আবদুল হালীম খাঁ
কবি ওমর বিশ্বাসের কাব্যগ্রন্থ ‘নৈঃশব্দের দ্যুতি’ ২০১৬ এর একুশে বই মেলাতে প্রকাশিত হয়েছে। তিন ফর্মার কাব্যটিতে রয়েছে সাতটি সনেট একটি রুবাইয়াতসহ মোট উনচল্লিশটি কবিতা। কবির প্রথম কাব্য নারী পুরুষ মৃত্তিকা প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় নীল জোছনার মায়া। আর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ উৎসুক কম্পার্টমেন্ট প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। এ ছাড়াও রয়েছে তাঁর কয়েকটি ছড়া গ্রন্থ। তাঁর ছড়া ছন্দবদ্ধ এবং অন্তমিলে পূর্ণ। গদ্য রচনার ক্ষেত্রেও কবি ওমর বিশ্বাস যথেষ্ট দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন ইতোমধ্যে।
উল্লেখিত কাব্যগ্রন্থের কবিতা থেকে সুষ্পষ্টভাবে বুঝা যায় ওমর বিশ্বাস পৃথক এবং স্বতন্ত্র এক কাব্যভাষা নিয়ে কাব্যাঙ্গনে উপস্থিত হয়েছেন। তাঁর শব্দ চয়ন, বাক্য নির্মাণ কৌশল ও উপমায় সর্বত্রই বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা পাঠকদের সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর কবিতার প্রতিটি শব্দ বলাকার নিঃশব্দ পাখা সঞ্চালনের কোমল উষ্ণতায় অসীম দিগন্তের দিকে উড়ে যেতে দেখা যায় এবং সেই সঙ্গে মুগ্ধ পাঠকদেরও টেনে নিয়ে যেতে চায়। কোনো কবির জন্যে এটা খুবই সুসংবাদ নেই।
নৈঃশব্দের দ্যুতি’র প্রথম ‘তুমিই অধরা’ চমৎকার নিটোল একটি সনেট। আজকাল অনেক কবিই নানাভাবে সনেট লিখছেন। ওমর বিশ্বাসের এ সনেটের ছন্দমিল করা হয়েছে এভাবে: ক খ খ ক, গ ঘ ঘ গ, ঙ চ চ ঙ এবং ছ ছ রীতিতে।
‘তুমিই অধরা’ সনেটের প্রথম বাক্যটি ‘আকাশের রূপ আজ শুভ্রতায় ভরা’। শুভ্রতা নির্মল ও পবিত্রতার প্রতীক। আকাশ আজ শুভ্রতায় ভরা হলো কি কারণে আগে কিছুই বলা হয়নি। কিন্তু সম্পূর্ণ সনেটটি পাঠ করলে বুঝতে আর কারো বাকী থাকে না, কার কারণে আকাশ ও প্রকৃতির রাজ্যে এমন একটা পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, কার আগমনে মেঘলা গুমোট বর্ষা পেরিয়ে এসেছে, নীলে কাশফুলে মিশে খুশিতে মেতেছে। আর তার রূপে-উজ্জ্বলতায় ‘ফেরানো যায় না চোখ,’ সে কে? তুমিই অধরা।
কবির এই অধরা প্রিয়ার আগমনে প্রকৃতি রাজ্যের আরো পরিবর্তন ঘটেছে:
রৌদ্রের উষ্ণতা নেই সাদা চিত্ত দোলে
প্রলুব্ধ সকাল আসে পেলবতা সুরে
তুলে আনে শরতের দীপ্ত দেহ জুড়ে
তুমি দোলো কাশফুলে আকাশের কোলে।
এ জন্যেই কবির ‘তুমি’ অধরা হয়ে রয়েছে। এই ‘তুমি’কে ধরার চেয়ে অধরা থাকাটাই কবির জন্য ভালো হয়েছে। খুবই ভালো হয়েছে। অধরাকে নিয়ে ভাবতে পারছেন, ছবি আঁকতে পারছেন, স্বপ্ন দেখতে পারছেন, কবিতা লিখতে পারছেন, কল্পনায় হৃদয় ভুবনে সতত অম্লান আসন পেতে বসে আছে। কবিদের নাকি এমনি অধরা কেউ থাকে। কবি ওমর বিশ্বাস সেই ‘তুমিই অধরা’ এর ঘোষণা দিয়েছেন:
শরতের মেঘনীল স্বর্গ থেকে আসা
তুমি বোঝ তাই ধন্য, তুমি ভালোবাসা।
সনেটটিতে কবি একাই তাঁর মনোবীণা বাজিয়ে জাননি, পাঠক মনেও তার সুর ঝংকার তুলতে সক্ষম হয়েছেন, এখানেই তার সার্থকতা।
‘বারো ভূঁইয়া’ নামে দুটি সনেট এবং বাংলার বারো ভূঁইয়াদের নেতা শৌর্য বীর্যের বীরত্ব ও গর্বের প্রতীক ঈশা খাঁকে নিয়ে দুটি, শহীদের গান এবং পথিক মোট ছয়টি সনেটও এতে স্থান পেয়েছে। ঈশা খাঁ সম্পর্কে বলা হয়েছে:
আজো এগারসিন্দুর সাক্ষী এখনো সোনারগাঁও
কথা বলে রাজধানী কাত্রাবোয় বীর ঈসা খাঁ-ও।
(ঈসা খাঁ, পৃষ্ঠা – ১০)
ঈসা খাঁ মরেনি আজো মরেছে দুর্বল ভীরু যত
ঈসা খাঁ মরেনি কেন – করেনি কখনো মাথা নত।
(ঈসা খাঁ, পৃষ্ঠা – ১১)
প্রকৃত কবিতার ভেতর মানব মনের অসংখ্য অমীমাংসিত প্রশ্নের বীজ সুপ্ত থাকে। এ জন্যই কবিতায় ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছকে হতে হয় প্রাঞ্জল, হৃদয়গ্রাহী। কবিতায় প্রতিস্থাপিত শব্দগুচ্ছ সহজ সরল হওয়াই উত্তম। কবির মাত্রাচেতনা থাকা উচিত, ছন্দ জ্ঞান ছাড়া কবিতা লেখা অসম্ভব। কেবল গুনে গুনে সমান সংখ্যক মাত্রার অন্তমিল সর্বস্ব পঙক্তি হলেই কবিতা হয় না, তার জন্য চাই সামঞ্জস্যপূর্ণ দ্যুতিময় শব্দ-সম্ভার। কবির ছন্দ মাত্রাচেতনা কবিতাকে পাঠ্যপযোগী করে তোলে সহজে। সৎ কবিতা সহজ সরল সাবলিল হওয়ার পরও থাকে রহস্যময়। এ রহস্যময়তা ওমর বিশ্বাসের কবিতায়ও রয়েছে। এ ধরনের কবিতার সম্ভাব্য দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে, এর একটি খুব সাধারণ অর্থ, কবিতা পাঠান্তে পাঠকের মনে একটি সাধারণ দৃশ্যকল্প ভেসে উঠবে যা সাধারণ পাঠকও অনুভব করতে পারবে, পারবে নিজস্ব ব্যাখ্যা দাঁড় করাতেও। অপর অর্থটি গভীরভাবে চিন্তা করলে সাধারণ দৃশ্য কল্পটি পাঠক মনে ক্রমাগত অস্পষ্টতর হতে থাকবে এবং এক সময় পাঠক রহস্যময় জগতে প্রবেশ করবেন যা অন্তহীন সম্মোহনের জগত। পাঠক মাঝে মধ্যে কবিতার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করবেন মাত্র, কিন্তু সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হবেন। ফলে পাঠক মনে এক অনাস্বাদিত রহস্যের অতৃপ্তি থেকে যাবে – যা পাঠককে বারবার নিষিদ্ধ আবেগের মতো কবিতার দিকে, কবিতার সৌন্দর্যের দিকে আকর্ষণ করবে। কবিতার এ সংজ্ঞার সঙ্গে কবি কবি ওমর বিশ্বাসের কবিতা মিলে যায় আশ্চার্যরকম ভাবে।
সৎ কবিতা তত্ত্বজ্ঞান নয়, আবার ধর্ম-দর্শন-ইতিহাস-বিজ্ঞান-ভূগোলও নয়। তবে সৎ কবিতায় ঐ সবের এক সম্মিলিত ও দূরান্বয়ী নান্দনিক ছায়াপাত থাকে অনিবার্য সত্য ও সুন্দরের মতো। কবিতা মোহন বাঁশির মতো, কবিতা পাঠে সৎ পাঠক নিশি পাওয়া মানুষের মতো ঘোরের মধ্যে পায়চারী করবেন। ঘোর কেটে গেলে অচরিতার্থ জীবনের হাহাকারের মতো ঘুরে ঘুরে নিজের মনের মধ্যে অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকবেন দীক্ষিত পাঠক। এবং এক সময় ডুব দেবেন অসীম সম্মোহনে। কবি ওমর বিশ্বাসের কবিতা তো এমনি মনে হয়। তার পূর্বে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ এবং আলোচ্য নৈঃশব্দের দ্যুতির নামকরণ ও কবিতাগুলোর অধিকাংশ নামেও এমনি ছায়াপাত করেছে।
কাব্যের প্রতিটি কবিতাই পৃথক পৃথক ফুলের মতো পৃথক পৃথক ঘ্রাণ ও সৌন্দর্য রয়েছে যা নতুন নতুন অভিনবত্বের ভাঁজ পাঠকদের সামনে খুলে দেয়। দু এক টুকরো উদ্ধৃতি দেয়া যাক:
কোথায় পাব রাত্রিরে
যে রাত্রির দেহভাঁজ খুলে দেয়
অজস্র পেখম
বর্ণিল জলোচ্ছ্বাস।
(স্পর্শের নদী, পৃষ্ঠা – ৪১)
এমনি আরেকটি কবিতা — ‘চলো রোদ্রে হাঁটি’। কবিতায় কবির সঙ্গে পাঠকদের আনন্দে হাঁটতে ইচ্ছে করে, দৃশ্যের পর দৃশ্যের রহস্যের ভাঁজ খুলে দেয় অপরূপ অবলীলায়:
চলো রোদ্রে হাঁটি
উত্তাপের ঘ্রাণ নেই
বৃষ্টির সুরভি মেখে
দুজনে দুজনা, চলো
বিকালের বিশ্রামে আবার।
চল হেঁটে হেঁটে
দুপুরের রোদ্র দেখি
সকালে শীতল ভোর
ভাবতে ভাবতে কোনো
স্বপ্নপুরির সন্ধানে যাবার।
…………………..
চলো হাঁটি চলো
পাশাপাশি সাথে সাথে
প্রেমের পিয়াসি হয়ে
আনন্দ আকুলতায়
আসো গড়ি স্বপ্নের ঠিকানা।
(চলো রোদ্রে হাঁটি, পৃষ্ঠা – ৩৯)
এ রকম আরো কয়েকটি কবিতা – বোঝ না মেয়ে, মেঘ, জোছনা, ছায়ার পিছনে, স্মৃতির ক্যানভাসে, রুবাইয়াত, চলো পালিয়ে যাই। কবির ভালোলাগা ভালোবাসা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আবেগঘন উষ্ণতায় মোহময় ভাষায় সংগীতময় হয়ে উঠেছে। মানব মনের বিচিত্র অনুভবের সঙ্গে স্বদেশের মাটির সোদা সোদা ঘ্রাণ শব্দ ছন্দে একাকার হয়ে হৃদয় ছুঁয়ে যায়:
ঐ ঝিরঝিরে ঠোঁটে চুম্বকের আস্বাদন
জেগে রাখে আমায় সারারাত্রি বৃক্ষের মতোন
শীতের রোদ কিংবা খরায় বৃষ্টির উন্মাতাল উন্মত্ততায়।
আমি নৈঃশব্দ্যের দ্যুতি নিয়ে ঘন অন্ধকারে
চাঁদের উজ্জ্বলতা অথবা
স্বপ্নের সাথে প্রণয়ের পংক্তিমালাগুলো গুছিয়ে দেই
শুধু গোলাপি অধরের তৃষ্ণায়
না বলে না ঐ মসৃণ উষ্ণতা।
(না বলে না ঐ মসৃণ উষ্ণতা, পৃষ্ঠা – ২৫)
কবিতাটির কয়েকটি উপমা চোখে পড়ার মতো। কাব্যবিশারদগণের কেউ কেউ বলেন উপমাই কবিতা – কাব্য, আবার শব্দ ও অর্থ ছাড়া কাব্যের কোনো স্বতন্ত্র আত্মা নেই। বাক্যের শব্দ আর অর্থকে আটপৌরে না রেখে সাজসজ্জায় সাজিয়ে দিলেই বাক্য কাব্য হয়ে ওঠে। এ সাজসজ্জার নামই অলংকার। শব্দকে অনুপ্রাস ইত্যাদি অলংকারে সাজিয়ে যেমন সুন্দর করা যায় অর্থকেও তেমনি উপমা রূপক উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদি নানা অলংকারে চারুত্ব দান করা যায়। কাব্য সম্পর্কে কোনো কথাই শেষ কথা নয়। কোনো কোনো বাক্যে অলংকার উপমা ইত্যাদি সকল থাকা সত্ত্বেও তা কাব্য হয়ে ওঠে না আবার এমন অনেক বাক্য আছে যাতে অলংকার নেই অথচ তা শ্রেষ্ঠ কাব্য বলে বিবেচিত। তবে শ্রেষ্ঠ কাব্যের লক্ষণ হচ্ছে বাচ্যকে ছাড়িয়ে বাচ্যাতীতকে প্রকাশ করা। শব্দ এবং তার আভিধানিক অর্থ দিয়ে যেটুকু প্রকাশিত হয় তা-ই একান্তভাবে সীমিত। তাই কাব্যের আসল বস্তু নয়। তা কাব্যের দেহ হতে পারে – প্রাণ নয়। প্রাণ হলো বাচ্যার্থকে ছাড়িয়ে যে অর্থ সংগীত-রেশের মতো অনুরণিত হয়ে ওঠে সেই অর্থ – সেই বাচ্যাতীত অনুরণন। যে অনুরণন দিগন্ত হারা অসীমের প্রতীক। সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশই তার লক্ষ্য। এই ব্যঞ্জনাই ধ্বনি, এই ধ্বনিই কাব্যের প্রাণ। এ যেন:
ধুপ আপনারে মিলাইতে চায় গণ্ধে,
গন্ধ সে চাহে ধুপেরে রহিতে জুড়ে।
সুর আপনাকে ধরা দিতে চায় ছন্দে,
ছন্দ ছুটিয়া ফিরে যেতে চায় সুরে।
কবি ওমর বিশ্বাসের কবিতায় সেই ধুপের গন্ধ ও ছন্দ সুরের রেশ আমরা শুনতে পাই। তার পাওয়ার আনন্দ আছে স্বপ্ন আছে আশা আছে, না পাওয়ার শোক দুঃখ বেদনাও আছে তবে তার তেমন তীব্রতা নেই, থাকলেই বা ক্ষতি কী? Our sweetest songs are those that tell of saddest thought. বেদনার গানই তো মধুর।
‘অপেক্ষার সময়’ কবিতায় ‘সময়’ শব্দের একাধিক অর্থে ব্যবহার ‘সময়গুলো চেয়ে থাকে সময়ের পথে’ এবং ‘অসহায় আফগান শিশুর মতো কিংবা ইরাকী ধ্বংসলীলার বিমূর্ত বেদনার ভাষার মতো’ তুলনাটা চমৎকার। এবং মাহমুদ দারবিশ এর বিখ্যাত কবিতা ‘আমার মা’ কাব্যটির সৌন্দর্য ও মান বৃদ্ধি করেছে।
গ্রন্থের চার পংক্তির একটি রুবাইয়াতে কবির কাব্যকর্মের সকল দিকের দক্ষতা ও শক্তিমত্তার পরিচয় বহন করছে এবং তাঁর বুকে লুকানো ইচ্ছেটিও ব্যক্ত হয়েছে। পাঠকদের জানানোর লোভ সংবরণ করতে না পেরে তুলে ধরছি:
ওই হাসিটা থাকুক লেগে ভালোবাসায় মিষ্টি মুখে
সেই হাসিতে বুঝবে সবাই কেমন আছ কেমন সুখে
সেই সুখেতে ডুবে থাকো অফুরন্ত শোকরানাতে
ভালোবাসা ছড়িয়ে দেব যা লুকানো এই বুকে।
(রুবাইয়াত, পৃষ্ঠা – ৪৭)
গ্রন্থটির প্রথম এবং দ্বিতীয় ফ্ল্যাপে সংক্ষিপ্ত কবি পরিচিতি ছবি সহ ছাপা হয়েছে। সৃজনী পাবলিকেশনের মশিউর রহমান প্রকাশিত নৈঃশব্দের দ্যুতি’র চার রঙা প্রচ্ছদ এঁকেছেন তাসনিম রহমান। গ্রন্থটি কবি রহমাতুল্লাহ খন্দকারকে উৎসর্গ করা হয়েছে। কাগজ ছাপা বাঁধাই উন্নতমানের। ৪৮ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির মূল্য ১২০ টাকা মাত্র। এ সময়ে মোটেই বেশি নয়। কবিতা প্রেমিক পাঠকদেরকে এ সময়ে এমন উন্নতমানের কবিতা গ্রন্থ উপহার দেয়ার জন্যে কবি ওমর বিশ্বাসকে অনেক মুবারকবাদ জানাচ্ছি। তাঁর হাত থেকে আরো সমৃদ্ধ ও উন্নত মানের কবিতা আশা করছি।