মুসা আল হাফিজ
ঔপনিবেশিক শাসনের আগের বাংলার দিকে দৃষ্টি দিলে একটি সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পরম্পরা দেখা যায় । ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির আগমনের আগে বাংলার ছিলো একটি সমৃদ্ধ দেশীয় সংস্কৃতি, একটি শক্তিশালী অর্থনীতি এবং একটি স্বতন্ত্র সামাজিক কাঠামো। এখানে ভাষিক বিশিষ্টতা ছিলো, ছিলো বৈচিত্রও । প্রধান ভাষা বাংলা একটি বিকশিত ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধিকে উদযাপন করছিলো। বিভিন্ন উপভাষা নিজের গতিপথে চলমান ছিলো , সচ্ছন্দ ছিলো। কবিতা, সঙ্গীত, অনুবাদ, এবং লোককাহিনীর সমৃদ্ধ প্রবাহ ছিলো তরঙ্গময়।
ইসলাম আগমনের আগ থেকে ঐতিহাসিকভাবে স্থানীয় বিশ্বাস ও বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্র ছিল বাংলা । হিন্দু ধর্মও এখানে প্রভাব তৈরী করে, লাভ করে কিছু রাজবংশের প্রবল পৃষ্ঠপোষকতা। ইসলামের বিকাশ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশকে নিজের দিকে যেমন আকৃষ্ট করে, তেমনি সমাজে বিদ্যমান ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যেও আনে নতুন অভিব্যক্তি। সহাবস্থান ও সমবেত বিকাশের মধ্য দিয়ে তা অগ্রসর হয়েছে। মুসলিম শাসনামল বাংলার বিচ্ছিন্ন জনপদসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রথমবারের মতো গঠন করে বাংলা নামের দেশ । দীর্ঘ পরিসরে মুসলিম শাসন বাংলার ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিকাশকে কৈশোর ও তারুণ্য দান করে। সামাজিক মননকে সুফিপ্রেমের পরশে নতুন মাত্রা দেয়। যার সাথে দীর্ঘ প্রতিবেশের ফসল হিসেবে হিন্দু সমাজে জন্ম নেয় ভক্তিবাদী জাগরণ। পরে উভয়ের যৌথতা এবং লোকায়ত নানা ভাব ও কুসংস্কারকে আলিঙ্গণ করে জন্ম নেয় সমন্বয়ী ভক্তিধারা, শরীরপুজা, সত্যপীরপুজা ইত্যাদি। সুফিপ্রেম সেবা, নিষ্ঠা ও শুদ্ধতার সাধনায় মানবকল্যাণের অনুশীলনে নিবেদিত থেকেছে সমাজের অন্তরতলে।
উপনিবেশ-পূর্ব কালে উর্বর কৃষি জমির কারণে বাংলাকে “ভারতের চালের বাটি” বলা হত। ধান, পাট, গম, তুলা, আখ, আম, কাঠাল, কলা,নারিকেল, রেশম, মরিচ, হলুদ, রসুন, আদা ইত্যাদির চাষ হতো বিপুলভাবে। গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু ও পুকুর ভরা মাছের প্রবাধ বাংলার কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার সমৃদ্ধিকেই বয়ান করে। কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যের প্রাচুর্য্ ছিলো, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সহজলভ্যতা ছিলো। প্রাচীন কালে প্রধানত কড়ির প্রচলন থাকলেও মুসলিম শাসনের শুরু থেকেই বিনিময় মাধ্যম হিসেবে স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন হয়।যা বাংলার সমৃদ্ধ অর্থব্যবস্থাকেই ব্যক্ত করে।
ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সাথে বাংলার একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্য নেটওয়ার্ক ছিল। কৃষিজ ও শিল্পজাত পণ্যের রফতানিতে বাংলার আবেদন শুধু এশিয়ায় নয়, আফ্রিকায়ও ছিলো বিস্তৃত, ইউরেশিয় অঞ্চলও এখান থেকে আমদানী করতো উন্নত শিল্পদ্রব্য, বিশেষত মসলিন কাপড় ও তৈরী পোশাক। প্রাচীন তাণ্ডা, গৌড় ও বাকলার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, সাতগাও, সোনার গাঁর মতো বন্দরগুলো ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের স্থানীয় কেন্দ্রবিন্দু।ইউরোপীয় জাহাজগুলো এখানে আসে মূলত এখানকার সম্পদের টানে, বিপুল অর্জনের লোভে।
সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্যেও এখানকার সমাজে শ্রেণীবিভাজন ছিলো বাস্তব একটি ব্যাপার। এটি ইসলামের পক্ষে সমাজে বৃহত্তর আনুকূল্য তৈরী করেছিলো। কারণ ইসলামে বংশ বা পেশাগত বর্ণবাদের কোনো স্থান নেই। যদিও মুসলিম সমাজে কথাকথিত আশরাফ-আতরাফ বিভাজনের কথা বলা হয়, তা আসলে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে হাজির করা একটি বয়ান। যা জাতভেদ প্রথার মুসলিম সংস্করণ তালাশের উদ্দীপনা থেকেই অতিরঞ্জিত হয়েছে। মাত্রা, ধরণ, প্রভাব ও ফলাফলে উভয়টির ব্যবধান ছিলো দুস্তর। এর মধ্যে সুফি ও ভক্তি আন্দোলন সমতার বিস্তার করেছিল।বাংলার সামাজিক গতিশীলতা ভারতের অন্যান্য অংশের তুলনায় তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল।
শিল্প ও কারুকার্যের জন্য বাংলার খ্যাতি ছিল। সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্র, জটিল পোড়ামাটির পাত্র এবং চমৎকার তাঁত পন্যে উন্নত রুচি ও শৈলী খচিত হতো।স্থাপত্য ঐতিহ্যে ছিলো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বহুমাত্রিকতা। শ্রেষ্ঠ নিদর্শনসমূহ তখন ছড়িয়ে ছিলো নানা শহরে, জনপদে।ঢাকার লালবাগ কেল্লা এবং মুর্শিদাবাদের কাটরা মসজিদের মতো চিত্তাকর্ষক স্মৃতিসৌধ এখনো তার স্বাক্ষর হিসেবে জেগে আছে। সুলতানী আমল থেকে নবাবী আমল বাংলার প্রশাসনিক ব্যবস্থায় নতুন প্রগতি নিয়ে আসে এবং শিল্প , সংস্কৃতি ও শিক্ষাকে অনন্য উদগতি দান করে। ঔপনিবেশিকতার পূর্ববর্তী কালপর্বে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জনলগ্ন ভাষিক ঐশ্বর্যে বিস্তারিত হয়। যাবনী মিশাল বা মুসলমানী জবান তখন হিন্দু-মুসলমানের লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা বা ব্যবহারিক ও সাহিত্যিক প্রকাশরীতি। এর নমুনা দেখা যাবে যেমন : আলাওল, আবদুল হাকিমে, তেমনি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী থেকে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরেও। এমনতরো কবিদের রচনা ও জীবনবাদিতা বাংলা সাহিত্যের বিকাশে রক্তজল সর্বরাহ করছিলো।
নবাবী আমলে বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রগতি বিশেষ স্থিতির দিকে এগুচ্ছিলো। কিন্তু এর মধ্যে বাস্তবতার আকাশে গুরুতর মেঘ জমছিলো দুই দিক থেকে। প্রথমত, মারাঠাদের আক্রমণ ও বর্বর ধ্বংসলীলা। দ্বিতয়ত, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির বাড়-বাড়ন্ত। প্রথমে পর্তুগীজ, পরে ইংরেজ।
মারাঠা-বর্গীদের আক্রমণে দেশ বিধ্বস্ত হয়, ব্যবসায়- বাণিজ্য ও শিল্প বিপন্ন হয়। মারাঠাদের নৃশংসতার বিবরণ পাওয়া যায় সমসাময়িক ইংরেজ ও বাঙালী লেখকদের ভাষ্যে। তাদের বিনাশ ও হত্যালীলার যে বর্ণনা গঙ্গারামের মহারাষ্ট্র পুরাণে রয়েছে, তাতেই স্পষ্ট হয় কী তীব্র আগুন, হত্যা, লুট, ধর্ষণ ও নৈরাজ্য নিয়ে তারা ধেয়ে এসেছিলো বাংলায়। আলীবর্দী খান প্রচণ্ড বিক্রমে এদের দমন করেন এবং বাংলায় শান্তি নিশ্চিত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় মেঘদল বাংলার আকাশকে ভয়াবহভাবে আচ্ছন্ন করেছিলো। পর্তুগীজদের বিতাড়িত করা এবং ফরাসিদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও ইংরেজদের অব্যাহত শক্তিবৃদ্ধি ও ছলে-বলে কৌশলে ক্ষমতাবৃদ্ধিকে মোকাবেলা করতে পারেনি নবাবী প্রশাসন। অবশেষে বণিকের মানদণ্ডকে শাসকের রাজদণ্ডে পরিণত করার চেষ্টাকে প্রতিহত করবার প্রত্যক্ষ যুদ্ধ পলাশীতে ব্যর্থ হলো পরোক্ষ ষড়যন্ত্রের ফলে। বাংলার স্বাধীনতা সূর্য্ অস্ত গেলো
ঔপনিবেশিক শাসন দ্রুতই বাংলার সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতায় প্রভাব তৈরী করলো।
ইংরেজ শাসনের অধীনে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা , প্রশাসনিক মাধ্যম ও উচ্চ মানদণ্ডের নিদর্শন হয়ে ওঠে, যার ফলে বাংলার মতো আদিবাসী ভাষার প্রাধান্য হ্রাস পেলো।
ব্রিটিশরা পশ্চিমা ধাঁচের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল, যার ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রভাব ছিল। যদিও এটি আধুনিক জ্ঞানে বাংলার অন্তর্ভূক্তিকে সহজ করেছে, অপরদিকে এটি ঔপনিবেশিক মূল্যবোধকেও স্থায়ী করেছে।
ঔপনিবেশিক প্রশাসনের দ্বারা সমর্থিত খ্রিস্টান মিশনারীরা স্থানীয় জনসংখ্যার ধর্মীয় পরিচয় বদলাবার চেষ্টা করেছিলো। জনগণকে ধর্মান্তরিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিলো, ধর্মীয় দৃশ্যপট পরিবর্তনের এ চেষ্টা নানা উত্তেজনা ও জটিলতা তৈরী করে।
ঔপনিবেশিক আমলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়, আইন ব্যবস্থায় ব্রিটিশ কানুন প্রবর্তিত হয়। শিল্পায়নকে উদ্বুদ্ধ করা হয়। কিন্তু সেটা হয় দেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করার বিনিময়ে। উপনিবেশ সবচেয়ে হীনবল করে বাংলার অর্থনীতিকে। উপনিবেশের আগে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও জনবান্ধব ছিলো যে অর্থনীতি, সেখানে নিরবচ্ছিন্ন লুটপাট ও প্রজাবৈরি নীতির মধ্য দিয়ে জীবনবিনাশী দুর্ভিক্ষ ও সম্প্রদায়গত গণদারিদ্র চাপিয়ে দিয়েছিলো ঔপনিবেশিকতা।
ভাষা, সাহিত্য, আইন, প্রশাসন, শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্র সমূহে ব্যাপক রূপান্তরের প্রণোদনা তৈরী হয়।
ব্রিটিশরা এমন নীতি প্রবর্তন করে যা ঐতিহ্যবাহী কারিগরি শিল্প ও কারুশিল্পের পতন নিয়ে আসে। তারা নীলের মতো ফসলের চাষকে অবধারিত করেছিল। এটা করেছিলো ব্রিটেন ও ইউরোপের শিল্পায়নের স্বার্থে। স্থানীয় কৃষি ও কৃষকের চাহিদাকে তারা উপেক্ষা করেছিলো এবং কৃষিব্যবস্থার জন্যে বয়ে এনেছিলো বৈরিতা। প্রথমে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং পরে ব্রিটিশদের দ্বারা আরোপিত জমিদারি ব্যবস্থার ফলে কিছু মধ্যস্থতাকারীর হাতে জমির মালিকানা কেন্দ্রীভূত হয়, যা কৃষকদের মধ্যে দারিদ্র্যকে বাড়িয়ে তোলে। তাদের মেরুদণ্ড দেয় ভেঙ্গে। ঔপনিবেশিক নীতিসমূহ প্রধানত মুসলিম জনসমাজকে পদপিষ্ট করে।
১৮২৮ সালে রাজা রামমোহনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজ। এর লক্ষ্য ছিল হিন্দু ধর্মের নববিন্যাস এবং একেশ্বরবাদ, যুক্তিবাদ এবং সামাজিক সংস্কারের প্রচার করা। আন্দোলনটি তার সমাজের গোঁড়া কুসংস্কারকে চ্যালেঞ্জ করে, নারীর অধিকার ও সামাজিক সমতার পক্ষে ওকালতি করে ।
ফলে বাল্যবিবাহ এবং বর্ণ প্রথার মতো সামাজিক কুফলগুলির বিরুদ্ধে লড়াই তীব্র হয়।মুসলিম শাসন এসবের উচ্ছেদ কামনা করতো। কিন্তু হিন্দু রীতি ও ঐতিহ্যে হস্তক্ষেপ করার নীতি মুসলিমদের ছিলো না। তখন থেকেই হিন্দুদের অগ্রসর একটি অংশ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছিলেন। রামমোহন রায় নতুন উপলব্ধির যে আলোকে শিখায়িত হন, তার ভিত্তি ব্রিটিশ সান্নিধ্যই ছিলো না, বরং তার তুহফাতুল মুওয়াহহিদিনের গ্রন্থ পড়লে স্পষ্ট হয় যে, ইসলামের প্রভাব তার ব্রাহ্ম মন গঠনে বড় ভূমিকা রেখেছিলো। সেই প্রভাবকে আত্মিকরণ করে ইউরোপীয় চিন্তার সাথে তিনি বেদ-উপনিষদীয় ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন আপন সমাজ ও সমকালের পরিসরে। সংস্কারের এই ধারা হিন্দু সমাজে চলমান ছিলো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো সংস্কারকদের প্রচেষ্টার ফলে নারীশিক্ষা ও বিধবা বিবাহের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়।বাংলার সাম্প্রদায়িক বৈচিত্র্য বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মধ্যে সংলাপ ও বিনিময়কে উৎসাহিত করে আসছিলো ।
কিন্তু ব্রিটিশদের প্রণোদনা বাংলায় ধর্মীয় উত্তেজনা ও সাম্প্রদায়িকতা বাড়িয়ে তোলে। ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ন্যারেটিভ সমূহ সাম্প্রদায়িক বাস্তবতাকে বিষিয়ে তুলছিলো। সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, ঐতিহাসিক ও ভাষিক জমিতে সাম্প্রদায়িকতার উপাদান সমূহের চাষ হয় ক্রমবর্ধমান ধারাবাহিকতায়। যার প্রধান ও পথিকৃত কণ্ঠগুলো ধ্বনিত হচ্ছিলো বাংলায়।
এরই মধ্যে ঘটছিলো বাংলায় জাতীয়তাবাদী উজ্জীবন।
এই সময়ে বাংলা ভাষার রূপান্তর ছিল লক্ষণীয়। উনিশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষার প্রমিতকরণ নিশ্চিত হয় ।
ইংরেজির প্রাধান্য থাকা সত্ত্বেও বাংলা ভাষা ফোর্ট উইলিয়াম ও কলকাতা কেন্দ্রিক বিশেষ চরিত্র লাভ করে।জনতার জবান থেকে বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতশাসিত একটি বাংলা শহুরে মধ্যবিত্ত্বের মধ্যে মাথা তুললো। ব্যাকরণ সামনে এলো এবং গদ্য হলো বিকশিত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মীর মোশাররফ হোসেন, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের মতো প্রখর কবি-সাহিত্যিকগণ বাংলা ভাষায় মাস্টারপিস তৈরি করতে থাকেন।
প্রখ্যাত শিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ এবং চলচ্চিত্র নির্মাতারা সামনে আসেন। পশ্চিমা রুচি ও আধুনিকতার স্রোত সৃজন ও মননে প্রভাব তৈরী করে।অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নন্দলাল বসুর নেতৃত্বে বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট শৈল্পিক কৌশল এবং থিম পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছিল। তারা এজন্যে আদর্শ খুঁজেছিলেন প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যে। এই ঘরানার শিল্পীদের শিল্পকলার পিতৃভূমি ছিলো অতীত-ভারত। বাংলা সঙ্গীত, নৃত্য এবং উৎসবে হিন্দু ও ইসলামিক উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটে ।
উনিশ শতকে ব্রিটিশ ও বাঙালি স্থাপত্য উপাদানের সংমিশ্রণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন নিও-গথিক এবং নিও-ক্লাসিক্যালের মতো স্থাপত্য শৈলী প্রবর্তন করেছিল, যা সরকারি ভবন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গীর্জা নির্মাণে প্রতিফলিত হয়। এর পাশাপাশি বাংলার ঐতিহ্যগত শৈলীর বাড়িও দৃশপটে উপস্থিত থেকেছে। যেখানে জটিল কাঠের কাজ এবং অলঙ্কৃত নকশায় মননের প্রতিফলন ঘটেছে।
বাংলায় নতুন বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশ ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে শিক্ষা ছিল একটি মূল অনুঘটক। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ভারতে একটি আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার লক্ষ্য ছিল এক শ্রেণীর শিক্ষিত ভারতীয় তৈরি করা, যারা ব্রিটিশ প্রশাসন এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করতে পারে। এই ব্যবস্থা পশ্চিমা শিক্ষা, বিশেষ করে ইংরেজি-ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে আদর্শ কর্মচারির ভূমিকা নেবে।
১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, জমির মালিকানার ধরণ পরিবর্তন করে। ফলে জমিদারি মুসলিমদের হাতছাড়া হয়, নতুন ভূস্বামীদের ক্ষমতায়ন ঘটে এবং বাঙালি জমির মালিকদের একটি নতুন শ্রেণি তৈরি করে। জমির মালিকানার এই পরিবর্তনের অর্থনৈতিক প্রভাব ছিল ভয়াবহ। কারণ এটি কিছু লোকের হাতে সম্পদ এবং ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে।
ঔপনিবেশিক প্রশাসন একটি বাজার-ভিত্তিক অর্থনীতির উপর জোর দিচ্ছিলো। এই পরিবর্তন বণিক, ব্যবসায়ী এবং পেশাদারদের উন্নতির সুযোগ তৈরি করেছে। পাট এবং টেক্সটাইল উত্পাদনের মতো নতুন শিল্পের উত্থান মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে আরও প্রসারিত করে। বাঙালি মধ্যবিত্ত, তাই, শুধু জমির মালিকই নয়, পেশাদার, উদ্যোক্তা এবং দক্ষ শ্রমিক হয়ে উঠে। এই গোটা প্রক্রিয়া থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠী থেকে গেলো বঞ্চিত।
জমিদারি, বাজারব্যবস্থা, প্রশাসনে চাকুরি ও শিক্ষা থেকে কোণঠাসা মুসলিম জনগোষ্ঠী একদিকে সামাজিক জীবনে বৈষম্য ও বিভক্তি দ্বারা পিষ্ট হচ্ছিলেন, অপরদিকে প্রতিবেশী সমাজের নবজাগরণের চাপ তাদের সাংস্কৃতিক জীবনকে প্রভাবিত করে। তাদের ধর্মীয় উপাদান মুসলিম সমাজকে প্লাবিত করে নানাভাবে। বৈষ্ণব ধারার প্রভাব মুসলিম জীবনে সূফিপরিভাষা ও গুপ্ততত্ত্বের আবরণে অনুপ্রবেশ করে। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে পিছিয়ে থাকা মুসলিম লোকজীবনে–না মুসলিম, না হিন্দু– ধরণের এক রকম ভাবধারা ও অনুশীলন বিস্তৃত হয়।
পচন ও পতনের নানা উপসর্গের ভিড়ে সংস্কার আন্দোলন মাথা তুলে সবলে। যা একই সাথে ব্রিটিশ উপনিবেশের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতাকে ফিরে পেতে চাইছিলো, অপরদিকে কুসংস্কার ও অপচর্চা থেকে মুসলিম সমাজের উত্তরণ-প্রয়াসী ছিলো। ফকির বিদ্রোহ, তিতুমীরের প্রতিরোধ, হাদা মিয়া, মাদা মিয়ার বিদ্রোহ স্বাধীকার প্রয়াসকে ধারাবাহিকতা দিলেও হাজী শরিয়তুল্লাহর সংস্কার আন্দোলন একটি তীব্র ও ব্যাপক সামাজিক তরঙ্গ নিশ্চিত করে। যা বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ এবং পরিচয়ের অনুভূতিকেও জোরদার করেছিলো। এ আন্দোলন একদিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসনের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে, অপরদিকে অন্যান্য সামাজিক সংস্কার প্রচেষ্টার সাথে সামাজিক ন্যায়বিচার ও সংস্কারকে কেন্দ্র করে একটি সম্মিলিত বাঙালি মুসলিম পরিচয়ের বিকাশে অবদান রাখে।
১৮১৭ সালের ২০ জানুয়ারি কলকাতায় স্থাপিত হিন্দু কলেজ কিংবা ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি শিক্ষিত বাঙালিদের একটি প্রজন্মকে উঠিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। পশ্চিমা শিক্ষায় প্রবেশ ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে হিন্দুদের একটি প্রতিশ্রুতিশীল প্রজন্ম দ্রুত সাড়া দিয়েছিলো।
বিভিন্ন খাতে তাদের অবদান ছিলো স্পষ্ট। জগদীশ চন্দ্র বসু এবং সত্যেন্দ্র নাথ বসুর মতো বুদ্ধিজীবীরা বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন এবং উদ্ভিদ শারীরবৃত্তের ক্ষেত্রে জগদীশ চন্দ্র বসুর অগ্রণী কাজ বাংলার বৈজ্ঞানিক পরাক্রম প্রদর্শন করে।
ভাষা, সাহিত্য , শিল্পকলা , শিক্ষা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় তারা ছিলো মনোযোগী।
তারা পশ্চিমা পোশাক এবং আচার-আচরণ গ্রহণের পাশাপাশি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, নৃত্য এবং শিল্পকলার প্রচারে সক্রিয় থেকেছেন। সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবন শুধুমাত্র অভিজাতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, উৎসব, বৈদিক অতীত ও ধর্মাশ্রয়ী প্রেরণার নব জাগরণে তারা ছিলেন নিবেদিত।
রামমোহন রায় প্রাচীন ঔপনিষদিক গ্রন্থগুলি থেকে একটি যুক্তিবাদী ‘আধুনিক’ ভারতের রূপকল্প অঙ্কণ করেছিলেন।আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী যতটা ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মের বিরোধী ছিলেন, ততটাই বিরোধী ছিলেন ব্রাহ্মণবাদের। হিন্দুদের সমন্বিত সামাজিক জাগরণ ছিলো তার প্রধান অন্বেষা। এর প্রভাব বাংলায় পড়ে গভীরভাবে।
রামকৃষ্ণ পরমহংস ছিলেন হিন্দুদের প্রণম্য মহাপুরুষ। ১৮৮০ এর দশকের মধ্যভাগ থেকে পশ্চিমা শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবীদের কাছে তিনি হয়ে উঠেন হিন্দু জাগরণের প্রেরণার প্রাণকেন্দ্র। একদল অনুসারিকে তিনি সংগঠিত করেন। যারা ১৮৮৬ সালে তার মৃত্যুর পরে ধর্মজাগরণের কাজ চালিয়ে যান।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারত মাতা চিত্রকলা, ভারতকে মাতৃদেবী হিসাবে চিত্রিত করে, জাতীয়তাবাদী অনুভূতির একটি আইকনিক উপস্থাপনা হয়ে ওঠে। স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন এই নবজাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ব্রিটিশ ভারতে তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ধারণাটি প্রবর্তন করেন। রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তার চিন্তার বিবর্তিত উত্তরাধিকার আজকের ভারতের প্রধান প্রবনতা। অরবিন্দ ঘোষ রাজনৈতিক নেতা, আধ্যাত্মসাধক এবং দার্শনিক। জাতীয়তাবাদের জোরালো এক আওয়াজ ছিলো তার। সবাইকে ছাড়িয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তার জাতীয়তাবাদ একেবারে খোলাসা। স্পষ্ট। দুtখজনক হলো তার জাতিঘৃণা । একজন পাঠক যখন আনন্দমঠ পড়েন, তিনি মুখোমুখি হন বঙ্কিমের নানা বর্ণনার। যেমন– (১) কেহ চিৎকার করিতে লাগিল, মার মার, নেড়ে মার।… কেহ বলে এমন দিন কি হইবে, মসজিদ ভাঙ্গিয়া রাধা মাধবের মন্দির গড়িব। (২)“আমরা রাজ্য চাই না। কেবল মুসলমানেরা ভগবানের বিদ্বেষী বলিয়া তাদের সর্বাংশে নিপাত করিতে চাই।” (৩) ‘ “ধৰ্ম্ম গেল, জাতি গেল, মান গেল, কুল গেল, এখন তো প্রাণ পর্যন্তও যায়। এ নেড়েদের না তাড়াইলে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?” মুসলিমপ্রধান ঢাকার প্রতি বঙ্কিমের মনোভাবের নজির পাওয়া যায় ১২২৭ সালের অগ্রহায়ণের ‘বঙ্গ দর্শনে’ প্রকাশিত তার এক রচনায়। এতে বঙ্কিম লিখেন– “ঢাকাতে দুই চারিদিন বাস করলেই তিনটি বস্তু দর্শকদের নয়ন পথের পথিক হইবে। কাক, কুকুর এবং মুসলমান। এই তিনটিই সমভাবে কলহপ্রিয়, অতি দুর্দম, অজেয়। ক্রিয়া বাড়ীতে কাক আর কুকুর। আদালতে মুসলমান।” [বঙ্কিম চন্দ্র, বঙ্গ দর্শন, অগ্রহায়ণ সংখ্যা, পৃঃ ৪০১]।
এমনতরো বুদ্ধিজীবীদের পুরোভাগে রেখে বিকশিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী সক্রিয়ভাবে সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলো। আপন পরিচয়, অধিকার এবং সামাজিক সংস্কারের প্রশ্নে তাদের ক্রমবর্ধমান সক্রিয়তা ছিলো। সেই সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়াস বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্থান ঘটায়।
এই সব আন্দোলন বৈদিক ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে ব্যবধান দূর করতে চেয়েছিল। যা বাংলার সাংস্কৃতিক রূপান্তরে গভীর প্রভাব ফেলে এবং পরবর্তী সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে।
উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এসব আন্দোলন স্পষ্টভাবে এমন বয়ান হয়ে উঠে, যা মুসলিমদের অগ্রগতি ও অধিকার প্রয়াসকে কবুল করতে পারছিলো না। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ যখন ঢাকা কেন্দ্রীক একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থানের পথমুখ খুলে দিলো এবং অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও রাজনৈতিক সক্ষমতা বিস্তারের সম্ভাবনাকে বিকশিত করলো, তখনই কলকাতা কেন্দ্রিক এই মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে।
এই বুদ্ধিজীবীদের প্রয়াস এমন এক ধারা তৈরী করে, যা পরবর্তীতে বাংলা-ভারতের বিবিধ জনসমাজকে এই হিন্দুত্বের আঙিনায় আসতে আগ্রহী করেছে।
কোনো স্থির বা একশৈলিক আদর্শের বদলে হিন্দুত্বকে তারা ডায়নামিক ডিসকোর্স করে তুলেছেন। পরবর্তীতে যা হয়েছে আরো চলমান, আরো পরিবর্তনশীল আখ্যান, আরো রাজনৈতিক এবং আরো স্বজাত্যাভিমানী।
কলকাতাকেন্দ্রীক বুদ্ধিজীবীদের এই নবজাগরণকে ব্রিটিশরা সন্দেহের চোখে দেখেনি। অপরদিকে যে মুসলিমরা ইংরেজি শিক্ষায় সাড়া দিয়েছিলেন, তাদেরকে এর ইতিবাচক ফলাফল লাভের পথে নানারূপ বঞ্চনা ও প্রতিবন্ধকতার কবলে পড়তে হয়।
মুসলিম সমাজের সামগ্রিক সঙ্কট ও চ্যালেঞ্জের বিপরীতে পুনর্জাগরণের সক্রিয় সাংস্কৃতিক প্রয়াস অব্যাহত ছিলো। শাহ ওয়ালিউল্লাহ, শাহ আবদুল আজিজ, সায়্যিদ আহমদ শহীদ, রহমতুল্লাহ কিরানাবি, কাসিম নানুতুবী, মাহমুদ হাসান দেওবন্দি বাহিত সংগ্রাম ও সংস্কারের ধারা এবং স্যার সৈয়দ আহমদ খান ও সৈয়দ আমীর আলীর রাজনৈতিক ও শিক্ষামূলক জাগরণের প্রভাব বাংলায় সবলে আন্দোলিত হয়। মুনশি মেহেরউল্লাহ, জন জমিরুদ্দীন, নবাব আবদুল লতিফ, মুহসীনউদ্দীন ওরফে দুদু মিয়া, আবু বকর সিদ্দিকী আল কুরাইশী, মাওলানা জমিরুদ্দীন আহমদ, কারী ইবরাহীম, আবদুল ওয়াহিদ বাঙালি, খাজা আহসানউল্লাহ , মওলানা ইসমাইল হোসেন সিরাজি, কাজী নজরুল ইসলাম, রিয়াজউদ্দীন মাশহাদী, শেখ আবদুর রহিম, মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দিন আহমদ,নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, স্যার আবদুর রহিম, মওলানা মনীরুজ্জামান এসলামাবাদী, নবাব আলী চৌধুরী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, একে ফজলুল হক, মওলানা আকরাম খাঁ, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখের নানামাত্রিক সংগ্রামের চলমানতা বাংলার মুসলিম জীবনে ঔপনিবেশিকতা এবং বহিরাগত প্রভাবের মোকাবেলায় দৃঢ়চিত্ত শক্তি বিস্তার করেছে। নিজস্ব সংস্কৃতির স্থিতিস্থাপকতা তার ঐতিহ্যের শক্তি এবং এর সাথে জনগণের অভিযোজন ক্ষমতার নবায়ন করেছে। যার ধারাবাহিকতা বাংলাদেশী জাতিসত্তার স্বতন্ত্র পটভূমি নিশ্চিত করেছে।
একটি চালক ও সমৃদ্ধ অবস্থান থেকে ছিটকে পড়ে রাজনৈতিক বিপর্যয় , অর্থনৈতিক বিনাশ , সাংস্কৃতিক পরিচয়নাশ ও সামাজিক অবনমন বাঙালি মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দেয় ঔপনিবেশিকতা। আবার তারই শিক্ষা, রাজনীতি-সংগঠন ও কৌশলব্যবস্থাপনার ভেতর ভেদ করে বেরিয়ে আসে বাঙালি মুসলিমের আধুনিক জাগরণ। উপনিবেশের অভিঘাত মুসলিম সমাজে ছিলো প্রধানত নেতিবাদী, প্রতিবেশী হিন্দু সমাজে ছিলো প্রধানত ইতিবাদী। ফলে মুসলিম প্রতিক্রিয়া ছিলো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ মুখর। যা শেষ অবধি পারস্পরিক প্রাপ্তিমূলক সহযোগিতা ও আলাপ-সংলাপের প্রক্রিয়াকেও আত্মস্ত করে। এরই মধ্যে উপনিবেশবাদ, ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদ, সামাজিক সংস্কার আন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের পরিচালক ও প্রকাশক অনুষঙ্গগুলো বিবর্তিত হচ্ছিলো।
ঔপনিবেশিক প্রশাসন নতুন প্রশাসনিক কাঠামো এবং আইনি ব্যবস্থা আরোপ করে বাংলার মুসলমান সহ সমাজের সকল অংশকে প্রভাবিত করেছিল। এই সময়কালে পশ্চিমা ধাঁচের শিক্ষার প্রবর্তন এবং প্রিন্ট মিডিয়ার প্রসার নতুন যে বাস্তবতাকে প্রণোদিত করলো, তা বাংলায় বুদ্ধিবৃত্তিক আদান-প্রদান এবং পরিচয় সম্পর্কিত আলোচনার চিত্র ও চরিত্রকে বদলে দেয়।
এরই মধ্যে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদ; ধর্মীয় শিক্ষা, ঐতিহ্য এবং অনুশীলনের নতুন হাওয়া প্রবাহিত হয়েছে। প্রতি নতুন করে আগ্রহের দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল। ধর্মীয় নেতা ও পণ্ডিতদের আবির্ভাব ঘটেছে অবিরল। নতুন প্রজন্মকে তাদের ধর্মীয় শিকড়ের সাথে পুনরায় সংযোগ তৈরী করতে অনুপ্রাণিত করেছে উভয় সম্প্রদায়।
পুনরুজ্জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ফলাফল ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জাগরণ, শিক্ষার বিস্তার ও সাহিত্যিক আত্মপ্রকাশ। এই উন্নয়নগুলি বাংলায় সাংস্কৃতিক নব উদগতির জ্বালানি সর্বরাহ করেছে। অপরদিকে বর্ণ-ভিত্তিক বৈষম্য, নারী শিক্ষা এবং দারিদ্র্যের মতো সামাজিক সমস্যাগুলি মোকাবেলা করার সচেতনতাকে নতুন অর্থে বিকশিত করেছে। এই প্রয়াসের ধারায় বাংলা নতুন করে বাণিজ্য, প্রশাসন এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
বস্তুত ঔপনিবেশিকতা আমাদের অতীতের সাথে বৈরি আচরণ করেছে, যা বিনাশ ও ভাঙনে পূর্ণ, আবার ঔপনিবেশিক কালপর্বেই নতুন নির্মাণের উদ্যম ও ধারা একটি মোহনার দিকে গতিমান হয়।
এর মধ্যে বাংলার সাংস্কৃতিক রূপান্তরের দিকগুলোতে ছিলো জটিল এবং বহুমুখী প্রক্রিয়া, যা বিভিন্ন ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণের আবর্তে গভীরভাবে মজ্জমান। মুসলিম সংস্কৃতির উন্নয়ন, বিকাশ বা পুনর্গঠনে উপনিবেশ কোনো সহায়ক ডালপালা বিস্তার করেনি। তবে তার প্রতিকূল চাপ ও পীড়ন থেকে মেহেদি পাতার মতো রং বিস্তার করে আত্মপ্রকাশ করেছে বাঙালি মুসলিমের আত্মপরিচয়ের নানা মাত্রা। ঔপনিবেশিকতা আমাদের যে সাংস্কৃতিক পটভূমিকে হত্যা করেছিলো, তা বাংলার হিন্দু ও মুসলমানের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বস্তি ও আশ্বাস হরণ করেছে। কিন্তু ঔপনিবেশিকতার প্রভাব বাংলার সংস্কৃতিতে নিয়ে এসেছে যে মাত্রা ও চরিত্র, যে প্রগতি ও বিস্তৃতি, যে মোচড় ও তীক্ষ্মতা , তাকে এককথায় নেতিবাচক বলে উড়িয়ে দেবার সুযোগ নেই । তা আমাদের বর্ণিল ও গতিমান করেছে যেমন, তেমনি প্রতিবন্ধতা দিয়ে একাকার করেছে আমাদের মহিমান্বিত হবার আপন গতিপথ।এই সব প্রতিবন্ধকতা আমাদের শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, রাজনীতিতে, প্রশাসনব্যবস্থায়, আইনী চলমানতায়, শ্রেণীচরিত্রে, সামাজিক মনে, অর্থনীতিতে, সাহিত্যে, চিন্তায় দূষণের নানা চ্যানেল জারি রেখেছে। যা থেকে উত্তরণের জন্য সত্যিকার, স্বকীয় ও বৃহত্তর বিউপনিবেশায়নের বিকল্প নেই।