টুটুল রহমান
কয়েক বছর আগে বুক ছিদ্র হয়ে মরে যাওয়া গোলাপের বিধবা জোয়ান বউ কুলছন ঘটনার আগাগোড়া কোনো কিছুই বলা শুরু করেনি তখনও। সে হাউ মাউ করে কাঁদছে কেবল।
তার ক্রমাগত কান্নার রোল আর আহাজারিতে মন্ডলের বাই-বাড়ির (বাহির বাড়ি) কদম গাছের মগডালে নিশ্চুপ বসে থাকা কাকটা ডানা ঝাঁপটে উড়াল দিলো। সাত-সকালবেলা দৃশ্যটা মঙ্গলের না। আজিজার মন্ডল কোথাও একটা যাবার পায়তারা থেকে পুরনো একটা ন্যাকড়া হুইল পাউডারে ভিজিয়ে তিন লাখ টাকা দামের নতুন মোটর বাইকটা পরিস্কার করছিল এক মনে। তার দুটো পায়ের গোড়ালি উপর দিকে তোলা। পাছার সাথে লাগানো। পায়ে চকলেট কালারের চামড়ার স্যান্ডেল। তার এক হাত মোটর বাইকের তেলের ট্যাংককিতে ধরা। হাত গোটানো প্রায় সাদাসাদা একটা শার্ট গায়ে জড়ানো। খয়েরি নতুন চকচকে প্যান্ট। শরীরের রঙের সাথে তা মিশে গেছে। আজিজার মন্ডলের ঠান্ডা মাথার চাঁন্দিতে কদুর তেল মেরে চুলগুলোকে পরিপাটি ব্যাকব্রাশ করা।
সে তাকায় উড়ে যাওয়া কাকটার দিকে। গোলাপের বউয়ের গলা ফাটানো আওয়াজ তার কানে ঢুকেছে কি ঢুকছে না সেটা সে-ই বলতে পারবে। কিন্তু কাকের ডানার ফড়ফড়ানির দিকে একবার চোখ তুলে তাকায় আজিজার। মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘কাইয়া ডাহা তো ভালা না।’
ছোট ভাইটা রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছে। শহর কমিটিতে পদও পেয়েছে একটা। পৌর শহরের তিন কিলোমিটার দূর থেকে গিয়ে সে রীতিমতো দলের কমিটিতে পদ পেয়েছে। অল্প কয়েকদিনেই এমপির অনেক কাছে চলে গেছে। পৌরসভার রাস্তা ভরাট, কালভার্ট বানানো, ভিজিডি কার্ড বিতরণ, বয়স্ক ভাতা বিতরণের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সে করে। আর কাজ করলে পয়সা আসেই। এইতো কয়েকদিন আগে বিলের কাছে জাহাদ আলির টানা তিন পাকি (বিঘা) জমি তারা ভোগরাহান (পত্তন) নিয়ে নিলো পুরো সাত লাখ টাকা দিয়ে। দুই ভাইয়ের দুটো দামি মোটর সাইকেল হয়ে গেছে। শুধু কি তাই, পোল্ট্রি ফিডের দোকান হয়েছে বাজারে। ছেলেমেয়েগুলোর পড়াশুনাও এগিয়ে চলেছে। প্রায় প্রতিটা সাবজেক্টেই তারা মাস্টার পেয়েছে। আজিজার মোল্লেরা তো তিন পুরুষ ধরে গ্রামের মাতব্বরি করে। সেই পাকিস্তান আমল না বৃটিশ আমল থেকে তার দাদার বাপ কি তার বাপ থেকে শুরু হয়েছে এই গ্রামের তাদের মাতব্বরি। গন্ডগোলের কয়েক বছরের মাথায় দাদা মরলো। তারপর মাতব্বরি সামলিয়েছে তা বড় কাক্কা। সেও একদিন হঠাৎ করে ওজুর পানি মুখে দিয়ে কুলকুচি করতে করতেই বেহুশ হয়ে আর উঠলো না। তারপর বাবার পালা। সেও বছর ১৩/১৪ আগে হঠাৎ জবানবন্ধ হয়ে বিছানায় পড়ে রইল কিছু দিন। ঢাকায় নেয়ার আগেই শরীরের এক অংশ অবশ হয়ে গেলো। ঢাকার হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল কিন্তু অপারেশন থিয়েটার থেকে সবুজ পোশাক পড়া, কাপড়ে মুখ ঢাকা, টুপি পড়া ডাক্তার বেরিয়ে বললো, ওনার তো ৩ দিন আগে ব্রেইন স্টোক হয়েছে। অনেক রক্ত জমেছে মাথায়। সেগুলো পরিস্কার করলাম। বাঁচা-মরা তো আল্লার হাতে। ৭২ ঘন্টা পর রোগীর জ্ঞান ফিরলে বোঝা যাবে কন্ডিশন। আপাতত কিছু বলা যাচ্ছে না। ওনাকে আইসিইউতে ট্রান্সফার করতে হবে। আপনারা টাকার জোগাড় করেন।
‘এই ডাক্তার আর হাসপাতাল– খালি টেহাটেহা করে।’–আজিজার মন্ডল বিড়বিড় করে।
আজিজার তখন কিছুই করে না। ছোট ভাইটাও ঢাকার কোনো এক প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করছে। তাদের বিঘা দশেক জমি। দাদার সূত্রে পাওয়া। বছরে আবাদ ফসল হয়। তাই দিয়ে চলে যায় কোনো রকমে। স্ট্রোক করা মোল্লে তো মাতব্বরি করে বেড়ায়। গ্রামের মানুষদের শাসানির ওপরে রাখে।
গত কয়েক দিনে ক্ষ্যাত্ ভোগরাহান রেখে লাখ তিনেক টাকা ডাক্তারদের হাতে তুলে দিয়েছে আজিজার। গ্রামে খবর দেয়া হলো আরো টাকা লাগবে। তার মা এজিয়া বেগম আরো জমি ভোগরাহান রাখার জন্য এর ওর কাছে ছোটাছুটি করে। টাকা পেয়ে যায়। গ্রামের অবশ্য তখন অনেকের হাতেই টাকা। থাকবে না? সারাজীবন নদীতে, বিলে মাছ মারতো যে মইনুদ্দি সেখ। সেও তো টাকা জমিয়ে ছেলে একটা বিদেশ পাঠিয়েছে। সৌদি না কুয়েত। নাকি আবুধাবি। সেটা মইনুদ্দি লোকের কাছে খোলাসা করে বলতে পারে না। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘পোলা সৈদি থাকে। বছর বছর হজ্ব করে। মাস গেলিপারে ব্যাংকে টেহা পাঠায়। আমার আর কিয়ের অভাবরে।’
আর বড় পোলা রেজাক আলিকে থার্ড ডিভিশনের বি এ পাশ করিয়েছে। এখন ঢাকায় সে বড় একটা গ্রুপ কোম্পানির সেলসম্যান হিসেবে প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি করে। ছেলে জানিয়েছে কদিন পরেই প্রমোশন হলে সুপারভাইজার হবে। বেতন বিশের ওপরে এখন। সুপারভাইজার হলে ৩০ হাজার তো পাবেই।
গত বছর চাকরিজীবী এই ছেলেটাকে বিয়ে করিয়েছে। মেয়েও মাশাল্লাহ প্রাইমারী স্কুলের টিচার। মইনুদ্দিনের বাড়িতে লাল দালান গজিয়ে উঠছে। মইনুদ্দি চিনি কোম্পানীতে চাকরি করা ছেলেকে খবর পাঠালো, ‘মোল্লেরে অপারেশনের ঘরে ঢুকিয়েছে ট্যাহার দরকার। বিপদে আপদে ওরা তো আঙ্গো সাহাইয্য-সহযোগিাতা করে। তুই এক লাখ ট্যাহা ব্যবস্থা কইরা দিস। বাজান।’ অবশ্য ট্যাহা ওরা এমনি এমনি নিবোনা। আঙ্গো বাড়ির হাতে যে ক্ষ্যাতটা আছে হেইডা অনেক আগেই নাগাবার চাইছিল। এইবার নিয়া নিমু।’
রেজাক আলির কি আর বুঝতে ভুল হয়? জমি ভোগরাহান রাখতে চায় মোল্লের পোলারা বাপের এই দুর্দিনে। তা এতো রাতে রেজাক আলি টাকা কই পায়? একাউন্টে তো আছে। রাত তখন তিনটা। না বেশিক্ষণ চিনির কোম্পানীতে চাকরি করা রেজাক মিয়ার ভাবতে হয় নাই। ব্যাংক থেকে গত সপ্তাহে একটা কার্ড দিয়ে গেছে। বলে গেছে, এটা দিয়ে রাত বিরাতে যখন তখন বুথ থেকে টাকা উঠানো যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো ৫০ হাজারের বেশি তো সে তুলতে পারবে না। মোল্লে যখন পান্থপথের একটা হাসপাতালের হিমঘরে ঘুমের মধ্যে তলিয়ে আছে তখন রেজাক আজিজার মন্ডলকে সঙ্গে নিয়ে বুথে ঢোকে। জাইলার পোলা রেজাক। স্কুল কলেজে পড়লে কি হবে বুক তার কাঁপে। সারাজীবন হাতে টাকাগোনা, মানুষের সাথে লেনদেন করা রেজাক আজ মেশিনের কাছ থেকে টাকা নিবে তাও আবার একটা প্লাস্টিকের কার্ড ঢুকিয়ে বিষয়টা তাজ্জবের তো বটেই। না। রেজাক সাহস পায় না। যদি কিছু একটা ঘটে যায়? টাকার যদি ক্ষতি হয়? কিংবা কারেন্টের জিনিস। যদি তারই কোনো ক্ষতি হয়?
এই বুক ধুকপুক সমস্যার সমাধান করে দিলো সিকিউরিটি কার্ড। বাটনে পিন টিপতে গিয়ে রেজাকের দু‘বার ভুল হয়। লজ্জা পায় সে। অন্তত সিকিরিটি গার্ডের চেয়ে একটা গ্রুপ কোম্পানীর সেলসম্যানের মর্যাদা একটু বেশি। তাও সে নব্বই দশকের বিএ পাশ। হোক থার্ড ডিভিশন।
কড়কড়া নোটের ৫০ হাজারের পুরোটাই আজিজারকে দেয়। সকালে আরো ৫০ দিবে। কিন্তু নতুন এই টাকা মন্ডলের জীবন বাঁচাতে পারেনি। আইসিইউতে রাখার তিনিদিন পর আরো দুইলাখ টাকা হাসপাতালে বিল মিটিয়ে সারারাত ধরে অ্যাম্বুলেন্সে লাশ এনে, ধুইয়ে আসর ওয়াক্ত পর আজিজার বাপটাকে কবরে শুইয়ে দম ধরে বসে রইল।
আহারে! মাথায় কাটাছেঁড়া করা বাপের ফোলা টবটবে মুখ, ফুলেফেঁপে ডোল হওয়া পেট, মায়ের কান্না সব দৃশ্যগুলো যেন মোটর বাইকের চকচকে নিকেল করা সাইলেন্সারের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগলো। তার কানের কাছে গুনগুন করে কোরআন খতম হচ্ছে। নাকেও লোবানের সুবাস।
এইসব স্মৃতিভারাক্রান্ত বুকের মধ্যে অনেক অভাব অনটনের কথাও লেখা আছে আজিজার ম। জমি তো সব ভোগরাহান রাখা হয়ে গিয়েছিল। শিক্ষিত ছোট ভাইটাও বেকার। শ্যালো মেশিন চালিয়ে ইরি-বোরো মৌসুমী মানুষের ক্ষ্যাতে পানি দিয়ে ফসলের সিকিভাগ দিয়ে তাদের সংসার চালাতে হয়েছে। ছোট ভাইটা তখন কেবল পার্টি অফিসে ঘোরে।
দু:খ ভারাক্রান্ত জলজ হৃদয় যখন একটু কাঁপছে তখন কুলছনের জোড়ালো কান্নার আওয়াজ আজিজারের কানে ঠা ঠা করে ওঠে। এখন অবশ্য মোল্লে বলার চল উঠে গেছে। কুলছন তাই ‘ও ভাইয়ে গো। আমিরুদ্দি আমার ইজ্জত মাইরাহালাইছে গো। আমার ব্যাক শ্যাষ করছে।’ বলে কান্নাকাটি শুরু করে।
কুলছনের ভরাট যৌবনে এই কান্না খুব বেশি তার মুখটাকে বেদনার্থ করে তুলতে পারে না। গোল শ্যামবর্ণের মুখ। পানখাওয়া কালচে অথচ গোছানো ছোট ছোট দাঁত, রসসিক্ত একজোড়া ঠোঁট, গভীর কালো চোখ, শাড়ীতে ঢেকে রাখা কোমরের বাঁক, নাভীর সুগভীরতা তার কান্নাকে ছাপিয়ে আলাদা এক দৃশ্য তৈরি করেছে। আজিজারের খেয়াল যায় কুলছনের গোটা শরীরে। নাহ, আজিজার তো আজ সকালে মদ খায়নি? তাহলে এমন নেশানেশা লাগছে কেন? চোখ ভরা মাদকতা নিয়ে সে তাকায়। কুলছনের কালো রূপের বিজলীর শক সে আরেকবার খায়।
‘এই সাত সকালে কান্দস ক্যা’ কি হইছে তর? কুলছনের বিদ্যুত থেকে নিজেকে বাঁচাতে মোটর বাইকে আরো জোরে জোরে ঘষা শুরু করে আজিজার মাতব্বর। আজ মনে হয় ময়লার সাথে বাইকের রঙও তুলে ফেলবে সে।
কুলছন বিরামহীন বলে যায়। সেটাকে ছোট আকারে বললে দাঁড়ায় এই যে, গতরাতে আমিরুদ্দি মানে বিধু সেকের নাতি, যার বয়স ২০/২১ বছর হবে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে কুলছন যখন রাতে উঠেছে তখন হঠাৎ করেই আমিরুদ্দির ছায়াটা মানুষের রূপান্তির হয়ে তাকে ঝাপটে ধরে মাটির পায়খানার পাশে ঝোপের মধ্যে নিয়ে যায় এবং যা করার তাই করে ছেড়ে দিয়েছে। আমিরুদ্দির বল প্রয়োগ, ধস্তাধস্তিতে তার নতুন তৈরি করা নীল রঙের ব্লাউজটা ছিঁড়ে গেছে, দুই ফালি হয়েছে প্যাটিকোট। প্রমাণ স্বরূপ ধর্ষনের সাক্ষী নির্বাক এই পোশাকদুটোকে নীল পলিথিনে মুড়িয়ে সে নিয়ে এসেছে। এবং হাউ মাউ কান্না থামিয়ে কখনো মিনমিনিয়ে কাঁদছে কখনো ঘ্যান ঘ্যান করছে আজিজারের কাছে। সে চায় একটা সালিশ এবং আমিরুদ্দির বিচার।
আজিজার কম কথা বলে।
‘হুম। বুঝছি হালার পোলা উঠুলির জাত। পাহাড়তথন আইছে। বাপটা আছিল ডাহাইত। মাইরা পুইতা রাখছিল বিলের মধ্যে। যাত্রার ছেঁড়ি ভাগায় আনছিল। তুই যা। ময়মুরুব্বিগো কয়া আয়। আমি মাগরিবের পর তগো বাড়িত সালিস করুমনে। গেরামে এইসব তো হওন দেওন যায় না।’
কুলছন আরো একবার কান্নার ভলিওম বাড়িয়ে আমিরুদ্দিকে শাপ-শাপান্ত করে ময়-মুরুব্বিদের উদ্দেশ্যে আজিজারের বাই-বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। আজিজার কুলছনের নাভির গর্তেও সৌরভ নিতে নিতে ভাবে, ছেড়ির এই ভরা যৌবনের সাধ কি মাজাভাঙ্গা আমিরুদ্দি মেটাতে পারে। এখানে তাকে লাগবে।
কিন্তু কুলছনের শরীর তাকে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। একটা দু:চিন্তায় আছে সে। ইলেকশনের পর এমপি সাব শহর কমিটি নাকি ভেঙ্গে দিবে। এবার শহর কমিটির সেক্রেটারী পদে কেন্ডিডেট নাকি অনেক। গাঙ্গা পাড়ার কাদের ডিলারের পোলা, আটা পাড়ার রশিদের পোলা, পশ্চিম বাড়ির বজলা ফকিরের নাতী, পালপাড়ার হাছন মেম্বরের পোলাও নাকি সেক্রেটারী হতে চায়।
আজিজার ভাবে, হালারা তগো বাপ দাদার খবর কি আমরা জানি না? রশিদ আছিল কলু, ত্যাল বেঁচছে, কাদের ডিলার সরকারি সার চুরি কইরা জেল খাটছে। বজলা ফকির তো ফকিরই আছিল। পোলায় মেলেটারীর চাকরি কইরা কয়টা পয়সা করছিল। আর হাছন মেম্বার তো আছিল পাক্কা গরু চোর। আঙ্গো বাবা কতবার সালিশ করছে হালারে নিয়া। হেগো পোলাপান পার্টি করে। সরকারি পার্টি। কি যে মধু!
আজিজার রাগে ফুলতে থাকে। যেন মরার পর তার বাপের ডোল হয়ে যাওয়া পেটটা তার পেটে বসে গেছে। হবে না? আগের এমপি ছিল আমলা। এলাকার মানুষের দিকে খুব একটা নজর দেয় নাই। বুড়া মরে গেছে। এবার নতুন এমপি। তাগড়া। পয়সাওয়ালা। বিদেশে ব্যবসা গুটিয়ে এলাকার মানুষের উপকার করতে এসেছে। এমপি হওয়ার দুই বছর আগে থেকেই যে এলাকায় গেছে সেখানেই খাই দাই। গরু জবাই দিছে। মসজিদ মাদ্রাসায় টাকার বস্তা ঢালছে। মানুষ খায় আর কয় ‘এ্যাবা এমপিই তো আঙ্গ দরকার।’
তার ছিটানো কোটি দুয়েক টাকা বৃথা যায় নাই। নির্বাচনে আসি আসি, না আসি না করা বিরোধী দলের প্রার্থী পেয়েছে ১০ হাজার ভোট। আর নতুন এমপি সাড়ে তিন লাখ। অবাক কান্ড। সেই এমপি অনেকের ভাগ্যই বদলে দিলো পাঁচ বছরে।
এমপি আসার পর পোট্রি ফিডের দোকানটা হলো। সেখানে লালপানির ব্যবসা তো জমে উঠলো। প্রশাসন ধমকি দেয়। আজিজার ওসিরে কয়, আমরা হইলাম এমপির খাস লোক। বাধাবাধি কইরেন না।’
ওসির বুঝতে বাকি থাকে না। তারপর এখন গ্রামের চাউর হয়ে গেছে আজিজার লাল বড়ি বেচে। এই লাল বড়ি তার পেট আর পকেট ফুঁলিয়ে দিয়েছে কয়েক বছরে।
আজিজারের মনে পড়ে কার কাছে যেন শুনেছিল আমিরুদ্দি নাকি হাটে বাজারে বলে বেড়ায় মন্ডলের পোলা লাল বড়ি বেঁচে। ছ্ট্টোয় রাস্তায় মাটি ফেলার আগেই পৌরসভা থেকে বিল উঠিয়ে খেয়ে রাস্তার কাজ করে। আরো অনেক কথাই তার কানে এসেছে। আজিজার ভাবে ‘এই বার পাওয়া গেছে উঠুলির পোলা বেইন্না আমিরুদ্দিকে। একটা শিক্ষা দেয়া যাইবো।’
বাইক ষ্টার্ট দেয় আজিজার। বাড়ির কামলা ছেলেটাকে ডাক দিয়ে গরুর চাড়িতে খেড় খইল দিতে বলে সে বেরিয়ে পড়ে। বাইকের পেট্রোল পোড়া গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ।
২.
আমিরুদ্দি তাকায়। আষাঢ়ের ভরা চাঁদ আকাশে। গলগল করে খসে পড়ছে জোছনা। সেই জোছনার আলো বিলের পানিতে আলোর সাদা দুধসর ফেলেছে। কিন্তু তার তো এখন বিলে কারেন্ট জাল চাবা ( জাল তোলা) দেয়ার কথা। সে যেতে পারেনি। গোল হয়ে সালিশে বসে থাকা মানুষগুলো জোছনার ভেতর মৌমাছি হয়ে গেছে। গুনগুন করছে। চাঁদের আলোয় মানুষগুলো ছায়া সত্যিই জ্বিন পরির ছায়ার মতো দুলছে বাতাসে। আমিরুদ্দি দেখে সেই খা খা করা জোছনার ভেতর তার ধর থেকে মাথা আলাদা হয়ে যাচ্ছে, পা আলাদা হয়ে যাচ্ছে হাত আলাদা হয়ে যাচ্ছে। এমনকি শিশ্ন খসে পড়লো টুপ করে। অঙ্গশুন্য শিমুল তুলোর মতো হালকা হয়ে অথবা শালিখের খসে পড়া পালক হয়ে জোছনার জলে সে কেবল ভাসছে। দুলে দুলে উঠছে। যেন মাছ ধরা ছোট নৌকা একটা। কিন্তু কান তার খোলা। স্পষ্ট শুনতে পায়।
তার বিরুদ্ধে আজিজার মাতব্বর অভিযোগ তুলেছে ভরা সালিশে। রাতের বেলা কুলছনকে আমিরুদ্দি ধর্ষণ করেছে। অভিযোগ কুলছনেরও। ছেঁড়াফাড়া ব্লাউজ আর পেটিকোট দলাপাকিয়ে মুঠোবন্দি করে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছে কুলছন। অঙ্গশুন্য আমিরুদ্দির মনে হলো একবার কুলছনের গলাটা টিপে ধরবে সে। বেইমান একটা। না হোক নিজের মামি। তবুও তো সে মামি বলেই জানে। কত কিছু কিনে খাইয়েছে। দিয়েছে। আর সেই কিনা তার তার বিরুদ্ধে ধর্ষনের অভিযোগ করছে। আর এই মাতব্বরের বাচ্চা ঘুষখোর, মাদক ব্যবসায়ী আজিজার তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কারণ আমিরুদ্দি তার সব গোমড় জানে। রাতে রাতে কুলছনের ঘরে আসর জমায় আজিজার, সে খবর তো সে রাখে। লাল বড়ি বেচে। মদ খায়। কুলছনের খিলখিল হাসির শব্দ আসে। চুড়ির শব্দ আছে। ফিসফিস কথাও শোনে আমিরুদ্দি একলা ঘরে শুয়ে। কই সে তো কোনো অভিযোগ করে না। এসব কথা কাউকে বলে না?
আজিজার শালাকেও একটা কষে লাত্থি দিতে পারলে ভালো হতো। আমিরুদ্দি ভাবে। কিন্তু আমিরুদ্দি উঠতে উঠতেই আষাঢ়ের যুবতি চাঁদটাকে ঢেকে দেয় একখন্ড মেঘ। তখন রায় হয় ১০০ টা জুতার বারি ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা।
এবং তখন চাঁদটাকে যখন পুরোপুরি ঝাপটে ধরেছে মেঘ, আমিরুদ্দি দেখতে পায় গুনগুন করা মৌমাছিগুলো আরো গোল হয়ে ঘন হয়ে তার চারপাশ ঘিরে ধরেছে। কারো এক পায়ের শক্ত জুতার সন্ধানে তখন পা হাতড়ে বেড়ায় জিয়ারু পালোয়ান। বহুদিন পর হ্যাঁ অনেক দিন পর সে বিনা শত্রুতায় বিনা ক্রোধে কারো গায়ে ১০০ টা বারি মারতে পারবে। এটাই তার আনন্দ। মন খুশি হওয়ার ব্যাপার।
আমিরুদ্দি ঘোলাটে আলোয় দেখতে পায় বিলের এক কোনায় ঘন জমাট কচুড়ি পানার মাঝ থেকে ঠিক ১০ হাত পানির নিচ থেকে গলাকাটা, গল্লমের খোঁচানো রক্তাত্ব শরীর নিয়ে তার বাবা জমিরুদ্দি উঠে আসছে। ভয়ে সে কুচকে যেতে থাকে। হ্যাঁ স্পষ্ট করে চাঁদের ঘোলা আলোয় আমিরুদ্দি দেখতে পাচ্ছে ২৫ বছর আগে খুন হওয়া, বস্তায় বন্দি করে বিলের কচুরি পানার নিচে ইট বেঁধে খুটির সাথে দড়ি পেঁচিয়ে পুতে রাখা জমিরুদ্দি উঠে সেই ভরা সালিশের ভিতর হাঁটু মুরে বসে পড়ে ঠিক আমিরুদ্দিনের চোখে সামনে। তারপর সে শুনতে পায় বাবা বলছে, ‘তর গোলায় তুইলা রাখা ৫ মন ধান ইন্দুরে খাইতাছে বাজান। মোল্লের বাড়িতে কামলা দিয়া কামাই করা ৪ হাজার ট্যাহায় তেলাচোরা হাঁটতাছে। আর তুই বয়্যা বয়্যা বিচার হুনস। যা ঘরে যা। বানের এই সময়ে তো কোনো কাম কাইজ নাই। খাবি কি? ধান, ট্যাহা বাঁচা গিয়া।’
আমিরুদ্দি বাপকে বলে, বাজান তোমারে না খুন কইরা কেরা জানি বিলে পুইতা রাখছে আমার জন্মের সময়। এহানে আইলা ক্যামনে? এতো খবর রাহো ক্যামনে?
জমিরুদ্দি তখন ক্রোধ নিয়ে তাকায়।
‘কেরায় মারছে আমারে জানস না? আজিজারের বাপ সফর মন্ডল আমরাকে মারছে। গেরামে জুয়া খেলাবার দেই নাই। যাত্রার ছেড়ি নিয়া রং তামাশা করতে বাঁধা দিছি। হালায় হালায় আমারে মাইরা ফেলাইলো। পুলিশ তো বিচার করবার পারলো না। তুই আইজ ওর বাপের বিচার আইজ কর? পোলার উপুর দিয়া। যা ওগার উপাত্তে একটা পুরান, চোকা ফছকা রাখছি অনেক দিন কামে নাগে না। আইজ ওইটারে কামে নাগা।’
আর ওই যে তোরে ধর্ষক বানাইছে? কুলছন? ওর প্রতি টান আছিল তর। ট্যাহা, ধানের কথা কইয়া দিছস। ওই তো মিছা কথা কইয়া তরে ফাসাইয়া ট্যাহা আর ধান নিবার চায়। আজিজজার এই কামে আজিজার মন্ডলেরও হাত আছে। বুঝস কিছু?
‘হাছা নাহি বাজান?–বলেই আমিরুদ্দি ওঠে দাঁড়ায় শক্ত পায়ে। সে তখন ক্রোধের আগুনে গলিয়ে দেয় মৌমাছির গোল হয়ে বসে থাকা চাক। এদিক ওদিক ছুটতে থাকে মৌমাছিগুলো।
আমিরুদ্দি ঘরে যায়। ধান খেতে থাকা ইঁদুর মারে। টাকায় বসা তেলাপোকা মারে এবং হাতে তুলে নেয় বহুদিন আগে ধার দেয়া ফছকা।
আজিজারের বুক বরাবর সে ফছকা বসিয়ে দিতে পারতো কিন্তু কে যেন তার ফছকা কেড়ে নেয় এবং তাকে শক্ত করে তারই উঠানে বেড়ে ওঠা বেলগাছটার সাথে শক্ত করে বেঁধে ফেলে এবং পালোয়ান তখন রায় কার্যকর শুরু করে ১০ বারিতে পৌছায় আর ঠিক তখনই কে বা কারা ফছকা বসিয়ে দিয়েছে আজিজার মোল্লের বুকে পেটে পিঠে। মন্ডলের শরীরে ক্রমাগত বিঁধতে থাকা ফছকার আওয়াজ এক গভীর ছন্দময় আওয়াজ তৈরি করে। ফিনকি দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্ত, মাগো, বাবাগো আর্তনাদ, চাক ভেঙ্গে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়া মৌমাছির গুনগুনানির মধ্যে আমিরুদ্দি দেখতে পায় জমিরুদ্দি হাত থেকে ফছ্কা ফেলে দিয়ে আবার ১০ হাতার পানির মধ্যে ঘন কালচে সবুজ কচুরি পানার মধ্যে সেঁধিয়ে পড়লো শিং মাছের মতো। আর বলে গেলো বিচার করলাম রে আমিরুদ্দি তর বাপকে মাইরা ফেলার বিচার করলাম।’
আমিরুদ্দিন ঘোর কাটার পর দেখতে পায় আজিজারের লাশ ঘিরে পুলিশ। তার হাত দড়িতে বাঁধা বিধায় তাকে সরাসরি দোষ দিচ্ছে না পুলিশ। শহরে কমিটি নিয়ে গন্ডগল করে আসা আজিজার মোল্লে যে এখানে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হবে পুলিশ সেটা ধারণা করতে পারেনি। আপাতত জুতার ১০ বারি খাওয়া আমিরুদ্দির বাঁধন খুলে দেয়া হয় এবং মামলার সাক্ষী হিসেবে তার নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। আর যেহেতু ফছকার মালিকানা তার সেহেতু কিছু দায় তারও আছে। তাকে গ্রাম না ছাড়ার নির্দেশ দিয়ে পুলিশ কমিটিতে আজিজার মন্ডলের ভাইয়ের প্রতিপক্ষ কে কে ছিল তাদের পুলিশ খুঁজতে থাকে। তখন পেটের ভিতর থেকে চাঁদকে বের করে দিয়েছে মেঘ। স্পষ্ট হয়ে উঠতে বিলের পানি, ঘন সবুজ কচুরি পানা। সেই জায়গায় যেখানে আমিরুদ্দির বাপকে মেরে পুতে রাখা হয়েছিল ১৫ বছর আগে। আমিরুদ্দি সেদিকে তাকায়। বড় ক্লান্ত তবুও মনে হয় জহিরুদ্দিকে সে বলে ‘বাজান তুমি অহনো বাঁইচা রইছো? আর ভাবে সে তো সালিশে ফছকা নিয়ে চুপ করে বসেই ছিল। সেটা কখন জমিরুদ্দির হাতে গেলো সে ভেবে পায় না।