ইসরাইল খান
আমাদের একজন প্রধান কবি আবদুল গনি হাজারী (১৯২১–১৯৭৬)। সকলের অজ্ঞাতেই চলে গেলো তাঁর জন্মশতবর্ষের শুভক্ষণটি।
মানে, তাঁকে আমরা পুরোটাই ভুলে গেছি।
কিন্তু সোনালী বাংলা হরফে লেখা রয়ে গেছে তাঁর ‘ জিব্রাইলের সঙ্গে সংলাপ ‘–
‘ হায় জিব্রাইল, বিশ্বাসী কোথায় পাব বল ?
তোমাদের প্রেরিতেরা আজ
প্রার্থনা করে নিজের জন্য শুধু
মুমিনদের বিশ্বাসের হাপরে তাই
প্রাচীন আগুনের ছাই
আত্মাহীন শরীর।’
‘ যদি পার তবে এসো / তোমাদের স্বর্গের সর্বশেষ সুসংবাদ নিয়ে।/ জিন্না এভিন্যুর নিহত মধ্যবিত্তের / মৃতদেহ উপেক্ষা করে।’
আর, ‘ আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী ‘ ও ‘ বন্দীবিবেক সমাজ ‘।
কাব্যময় এসমস্ত শব্দবন্ধ অনেকটা না ভোলা প্রবাদের মতো স্থায়ী বচনে রূপলাভ করেছে এখন।
আবদুল গনি হাজারী খুব ‘বেশিলেখা কবি’ বা ‘লেখক’ ছিলেন না।
কিন্তু তিনি ছিলেন মেধাবী আর সৎ-সাহস স্বদেশ প্রেমিক নাগরিক। তাঁকে যদি শুধু একজন ‘সাংবাদিক’ হিসেবেই আমরা বিবেচনা করি, তাহলেও বলা যাবে, — শুধু ‘সাংবাদিক জীবন’ যেটা তিনি যাপন করে গিয়েছেন, তাতেই তাঁকে একজন সফল পুরুষ হিসাবে আমরা স্মরণীয়দের তালিকাভুক্ত করতে পারতাম ।
যদি একজন ‘কবি’ হিসাবে আমরা স্থায়িত্বের বিবেচনায় তাঁকে পরিমাপ করতে চাই, তাহলেও দেখবো, সাতচল্লিশ থেকে স্বাধীনতা লাভের সত্তরের দশক পর্যন্ত সময়ে যাঁরা আমাদের দেশে কাব্যচর্চা করেছেন, তাঁদের মধ্যেও তিনি ভিন্ন ঘরাণার এক মাথাউঁচু কবি। নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে প্রকৃত কবির ভূমিকা জীবনভর পালন করেছিলেন তিনি।
কবি নির্ভয়ে সবসময় ‘সত্য’ উচ্চারণ করে থাকেন।
কবি হচ্ছেন ঈশ্বরের প্রতিভু , ‘সত্যভাষণ’ তাঁর ভূষণ।
সেই বিবেচনায় আবদুল গনি হাজারী এক অসীম সাহসী কবির নাম।
আইউব খানের আমলাতন্ত্রের সুবর্ণ সময়ে ১৯৬৩ সালের জানুয়ারি- মার্চে তিনি তীর্যক আলো ফেলে আমাদের দেশের প্রশাসনের উপরিতলের সারহীনতাকে নগ্নভাবে উপস্থাপন করে যে কবিতা তিনি লিখেছিলেন,তা আর কারো পক্ষে সেকালে লেখা সম্ভবপর হয়নি।
‘আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী
তোমার দিকে মুখ ফেরালাম
হে প্রভু, আমাদের উদ্ধার করো
বিশ্রামে বিধ্বস্ত
আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী। “
এই লেখার সাথে কবির হাতে লেখা পান্ডুলিপির প্রতিলিপি সংযুক্ত করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, কবি প্রথম খসড়ার সময়েই ইংরেজি ভার্সনও পাশাপাশি লিখে রেখেছিলেন। এই কবিতাটি মাসিক ‘সমকাল’এর পৃষ্ঠায় ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো।
তিনি তাঁর কবিতার ভবিষ্যৎ জানতেন। তাই ভাবের মুহূর্তে তিনি একই সাথে কাজটি করে রেখেছিলেন! চাহিদার উত্তুঙ্গ সময়ে; অতঃপর তিনি এর ইংরেজি ভার্সনও প্রকাশ করেন। এবং সেটা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’ কবিতাটি ১৯৬৪ সালে ইউনেস্কো পুরস্কারে ভূষিত হয়।
১৯৭২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারও লাভ করেছিলেন।
বলা হয়েছে যে, তিনি খুব বেশি লেখেন নি। কিন্তু এর চেয়ে বেশি লেখার কি প্রয়োজন ছিলো? মনে হয় না। কারণ পাকিস্তানি শাসনকালে আমাদের করণীয়-অকরণীয়, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার এপিঠ-ওপিঠ সবই তিনি লিখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের বিষয় বিন্যাস করলে দেখা যায়, তিনি পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনাধীন পূর্ববাঙলার মানুষের যা যা করা উচিৎ, তার প্রতিটি বিষয়েই তিনি স্বকীয় মতামত বা অনুভব অভিব্যক্ত করে লিখেছিলেন কবিতা, প্রবন্ধ বা সম্পাদকীয় কলাম।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো : ‘সামান্য ধন’ (কাব্য,১৯৫৯/৬০); ’সূর্যের সিঁড়ি’ ( ১৯৬৫), ‘ জাগ্রত প্রদীপ‘(১৯৭০) ; স্বর্ণগর্দভ ( প্রাচীন গ্রীক উপন্যাসের অনুবাদ); মনঃসমীক্ষা ( ফ্রয়েডের অনুবাদ ) এবং প্রবন্ধগ্রন্থ ‘ বন্দী বিবেক’ ; আর রম্যরচনাঃ ‘কালপেঁচার ডায়েরি’ (১৯৭৬)।
ডায়েরি অর্থাৎ এতে সংকলিত হয়েছে তাঁর লিখিত সম্পাদকীয়গুলো। যাতে লিপিবদ্ধ হয়েছে তাঁর সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবলি। প্রতিটি বিষয়ে তাঁর বক্তব্য খুবই স্বচ্ছভাবে এতে ধরা পড়েছে। তাঁর কবিতায় মুখ্যরূপ লাভ করেছে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মাধ্যমে নাগরিক সমাজের বিকার ও অসঙ্গতির উপস্থাপন।
দুই.
জীবন শুরু করেছিলেন আবদুল গনি হাজারী কলকাতার বিদ্বৎসমাজে সাংবাদিকতার মাধ্যমে। তিনি পাবনা জেলার সুজানগরে ১৯২১ সালের ১২ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতক সম্মান ডিগ্রি লাভ করে তিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ছিলেন দর্শন বিভাগে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের এক সমস্যা ডিগ্রি না নিয়েই পড়াশোনায় ইতি টেনে দেওয়া। হাজারীরও তা-ই নিয়তি হয়। ১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘আলোড়ন’ পত্রিকার সম্পাদনা কাজে যুক্ত হয়ে যান।
এরপর তিনি ১৯৪৮ সালে ঢাকায় এসে ‘জুবলি প্রেস’ নামে এক ছাপাখানার সহকারি ম্যানেজারের চাকুরি গ্রহণ করে ঢাকার কর্মজীবনের সূচনা করেছিলেন। প্রথমে ছাপখানা অর্থে যে ‘প্রেস’, তা দিয়ে শুরু করে তিনি সাংবাদিকতা জগতের যে ‘ প্রেস ‘ — তার শীর্ষপদে আরোহন করেছিলেন।
মৃত্যুর আগে তিনি ছিলেন অবজারভার গ্রুপ অব পাবলিকেশন্সের প্রশাসক (১৯৭২-৭৩) এবং সংবাদপত্র ব্যবস্থাপনা বোর্ডের চেয়ারম্যান (১৯৭৪-৭৬)।
তিনি ঢাকায় এসেই পূর্ব বাঙলার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জগতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সরদার জয়েনউদ্দিনের সাথে যৌথভাবে ১৯৫০ সালে তিনি মাসিক ‘ মু ক্ তি’ নামের এক উচ্চচিন্তার প্রগতিশীল সাময়িকপত্র প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
এই ‘ মু ক্ তি’র সম্পাদনা পর্ষদে মাহবুব জামাল জাহেদী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও অধ্যাপক হাবীবুর রহমানের নাম যুক্ত থাকলেও মি. হাজারী ও সরদার জয়েনউদ্দিনই ছিলেন প্রধান কর্তা। হাজারী ছিলেন দর্শন-মনবিজ্ঞানের ছাত্র। মু ক্ তি রও প্রথম রচনা একটি কঠিন দার্শনিক প্রবন্ধ জেম টরেস বোডেট এর অনুবাদ ‘ প্রাপ্ত-বয়স্কদের শিক্ষা ও আমাদের সভ্যতার ভবিষ্যৎ’।
আবদুল গনি হাজারী ১৯৬৫ -৬৮ তে পাকিস্তান লেখক সঙঘের পূর্বাঞ্চল শাখার মুখপত্র মাসিক ‘ পরিক্রম ‘ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ১৯৫১-৫৪ সময়ে ‘দৈনিক সংবাদ’ এর সহকারী জেনারেল ম্যানেজারের চাকুরি করার সময়ে ঐ কাগজের সাহিত্য সাময়িকীও সম্পাদনা করতেন।
তিনি লেখক সংঘের কার্যকরী কমিটিরও সদস্য ছিলেন। শিল্পাচার্যের সঙ্গে ঢাকায় ১৯৪৮ সালে আর্টস স্কুল প্রতিষ্ঠায়ও সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন। ইতিহাস খ্যাত ১৯৫৪ সালে ঢাকার কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ‘সাহিত্য সম্মেলনে’র তিনি ছিলেন যুগ্ম-সম্পাদক। এবং আশ্চর্য তিনি বারডেম হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক উদ্যোগের সাথেও জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৫ সালে তিনি মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হাসনার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন।
একজন শক্তিশালী বিদগ্ধ নাগরিক কবি হিসেবে তিনি সমাজের প্রতিটি কল্যাণ মূলক কাজে নিজেকে দাপটের সঙ্গে যুক্ত রেখে নিজস্ব বিবেকের পরিচয় দিয়ে অপরিণত বয়সে ১৯৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পরপারে চলে যান। জানি না কেনো, অল্পদিনের মধ্যেই তিনি বিস্মৃতও হয়ে যান।
তবে বিস্মৃতি তাঁকে বেশি দিন ঘিরে রাখতে পারবে বলে আমার মনে হয় না । তাঁর কাজগুলোর সবই আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক বিবেচনায় ঐতিহ্যগত ও তাৎপর্য গুণে ঐতিহাসিক।
কোনো জাতি সব সময় একই রকমের চিন্তা ও চরিত্রের হয় না বা থাকে না। সকল প্রাণির মতো জাতিও কখনো ঘুমায়, কখনো বা সে জাগে।
‘ জাগ্রত প্রদীপে’র ঔজ্জ্বল্যে যখন জাতি পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাবে চারিদিকে, তখন মনস্বী কবি আবদুল গনি হাজারী আবার পূর্ণ মহিমা নিয়ে তাঁর মরণোত্তর দায়িত্ব পালন করবেন।
আমরা সেদিন আবার তাকে নতুন করে আবিষ্কার করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ঋণ শোধ করবো।
৩ জুন ২০২১