কাজী জহিরুল ইসলাম
কবি রফিক আজাদের সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয় ছিল কিন্তু এক সঙ্গে বসে অন্তরঙ্গ আড্ডা দেবার সুযোগ তেমন ঘটেনি। যে সুযোগটি আমার ঘটেছে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন এবং শহীদ কাদরীর সঙ্গে। আশির দশকের শেষের দিকে এক সন্ধ্যায় হাঁটতে হাঁটতে তার বাসায় গিয়ে হাজির। তখন তিনি ধানমন্ডির ১ নম্বর রোডে থাকেন। খোলা বারান্দায় অন্ধকারের মধ্যে বসে আছেন। গায়ে একটি স্যান্ডো গেঞ্জি। আমি হঠাৎ কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না, তার কণ্ঠও জড়ানো। তিনি এমনভাবে আমার সাথে কথা বলছেন যেন আগের দিন আমি দু’ঘন্টা আড্ডা মেরে গেছি, অসমাপ্ত আড্ডাটা জমিয়ে তুলতে আজ আবার এসেছি। আমি তার অসংলগ্ন কথায় কিছুটা ঘাবড়ে যাই এবং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কেটে পড়ি। পরে বহুবার রফিক ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তার কথা বলার ভঙ্গিটিই এমন ছিল যে মনে হতো সর্বক্ষণ নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। হ্যাঁ, নেশায় ডুবে তো থাকতেনই, সেটা শিল্পের নেশা, প্রেমের নেশা, কবিতার নেশা।
২০০৭ এ, আমার নিকেতনের বাসায় আড্ডা জমে উঠেছে। হঠাৎ সমুদ্র গুপ্ত আমার হাতে তার সেল ফোনটি ধরিয়ে দিয়ে বলেন, নে রফিক ভাইকে পয়ষট্টি পূর্তির শুভেচ্ছা জানা, খুশি হবেন। রফিক ভাই তখন হাসপাতালের বেডে। রফিক ভাইয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কথা-বার্তা ছাড়া ঘনিষ্ঠ আড্ডা দেবার সুযোগ আমার এই দীর্ঘ সময়েও আর ঘটেনি। তখন আমি এতোটা জড়তাহীনও ছিলাম না যে চট করেই কারো সঙ্গে, বিশেষ করে রফিক ভাইয়ের মত এতো বড় একজন কবির সঙ্গে, কথা বলা শুরু করে দিতে পারি। আমি তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই। তিনি তখনও, অসুস্থ শরীরে, জড়িয়ে জড়িয়ে আন্তরিক আলাপ জুড়ে দেন। যেন কত কত দিন আমরা একসঙ্গে বসে আড্ডা দিয়েছি। রফিক ভাইকে তার অনুজপ্রতিম কবিরা ওস্তাদ বলে ডাকতেন, তিনি তাদের সম্বোধন করতেন বেটা বলে। আবার তিনি নিজেও ওস্তাদের জবাবে ওস্তাদ বলতেন। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে আমাকেও স্নেহের কণ্ঠে ওস্তাদ বলছিলেন। তার গোঁফ, পোশাক, বাইক চালানো, ইত্যাদি দেখে আধুনিক মনস্কতার পাশাপাশি কিছুটা রুক্ষ মনে হত কারো কারো কিন্তু তিনি প্রকৃতপক্ষে ছিলেন খুব কোমল মনের মানুষ। চেনা-অচেনা সকলের সঙ্গেই এমনভাবে কথা বলতেন যেন কতকালের চেনা, কত আপন। এই গুণ একজন মানবিক বোধসম্পন্ন কবির মধ্যেই কেবল খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের কবিদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। রফিক আজাদ তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি কাদেরিয়া বাহিনীর একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছেন কিন্তু প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মধ্যে যখন বিস্তর ফারাক দেখতে পেলেন তখন আর অস্ত্র নয় জ্বলে ওঠে তার কলম। লিখে ফেলেন, ‘ভাত দে হারামজাদা তা না হলে মানচিত্র খাবো’।
যখন থেকে কবিতা লেখা শুরু করেছি, “ভাত দে হারামজাদা” খ্যাত কবি রফিক আজাদ আমার কাছে এক জীবন্ত কিংবদন্তী। পরবর্তীকালে যখন নিবিড়ভাবে তাকে পাঠ করতে শুরু করি তখন তার বহু কবিতাই প্রিয় কবিতার তালিকায় উঠে এসেছে। একবার পশ্চিমবঙ্গের কাগজ “কৌরব” এর জন্য আল মাহমুদের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পঞ্চাশ মানেই তো আল মাহমুদ আর শামসুর রাহমান। ষাটের কবিদের বেলায় কি এমন যুগল নাম উচ্চারিত হবে? তিনি বলেন, হবে, রফিক আজাদ আর নির্মলেন্দু গুণ।
রফিক আজাদের কবিতা সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন শহীদ কাদরীও। শহীদ ভাইয়ের সাথে প্রত্যেকের নাম ধরে ধরে, কবিতা ধরে ধরে, দিনের পর দিন আলোচনা করেছি। তিনিও ষাটের কবিদের মধ্যে দুজনকে প্রধান কবি মনে করতেন, তাদের একজন রফিক আজাদ। অন্যজন কিন্তু নির্মলেন্দু গুণ না। তিনি গুণ সম্পর্কে বলতেন, খালি গল্প আর গল্প, কবিতা কই মিয়া? তার বিচারে ষাটের প্রধান কবি রফিক আজাদ, অন্যজন আবদুল মান্নান সৈয়দ।
যারা রফিক ভাইকে নিবিড়ভাবে পাঠ করেননি, তারা বলেন, রফিক আজাদ শুধু অক্ষরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখেছেন। অতিমাত্রায় প্রবন্ধগন্ধী তার কবিতা। কিন্তু নিন্দুকেরাও স্বীকার করেন প্রবন্ধগন্ধী হলেও কী এক জাদুমন্ত্রের কারণে শব্দগুলো তার কবিতায় বসার পরে সফল কবিতা হয়ে ওঠে। একটি উদাহরণ দিই – ‘শেষোক্ত প্রাণীরা শুধু ক্ষতস্থান খুঁজে তুষ্ঠ থাকে/ ক্ষত সৃষ্টি সাধ্যের অতীত ব’লে তারা তো কেবলই/ মানুষের সৃষ্ট ক্ষতে ব’সে ক্ষরিত রক্তের থেকে/ বিষ পান করে শুধু জেনে-শুনে, পান ক’রে থাকে’ (মানুষেরা বড় ভয়াবহ প্রাণী)।
দেখুন ভারী শব্দের ভারে কবিতাটি কিন্তু কাব্যিকতা হারায়নি। এর প্রাধান কারণ হলো শুদ্ধ অক্ষরবৃত্ত ছন্দের প্রবহমানতা। ছন্দের সাথে তিনি মোটেও আপোষ করেননি।
অনেকে রফিক আজাদের কবিতায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দ খুঁজে পান না। তাদের জন্য কয়েক লাইন উদ্ধৃত করছি।
‘চক্ষু বুঁজে বুকের কাছে খোঁজে/ বুঝি বা তার বুকের মাঝে আছে/ গুপ্তধন – লক্ষ শত ঘড়া;/ লুকিয়ে আছে রক্তে একজোড়া/ বাস্পাতুর নম্র নত আঁখি।/ কিংবা এক রক্ত-ঠোঁট পাখি/ শব্দহীন আর্তনাদে ভিজে/ করুণ স্বরে করছে ডাকাডাকি।’ (এক উন্মাদের জীবনচরিত)
পাঁচ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দের একটি সফল কবিতা। এই কবিতাতেও কিন্তু প্রবন্ধগন্ধী শব্দের সফল কাব্যিক ব্যবহার তিনি করেছেন। তিনি নিজেও নিজেকে নিয়ে মজা করে বলতেন, আমি তো কবিতা লিখি না কাব্য-প্রবন্ধ লিখি। শুধু বলতেনই না, কবিতাতেও সেই মজাটি তিনি করেছেন –
‘কয়েক দশক আগে হলেও/ বলতুম ‘পায়ে হেঁটে’ নয় -/ ‘পদব্রজে’…/ ‘পদব্রজ’ শব্দটি একই সঙ্গে/ খুব সুন্দর এবং হাস্যকর!/ আমার বাবা এই শব্দটি এক সময়/ ভীষণ পছন্দ করতেন -/ এবং প্রকৃতপক্ষে তিনি পদব্রজে/ বহু দীর্ঘ পথ অতিক্রম ক’রে/ এখন বার্ধক্য নামে এক/ অস্পষ্ট বিদেশি হাওয়ায়/ এসে পৌঁছছেন…’ (‘পদব্রজে’ না ‘পায়ে হেঁটে’)।
প্রতীক্ষার মতো একটি ভারী শব্দ তিনি কবিতায় কত সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তা-তো আমরা সকলেই জানি। এটিই একজন বড় কবির ক্ষমতা। এই ক্ষমতা খুব কম কবির মধ্যেই দেখা যায়। অনেকেই হয়ত জানেন না, প্রতীক্ষা কবিতাটি তিনি তার প্রিয়তমা (এবং পরে স্ত্রী) দিলারা হাফিজকে নিয়েই লিখেছেন। রফিক আজাদ প্রকৃতপক্ষে একজন প্রেমের কবি। তার মধ্যে প্রেমের হাহাকার ছিল, অপ্রাপ্তির বেদনা ছিল। টানা গদ্যে রচিত নারী কবিতায় এই অপ্রাপ্তির কথা, এই প্রতীক্ষার কথা তিনি লিখেছেন – ‘তো বালকের উথাল-পাথাল বুকে নানা ঢেউ এসে আছড়ে পরে – কোনো এক কিশোরীর চঞ্চল চোখের চাউনি, কারু পিঠ ছেয়ে নেমে আসা ঘনকৃষ্ণ কুন্তলদাম, কারু হাসির ঝর্ণাধারা, কারু বা দেহসৌষ্ঠব, গালের তিল, ওষ্ঠপ্রান্ত। একক একাকী নির্দিষ্ট কেউ নয়, বালক সবার কাছ থেকে তিল-তিল সৌন্দর্য আহরণ করে গড়ে তোলে এক মানসিক ‘তিলোত্তমা’ কিশোরী – সেই কিশোরীই ধীরে ধীরে বয়ঃপ্রাপ্ত হচ্ছে এখনো – মৃত্যুর আগে হয়ত এক পরিপূর্ণ ‘নারী’ এসে আসন পাতবে তার কবিতায়। সেই প্রতীক্ষায় সুদূরের পিয়াসী এক বিহ্বল বালক এখনো নদীতীরে দাঁড়িয়ে আছে’।
সাত মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে, যাকে আমরা মন্দাক্রান্তা ছন্দও বলি, বাংলা ভাষায় খুব বেশি কাজ হয়নি। কবি রফিক আজাদও এই ছন্দে একটি কবিতা লিখেছেন – ‘বালক জানে না তো পুষবে অনুরাগ/ হৃদয়ে কতদিন, কার বা চলা-পথে/ ছড়াবে মুঠো মুঠো বকুল ফুলগুলো;/ কোথায় যেতে হবে, যাবে না কোনদিকে,/ ব্যাপক হাঁটাহাঁটি করবে কোন পথে!’ (বালক ভুল করে নেমেছে ভুল জলে)।
স্বরবৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্ত ছন্দে তিনি কম লিখেছেন একথা ঠিক কিন্তু যা লিখেছেন তা বেশ সফল কাজ। একটি স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতা থেকে কয়েক পঙক্তি এখানে উপস্থাপন করছি – ‘উৎস-মুখের স্বচ্ছ জলের তলে/ খড়কুটো নয় পাথর প’ড়ে থাকে;/ প্রতিবন্ধক দারুণ প্রবল ব’লে/ নদীর উৎসে ক্ষিপ্র খরধারা।/ জলের মধ্যে ধাউর পাথররাশি/ জলের বাইরে অর্থহীন ও জড়;/ উষ্ণ জলের গতির চঞ্চলতা/ পাথর দাঁড়ায় রুদ্ধ ক’রে দিতে;/ কিন্তু খুবই মজার ব্যাপার হলো/ পাথর শুধুই হচ্ছে পরাজিত!’
রফিক ভাইকে নিয়ে প্রচুর গল্প/গসিপ আছে। অধিকাংশই প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য, তাই সব বলা যাবে না। একটি গল্প বলি। গল্পটি আমাকে বলেছেন কবি আতাহার খান। এক রাতে সাকুরা থেকে মদ্যপান করে ফিরছেন রফিক আজাদ এবং আতাহার খান। রফিক ভাই বাইক চালাচ্ছেন। মধ্যরাত। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই। হঠাৎ হঠাৎ পথে কাউকে দেখলেই একটি নোংরা গালি দিচ্ছেন। আতাহার ভাই গল্পটি বলার সময় গালিটি উচ্চারণ করতে পারেননি। এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যালের কাছে গিয়ে এক পুলিশ সার্জেন্টকেও তিনি একই গালি দেন। পুলিশ সার্জেন্ট উল্টো দিকে যাচ্ছিলেন। তিনি তার মোটর সাইকেল ঘুরিয়ে পিছু নেন। অ্যারোপ্লেন মসজিদের কাছে গিয়ে ওভারটেক করে পথ রোধ করে দাঁড়ান। রফিক ভাই মোটর সাইকেল থামিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। আস্তে করে আতাহার ভাইকে বলেন, বেটা ঝামেলা হয়ে গেল। আতাহার খান বলেন, লোকজন দেখে গালি দিবেন না ওস্তাদ। সার্জেন্ট কাছে এসে স্যালুট দিয়ে বলেন, স্যার কেমন আছেন? আমাকে চিনতে পারছেন? আমি আজাদ স্যার। কাগমারির মোহাম্মদ আলী কলেজে আমি আপনার ছাত্র ছিলাম।
কবি দিলারা হাফিজ রফিক আজাদের স্ত্রী। তিনি নিজেও একজন সফল কবি ও সাহিত্যিক। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখেছি, নিজের কথা তিনি কখনোই কোথাও তেমন বলেন না, যখনই কোথাও কথা বলার সুযোগ আসে কবি হিসেবে রফিক আজাদকেই তিনি সামনে নিয়ে আসেন। তখন মনে হয় এই নারীর জন্যই হয়ত তিনি সারা জীবন প্রতীক্ষা করে দাঁড়িয়ে ছিলেন নদীর অন্য পাড়ে। তার জন্যই তিনি লিখেছেন – ‘এমন কাউকে খুঁজি/ যে হবে আমার/ বোধের অংশীদার/ এমন কাউকে খুঁজি/ যার চোখ দেবে কর্মে প্রবর্তনা;/ এমন কাউকে খুঁজি/ যার মুখ চেয়ে জীবনকে আগলাবো;’
রফিক ভাই আমাদের মাঝে নেই, এটি একটি ডাঁহা মিথ্যে কথা। একজন প্রকৃত কবির মৃত্যু নেই। তিনি আছেন, তিনি থাকবেন। আজ কবি রফিক আজাদের ৭৯ তম জন্মদিন। কবিকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে তার লেখা আমার খুব প্রিয় একটি কবিতার কয়েক পঙক্তি উদ্ধৃত করেই শেষ করছি।
“যেখানে রয়েছো স্থির – মূল্যবান আসবাব, বাড়ি;
কিছুতে প্রশান্তি তুমি এ-জীবনে কখনো পাবে না।
শব্দহীন চলে যাবে জীবনের দরকারি গাড়ি-
কেননা, ধ্বংসের আগে সাইরেন কেউ বাজাবে না।
প্রোথিত বৃক্ষের মতো বদ্ধমূল আমার প্রতিভা –
সাধ ছিল বেঁচে থেকে দেখে যাবো জিরাফের গ্রীবা।”
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১ ফেব্রুয়ারি ২০২১।