spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যবিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ

লিখেছেন : আল মাহমুদ

বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ

আল মাহমুদ 

আমার বিবেচনায় বর্তমান সময়টা হলো দেশ থেকে নানা কারণে ছড়িয়ে পড়া প্রবাসী লেখকদের লেখার সময়। এরা বাংলা ভাষার আশাজাগানিয়া সাম্প্রতিক লেখকগোষ্ঠী। এদের মধ্যে কবির সংখ্যাই অধিক। আমার জানা মতে আমাদের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ লেখক দেশের বাইরেই অবস্থান করছেন। তাদের মধ্য আমার বন্ধু শহীদ কাদরী নিস্ক্রীয় হলেও সাহিত্যগতপ্রাণ। নাম উল্লেখ করতে গেলে অনেকের নামই বলা যায়। কিন্তু যেহেতু আমি ভেবেছি আমি এমন একজন লেখকের ওপর লিখব যার কবিতা, প্রবন্ধ, ভ্রমণবৃত্তান্ত, আন্তর্জাতিক চাকরি সব মিলিয়ে একটা মোহ সৃষ্টিকারী মানুষ। তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়েছে এটা তার কোনো উপকারে লাগবে কিনা আমি জানি না কিন্তু আমি নিজেকে তার দ্বারা উপকৃত মনে করি। এর আগেও আমি তার ওপর লিখতে চেষ্টা করেছি। তার নাম কাজী জহিরুল ইসলাম। তিনি জাতিসংঘের একটি ভ্রাম্যমাণ পদে অধিষ্ঠিত আছেন। তার বর্তমান আবাস আইভরিকোস্টের আবিদজান শহরে। জায়গাটা সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা ছিল না। কবি জহিরুল ইসলাম আমাকে সেই ধারণা দিয়েছেন।

বাইবেলে (ওল্ড টেস্টামেন্ট) সিটিম কাঠের কথা উলেখ আছে। আমরা এখন যে কাঠকে এবনি কাঠ বলে উলেখ করি, খুব সম্ভব এটাই অতীতের সেই সিটিম কাঠ। সেই সিটিম কাঠের  স্বর্গখ্যাত পশ্চিম আফ্রিকায় অবস্থানকারী এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি কবি কাজী জহিরের আলোচনা করতে গিয়ে আমাকে দুটি বিষয় সামনে রেখে এগোতে হবে। এক হলো তার আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও জাতিসংঘের চাকরি আর দুই হলো জহিরের কবিতা। শুধুই কবিতা আর কিছু নয়। আমার দৃঢ় ধারণা জহির যদি কবি না হতেন তাহলে তার পক্ষে সে যে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত সেটা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারতেন না। হয় কবিতা জহিরকে বাঁচিয়েছে কিংবা বলা যায় মানুষের মধ্যে যে কবিতার উৎসমূল স্বপ্নে, জাগরণে উৎসারিত থাকে সেটাই জহিরকে বাঁচিয়েছে। আমি বহু প্রবাসী লেখকের সাথে সম্পর্কিত। মাতৃভূমির সাথে যোগাযোগ রাখার যে ব্যাকুলতা সেটা কবি না হলে সম্ভবপর হয় না। জহিরকে আমি ভালোবাসি। তার হাতে যে কবিতা খুলছে সেটা বাংলাভাষার সর্বশেষ আধুনিক স্তর। এই স্তর পুরোটাই সৃষ্টি করেছেন প্রবাসী কবিকুল। শামসুর রাহমানের মৃত্যুর পর আমার বিবেচনায় আমাদের কবিতার মৌলিক সূত্রগুলো ক্রমাগত বাইরে সরে যাচ্ছে।। না তা ঢাকায় বসতি করতে পারছে, না কোলকাতায়। আমরা কি করতে পারি যদি নিউইয়র্কে, প্যারিসে, লন্ডনে কিংবা জহির যেখানে থাকে সেই আইভরিকোস্টে পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে বাংলা কবিতা? বাংলা কবিতার দেশজতা নিয়ে অহংকার করে কোনো লাভ নেই। কারণ আমার জীবনকালেই আমি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিতারুণ্যকে প্রবাসে দেখতে পাচ্ছি।

অমিয় চক্রবর্তী যেখানেই থাকুন সবসময় দেশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। দেশে তার একটি কবিতা তার বন্ধু বুদ্ধদেব বসু ছেপে বের করে দিলে তিনি ভারি খুশি হতেন। বলতেন, মেলাবেন তিনি মেলাবেন, পুরো বাড়িটার এই ভাঙা দরোজাটার…কিন্তু প্রকৃত মেলানোর কাজটা এখন সাধিত হচ্ছে অত্যন্ত রহস্যজনক নিয়মের মধ্যে প্রবাসে। কবিত্বশক্তির সবগুলো লক্ষণ নিয়ে এই কবি, আমার বন্ধু কাজী জহিরুল ইসলাম কয়েকদিনের জন্য আইভরিকোস্ট থেকে ঢাকায় এসে নিশ্বাস ফেলছেন। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচা কিংবা ভাবটা এমন, দেখুন না মাহমুদ ভাই, আমি ঢাকায় এসেছি। এই যে ভ্রমণবিলাসী বিচরণশীল কবিত্বশক্তি, এটাই হলো আমার কালের বা বয়সের একেবারে শেষদিকের বিবর্তন। ঢাকায় কেউ লিখতে পারছে না, এজন্য বাংলা কবিতা তো আর হাত গুটিয়ে বসে নেই। লেখা হচ্ছে আইভরিকোস্টে, লন্ডনে, প্যারিসে, নিউইয়র্কে। কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করছে না। তারা নিজের ভাষাকে দিগ্বিজয়ী করে চলেছেন, এজন্য আমার মতো বৃদ্ধের কি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত নয়?

জহিরের কবিতা আমার ভালো লাগে এ কথা আমি আগেও বলতে চেয়েছি। শুধু বলিনি, তার ওপর প্রবন্ধ লিখে তা আমার প্রবন্ধের বই ‘কবির সৃজন বেদনা’-তে অন্তর্ভুক্ত করেছি। কাজী জহির বাংলা ভাষার সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রবাসী কবিত্বশক্তি। তার কবিতা তারুণ্যকে পথ দেখায় এবং আমার মতো বৃদ্ধকে বিস্মিত করে। আমি অবশ্য আমার সাম্প্রতিক চিন্তায় চিত্রকল্পকেই কবিতা বলে কিংবা কবিতার প্রধান কাজ বলে ঘোষণা করেছি। কেউ কেউ এর জন্য আমাকে একটু খোটাও দিতে চেষ্টা করেছেন। বলেছেন অন্ধের এ ছাড়া উপায় কী? আমি বাংলা কবিতার স্বার্থেই এই খোটা হজম করে নিতে চাই। একই সাথে কাজী জহিরের চিত্রকল্পের অভিনবত্ব নিয়ে আমার বিস্ময়বোধ কবিতা প্রেমিকদের জানাতে চাই।

এবার জহিরের সাথে আমার বিস্তারিত সাহিত্য আলোচনা সম্ভব হয়নি। সে হঠাৎ ঢাকায় এসে সম্ভবত তার পরিবার পরিজন নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটিয়েছে। তবু যেটুকু কথাবার্তা হয়েছে, তাতে আমার উপলব্ধি হয়েছে যে এই বিচরণশীল কবি প্রতিভা মুহূর্তের জন্য থেমে নেই। সে ক্রমাগত পৃথিবীর আলোকোজ্জ্বল শহর থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে আইভরিকোস্টের দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন চাকরির অবকাশে তৈরি করছে চিত্রকল্প।

ভোরবেলা অরেঞ্জ টিপে বের করি সকাল

ফ্রিজটা হা করে শ্বাস ছাড়ে, শীতল প্রবাস

স্পিনাচের কাছে দুপুরটা জমা রেখে বের হই

উইকডে’র গিয়ার বদলাই অভ্যাসের হাতে

ড্যাশবোর্ডে তিনটা ডেডলাইন, দুইটা মিটিং

গোটা পাঁচেক রিপোর্ট,

ভালোই কাটছে আবিদজান।

(হঠাৎ কবিতা-৭, কাব্যগ্রন্থ: দ্বিতীয়বার অন্ধ হওয়ার আগে)

এখন তো আকাশের স্ট্রিটে হাঁটে ডিজিটাল নারদ

ইথারের অভেনে সেদ্ধ হয় বাতাসের ডিম

রাত্রির বাগানে ফোটে ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাস

অন্ধকারের ফরাশ বিছিয়ে বসেন ই-পীর

রুপোর তাবিজে আবেগের মোম লাগানো সারারাত

দুধ ভরা ওলান ঝুলিয়ে হাঁটে বরফের গাই

মুখ দেয় সেল্যুলার ঘাসে

কষ্টের টু ব্রাশে দাঁত মেজে স্নেহের ঝাপটা দিই চোখে-মুখে

সারাদিন পার করি স্বপ্নের জামায় বোতাম লাগাতে লাগাতে

(আকাশের স্ট্রিটে হাঁটে ডিজিটাল নারদ,

কাব্যগ্রন্থ : আকাশের স্ট্রিটে হাঁটে ডিজিটাল নারদ)

আসলে এটা কি কবিতা? এটা প্রকৃতি বর্ণনা? নাকি এক কবির অন্তর নিংড়ে নেওয়া একটি পৃথিবীর চিত্র, যা এ সময়ের হয়েও চিরকালের। এই কবিতা বিচারের জন্য বাংলাদেশে সম্ভবত এই মুহূর্তে আমি ছাড়া কেউ নেই। হয়তো বা বাংলা ভাষায়ই আর কেউ নেই। আমি এই বিচরণশীল বাঙালি কবি কাজী জহিরুল ইসলামকে তার কাজ পরিশ্রমের সাথে ও অন্তর্দৃষ্টির উপলব্ধি মিশিয়ে আরো বিস্তৃত করতে অনুরোধ করতে পারি। মনে রাখতে হবে কবিকে উপদেশ দেওয়া অনুচিত কাজ। এজন্য অনুরোধ শব্দটি সাহসের সাথে ব্যবহার করলাম। আমার আনন্দ হলো আমাদের দেশের তারুণ্য যেমন কেবল নারী শরীরের মধ্যেই সমস্ত বিস্ময় জমা করে নিজের চারদিকে দেয়াল তুলে দিয়েছে কাজী জহির তা করেননি। তার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো এই পৃথিবী। পৃথিবীর জন্য কাজ করা এবং কবিতা লেখা এই দুটোই এক সঙ্গে কাজী জহির করে চলেছেন। তিনি কোথায় পৌঁছবেন তা আমার মতো বৃদ্ধের পক্ষে আন্দাজ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমি ভবিষ্যত বক্তাও নই। তবে যেখানে ঢাকায় বসে তরুণদের কবিতা পাঠ করে আশা-নিরাশার এক অনিশ্চিত অবস্থায় কাল কাটাচ্ছিলাম সেখানে কাজী জহিরুল ইসলাম মুহূর্তের মধ্যেই আমাকে জানিয়ে দিলেন কবিতা কোনো পারদর্শিতার ব্যাপার নয়। এর জন্য জন্ম থেকেই কিছু একটা স্বপ্ন নিয়ে জন্মাতে হয়। জহিরের স্বপ্ন শেষরাতের, ভোরের স্বপ্নের মতো সদ্য স্বপ্ন।  পৃথিবীর প্রতি গভীর মমতা না থাকলে কাজী জহিরের সাম্প্রতিক কবিতার মতো কোনো কিছু রচনা করা যায় না। একসময় আমি বলতাম, একজন কবির একটা দেশ থাকতে হবে। কিন্তু জহির আমাকে বুঝিয়ে দিলেন যে একজন কবির যদি দেশ শেষ পর্যন্ত না-ই থাকে তাহলে সে শুধু কবিতার মধ্যেই বাঁচতে পারে। আমি কাজী জহিরের এই বাঁচাকে সার্থক বাঁচা বলে বিবেচনা করি।

বাংলাদেশের অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত এই শ্রম বিক্রির একটা প্রতিযোগিতা আমাদের জাতির মধ্যে প্রতিনিয়তই ব্যাকুলতা সৃষ্টি করছে। অনেকেই ঘর-বাড়ি ভিটে-মাটি বিক্রি করে দেশ দেশান্তরে অর্থ উপার্জনে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। তারা যোগ করছে বাংলা ভাষার নতুন কলরব। নতুন শব্দ। এবং এইসব শব্দ ও কলধ্বনি আমাদের কবিরা দেশে থেকে কবিতায় নিষিক্ত করতে পারছেন না। কিন্তু  কাজী জহিরুল ইসলাম চিরনির্বাসিত কবি ব্যক্তিত্ব।  তার দ্বারাই সম্ভব পৃথিবীর শ্রমবিনিময়ের ভাষা সঠিকভাবে অনুভব করে তার ভেতরকার মূল্যবান শব্দরাজি নিজের কবিতার অন্তরে সংযোজন করা। আমি এটাকে জহিরুল ইসলামের সৌভাগ্যের সূচক বলে ধারণা করি। আজ থেকে ৫০ বছর পরে বাঙালি কবিকুল কি ধরনের কবিতা সৃষ্টি করবেন তা হয়তো এই মুহূর্তে আন্দাজ করা আমার সাধ্যের বাইরে কিন্তু কাজী জহিরুল ইসলামের মতো বিশ্ব আবর্তনকারী কবি সেটাও হয়তো আন্দাজ করতে পারেন। আর আমরা পারি অপেক্ষা করতে।

ত্রিশের দশকের কবিরা পশ্চিমের কয়েকটি জানালামাত্র আমাদের কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সামগ্রিক অর্থে পশ্চিমকে হৃদয়ে ধারণ করার মতো কোনো বড় কাজ তারা করতে এগুননি। এ কথাটা কাজী জহিরুল ইসলামদের মনে রাখা উচিত বলে মনে করি। কবি যদি অনেক কিছু দেখেন তবে তা কয়েকটি চিত্রকল্প এবং শব্দে ইঙ্গিতময়ভাবে তার পাঠকদের জানিয়ে দেওয়া খুব দুরূহ কাজ নয়। সমস্ত দেখার অভিজ্ঞতাকে নিজের জাতির মধ্যে সঞ্চার করতে হলে কাজী জহিরুল ইসলামদের ভেবে দেখতে হবে সেটার পদ্ধতি কি হওয়া উচিত।

জাতিসংঘের নিয়োগ পেয়ে কাজী জহিরুল ইসলাম সস্ত্রীক জাতিগত বিরোধে ক্ষতবিক্ষত যুগোস্লাভিয়ার কসোভোতে অবস্থান করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই সময়টাকে তিনি লিখতে চেষ্টা করেছিলেন। না জেনে লেখা নয়, জেনে সত্য আবিষ্কার করার মতো দৃঢ়চিত্ত লেখা। তিনি কবির মতো কাজ করেছেন। এই ধরনের কাজকে কবিত্বের কলমবাজবৃত্তি বলা যায়।

রাখাল যুবক খোঁজে নড়ে ওঠা রোদের উৎস

স্কার্টের গভীরে ফেলে শিপটর দৃষ্টি

কত বন, নার্সিসের সুবাস

কত পাহাড়, ঝরনার কলকল

কত নদী, বহমান সময় পেরিয়ে অবশেষে খুঁজে পায় সে রৌদ্রের উৎস

এর পরের গল্পটা খুব কষ্টের

… … … …

হোক না এক টুকরো

তবুতো রোদ, আগুনের সহোদর

ওকে কি লুকোনো যায়

ইলের সমাজে এ যে ঘোর অন্যায়

জাতিভেদ নেই বুঝি তোর মূর্খ  রাখাল

বুঝি ভুলে গেছিস এরি মধ্যে

কী নির্মম দাহে জল্লাদ রৌদ্রের তেজ

পুড়িয়েছে তোর স্বজাতির সম্ভ্রম

আমাদের কচি ঘাস, সবুজ ফসলের মাঠ

শিপনঈয়ার ডানার পালক

… … … …

সেই থেকে বলকানে আগুন, যুদ্ধ ও রক্তের খেলা

ঘরে ঘরে প্রেম ও ঘৃণার যুদ্ধ

যুদ্ধ ভাষা ও শব্দের

যুদ্ধ মসজিদ ও গির্জার

যুদ্ধ সম্ভ্রম ও মর্যাদার

দখলের যুদ্ধ, যুদ্ধ বাঁচা-মরার, প্রেম ও ভালোবাসার

স্বাধীকার ও স্বাধীনতটার

যুদ্ধ এখন তাহাদের জীবনের অনুষঙ্গ

সবচেয়ে নিকট আত্মীয়।

(লাল স্কার্ট, কাব্যগ্রন্থ : পাঁচতলা বাড়ির সিঁড়িপথ)

তিনি আবিষ্কার করেছেন, দেখেছেন এবং লিখেছেন যা বাংলা কবিতায় স্বাভাবিকভাবে নতুন অভিজ্ঞতা। কবি যে পরিবেশে থাকেন সেখানেই শব্দচিন্তা তাকে লেখার প্রেরণা যোগায়। কাজী জহিরুল ইসলাম এই প্রেরণায় দীর্ঘকাল পর্যন্ত উদ্বুদ্ধ ছিলেন। কাজী জহিরুল ইসলামের কবিমানস আমাদের দেশের সাধারণ পাঠকদের কাছে অচেনা আগুন্তুকের মতো। সৌন্দর্যের ঘাত-প্রতিঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়কে আমরা কবিহৃদয় বলি। আমি সৌন্দর্য বলতে মানুষের সুন্দরের ধারণাকেই বোঝাতে চাই। কবি জহিরুল ইসলাম তার বিচরণবাদী কবিতায় আমাদের কাব্যধারণাকে ঈষৎ পরিবর্তিত করে দিন এটা আমার কাম্য এবং একই সাথে প্রশংসারও কারণ। অগ্রজ কবিরা কাউকেই প্রশংসা করেননি এই দুর্নাম নিয়ে অনেক বড় কবি আমাদের পরিবেশ থেকে অন্তর্হিত হয়ে গেছেন। আমি এই ভুল করতে চাই না। আমি সব সময় প্রশংসা করতে চেষ্টা করি। বৃক্ষের কোমল চারাগাছ আকাশের দিকে পাতা মেলে দিয়ে যেমন বৃষ্টি প্রার্থনা করে তেমনি প্রতিটি ভাষার তরুণ কবিকুল তাদের প্রতিভার ডালপালা মেলবার আগেই অগ্রজদের দিকে তাকিয়ে প্রশংসার সামান্য বারিবিন্দু প্রত্যাশা করে। সাহিত্যে কৃপণতার চেয়ে পাপ আর কিছু নেই। যোগ্যকে, প্রতিভাবানকে প্রশংসা বা স্বীকৃতি না দেওয়ার চেয়ে কপোন স্বভাব আর কিছু হতে পারে না।

আমি কাজী জহিরুল ইসলামের চির ভ্রাম্যমাণ কবি স্বভাবের প্রশংসা করি। একজন কবি কি করতে পারেন যদি তিনি তার জীবনের মূল্যবান সময় দেশে বিদেশে পেশাগত কারণে অবস্থান করতে বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকেন? কাজী জহিরুল ইসলাম কবিতা লিখে তার নিজের দেশের সাথে একটা সংযোগ স্থাপনের নিরন্তর প্রয়াশ চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি এই প্রয়াসের মূল্য দিতে চাই। বাংলা কবিতার একটা অংশ প্রবাসী কবিদের হাতে স্ফূর্তি  পাচ্ছে। এটাকে আধুনিক কবিতার সৌভাগ্যই বলতে হবে। মাঝে মাঝে কাজী জহিরুল ইসলাম দেশে ফিরে এলে তিনি তার কবিতার ভাণ্ডার আমাকে উজাড় করে শোনান। আমি লক্ষ করেছি তার কবিতায় কোনো ধার করা বিষয় নেই। তিনি যেসব দেশে ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় থাকেন সেসব দেশের নিসর্গচিত্র, মানুষ এবং সামাজিক অবস্থার বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এটা আমাকে মুগ্ধ করে। কাজী জহিরের শক্তি হলো তার ভাষাকে সব কিছু বর্ণনা করার মতো করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। সম্প্রতি তিনি তার কিছু কবিতা আমাকে পাঠ করে শুনিয়েছেন যা চিন্তার দিক দিয়ে এক আন্তর্জাতিক পরিকল্পনার প্রান্ত ছুঁয়ে খেই খুঁজে ফিরেছে। এই ধরনের কবিতা আমাদের তরুণ কবিদের পক্ষে লেখা সম্ভবপর নয়, কারণ চির ভ্রমণশীল জীবন সম্বন্ধে তারা অবহিত নন। কাজী জহিরুল ইসলাম বর্তমানে আফ্রিকার আইভরিকোস্টে জাতিসংঘের একজন আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। চেষ্টা করছেন যেখানে আছেন সেখানকার মানুষজনের এবং প্রকৃতির সঙ্গে একটা সম্বন্ধসূত্র তৈরি করতে। এই তৈরি করার আগ্রহটা প্রকৃতপক্ষে কাজী জহিরের কবিতার একটা বিশেষ দিক। বাংলা কবিতা নানান দিক থেকে সমৃদ্ধ হোক এটা একজন বয়োজ্যেষ্ঠ কবি হিসাবে আমার একান্ত কামনা। কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা বাংলা কবিতার এই অভাব বা চাহিদা পূরণে আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন মহিমা দিবে।

এখানে একটি কথা বলে রাখতে হবে কাজী জহির ভ্রমণবিলাসী মানুষ কিন্তু বাংলাদেশের ও পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য আন্দোলন স্বতস্ফূর্ত  আবর্তনের মধ্যে ক্রমাগত দিক বদল করে চলেছে। এই আবর্তনটি জহিরুলকে সবসময় সজাগ রাখবে এটা ভাবা যায় না। আমার একান্ত ইচ্ছা জহিরুল ইসলাম দেশের এই কবিতার দিক পরিবর্তনের মুহূতর্গুলো অধ্যয়নের চেষ্টা করবেন। তাহলেই তার কাজ, তার বিচরণ ও কবি হিসাবে কাব্যসৃষ্টির প্রয়াসের মধ্যে সাযুজ্য স্থাপিত হবে। এমন যদি হয় যে ঢাকায় ও কলকাতায় বাংলা কবিতার স্বতঃস্ফুর্ত দুটি ধারা সৃষ্টি হয়েছে অথচ বিচরণশীল মানুষ হিসেবে কাজী জহিরুল ইসলাম সাহিত্যের এইসব উৎক্ষেত ও প্রেরণাকে আত্মস্থ করতে পারছেন না তাহলে তার উদ্যম স্বাভাবিক হিসাবে গণ্য হতে নাও পারে। আমি অবশ্য ওই ধরনের আশঙ্কা মনে স্থান দিই না।

জহিরের কাজ যেহেতু কেবলি কবিতার অনুসন্ধান সে কারণে স্থান-কালের একটা মহিমা তাকে মেনে নিতেই হবে। তিনি পৃথিবীর যে স্থানে অবস্থান করুন সব সময় জানতে হবে ঢাকায় ও কলকাতায় কারা লিখছে, কি ধরনের লিখছে এবং তাদের লেখার গুণে বাংলা কবিতার সাবেক আঙ্গিক ভেঙে পড়ছে কি-না? তিরিশের কবিতার প্রশ্রয় ও প্রভাব এখন আর বাংলা কবিতার অঙ্গে কোনো চুমকি বসাতে পারছে না। কারণ জগৎ বদলে যাচ্ছে। এটা একজন চিরভ্রাম্যমাণ কবি যদি বুঝতে না পারেন তাহলে কে বুঝবে? আমি জহিরুল ইসলামকে তার সাথে আমার সর্বশেষ সাক্ষাতের সময় তা বলেছি। আমার মনে হয় তিনি এ ব্যাপারে সচেতন আছেন। কাজী জহিরের মর্মমূলে এখনো পুরোনো দিনের প্রেমের কাতরানি আমি শুনতে পাই। প্রেমেরও দিক বদল হওয়া দরকার। প্রেমরহস্য পৃথিবীর সব কবিতার একটি প্রধান বিষয় কিন্তু  আমরা এই উপমহাদেশের মানুষেরা ‘ইশক’ বলে এক ধরনের অবস্থার কথা বিবেচনা করে থাকি। আমাদের কবিতায় এর কিছু বিচ্ছুরণ আছে। কাজী জহির এই বিষয়টিকে বিবেচনা করে দেখতে পারেন। যেহেতু কাজী  জহিরুল ইসলাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিচরণ করে মানুষের শারীরিক মাধুর্যের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ কিন্তু মানুষের হৃদয় হলো সব সময় একটি আন্তর্জাতিক ব্যাপার। এই হৃদয়বৃত্তি নিয়ে একজন বিচরণশীল কবি কবিতায় কি তরঙ্গ তোলেন তা আমার খুব জানতে আগ্রহ হয়। আমার বিশ্বাস কাজী সাহেব আমাদের সেই আকাঙ্ক্ষা মেটাতে পারবেন। কথা হলো বাংলা কবিতাকে আধুনিক করে তোলার দায়িত্ব খানিকটা হলেও কাজী জহিরের মতো ভ্রমণবিলাসী কবিদের ওপর বর্তায়। যারা দেশের বাইরে থাকেন তাদের মধ্যে কাজী জহিরুল ইসলামের সম্ভাবনা ও সুযোগ সব চাইতে বেশি ও একটু বৈচিত্র্যপূর্ণ। কারণ তিনি জাতিসংঘের কর্মকর্তা হিসাবে একটি মূল্যবান পাসপোর্ট  বহন করেন এবং একটি দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। এতে তার সুযোগ ও সম্ভাবনা অনেক প্রসারিত হয়েছে। অনেকেই তো বাইরে থাকেন কিন্তু কাজী জহিরুল ইসলাম প্রবাসে থেকেও কাব্যচর্চা করেন এবং তার কবিতায় প্রবাসের অনেক বিচিত্র ঘটনা এসে উপমা উৎপ্রেক্ষারূপে কবিতাকে সাহায্য করে। সবচেয়ে বড় কথা হলো কাজী জহিরুল ইসলাম আমার কালের আন্তর্জাতিক বিচরণশীল কবি হিসাবে সর্বাধিক সক্রিয় লেখক। তিনি কবিতাই লেখেন না ভ্রমণবিলাসী মানুষ হিসাবে তার অভিজ্ঞতার পূর্ণ  বিবরণ দিয়ে ভ্রমণকাহিনি রচনা করে চলেছেন। আমি অগ্রজ লেখক হিসেবে কাজী জহিরুল ইসলামে প্রতিটি লেখার মূল্যায়ন করতে আগ্রহী। আমার ধারণা কাজী জহিরুল ইসলাম এই সময়ের সবচেয়ে বিচরণশীল আধুনিক কবি। তার ওপর একটি বিস্তারিত আলোচনা একান্ত দরকার। আমার দ্বারা এই মুহূর্তে সেটা সম্ভবপর হচ্ছে না কিন্তু আমি আশা করি ঢাকা ও কলকাতার বাংলা কবিতার চর্চাকারীরা বিষয়টা বিবেচনা করে দেখবেন। তবে সাধ্যে কুলালে কাজী জহিরুল ইসলামের সাক্ষাতে তার বিষয়ে আরো জেনে নিয়ে একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনার ইচ্ছে আমার আছে।

[রচনাকাল ২০০৭। গুলশান, ঢাকা।]

আরও পড়তে পারেন

4 COMMENTS

    • অনেক ধন্যবাদ ভাই। ভালোবাসা জানবেন।

  1. কবি আল মাহমুদ কী আন্তরিক এবং উদার! অনুজ কবির প্রতি এমন মায়াভরা কিন্তু গভীর আলোচনা আজকাল বিরল। কবি কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতার অনন্যতা, বিশ্বময়তা এবং উদীয়মান কাব্যধারার অগ্রভাগে থেকে বাংলাকে অগ্রসর করে নেয়ার ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস প্রস্ফুটিত হয়েছে অগ্রজ কবি সম্রাট আল মাহমুদের এই লেখায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ