লাভ করে । এরই ভিত্তিতে গড়ে উঠে তার পদ্ধতিসমূহ। যদিও তিনি আশা প্রকাশ করেন , পরবর্তীরা এসে যেন একে পূর্ণতা দেন। পরবর্তীদের তার কাছে আসতে কয়েক শতাব্দী লেগে যায়। তার কাজকে এগিয়ে নেবার জন্য প্রতিটি মহাদেশ নিজেদের শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের একটি অংশে নিবেদন করেছে। তবে সবচেয়ে বেশি নিবেদন করেছে ইউরোপ। মেকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭), মন্টেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫), জিয়ামবাতিস্তা ভিকো (১৬৬৮-১৭৪৪)এডওয়ার্ড গিবন ( ১৭৩৭ – ১৭৯৪) এডাম স্মিথ (১৭২৩-১৭৯০)পিয়েরে জুসেফ প্রুঁধো (১৭৫০-১৮৫০) অগাস্ট ক্যোঁৎ (১৭৯৮-১৮৫৭) অটোকার লরেঞ্জ (১৮৩২-১৯০৪)ফ্রিডরিখ হেগেল (১৭৭০-১৮৩১)চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২)আর্থার ডি গোবিনিউ (১৮১৬-১৮৮২) কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩),হার্বার্ট স্পেন্সার (১৮২০-১৯০৩) এডওয়ার্ড বার্নেট টাইলর (১৮৩২-১৯১৭) এমিল দুরখায়েম (১৮৫৮-১৯১৭) আর্নল্ড টয়েনবি(১৮৮৯-১৯৭৫)সহ অসংখ্য শিক্ষার্থী লাভ করেন ইবনে খালদুন। যারা ইবনে খালদুনের খোদা ও দ্বীনকে বাদ দিয়ে তার বিচারিক প্রকল্পকে যার যার মতো করে কাজে লাগিয়েছেন।
সমাজ ও সভ্যতার উদ্ভব, বিকাশ ও প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন প্রজ্ঞা হাজির করেন ইবনে খালদুন । এই দুর্গম পথে তার গন্তব্য ছিলো সুস্পষ্ট। তিনি চেয়েছিলেন যা যেমন, তাকে তেমনই দেখার দৃষ্টি ও ক্ষমতা সরবরাহ, রূপ থেকে স্বরূপে যাওয়া, বাহির থেকে অন্তরালে প্রবেশ , বিষয়কে ধরে বিষয়ীকে ধরা এবং সহজাত নীতির নিখিলে মানুষের অতীত ঘটনাচক্রের সত্য-স্বরূপ আবিষ্কার করে বর্তমানের সাথে তার সংযোগসূত্র সুস্পষ্ট করা। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের বিনির্মাণ। এই বিপুল বিশাল কর্ম সম্পাদনে জরুরী হলো বাতেনী ইতিহাস চর্চা ও সমাজ অধ্যয়ন।
বাতেনী ইতিহাস চর্চা এবং সমাজ অধ্যয়নে ইবনে খালদুন ছয়টি কেন্দ্রীয় কর্মনীতি পেশ করেন। সেগুলো হচ্ছে , (১) নজর ; থিউরি, তত্ত্বীয় দৃষ্টি, ভাবনার শৃঙ্খলা। এর মধ্য দিয়ে তত্ত্বীয় অবয়ব গঠন, পুনর্গঠন, পঠন, পুনর্পঠন । এই প্রক্রিয়ায় তত্ত্বীয় উন্নয়ন, নবসৃষ্টি ও জ্ঞানসৃষ্টি। ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত নানা বিষয় ও বাস্তবতাকে বিচারে এনে অতীত-বর্তমানের ঘটনার মূল্যায়ন করা। ইতিহাসকে শুধু পাঠ বা রচনা নয়, বরং পর্যালোচনা করা।
(২) তাহকিক: যাচাই ও সত্যউদঘাটনমূলক ভাবনা ও জ্ঞানকর্ম। সত্য ও বাস্তবতায় উপনীত হবার জন্য ক্রিটিক্যাল থিংকিং । কোনো কিছু পড়ে বা শুনে প্রামাণ্য অনুসন্ধান করে তারপর গ্রহণ করা। ব্যাপারটিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করা। বাস্তব অনুসন্ধান, অভিজ্ঞতাবাদী বিচার, জ্ঞানের বিভিন্ন দিকের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে মর্মবস্তু ও সত্যমূল্য অনুসন্ধান করতে হবে। এর নজির ইবনে খালদুনের রচনাকর্মে বিস্তর।
(৩) তালিল বা কারণ ও ফলাফল বিচার। যা প্রতিটি বিষয়ে– কেন?– সমূহের জবাব দেয়। কারণ ও ফলাফলের মিল ও অমিল বিশ্লেষণ করে । প্রতিটি বিষয় ও ঘটনার ডিজাইনের মধ্যে কারণ ও ফলাফল নিহিত রয়েছে। আবার প্রতিটি ঘটনা ও বিষয়ের কারণ ও ফলাফলের মধ্যে তার ডিজাইনের যোগসূত্র রয়েছে। ফলে কোনো বিষয়, চিন্তা বা ঘটনাকে মূলীভূত সমস্ত কারণ সহকারে দেখলেই তাকে বুঝার প্রথম ধাপ পার হওয়া যাবে। শেষ ধাপটা হলো তার সব রকমের ফলাফল ও পরিণতি বিশ্লেষণ করা। এই প্রক্রিয়া যতো সামগ্রিক ও নিখুঁত হবে, একটি বিষয়ের সত্যচিত্র ততো পরিষ্কার হবে।
(৪) মাবাদিয়ে দাকিক: সূক্ষ্ম , সূক্ষ্মাতিসূক্ষ ও অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ নীতিমালা। যা কারণ ও ফলাফলকে মেলাবার নীতি বাতলে দেবে । বিশ্লেষণকে পথ দেখাবে। প্রয়োজনীয় সূত্র সৃষ্টি করবে। তত্ত্বের শাখা-প্রশাখার নবায়ন ও বিস্তারণ ঘটাবে। সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে শেখাবে এবং পদ্ধতির আভ্যন্তরীণ কাঠামোকে এমন বহুবিস্তারী বানাবে, যা যে কোনো ঘটনাকেই আতশকাচে হাজির করতে সক্ষম।
(৫) ইলমুল কাইফিয়াহ : প্রকরণগত জ্ঞান, শৈলী ও পদ্ধতিভিত্তিক বিজ্ঞান। ইবনে খালদুন এই জ্ঞানের পরিচয়ে লিখেছেন ইলমুন বিকাইফিয়াতিল ওয়াক্য়; যা মূলত অন্তর্নিহিত সারবস্তু, বাস্তবতা, রহস্য ও মূলতত্ত্বকে অবগত করে। সে কারণ সমূহের জানান দেয়।
(৬) আসবাবে আমীক : গভরতর কাযকারণ। এই গভীরতা এক স্থরী , এক মর্মী বা এক ধর্মী নয়। এতে রয়েছে কারণের কারণ, কারণের মৌলিক কারণ, শাখাগত কারণ, এমন কারণ, যা অন্য কারণের মধ্যস্ততায় কারণ হয়েছে, নিকট, মধ্যম ও দূরবর্তী কারণ, স্থায়ী কারণ, অস্থায়ী কারণ, ইচ্ছুক কারণ, অনিচ্ছুক কিংবা ইচ্ছেশূন্য কারণ, সূক্ষ্ম কারণ ইত্যাদি। এসব কারণও বহু শাস্ত্রে, বহু শাখায় , বহু স্থানে, বহু সময়ে বিস্তৃত থাকতে পারে। এগুলোকে বিবেচনা ও বিচারের বাইরে রেখে কোনো ঘটনা বা ইতিহাসের সঠিকতা অধ্যয়ন করা যাবে না, ইতিহাসের সত্যস্পর্শ বা সত্য উদ্ধার করা যাবে না।
ইবনে খালদুনের এই প্রকল্প আজকের দিনের জ্বলন্ত ঐতিহাসিক বিতর্কেরও মীমাংশা হাজির করতে প্রস্তুত। হোক সেই ঘটনা আমেরিকার, তুরস্কের, চীনের কিংবা বাংলাদেশের। এখানে ইতিহাসের নামে রচিত রাশি রাশি গ্রন্থের স্তূপ হাজির থাকলে খালদুনিয় অন্তর্দৃষ্টি তার হাকিকত সম্পর্কে রায় দিয়ে দেবে। বলে দেবে এই সব ইতিহাস চর্চা জাহেরী ধারার না বাতেনী ধারার। এই সব ইতিহাস চর্চা ইতিহাসের সত্যসন্ধানের কোন কোন শর্তকে লঙ্ঘন করেছে , কোন কোন সূত্রের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করেনি।
এখানে ইতিহাসকাররা কেমনতরো ভুল করেছেন এবং কেন ভুল করেছেন। ঘটনাটি যে কালেই হোক, বখতিয়ার খিলজির ঘটনা, কিংবা পলাশী বা অন্ধকূপের ঘটনা, অথবা ১৯৪৮ এর ঘটনা এখানে বিচারিক কাঠামোর সুনির্দৃষ্ট নীতির আওতায় বিশ্লেষিত হবে। এতে বাতেনী রূপটাই প্রাধান্য লাভ করবে। কারণ ইবনে খালদুনের মতে, বাতেনি ইতিহাস জাহেরি ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বেশি প্রবল, বেশি বিস্তৃত ও শক্তিশালী। সে অতীতের ঘটনাবলীর স্বরূপ উন্মোচনে কাজ শুরু করবে। যে কোনো ঘটনা কিংবা বিষয়কে ‘কিভাবে'(How) ও ‘কেন'(Why) দ্বারা প্রশ্ন করে তার মূলের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে নিজস্ব নিয়মে। সব ধরণের কারণ ও উপাদানকে সে মূল্য দেবে। কাউকে এখানে প্রাপ্যের অধিক মূল্য দেওয়া চলবে না। প্রাপ্যের কম মূল্য দিলেও মুশকিল।
অধিবিদ্যায় এরিস্টটল কথিত উপাদানগত কারণ , আকারগত কারণ, কার্যকরী কারণ এবং উদ্দেশ্যমূলক কারণ যেমন বিশ্লেষিত হয়, তেমনি ইবনে খালদুন ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বে নিজস্ব বিশ্লেষন প্রক্রিয়ায় সব ধরণের কারণকে গুরুত্ব দিতে বলেন, যার যার প্রাপ্য মনোযোগ দিতে বলেন। তবে এরিস্টটলের বিশ্লেষণ ভাবের জিনিশ, তা ধারণাপ্রধান, ইবনে খালদুনের বিশ্লেষণ বাস্তব জগতের জিনিশ এবং তা পরীক্ষাপ্রধান। বস্তুত বিশ্লেষণকে তিনি গ্রীক ধারণার শাসন থেকে মুক্তি দিয়ে বাস্তব পরীক্ষার জগতে নবজন্ম দান করেন।
এখানে নানা মুখী তথ্য-উপাত্ত , বিস্তর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নিয়ে এগুতে হয়। ।কান্ডজ্ঞান ও গভীর অন্তর্দৃষ্টিকে কাজে লাগিয়ে মিথ্যা বিবরণের কুহক, রক্তচক্ষু ও মায়াজাল থেকে সুরক্ষা পেতে হয়।মিথ্যাকে সনাক্ত করতে হয়। সত্যের সাথে মিশ্রিত মিথ্যাকেও আলাদা করতে হয়। ইতিহাসের যে কোনো শাখায় ইতিহাসের নামে প্রচলিত বহু ব্যক্ত, বহুশ্রুত যে কোনো জঞ্জালকে সাফ করতে হয়।
একটি সুস্থির সত্যে উপনীত হবার যথাযথ ও বিশ্বাসযোগ্য ভাষ্য নিশ্চি করতে হয়। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তাই ইবনে খালদুন চ্যালেঞ্জ করেন বহু উদ্বৃত, বহু ব্যক্ত বহু রটনাকে। এক রটনার দাবি হলো ইবরাহীম আ. ৭০ হাত লম্বা ছিলেন। ইবনে খালদুন লিখেন, আমি বায়তুল মাকদিসে গিয়েছি বহুবার। ইবরাহীম আ. এর কবর দেখেছি বারবার। তার কবর তো এতো লম্বা নয়!
বহু ব্যক্ত বহু শ্রুত একটা রটনা হলো উজ ইবনে উনুক খুবই লম্বা ছিলেন। তিনি মাছ ধরে উপরের দিকে তুলে রাখতেন। সূর্যের তাপে তা সিদ্ধ হয়ে যেতো। ইবনে খালদুন সৌরবিদ্যার সত্য দিয়ে একে খারিজ করলেন। কারণ তাপ মাটির সাথে যুক্ত। কেউ যতো উপরে যাবে, ততোই মুখোমুখি হবে শীতলতার।
ইবনে খালদুনের আগে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও শক্তিমান ঐতিহাসিক ছিলেন মাসউদী। ইবনে খালদুন তার কাছে ঋণী। ইবনে খালদুন তার ঋণ স্বীকার করেছেন, তার শ্রদ্ধাভাজন কর্তৃত্বকে বরেণ্যতা দিয়েছেন। কিন্তু তার ভুলকে কবুল করেননি। আরো বহু ঐতিহাসিকের মতো মাসউদী দিয়েছেন হযরত মুসা আ. ও ফেরাউনের লশকরের বিবরণ। সেখানে দেখানো হয়েছে উভয়ের পক্ষে মোট সৈন্য ছিলো ছয় লক্ষ। ইবনে খালদুনের আগে শত শত গ্রন্থে তা রচিত হয়েছে। কিন্তু ইবনে খালদুন তার ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে প্রশ্ন করলেন- কীভাবে তা সম্ভব? লাখ লাখ সৈন্যের গল্প যতোই বিখ্যাত হোক, কিন্তু তার সম্ভাব্যতার প্রশ্নের ন্যায্যতা কে অস্বীকার করবে? ইবনে খালদুন এভাবে প্রশ্ন করতে শেখান। সমাধানের পথও বাতলে দেন।
তিনি এজন্য বিচারে আনেন তখনকার সামাজিক বাস্তবতা, ফেরাউন ও মুসা আ. এর সময়কার জনসংখ্যার চিত্র, সেখানকার জনপদ সমূহের অবস্থা , তখনকার ভৌগলিক ও সামরিক বাস্তবতা ইত্যাদি। সমস্ত কিছু বিচার করে দেখা যায় এই সৈন্য সংখ্যা কোনোভাবেই সঠিক নয়, বাস্তব নয়।
ইবনে খালদুন এভাবে ইতিহাস থেকে কল্পনারস ও কর্তৃত্বের অন্ধ অনুকরণকে খেদাতে থাকেন। তিনি তাবারি, ওয়াকেদি, মাসউদীসহ বহু মুফাসসির , সীরাতকার ও ঐতিহাসিকের ভ্রান্তির এক্সরেরিপোর্ট হাজির করেন। কিন্তু এর চেয়ে বড় কথা হলো, কীভাবে পরবর্তীতে যে কোনো ঐতিহাসিক প্রসঙ্গে কাজটি করা যাবে, তার রূপকল্পও আমাদের হাতে তুলে দেন।
ফলে ইবনে খালদুন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিতর্ক সমূহকেও মোকবেলা করেন। ধরা যাক তার সামনে হাজির করা হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভাষ্য সমূহ। বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ভাষ্যসমূহ, ভারতীয়, আমেরিকান, রুশ চীনা বা পাকিস্তানী ভাষ্য সমূহ। দেখা যাবে এগুলো পরস্পর থেকে কত আলাদা। কিন্তু কেন? ইবনে খালদুন এখানে প্রয়োগ করবেন জাহেরী ইতিহাস রচনা ও বিকৃতির সূত্রসমূহ। এতো সব ভাষ্যের মধ্যে সঠিকতা কোথায়? ইবনে খালদুন একজন বাংলাদেশী বা বাঙালি জাতীয়তাবাদী হয়ে কথা বলবেন না। তিনি এখানে প্রয়োগ করবেন বাতেনী ইতিহাস বিচারের সূত্রসমূহ।
এই সূত্র সমূহ বলে দেয় , কোথায় ভুল বলা হচ্ছে, কেন বলা হচ্ছে, কীভাবে বলা হচ্ছে? তিনি দেখবেন-
(ক) ইতিহাস রচনায় লেখক কোনো ঝোঁকপ্রবণা বা পক্ষপাত দ্বারা পীড়িত কি না ?
(খ) তিনি আপন আদর্শ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা চালিত ও শাসিত হয়ে ইতিহাস লিখছেন নাকি ঐতিহাসিকের নির্মোহ অবস্থান থেকে লিখছেন?
(গ) পূর্ববর্তী লেখক ও বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন? কারো প্রতি অন্ধ বিশ্বাস আছে কি না? সেটা থাকলে তিনি দৃষ্টিশক্তিহীনের মতো তার বা তাদের আনুগত্য করবেন।
(ঘ) ঘটনা সমূহ যারা যেভাবে লিখেছেন, তাদের রচনা ও ন্যারেটিভ কোন উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত? কোনো লক্ষ্যের লাগাম কি ছিলো তার কলমে ? কোন উদ্দেশ্য চালিত করেছে তার রচনা বিস্তার ও উপসংহারকে? তার রচনা থেকে এর কী কী লক্ষণ ধরা পড়ে? যিনি ইতিহাস লিখছেন, তিনি পূর্ববর্তী বিবরণদাতাদের এসব বিষয় যাচাই করেন কি না, এসব বিষয়ে তিনি উদাসীন না সচেতন?
(ঙ) যিনি ইতিহাস লিখছেন, তিনি অতীতের ঘটনার সাথে বর্তমানের দৃশ্যপট ও সমগোত্রীয় বিষয়কে মিলিয়ে দেখতে সক্ষম কি না? তিনি অবর্তমানের সাথে বর্তমানের যোগসূত্র সন্ধানে কতটা পক্ষপাতী আর কতটা সত্যসন্ধানী? কতটা নির্মোহ ও দক্ষ আর কতটা প্রোপাগান্ডিস্ট ও আরোপী?
(চ) যিনি ইতিহাস লিখলেন, তিনি কি পূর্বানুমান দ্বারা পীড়িত? চালিত? প্রভাবিত? এসব অনুমানের ছায়ায় বসে তিনি ইতিহাস লিখছেন , না ঐতিহাসিকের দায় ও নিষ্ঠা তাকে পূর্বানুমান থেকে নিরপেক্ষতা দিয়েছে?
(ছ) যিনি ইতিহাস লিখছেন, তিনি কি ক্ষমতাসীন শক্তির মোসাহেবী করেন? তাদের থেকে সুবিধা কামনা করেন? তাদের নৈকট্য লাভ ও বৃদ্ধির জন্য তিনি কি স্তুতিবৃদ্ধি করে ঘটনার বিবরণকে অতিরঞ্জিত করেন?
(জ) ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন জ্ঞান ও শাস্ত্রের সাথে তার যোগাযোগ কোন রকমের? তিনি কি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাথে যুক্ত অন্যান্য জ্ঞান ও শাস্ত্রের সহায়তা নিয়ে সত্য উন্মোচনের পথে হাটতে পারেন? তার প্রাজ্ঞতা কি তাকে বিচারিক দক্ষতা সর্বরাহ করে? তিনি কি ঘটনার সাথে পূর্ববর্তী ঘটনার যোগসূত্র সন্ধানে সক্ষম? বিভিন্ন সংস্কৃতি, নানা সভ্যতা ও রীতি-নীতি, ভৌগলিক অবস্থা ও বিশ্বাস,মূল্যবোধ, ভাষা, প্রথা , সমসাময়িক বাস্তবতা, রাজনীতি, অর্থনীতি, মূল্যবোধ , বিবিধ পক্ষ-প্রতিপক্ষ, স্বার্থ-প্রতিস্বার্থ, মতবাদ-প্রতিমতবাদ ইত্যাদির সক্রিয় ভূমিকা ও মাত্রা সমূহ সম্পর্কে তিনি কি জ্ঞানীয়ভাবে সচেতন? তিনি কি এসব বিষয়ে ফাক ও ফাকি সমূহ ধরতে সক্ষম? ইতিহাসের বিবরণীতে মিথ্যার অনুপ্রবেশের আশঙ্কাজনক দিক সমূহের সাথে তিনি কি দায়িত্বশীল আচরণ করেন?
(ঝ) যিনি ইতিহাস লিখছেন, তিনি কি নির্ভরযোগ্য লেখক বা বর্ণনাকারীর অনুকারিতায় আবদ্ধ? নাকি তিনি বক্তব্যসমূহের বস্তুনিষ্ঠতাকে তলিয়ে দেখেন?
ইবনে খালদুনের প্রকল্প ও মূল্যমান সমূহের নিক্তিতে বাংলাদেশের ইতিহাসের পুনর্পঠন, পুনর্গঠন কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।