spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাক্ষাৎকারবিশেষ সাক্ষাৎকার : কাজী জহিরুল ইসলাম 

গ্রহণে সজ্জাদ বিপ্লব

বিশেষ সাক্ষাৎকার : কাজী জহিরুল ইসলাম 

 ১.জীবন কি? আপনার বর্তমান জীবন, অবস্থান– যা হতে চেয়েছিলেন বা যা হয়েছেন–এসব নিয়ে কোন আক্ষেপ, অনুশোচনা বা গর্ব হয়?

জহিরুল: জীবন একটি বহমান প্রবাহ। এর শুরু আমার বা আপনার জন্ম থেকে নয়, পৃথিবীতে যখন প্রথম প্রাণের উন্মেষ হলো, তখন থেকেই এর শুরু এবং তা প্রবহমান থাকবে পৃথিবী ধ্বংস হওয়া অবধি। কাল-মহাকালের স্রোতে ভেসে চলেছে একটিই জীবন, তাই আমরা সকলেই যুক্ত। যারা বেঁচে নেই এবং যারা জন্মায়নি তাদের মধ্যে যোগসূত্র নির্মাণ করছি আমরা, যারা এখন বেঁচে আছি। আপনার, আমার ডিএনএ-র মধ্যে কোটি বছরের প্রাণের অস্তিত্ব আছে, তা আরো কোটি বছরের পরের মানুষের দেহেও থাকবে। 

সকল কালেই আমি আমার বর্তমান নিয়ে সুখী ছিলাম। আজকের অবস্থানের কথা আমি শৈশবের দরিদ্র-দিনেও জানতাম। আমি তো সারা জীবন কবি হতেই চেয়েছি, কবিই হয়েছি, কাজেই আমার বড়ো ধরণের কোনো আক্ষেপ নেই। তবে আমার সব কাজই ভালো লাগে। কৃষক হতে চাই, জেলে হতে চাই, ঝাড়ুদার, মেথর, মুচি, অফিসার, রাষ্ট্রনায়ক, সব হতে চাই। তবে কখনোই সৈনিক হতে চাইনি, অস্ত্র হাতে নিয়ে মানুষ মারার কাজ, হোক তা কোনো মহৎ উদ্দেশে, আমি তা করতে চাই না, চাইনি কখনোই। অনেকদিন আগে একবার আমাদের একটি ফ্যানের ব্লেড বাঁকা হয়ে যায়। কেউ তা সোজা করতে পারছিল না। আমি রাগ করে ভাবলাম ওটা ভেঙে ফেলি। ভাঙার জন্য এলোমেলো মোচড় দিয়েছি, ওটা সোজা হয়ে গেছে। তখনই মনে হলো, এই হাত শুধুই সৃষ্টির জন্য ঈশ্বর তৈরি করেছেন, ধ্বংসের জন্য নয়।

কোনো কিছু নিয়ে গর্ব কিংবা অনুশোচনা হয় না। এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারত তা আমার মনে হয় না। যা হয়েছে তা-ই যথার্থ হয়েছে। আমাকে যিনি পাঠিয়েছেন তিনি একটি সুনির্দিষ্ট অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েই পাঠিয়েছেন, আমি সেই কাজটিই করছি। এতে গর্ব হবার তো কিছু নেই। 

২. আপনার শৈশব-কৈশোর কোথায় কেটেছে? কীভাবে কেটেছে? কোন অব্যক্ত কথা বা স্মৃতি কি মনে পরে? তাড়িত করে?

জহিরুল: আমার জন্মের আগে থেকেই আব্বা-আম্মা ঢাকার টিকাটুলি এলাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। আমি প্রথম সন্তান। আমার জন্মের জন্য আম্মা নানা-বাড়ি যান। সেই সুবাদে আমার জন্ম হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার খাগাতুয়া গ্রামে। শৈশব-কৈশোর খুব বর্ণাঢ্য ছিল, এবং তা ছিল ঢাকা এবং খাগাতুয়ায় বিস্তৃত। খাগাতুয়া গ্রামের প্রতিটি গোহালের গরু, আঁতালের হাস-মুরগী, পুকুরের মাছ, পাখ-পাখালির সঙ্গে আমার নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল। গ্রামের এমন কোনো মানুষ ছিল না, আমাকে চিনত না, এমন কেউ ছিলেন না যাকে আমি চিনতাম না। সব কিছুকে জানা, সবাইকে চেনার এক দুর্নিবার আগ্রহ আমার শৈশবেই গড়ে উঠেছিল। যে কোনো বয়সের মানুষের সঙ্গেই আমার সখ্য গড়ে উঠত, যারা নানা-স্থানীয় ছিলেন তাদের অনেকের সঙ্গেই আমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মত। তারা তাদের বিগত যৌন-জীবনের গল্পও আমার সঙ্গে করতেন। আমি শৈশবে পালাগান করতে পারতাম, ওয়াজ করতে পারতাম। পারতাম মানে, এইসব দেখতে দূর-দুরান্তের গ্রামে চলে যেতাম, রাত জেগে দেখতাম, ফিরে এসে তাদের সুরে, উচ্চারণে গ্রামবাসীদের শোনাতাম। তারা উঠানে গোল হয়ে বহুদিন আমার কণ্ঠে পালাগান, কবির লড়াই, ওয়াজের বয়ান ইত্যাদি আনন্দ নিয়ে শুনতেন। যখন ঢাকায় থাকতাম মিশে যেতাম এখানকার শহুরে জীবনের সঙ্গে। ক্রিকেট খেলতাম, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হয়ে এর-ওর গাছ থেকে আম-পেয়ারা চুরি করতাম। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় আমি বড়োদের ক্রিকেট দলে বোলিং করার সুযোগ পাই। আমাদের বাড়িওয়ালী, সুন্দরী আন্টি ছিলেন সিনেমার অভিনেত্রী, বাসন্তী নামে তিনি অভিনয় করতেন, তার সঙ্গে প্রায়শই এফডিসিতে চলে যেতাম। 

একটি অব্যক্ত কথা আছে, যা আমি আজ অবধি কাউকে বলিনি। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় আমি একবার যৌন-নির্যাতনের শিকার হই। ঘটনাটি ঘটে গ্রামে। 

৩. সাহিত্যে এলেন কেন? কীভাবে এলেন?  অর্থাৎ শুরুটা কীভাবে? কোথায়? 

জহিরুল: এই প্রশ্নের উত্তর বহুবার বহু জায়গায় দিয়েছি। খুব ছোটোবেলায় গৃশিক্ষকের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলাম, বড়ো হয়ে নবী হতে চাই। তিনি বলেছিলেন সেটা সম্ভব নয়, তুমি বরং কবি হও। এটা একটা কারণ হয়ত, তবে মূল কারণ নয় নিশ্চয়ই। আমার কবিতা নিয়ে লিখতে গিয়ে কবি আল মাহমুদ বলেছিলেন, এইরকম কবিতা লেখার জন্য কবি হয়ে জন্মাতে হয়। আমারও তাই মনে হয়। কবি হওয়া যায় না। এটি জন্মগত একটি ব্যাপার। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে খাতায় লিখতাম, এর আগে মুখে মুখে কবিতা বানাতাম। একদিন লিখি “হাত নেড়ে নেড়ে তামাকের চারা লাগায় ক’জন চাষী/ বটছায়াতলে কে বসে বাজায় অমন মধুর বাঁশি”। অপরিণত বয়সে লেখা শত শত পৃষ্ঠার কবিতা, গল্প, ভ্রমণ হারিয়ে গেছে। একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় ” বাগান” নামের একটি কবিতা দৈনিক আজাদের সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়। সেই কবিতাও কোনো বইয়ে নেই। এরপর থেকেই প্রকাশ মাধ্যমে আসি।

৪. প্রবাসে কেন এলেন? কিভাবে এলেন? বিস্তারিত বলবেন।  

জহিরুল: আমার স্ত্রী ডেনিশ সরকারের ফেলোশিপ নিয়ে ডেনমার্কে পড়তে যায়, তখন আমি সেখানে বেড়াতে যাই। ওখানকার বাঙালিরা বলে, থেকে যান, আমরা সব ব্যবস্থা করে দিই। আমি প্রত্যাখ্যান করি। জাতিসংঘের চাকরি নিয়ে কসোভোতে যাই ২০০০ সালের এপ্রিলে। ২০০৪ এ একটি কনফারেন্সে যোগ দিতে নিউইয়র্কে আসি। পরিবারের সবাই তখন বেড়াতে আসে। এখানকার বাঙালি বন্ধুরা বলেন, পুরো পরিবার চলে এসেছেন, আর যাওয়ার কী দরকার থেকে যান। আমি বলি, না, অবৈধভাবে বিদেশে থাকবো না। এরপর জাতিসংঘের চাকরির সুবাদের আইভরিকোস্ট, সুদান হয়ে ২০১১ সালে আসি নিউইয়র্কে। সেই থেকে এখানে আছি, আজও চাকরি-সূত্রেই, একজন বাংলাদেশি হিসেবে, জাতিসংঘের ডিপ্লোমেটিক ভিসায়। নিউইয়র্কে আসার আগে মাঝখানে ব্রিটেনের হাইলি স্কিল্ড মাইগ্রেশন প্রোগ্রামে আবেদন করে ওখানকার ইমিগ্রেন্ট হবার সুযোগ পাই এবং ৪ বছর ইংল্যান্ডে থেকে ওখানকার ইমিগ্রেশন প্রত্যাখ্যান করে চলে আসি। আমি নিজেকে একজন আন্তর্জাতিক মানুষ মনে করি, আকাশ আমার ছাদ, পুরো পৃথিবীই আমার ঘর। তবে এটাও মানি আন্তর্জাতিক হতে হলে নিজের একটা দেশ লাগে, আমার সেই দেশ বাংলাদেশ। 

৫. বাংলা ভাষার তথা বাংলাদেশের প্রধান তিন কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ ও শহীদ কাদরী’র সঙ্গে আপনার সখ্য বা ঘনিষ্ঠতার কথা আমরা জানি। তাদের সাহিত্যকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন? আর কার-কার সঙ্গে আপনার সখ্যতা বা বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিলো বা আছে? তাদের সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা বা তাদের সাহিত্য নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই। 

জহিরুল: তিনজনই বড়ো কবি। এই তিনজনের মধ্যে শহীদ কাদরী বিরলপ্রজ, মানে খুব কম লিখেছেন। সর্বসাকুল্যে তার কবিতার সংখ্যা শ’দেড়েক। এতো কম লিখে মেজর পোয়েট হওয়া যায় না কিন্তু শহীদ কাদরী হয়েছেন। কেন হয়েছেন? কারণ, তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে, নিজের বায়োলজিক্যাল বয়সের চেয়ে তার মানষিক বয়স অনেক বেশি পরিপক্ক ছিল। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে তিনি কবিতায় যে পরিভাষা ব্যবহার করেছেন তা ছিল তার সামসময়িক এবং উত্তর প্রজন্মের কবিদের কাছে অনুকরণীয়। একজন কবি যখন তার ভাষার কবিদের কাছে অনুকরণীয় হয়ে ওঠেন তখন তিনি সেই ভাষার একজন প্রধান কবির আসনে অধিষ্ঠিত হন। এই তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে প্রখর কাব্যপ্রতিভা ছিল আল মাহমুদের। তিনি যা লিখতেন তা-ই কবিতা হয়ে উঠত। আল মাহমুদ বাংলা কবিতাকে একটি দিক নির্দেশনা দিতে পেরেছিলেন, তা হচ্ছে লোকজ শব্দরাজীর আধুনিক উপস্থাপন। আজ আমরা যেমন পান্তা ভাত মার্বেল পাথরের আধুনিক ডায়নিং টেবিলে বসে খাই, কবিতায়, সাহিত্যে এই কাজটি আল মাহমুদ করেছেন। এই কাজের তিনিই পাইওনিয়ার। নগ্নতা এবং যৌনতার শৈল্পিক উপস্থাপনেও আল মাহমুদ দক্ষতা দেখিয়েছেন। আধ্যাত্মিকতা আধুনিক বাংলা কবিতায় প্রায় উপেক্ষিত ছিল, এটিও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন, যদিও এজন্য তাকে আজও গালমন্দ শুনতে হয় কিন্তু নিন্দুকেরাও একথা বলেন না যে এই কবিতাগুলোতে কাব্যগুণ এবং শিল্পগুণের কোনো কমতি আছে। শামসুর রাহমান বড়ো কবি হয়ে উঠেছেন তার রাজনীতি-সম্পৃক্ততার কারণে। তিনি সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের ওপর প্রচুর কবিতা লিখে এই জনপদের মানুষের প্রাণের কবি হয়ে উঠেছেন। তিনি যে কোনো বিষয় নিয়ে যখন-তখন কবিতা লিখতে পারতেন। তাকে কবিতার ফ্যাক্টরিও বলা যায়। ফরমায়েশ দেন, একদিন পর এসে কবিতা নিয়ে যান। এতে করে শিল্পগুণের একটা বড়ো ঘাটতি তার অধিকাংশ কবিতাতেই দেখা যায়। তিনি হাজার হাজার কবিতা লিখেছেন কিন্তু চমকে দেবার মতো লাইন খুব বেশি পাওয়া যায় না। খুব কম বয়সেই তিনি কবিতার রীতি-নীতি, ছন্দ-প্রকরণ ইত্যাদি শিখে ফেলেছিলেন, ফলে তিনি যা-ই লিখেছেন সবই কবিতা হয়ে উঠেছে। 

এই তিন কবির সঙ্গেই আমার সখ্য ছিল। কাছে থেকে সবাইকে দেখেছি। তবে বেশি বন্ধুত্ব ছিল আল মাহমুদের সঙ্গে। তাদের সামসময়িক আরো একজন কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের সঙ্গেও আমার নিবিড় সখ্য ছিল। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে আশি-নব্বুইয়ের দশক পর্যন্ত যারা ভালো কবিতা লিখেছেন, লিখছেন তাদের প্রায় সকলের সঙ্গেই আমার জানাশোনা, আলাপ-পরিচয় আছে। বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আমার গড়ে উঠেছিল সত্তরের কবিদের সঙ্গে, আতাহার খান, মাহবুব হাসান, জাহিদ হায়দার, দাউদ হায়দার, সৈয়দ হায়দার, শিহাব সরকার, আবিদ আজাদ, কামাল চৌধুরী, ইকবাল আজিজ, মতিন বৈরাগী, নাসরীন নঈম, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, জাফরুল আহসান, কাজী সালাহউদ্দিন, শেখ সামসুল হক, আমিনুল হক আনওয়ার, সৈয়দ কামরুল প্রমূখের সঙ্গে আমার কম-বেশি আড্ডা, আলাপ হয়েছে। ষাটের কবিদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ, আল মুজাহিদী, জরিনা আখতার, রফিক আজাদ, আনওয়ার আহমদ, নির্মলেন্দু গুণ, সমুদ্র গুপ্ত, অসীম সাহা, শামসুল ইসলাম, জাহিদুল হক, মহাদেব সাহা, কাজী রোজী প্রমুখের সঙ্গে প্রচুর আলাপ-আড্ডার সুযোগ হয়েছে। আশির কবিদের মধ্যে রহিমা আখতার কল্পনা, দিলারা হাফিজ, রেজাউদ্দিন স্টালিন, শাহীন রেজা, মারুফ রায়হান, মারুফুল ইসলাম, মাসুদ খান প্রমুখ আমার বন্ধু স্থানীয়। পঞ্চাশের কবিদের নিয়ে তো বিস্তারিত বললামই, ষাটের কবিদের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণ এবং রফিক আজাদকেই প্রধান যুগল মনে হয় আমার কাছে। রফিক আজাদ ছিলেন আমাদের কালের সবচেয়ে ছন্দ-সচেতন কবি। নির্মলেন্দু গুণ ন্যাচারাল কবি-প্রতিভা, তিনি খুব বেশি প্রকরণসিদ্ধ কবি নন। সত্তরের কবিদের মধ্যে আমি আবিদ আজাদ এবং রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহকেই প্রধান যুগল বলবো এবং তা বলা এই মুহূর্তে কিছুটা নিরাপদও, কেননা দুজনই প্রয়াত, জীবিত কারো নাম নিতে গেলে বিপদের সম্ভাবনা আছে। আশির দশকের কবিদের কারো নাম এই মুহূর্তে করছি না, তবে পরে এই দশকের ওপর আমি একটি মূল্যায়ন করবো। 

৬. আপনি একাধারে একজন কবি-সম্পাদক-অনুবাদক-ভ্রমণলেখক–অর্থাৎ বহুমাত্রিক। আপনার অভিজ্ঞতা ও বিচরণ ক্ষেত্র ব্যাপক ও বর্ণিল। বিচিত্র। এই সামগ্রিক সত্তাকে কিভাবে দেখেন? কিভাবে উপভোগ করেন? 

জহিরুল: লেখালেখির ক্ষেত্রে আমি এক সীমাহীন অতৃপ্তি অনুভব করি। যখন যে জনরা আমাকে টানে আমি সেখানেই হাত দেই। আমি আসলে বৈচিত্র-প্রিয় মানুষ। শুধু কবিতার কথাই যদি বলেন, দেখবেন, সনেট, হাইকু, রুবাইয়াত, পানতুম, লিমেরিক এবং আমার নিজের উদ্ভাবিত ক্রিয়াপদহীন কবিতা, কী-না লিখেছি, লিখছি। ভিন্ন ভিন্ন ছন্দে কবিতা লিখে বইও করছি। শুধু স্বরবৃত্তে লিখলাম “শেষ বিকেলের গান” মাত্রাবৃত্তে “ভোরের হাওয়া”। অক্ষরবৃত্তেও একটা বই লিখছি ” রোদেলা দুপুর” এরপর ফ্রি-ভার্সেও একটা লিখব। প্রায় দু’হাজার কবিতা লিখেছি, বিষয় বৈচিত্রের দিক থেকেও আপনি একটা ওয়াইড রেঞ্জ খুঁজে পাবেন। একবার বিখ্যাত আবৃত্তিশিল্পী মাহিদুল ইসলাম এক অনুষ্ঠানে বলছিলেন, “যখন নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের ওপর কবিতা দরকার হয়, আমরা নজরুল, রবীন্দ্রনাথের কাছে হাত পাতি, সেখানেও যদি ব্যর্থ হই তখন হাত পাতি কাজী জহিরুল ইসলামের কাছে এবং নিশ্চিত জানি যে এখানে পাবোই।”  

নানান কিছু লিখলেও আমার আরাধ্য হচ্ছে কবিতা। দেখবেন, অনুবাদের ক্ষেত্রেও আমি শুধু কবিতাই অনুবাদ করেছি। কেন কবিতা অনুবাদ করি? কারণ অনুবাদের মধ্য দিয়ে আমি সেইসব কবিতার অন্তরে ঢোকার চেষ্টা করি। সাধারণত পাঠে তা হয় না। একই কবিতায় একটি শব্দকে, যদি একাধিকবার উল্লেখ করার প্রয়োজন হয়, আমি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিশব্দে উল্লেখ করার চেষ্টা করি। রিপিটেশন এড়াবার চেষ্টা। লক্ষ করে দেখবেন আমি প্রচুর নতুন শব্দ তৈরি করেছি, প্রচুর বিদেশি শব্দ ও অনুষঙ্গ বাংলা কবিতায় নিষিক্ত করেছি। ফলে আমার একটি নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি। 

সাহিত্যের নানান বিভাগে কাজ করলেও বেশি করেছি কবিতা ও ভ্রমণসাহিত্যে। আমার ভ্রমণগুলো কিন্তু নিছক ভ্রমণের বর্ণনা নয়। সেখানে প্রচুর তথ্য যেমন আছে আবার উপন্যাসের ভাষায় লেখা প্রচুর গল্পও আছে। এ ছাড়া আমি প্রচুর মুক্তগদ্য, প্রবন্ধ এবং কলাম লিখেছি। কিছু ছড়া ও গান লিখেছি। দুটি গল্পের বই আছে, এর বাইরেও কিছু অগ্রন্থিত গল্প আছে। ৪টি উপন্যাস লিখেছি। তবে উপন্যাসে আমি উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পেরেছি বলে মনে করি না। আমার গল্প থেকে টিভি নাটক হয়েছে। কয়েকটা গানও লিখেছি। সাহিত্যের যে কোনো শাখায় কাজ করতেই আমি পছন্দ করি, তবে আবারও বলি, কবিতাই আমাকে টানে বেশি।

৭. সম্প্রতি আপনি উমরাহ হজ্জ্ব পালন করেছেন। আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করেছেন। রাসুল (সা) এর রওজা জিয়ারত করেছেন। এবারই কি প্রথম এই হজ্জ্ব যাত্রা? আপনার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি জানতে চাচ্ছি। আপনি একজন খ্যাতিমান গদ্যকার। গল্পকার। কথাসাহিত্যিক। আপনার কি ইচ্ছে জাগে নাই, নবী’র (সা) জীবনী রচনার? হজ্জ্ব নিয়ে কোন গ্রন্থ রচনার? আমরা জানি, কবি সৈয়দ আলী আহসান এর “হে প্রভু আমি উপস্থিত” এবং কবি আল মাহমুদ এর “মহানবী”(সা) জীবনী– অসাধারণ এই দুটি গ্রন্থ’র কথা। আপনার সেরকম কোন পরিকল্পনা বা ইচ্ছে আছে কি-না, জানতে চাচ্ছি?

জহিরুল: ধর্মের রিচুয়ালসগুলো হচ্ছে আধ্যাত্মিকতায় প্রবেশের দরোজা। আমার লেখায় প্রচুর আধ্যাত্মিক অনুষঙ্গ পাবেন। যখন সরাসরি প্রবেশ করতে পারি না তখন দরোয়ার কড়া নাড়ি। ওমরাহ করতে গিয়ে যখন পবিত্র ক্কাবা স্পর্শ করেছি আমার মনে হয়েছে আমি নবী ইব্রাহীম, নবী ইসমাইল সহ এখানে আসা শত শত কোটি মানুষকে এক সঙ্গে ছুঁয়ে ফেলেছি। আমি এক বিশাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছি। নিজের মধ্যে আমি এক বৃহৎ শক্তির উপস্থিতি অনুভব করেছি। না, আমি মদিনায় রসুলের রওজায় যাইনি, সময়ের অভাবে যেতে পারিনি, তবে ইচ্ছে আছে আল্লাহ সহায় হলে আবারও ওমরাহ করতে যাবো, তখন রসুলের রওজায়ও যাবো।

মুহাম্মদ [স:] সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন মানুষ। তাকে নিয়ে লক্ষ লক্ষ পুস্তক রচিত হয়েছে। আমার মত সামান্য মানুষ তার জীবনী লিখে নতুন কিছু কি উপহার দিতে পারব? তবে তার কথা, যা মানব সভ্যতার জন্য কল্যাণময় তা আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করি। যেমন তিনি ভ্রমণের ওপর খ্যব গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, “তুমি কতটা জ্ঞানী তা বলতে এসো না, বরং বলো কতটা পথ হেঁটে এসেছ।”

৮. আপনার পূর্ববর্তী দশকের কবিদের মধ্যে কে- কে আপনার বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ? কেন? বিস্তারিত জানতে চাই। 

জহিরুল: আমি এই প্রশ্নের উত্তর আগেই দিয়েছি। তবে তাদের বাইরেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি কবি আছেন। অন্য এক আলোচনায় হয়ত শুধু এই দিকটি নিয়েই আলোচনা করা যাবে।

৯. আদি বাংলা তথা চর্যাপদ থেকে আজ অবধি বাংলা সাহিত্য কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে–আপনার বর্ণনা ও বিশ্লেষণে? 

জহিরুল: কবিতার ভাষায় বিরাট বিবর্তন ঘটেছে, কাঠামোর দিক থেকে কিংবা বিষয়ের দিক থেকে আমুল কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। কুড়ি শতকের ত্রিশের দশকের কবিরা বাংলা কবিতার মৌলিকত্ব বিনষ্টে বড়ো ভূমিকা রেখেছেন। বুদ্ধদেব বসু গংরা সকলেই ছিলেন ইউরোপীয় [মানে ইংরেজি] সাহিত্যের ছাত্র ও শিক্ষক, তারা বাংলা কবিতাকে কলোনিয়াল কবিতা করে তুলেছেন। ধুতি, পাঞ্জাবী, লুঙ্গি, কোর্তা খুলে বাংলা কবিতার গলায় টাই ঝুলিয়ে দিয়েছেন। কলোনিয়াল স্লেইভারি আমাদের মধ্যে তো ছিলোই, এখনো আছে, যে কারণে পাশ্চাত্য ধারাটিকে আমরা খুব দ্রুতই লুফে নিই। এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন নজরুল এবং জসীম উদদীন, কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপকেরা এই দুজনকে উপেক্ষা করেই গেছেন। আমার মনে হয় এখন সময় এসেছে মূলধারায় ফেরার। 

১০. একজন প্রবাসী বা ডায়াস্পোরা সাহিত্যিক হিসেবে, কোন-কোন চ্যালেঞ্জ বা সুবিধা-অসুবিধা আছে বলে আপনার মনে হয়? কীভাবে এগুলি মোকাবিলা করেন?

জহিরুল: শহীদ কাদরী একদিন আমাকে বলেছিলেন, “মিয়া ঢাকা থাইকা চিটাগাং গেলেই ওরা মুইছা দিবার চায় আর তুমি তো থাকো নিউইয়র্কে।” এইটা একটা সমস্যা, দূরে থাকার ফলে ঈর্ষাজনিত কারণে প্রবাসের বড়ো প্রতিভাদের, দেশের যারা সাহিত্যের হর্তাকর্তা, তারা ইগনোর করে। দেখবেন, প্রবাসের অলেখক, সাব-স্ট্যান্ডার্ড লেখকদের এরা ঠিকই তুলে ধরে, পদক-টদক দেয়। এর মধ্য দিয়ে জাতিকে এরা বোঝায়, প্রবাসে মাল নাই। এই কুপমণ্ডুক মানসিকতা জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক সুচককে নিম্নমুখী করে তুলেছে। তবে সোস্যাল মিডিয়া এবং অন্তর্জালের কারণে সারা পৃথিবী এখন একটি গ্রাম হয়ে উঠেছে, কাউকে এখন আর আড়াল করে রাখা যাবে না। 

গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব। ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on ‘প্রথম আলো’র বিকল্প
পথিক মোস্তফা on মানবিক কবি ফররুখ আহমদ
মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন on ক্রান্তিকাল
এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা