পূরবী বসু
“থাবড়া হামিদ” কাজী জহিরুল ইসলামের সদ্য প্রকাশিত একটি উপন্যাস। কাজী জহিরুল ইসলাম একজন কবি হিসেবে বাঙালি পাঠকের কাছে পরিচিত। তাঁর লেখা, আমার জানা মতে, এটি-ই প্রথম উপন্যাস। ছিয়ানব্বই পৃষ্ঠার ছোট্ট পরিসরের উপন্যাসটি আগাগোড়া অত্যন্ত মনোগ্রাহী এবং সাবলীল ভাষায় লিখিত। একবার পড়া শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত পাঠকের মনোযোগ টেনে ধরে রাখে এই বই।
বাংলাদেশের কোনো উপশহর কিংবা গ্রামের অতি পরিচিত পরিবেশে কিছু চেনা চরিত্রের প্রথাগত চলাফেরা, কথাবার্তা, জীবনযাত্রা, স্থানীয় রাজনীতি, ক্ষমতার প্রতাপ, সেই সঙ্গে হাসিঠাট্টা মিলে একটি জনপদের দৈনন্দিন জীবনের সংস্কার, কুসংস্কারসহ বেঁচে থাকার নানা অনুষঙ্গ রয়েছে এই উপন্যাসে। সবেচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য ও নান্দনিক এই বইয়ের অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত সহজ সরল সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত কথাবার্তা। ছোট ছোট বাক্য গঠনে তৈরি, কৌতুকপূর্ণ কথোপকথন শুরু থেকেই মন কাড়ে। লেখকের চরিত্র নির্মাণ, তাদের মজাদার কিছু রুটিন শব্দ প্রয়োগ, বিশেষ কিছু কাজকর্ম বা স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য (এই ক্ষেত্রে যেমন যথেষ্ট আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে চেয়্যারম্যান হামিদের “থাবড়া” দানের উৎসব) আমাদের বারে বারে বাংলাদেশের সবচাইতে পাঠকনন্দিত ঔপন্যাসিক ও জনপ্রিয় নাট্যকার হুমায়ুন আহমেদের পরিহাসপ্রিয়তা ও রসিকতা বোধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রাত্যহিক গৃহস্থালীতে ব্যবহৃত পরিচিত আরবী ফারসী শব্দ, এমন কি কিছু অতি ব্যবহৃত ইংরেজি শব্দ-ও তুলে এনে তিনি যেভাবে ব্যবহার করেছেন, যেভাবে পশুপাখির সঙ্গে মানুষের পার্থক্য নির্ণয়ে দু’টি পরিনত ব্যক্তি ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করেন, তা হুমায়ূনের কথা মনে করিয়ে দেয় নিঃসন্দেহে।
উপস্থাপনায়, পরিচ্ছেদের শুরুতে প্রায়শ-ই যেমন করে স্থান কাল আসবাবের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাতে আমার ধারনা উপন্যাসটির নাট্যরূপ দেয়ার সদিচ্ছা রয়েছে লেখকের এবং তার একটি অনুশীলনও হয়ে গেছে এই উপন্যাসে।
“থাবড়া হামিদ” উপন্যাসে নানাবিধ চরিত্রের আনাগোনা থাকলেও দুটি চরিত্র-ই সবচেয়ে জীবন্ত হয়ে আমাদের কাছে পূর্ণতা পেয়েছে। তার একজন থাবড়া হামিদ নিজে এবং অপরটি তার আশ্রিত আত্মীয় মকবুল। বেশ কিছু চরিত্র উপন্যাসে সংযোজিত হয়েছে, যাদের কেউ কেউ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে বলে পাঠকের মনে বিশ্বাস জন্মেছিল। কিন্তু তারা হঠৎ মাঝপথে এসে হারিয়ে যায়। অথচ উপন্যাসের কাঠামোতে তাদের আগমন ও প্রাথমিক উপস্থাপন পাঠকের মনে আশা উস্কে দিয়েছিল যে চরিত্রগুলোর বিস্তৃতি ঘটবে। তেমন একটি চরিত্র বিদেশিনী ক্যারোলাইন। হামিদপুত্র সুপুরুষ রূপ মিয়া বিয়ে করতে এসেছে বাড়িতে। কিন্তু সকলকে স্তম্ভিত করে দিয়ে তার সঙ্গে লঞ্চ থেকে নামে পরিবার ও গ্রামের সকলের কাছে অপরিচিতা এক বিদেশিনী নারী। ক্যারোলাইন। এন, জি ও কর্মী। গ্রামে, নদীর ঘাটে কানাঘুষা ওঠে রূপ মিয়া এই বিদেশিনীকে বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে এসেছে। ক্যারোলাইনের সঙ্গে রূপের সম্পর্কের রহস্যের জট ভালোমতো না খুললেও ক্ষমতাধর, প্রবল ব্যক্তিত্ত্বশালী পিতার জেরার জবাবে রূপের যে ধরণের প্রতিক্রিয়া হয়, যেভাবে মেয়েটিকে তার বন্ধু বলে সে পরিচয় দেয়, তাতে কেবল বাড়ি আসার পথে লঞ্চেই তাদের পরিচয় হয়েছে মনে হয় না। তার অনেক আগে থেকেই পরিচয়ের সূচনা, সে আভাস-ও মেলে পরবর্তিকালে এক দূরবর্তিনীর ফোন-আলাপনে। । কিন্তু যেই মুহুর্তে রূপ তার ভাবী স্ত্রী-অপূর্ব এক সুন্দরী নারীকে দেখে, সে এতোটাই বিমোহিত হয়ে পড়ে, মুগ্ধতায় এতোখানি গলে পড়ে যে বিদেশিনী ক্যারোলাইন কেবল তার হৃদয় থেকে নয়, বইয়ের পৃষ্ঠা থেকেও স্থায়ীভাবে অন্তর্হিত হয়ে পড়ে। সর্বশেষ তার উপস্থিতি আমরা দেখি যখন পুকুর পাড়ে মকবুলের তিন কন্যার সঙ্গে সে খেলা করে। ক্যারোলাইন রূপের বিয়ের আসরে ছিল কি ছিল না তাও জানতে পারে না পাঠক যদিও রূপের ভাবি শশুরের ভাষ্যমতে ক্যারোলাইন বিয়ের আগের দিন দিনান্তেও গ্রামেই ছিল। ক্যারোলাইনের চরিত্রটি উপন্যাসে যথেষ্ট সম্পূর্ণতা পায়নি। রুপের সৎ বোন নাসরীনের একটি উজ্জ্বল ও তীক্ষ্ণ উপস্থিতি থাকতে পারতো গ্রন্থটিতে। সেটা ঘটেনি। আগাগোড়াই আড়ালে আড়ালে থেকে গেছে সে। বলাবাহুল্য উপন্যাসের প্রথম অর্ধেকাংশে কোনো উল্লেখযোগ্য স্ত্রী চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় না। বলতে গেলে পরের দিকে রূপের স্ত্রী আরিফা ছাড়া এই উপন্যাসে নারী চরিত্ররা খুব কম জায়গা দখল করে আছে।
বিয়ের পর শহরে এসে আরিফার ভার্সিটিতে পড়াশোনা শুরু, কবিতা লেখা, অল্পবয়সী প্রফেসরের সঙ্গে রোমান্টিক বাক্যালাপ তার প্রাক্তন জীবন থেকে এক বিশাল উল্লম্ফন বলে মনে হয়। আরেকটু ধীরে বা বিস্তৃতির সঙ্গে তার গ্রাম থেকে শহুরে এক আধুনিকা নারী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা হলে আরো বাস্তবসম্মত হতো।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করেছি, স্থান – কালের ব্যবধান বা তা অতিক্রান্ত হয়ে যাবার বিষয়টি কোনো প্রকার পদ্ধতি প্রয়োগে আলাদা করা হয়নি, যেমন সাধারণত করা হয় নতুন পরিচ্ছেদ সংযোজনে, কিংবা কয়েক লাইন জায়গা ছেড়ে দিয়ে সময়ের পার্থক্য বোঝাতে। তবে এক-ই পরিচ্ছেদে বিভিন্ন সময় বা স্থানের সম্পূর্ণ আলাদা ঘটনা বর্ণিত হলেও সাধারণত নতুন প্যারাগ্রাফ করা হয়েছে। তার মানে একটানা লেখায় এক-ই পরিচ্ছেদে, এক-ই পৃষ্ঠায় ভিন্ন প্রসঙ্গ, ভিন্ন চরিত্র বা পরিবেশের সূচনা হয়েছে কোথাও কোথাও কেবল ভিন্ন স্তবক দিয়ে। এটাও হয়তো লেখকের নিজস্ব স্টাইল।
জহিরুলের আকর্ষনীয় ভাষা, গ্রাম্য রাজনীতির সুচারু চাল, কথাবার্তার ধরণ, রম্য-রসিকতা, আালাপ-আলোচনার পরিবেশ, ভোজন-আপ্যায়ণ ইত্যাদি খুব বাস্তবসম্মত ও নিখুঁতভাবে বর্ণিত হয়েছে। উপন্যাস শেষের চমক ও সহিংসতা চরম পরিণতি পেলেও গ্রন্থের শুরু থেকেই তা ধীরে ধীরে অন্তরালে গড়ে উঠছিল, টের পাওয়া গেছে। বিশেষ করে জয়নালের আগমনে।
বইটি পড়তে পড়তে প্রথম দুই পরিচ্ছেদে হুমায়ূন আহমেদের লেখার সঙ্গে যতটা সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়, পরের পরিচ্ছেদ্গুলোতে তার প্রভাব ততটা পরিলক্ষিত হয় না। বরং ধীরে ধীরে তা কাজী জহিরুল ইসলামের নিজস্ব ঢং-এ লেখা উপন্যাস নিজস্ব উপস্থাপনা, প্রকাশভঙ্গি এবং চরিত্র চিত্রনের মুন্সিয়ানায় আমাদের কাছে ভিন্ন স্বাদে পরিবেশিত হতে থাকে। তিনি তাঁর স্বতন্ত্র স্টাইল, স্বতন্ত্র বর্ণনা, পরিচিত দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দে নির্মিত ছোট ছোট বাক্যালাপ দিয়ে গঠিত এই উপন্যাসটির মতো মনোগ্রাহী এবং বাস্তবসম্মত করে ভবিষ্যতে আরো সুন্দর সুদর উপন্যাস সৃষ্টি করবেন, এই আশাই করি তাঁর শুভ অর্ধ শতাব্দীর জন্মদিনে।
এই উপন্যাস পড়ে মনে হচ্ছে আমাদের জনপ্রিয় উপন্যাসের মরুভূমিতে নতুন মরুদ্যানের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এখন থেকে কাজী জহিরুল ইসলাম কবিতার মতো কথাশিল্পের দিকেও নজর দেবেন এই প্রত্যাশা।
১৬ ডিসেম্বর ২০১৭। ডেনভার, কলোরাডো