spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধএকুশের আবৃত্তি

লিখেছেন : নাসিম আহমেদ

একুশের আবৃত্তি

নাসিম আহমেদ

একুশের সাহিত্য শুরুই হয়েছে সদ্য রচিত একটি কবিতা এবং চট্টগ্রামের প্রতিবাদ সভায় কবিকণ্ঠে সেই কবিতা আবৃত্তির মধ্যদিয়ে। একুশ বললেই মুহূর্তে আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে ইতিহাসের সেই সব দিন যখন ভাষার জন্যে বুকের রক্ত ঢেলেছিলেন ভাষা শহীদেরা। একুশ এখন বাংলাদেশের ও পৃথিবীর মানুষের চেতনার অবনিশ্বর বীজমন্ত্র। একুশ এখন বাংলাভাষা ও বাংলাদেশের সমার্থক। বুকের রক্তে কেনা বাংলাভাষার রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্যনির্ভর সাহিত্য। আর বাংলা সাহিত্য মূলত কবিতা নির্ভর। বাংলাদেশের মানুষ কবিতাপ্রেমী। আমাদের জীবনে সমাজে ও রাষ্ট্রের আশা-আকাক্সক্ষা আনন্দ বেদনার ছবি সাহিত্যের যে শাখায় সবচেয়ে বেশি প্রতিবিম্বিত হয়েছে তার নাম কবিতা। একুশের ঘটনা প্রবাহ ছিল বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদায় সমুন্নত থাকবে কি থাকবে না সে প্রশ্ন নিয়ে । আবেগ যুক্তি ও অস্তিত্বের সুবিশাল পটভ‚মি নিয়ে গড়ে উঠেছে একুশ। বাঙালির জীবনে একুশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক মৌলিক ঘটনা। এই সুবিশাল ঘটনায় আমাদের সাহিত্যের কবিতা শাখা সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। সচকিত হয়ে বহু বছরের ব্যবহৃত খোলস ঝেড়ে মুছে ভাষার নামে স্বাজাত্যবোধের প্রয়োজনে শত শত কবিতাকর্মী সৃষ্টিশীলতার অর্গল খুলে দিয়েছে। ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রামে কবি মাহবুব-উল আলম চৌধুরী“কাঁদতে আসিনি ফাঁসীর দাবি নিয়ে এসেছি” সৃষ্টি হওয়া থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত একুশে নিয়ে আমাদের কবিদের সৃজনশীলতা ক্লান্তিহীন উৎসাহব্যঞ্জক। একুশকে নিয়ে তাঁরা কবিতা লিখতে পারলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন। ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসীর দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি চট্টগ্রামের প্রতিবাদ সভায় ২২শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে তিনি পাঠ করেন এবং মুদ্রিত কপি জনতার মাঝে বিতরণ করেন। শুরু হলো একুশের সাহিত্য আর একুশের আবৃত্তির একত্র পথ চলা। আর সেই জন্মলগ্ন কাল থেকেই একুশের কবিতা ও তার আবৃত্তির ধারা একে অপরের পরিপূরক হয়ে পরিবেশিত হচ্ছে।
মঞ্চ মিডিয়াগুলো একুশের অনুষ্ঠানমালা নির্মাণ করে কবিতা আবৃত্তিকে প্রাধান্য দিয়ে। ঈদ উৎসব, রমজান উৎসব, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, পহেলা বৈশাখ, দুর্গাপূজা, বৌদ্ধপূর্ণিমা, বড়দিন, ইত্যাদি অনুষ্ঠানের চেয়ে একুশের অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি বেশি পরিবেশিত হয়। একুশের সকল অনুষ্ঠান যেন আবৃত্তিরই অনুষ্ঠান–কবিতারই অনুষ্ঠান। জনপ্রিয় কবিতা থেকে শুরু করে সদ্যসৃজিত কবিতার আবৃত্তি যত্রতত্র। শ্রোতা দর্শক তা বিপুল উৎসাহে গ্রহণ করছেন। আমরা জানি অমর একুশে, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবস নিয়ে শিল্প সাহিত্যের অন্যান্য শাখার চেয়ে কবিতাই লেখা হয়েছে বেশি। এটিও একুশের আবৃত্তি বেশি হওয়ার একটি কারণ বলে মনে করি। একুশের কবিতায় কবিরা কল্পনা প্রতিভা, আবেগানুভ‚তি স্বতঃস্ফ‚র্তি দিয়ে বারবার মূল্যায়ণ পুনর্মূল্যায়ন ও পুনসৃষ্টি করেন একুশকে। একুশকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতি আগামীর স্বপ্ন দেখে চলেন। করিরা স্বপ্নদ্রষ্টা এবং দার্শনিক। একজন মহৎ কবি তার জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়ে চলেন। কবিতায় স্বপ্নের বীজ গভীর ও তীব্রভাবে বুনে দেয়া যায়। একুশের কবিতায় মানুষ জয়ের গভীর উল্লাস আর আগামী স্বপ্নের প্রতিফলন দেখতে পায় বলেই তা গ্রহণ করে বেশি। আবৃত্তির কাজ হলো কবিতার ব্যাখ্যা করা পুনর্জন্ম দেয়া। লিখিত শব্দের ধ্বনি মাধুর্য দান করা, তাকে জীবন্ত করা।
বাক্যের শিল্পিত উচ্চারণই আবৃত্তি। আবৃত্তিতে মূর্ত হয় বাক্যের অন্তর্নিহিত ক্ষণিক ও চিরকালীন ভাবনা, সমস্ত স্বপ্ন এবং দেখা-অদেখা চেনা-অচেনার যাবতীয় নির্মাণ। কবিতা ছন্দের ঐশ্বর্যে গ্রথিত বলে কণ্ঠেই তার পূর্ণতা। ললিত ধ্বনিতেই সে জাগ্রত, শিল্পিত সৌকর্যে সে দেদীপ্যমান। অগোচরের গূঢ়কে বর্ণিল বৈভবে পূর্ণ প্রকাশ করার জন্য কণ্ঠের সৃজনশীল প্রকাশভঙ্গি একটি নতুন মাত্রিকতা পেয়ে পৃথক মাধ্যম হয়ে ওঠে। কবিতার বিষয় আবৃত্তিশিল্পীর বোধে লালিত হয়ে বাক্যের আবেগ রূপান্তরিত হয় কণ্ঠের আবেগে। আমাদের আকাক্সক্ষা পূরণ হয় আমরা আন্দোলিত হই। নতুন অর্থে নতুন বর্ণে নতুন ছোঁয়ায় নতুন সৃষ্টিতে নতুন ভঙ্গিতে এক আচ্ছন্নতায় আমরা পেয়ে যাই এক নতুন সৃষ্টি-শিল্প, কণ্ঠ যার আশ্রয়, আবৃত্তি। একুশের কবিতা হচ্ছে বাকরীতি কাব্যরীতি ও বিষয়চেতনার মিশ্রণে অভিনব চিত্রকল্প সহযোগে প্রগাঢ় আবেগের ও বিশ্বাসের শব্দ প্রয়োগে রৌদ্ররস, বীররস ও করুণরসের বহুল ব্যবহারসমৃদ্ধ বিষয় বৈচিত্র্যে উজ্জ্বল অর্থালঙ্কার প্রধান কবিতা। স্বভাবত কারণেই একুশের কবিতা আবৃত্তির একটি পৃথক রীতি বা ঢং আছে। প্রতিটি আবৃত্তিশিল্পীর যেমন শিল্পসচেতন হওয়া আবশ্যক তেমনি একুশ সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা থাকাও আবশ্যক। একুশের কবিতার বিচিত্র স্তরবিন্যাস, বোধি বা ভাবচেতনার আকস্মিক পটপরিবর্তন, স্বহৃদয় সংবেদী শব্দাবলী, অপূর্ব উপমা উৎপ্রেক্ষার বাক-প্রতিমা, বিস্ময়কর বাস্তবচিত্রকল্প, কবির সহজ ও স্বভাবিক জীবনবোধ, প্রগাঢ় ব্যক্তিক বা আত্মিক অনুভ‚তি ইত্যাদি আবৃত্তিকারকে গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে উপলব্ধি করতে হবে। একুশের কবিতার লক্ষ্যÑতা হবে সত্য থেকে জাত কল্পনা। একুশের কবিতা অনেক বেশি সমাজসচেতন বলেই তার কাব্যিক কল্পনার জন্মভ‚মি অনেক বেশি বিশ্বাস্য ও তথ্যনির্ভর। যেমন :
১. যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি \
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায় \
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি \
(বঙ্গবাণী, আবদুল হাকিম, ১৬২০-১৬৯০)

২. হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন,
তা সবে (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
(বঙ্গভাষা, মাইকেল মধুসূদন দত্ত)

৩. এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে
রমনার ঊর্ধ্বমুখি কৃষ্ণচ‚ড়ার তলায়
যেখানে আগুনের ফুলকির মতো
এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ
সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি
আজ আমি শোকে বিহ্বল নই
আজ আমি ক্রোধে উন্মত্ত নই
আজ আমি প্রতিজ্ঞায় অবিচল … … … …

(কাঁদতে আসিনি ফাঁসীর দাবি নিয়ে এসেছি, মাহবুব উল আলম চৌধুরী)

আবৃত্তিকার যখন একুশের আবৃত্তির জন্য কবিতা নির্বাচন করবেন তখন প্রথমেই তিনি গভীর মনোযোগের সাথে আবিষ্কার করবেন কবিতার অন্তর্গত ভাবার্থ। আরো জানবেন কবিতার মূলরস ও গূঢ়তম ব্যঞ্জনা। কবিতার মূলভাব রস ও অর্থ ব্যঞ্জনা উপলব্ধি করতে না পারলে ভরাট কণ্ঠ ও সূচারু ছন্দজ্ঞান থাকলেও আবৃত্তিকার শ্রোতাদর্শকের হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবেন না। যেমন :
১. আশ্চর্য এমন দিন! মৃত্যুতে করে না কেহ শোক,
মৃত্যুরে করে না ভয়, শঙ্কাহীন কীসের আলোক
উদ্ভাসিত করে তোলে ক্লান্ত দেহ, মুখ, পদক্ষেপ
সংকল্পের দ্যুতি তরে দৃঢ়তার প্রচার প্রলেপ
করেছে ভাস্বর!
এরা যেন করেছে স্বাক্ষর
মৃত্যুর পরওয়ানা পরে বাংলা ভাষার লিখি নাম
আমার মায়েরে আমি মাটি থেকে বুকে মোর তুলিয়া নিলাম।
(এমন আশ্চর্য দিন, সুফিয়া কামাল)

২. কুমড়ো ফুলে ফুলে
নুয়ে পড়েছে লতাটা
সজনে ডাঁটায় .
ভরে গ্যাছে গাছটা
আর আমি ডালের বড়ি
শুকিয়ে রেখেছি
খোকা তুই কবে আসবি
কবে ছুটি– … … … …
(কোন এক মাকে, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ)
এখানে আবৃত্তিকার যদি মা রূপি মাতৃভ‚মির শোকসন্তাপকে সনাক্ত করতে না পারেন তবে কবির বাক্‌বৈদগ্ধ সমূলে বিনষ্ট হবে। এই কবিতার মূল রস করুণ। কণ্ঠে দুঃখ ভারাক্রান্ত শোক বিহŸল স্বর আনতে হবে। মায়ের সাথে সন্তানের যে বাৎসল্য তাও পৃথক কণ্ঠে ধারণ করতে হবে। কেননা কবিতাটিতে মা ও পুত্রের কথোপকথন রয়েছে। কবিতাটির আরো একটি মজা হচ্ছে বিস্তারিত বর্ণনার সময় সংলাপধর্মীতা ত্যাগ করে এক ধরনের নিরাবেগ অথচ ঋজু কণ্ঠস্বরের প্রয়োজন হবে। শ্রোতা যেন বুঝতে পারেন এখানে মা হচ্ছেন স্বদেশ এবং সন্তান হচ্ছেন ভাষা শহীদের প্রতীক। আবৃত্তিকার শব্দার্থের সর্বোচ্চ ব্যবহারের প্রতি সব সময় সচেতন হবেন। শিল্পী তার স্বরভঙ্গি প্রক্ষেপণের বৈচিত্র্যে চিরচেনা এই কবিতাটিকে এক মোহময় আনন্দলোকে পৌছে দেবেন ।
আবৃত্তি এমন একটি শিল্প যা রসিকজনের কাছে একটি বিষয়কে নতুন ভাবে রসগ্রাহী করে তোলে। তাই আবৃত্তিকারের রয়েছে তার পরিবেশনাটি হৃদয়গ্রাহী করে তোলার দায়। আবৃত্তিশিল্পী হচ্ছেন মধ্যস্ততাকারী। শিল্পমানসম্পন্ন কবিতা আবৃত্তির জন্য কবিতার পটভ‚মি যেমন শিল্পীর অন্তর্গত চৈতন্যলোক উন্মোচন করে তেমনি কাব্য সৃষ্টির দর্শন অঙ্গীকার ও কবিতা রচনার প্রেক্ষাপট জানা থাকলে সে সৃষ্টি নিয়ে কাজ করার এক ধরনের স্বচ্ছন্দ ও প্রত্যয়ী মনোভাব জাগে ।
যেমন :
স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু আমরা এখনো চার কোটি পরিবার খাড়া রয়েছি তো। যে-ভিৎ কখনো কোনো রাজন্য পারেনি ভাঙতে
হীরের মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার
খুরের ঝটিকা ধুলায় চূর্ণ যে পদপ্রান্তে
যারা বুনি ধান
গুণ টানি আর তুলি হাতিয়ার হাঁপর চালাই
সরল নায়ক অমরা জনতা সেই অনন্য। …
(স্মৃতিস্তম্ভ, আলাউদ্দিন আল আজাদ)
এই কবিতাটির প্রেক্ষাপটে রয়েছে প্রথম শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলার অন্তর্বেদনা এবং বিদ্রেহী চেতনা। জাতির কাছে কবির এই অনুভবকে প্রত্যক্ষ ভাবে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব আবৃত্তিশিল্পীর। সেজন্য আবৃত্তিকারকে স্বর প্রক্ষেপণের বিভিন্ন সত্তা প্রয়োগ করে ছন্দের সাহায্য নিয়ে শ্রোতার কাছে পৌঁছে দিতে হবে অমিয় বাণীপ্রবাহ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও শাসক গোষ্ঠী আরো একবার শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলেছিল। শহীদ মিনার যে এখন আর ইটের মিনার নেই হয়েছে আমাদের সকলের জাগ্রত চেতনা এবং যা আর কখনোই ভাঙ্গা সম্ভব নয় তারই মূর্ত প্রতীক এই কবিতা। এই সুবার্তাটি আবৃত্তিশিল্পী পৌঁছে দেবেন জনতার কাছে ।
একুশের আবৃত্তি ছন্দ কবিতার প্রাণ। একটি সুআবৃত্তি নির্দিষ্ট শিল্পমাত্রায় পৌঁছানোর অন্যতম শর্ত হচ্ছে আবৃত্তিকারের ছন্দ বোধ। ছন্দের পারদর্শীতার ওপর শিল্পসম্মত আবৃত্তি নির্ভরশীল। অর্থপূর্ণ চাপের সঙ্গে ছন্দের মাত্রাবিভাজনে সৃষ্টি হয় এক স্বয়ংসম্পূর্ণ নির্মিতি, যেমন :

১. দেশের মানুষ একটি দণ্ডে
একাত্ম হয়েছিলো,
স্নায়ু গ্রন্থিতে পাঁজরে-পেশীতে,
মেখে নিয়েছিলো একটি অঙ্গীকার
সেদিন প্রথম।
এক প্রথম নতুন দিগ্বলয়ে
সঞ্চরমান এদেশের ইতিবৃত্ত।
চেতনার পথে দ্বিধাহীন অভিযাত্রা
নানান মুখীন হাজার লোকের
একত্র অস্তিত্ব
একুশে ফেব্রুয়ারী।
(একুশে ফেব্রুয়ারী, সিকানদার আবু জাফর)

২. ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়
বরকতের রক্ত।
হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে এমন লাল যে
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে ! … … … …
(একুশের কবিতা, আল মাহমুদ)

৩. ফাগুন এলেই পাখি ডাকে
থেকে থেকেই ডাকে
তাকে তোমরা কোকিল বলবে? বলো
আমি যে তার নাম রেখেছি আসা
নাম দিয়েছি ভাষা। … … … …
(ফাগুন এলেই, আসাদ চৌধুরী)
একুশের এই কালজয়ী কবিতা তিনটি পূর্ণাঙ্গ ছন্দসমৃদ্ধ কবিতা। এ কবিতার বোধটুকু শ্রোতার কাছে পৌছাতে হলে ছন্দকে প্রধানতম বাহন হিসেবে ব্যবহার করাই হবে আবৃত্তিকারের কাজ। কবিতা তিনটির আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো বর্ণনা ও সংলাপধর্মীর মিশেল। এখানে ছন্দের প্রবহমানতা ঠিক রেখে সংলাপের ভিতরে যাচিত আবেগ দিতে হবে। একুশের যেসব কবিতা ছন্দপ্রধান তা ছন্দে আবৃত্তি করা উচিত। যা গদ্য ছন্দে লেখা হয়েছে তা স্বাধীন ও বাঁধনহারা হলেও আবৃত্তিকারকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা ও লয় বজায় রেখে, অর্থপূর্ণ বিরামের প্রয়োজন অনুভব করলে সেখানে স্বর বিরতি গ্রহণ করে আবৃত্তিটি উপস্থাপন করতে হবে। যেমন :
নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পাতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।
মমতা নামের প্লুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়
ঘিরে রয় সর্বদাই। কালোরাত পোহানোর পরের প্রহরে
শিউলী-শৈশবে ‘পাখিসব করে রব’ বলে মদন মোহন
তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক।
তুমি আর আমি,
অবিচ্ছিন্ন, পরস্পর মমতায় লীন,
ঘুরেছি কাননে তাঁর নেচে নেচে, সেখানে কুসুমকলি সবই
ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সংকেতে। … … …
(বর্ণমালা, আমার দুঃখিনি বর্ণমালা : শামসুর রাহমান)
কবি যেমন তার প্রতিভার স্পর্শে চিরপরিচিত শব্দের সাহায্যে অসাধারণ কোন পংক্তি নির্মাণ করতে পারেন আবৃত্তিশিল্পীও তেমনি পারেন তার স্বর প্রক্ষেপণের সাহায্যে চির পরিচিত শব্দের নতুন ব্যঞ্জনা দোতনা সৃষ্টি করতে। মানুষের মনের বিচিত্র অনুভ‚তির দোলাচলের বৈচিত্র্য অনুসারে কণ্ঠস্বরের ভিন্নতার প্রয়োজন পড়ে। কবিতার অন্তর্গত সৌন্দর্য অনুসারে স্বর যেমন উঁচু নিচু হয় তেমনি স্বরের স্থায়িত্বও বাড়ে কমে। আবার আবেগের তীব্রতা বাড়লে উচ্চারণ দ্রুত হয়, স্বরস্তর বেড়ে যায় সেই সাথে স্বরের তীব্রতাও বাড়ে। তেমনি উদ্দামহীনতা বিষাদে দুঃখের ভাবে স্বরস্তর নিচে নেমে আসে। যেমন :
১. আম্মা তাঁর নামটি ধরে একবারও ডাকবেনা তবে আর?
ঘূর্ণিঝড়ের মতো সেই নাম উন্মথিত মনের প্রান্তরে
ঘুরে ঘুরে জাগবে, ডাকবে,
দুটি ঠোঁটের ভেতর থেকে মুক্তের মতো গড়িয়ে এসে
একবারও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না, সারাটি জীবনেও না? তবে আর? কি করে এই গুরুভার সইবে তুমি কতদিন … …
(অমর একুশে : হাসান হাফিজুর রহমান)
২. এসব রাত্রিকে ঢেকে দাও
সমুদ্রের বিশাল গহ্বরে নয়তো উধাও
মেঘ ভরে আনো অবিশ্রাম
বর্ষার সঙ্গীত।
এক ঝাঁক নাম
মুখরিত সূর্য কাঁপে
সুদূর বিস্তৃত সেই একক সংলাপে
ইতিহাস তারা নয়
বিস্মৃতি বিলয়
তাদের প্রচ্ছন্ন করে রাখে না কখনো
সমুদ্রের গান শোন–
সে গানে তাদের হাসি
কি আশ্চর্য ফুল হয়ে ঝরে।
(কৃষ্ণচ‚ড়ার মেঘ : মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান)
শিল্পমাধ্যম হিসেবে আবৃত্তি বাচনিক ধারার শিল্প। মানুষের সহজাত অনুভ‚তি যা কবির লেখনির মাধ্যমে পাঠকের চিত্তকে দোলায়িত করে তাকে উচ্চারণের মাধ্যমে আবৃত্তিশিল্পী নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত করবেন। পাঠক নিজে কবিতাটি পড়ে যতটা আনন্দিত হবেন আবৃত্তি শুনে তার চেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত হবেন। একুশের ঐশ্বর্যময় কবিতাগুলো তেমনি আবৃত্তিশিল্পীর কণ্ঠে বারবার উচ্চারিত হয়ে বাঙালি জাতিকে তার সত্তা চিহ্নিত করার সুযোগ দান করবে আজকের দিনে এই প্রত্যাশা।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমির মুখোস উন্মোচন
কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমি এবং আমার গ্লানি
কাজী জহিরুল ইসলাম on ‘প্রথম আলো’র বিকল্প
পথিক মোস্তফা on মানবিক কবি ফররুখ আহমদ
মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন on ক্রান্তিকাল
এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা