জাকির আবু জাফর
আধুনিক কবিতার পাঠক কেনো কম? এটি একটি দুরন্ত জিজ্ঞাসা! একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন!
এ কথাটি প্রায়ই শোনা যায়- এখন আর কবিতা আগের মতো পড়ে না কেউ। পাঠ হয় না তেমন করে। একসময় ঘরে ঘরে পাঠ হতো কবিতা। আবৃত্তি হতো বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে। ছোট বাচ্চাদের মুখে ছড়ার আনন্দ থাকতো। কিশোর কিশোরীদের মুখে শোনা যেতো কবিতার ধ্বনি। মায়েরা ছড়া কেটে ঘুম পাড়াতো শিশুদের। এখন কি হয় তেমন! না হয় না! কেনো? এ কেনোর জবাবটি গুরুত্বপূর্ণ।
একটি সময় ছিলো যখন মজার মজার কবিতা ঠাঁই পেতো পাঠ্য পুস্তকে। নীতি কবিতা, দেশাত্মবোধের কবিতা, বিশ্বাসের কবিতা, ব্যঙ্গ কবিতা, ইতিহাস ঐতিহ্যধর্মী কবিতা কিংবা অন্তত পড়ে মজা পাওয়ার মতো কবিতা ছিলো পাঠ্যবইতে। কিছু ছাত্র- ছাত্রী হয়তো জোর করে পড়তো এ কথা ঠিক। কিন্তু বেশির ভাগ ছাত্র ছাত্রীই আগ্রহ ভরে পাঠ করতো কবিতা। শুধু কি পাঠ! না পাঠ করে করে একসময় অতি ভালো লেগে যেতো। এই অতি ভালোলাগা কবিতাটি বা কবিতাগুলো মুখস্থ করে নিতো তারা। কণ্ঠস্থও হতো কারো কারো। ঘরে বাইরে আবৃত্তি করতো আপন মনে। সুযোগ পেলেই পড়ে বা আবৃত্তি করে শোনাতো একে অপরকে। এখন পাঠ্যবইতে আগের মতো কবিতা ঠাঁই পাচ্ছে না। তেমন বিষয়ও নেই কবিতায়। অনেকটা নীতি নৈতিকতাহীন কিংবা অর্থহীন অথবা কবিতা হিসেবে উন্নত মানের নয়। আবার আগের মতো কবিতা মুখস্থ করার কোনো দায়ও নেই। শিক্ষকদের তরফ থেকে ছাত্র ছাত্রীদের কবিতা মুখস্থ করার কোনো নির্দেশনাও নেই। তাই কবিতার প্রতি ছাত্র ছাত্রীদের কোনো মনোযোগ থাকছে না। নেই।
একইভাবে যারা একসময় কবিতার প্রতি আগ্রহ পোষণ করতেন, তারাও এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে এখন কবিতার পাঠক বেজায় কমে গেছে। বিশেষ করে আধুনিক কবিতার পাঠক খুবই কম। আধুনিক কবিতার প্রতি এটি একটি অভিযোগ বটে। কিন্তু অভিযোগটি নির্ভেজাল সত্যি। সত্যি এ কারণেই- বাস্তবেই আধুনিক কবিতার পাঠক খুবই সীমিত। খুব অল্প পরিসরের পাঠক পাঠ করেন আধুনিক কবিতা। আরও খানিক এগিয়ে বললে বলতে হয়, আধুনিক কবিতার পাঠক আসলে কবিরাই। সাধারণ পাঠক খুবই কম। বদলেয়ার এ কথাটিই বলেছেন অন্যভাবে। তিনি বলেছেন- আধুনিক কবিতার বড় বৈশিষ্ট হলো- আধুনিক কবিতা সকলে জানবে না, জানতে পারবে না, জানতে চাইবে না কিন্তু কবিরা জানুক বা কবিরা জানবে। এর অর্থ কি দাড়ায়? দাড়ায়, আধুনিক কবিতা কবিদের জন্যেই লেখা হয়। সাধারণ মানুষের জন্য নয়। তাই কবিরাই বুঝবে কবিতা। কবিরাই পড়বে শুধু। আর কেউ বুঝবে না, বুঝতে চাইবে না এবং বুঝতে পারবেও না!
বোদলেয়ারের কথাটি এতটা সত্যে পরিণত হবে কে জানতো! বাস্তবতা এটিই যে, আধুনিক কবিতা সাধারণ পাঠকের আয়ত্তের বাইরেই চলে গেছে। কবিতার ভেতর প্রবেশ করে কবিতা বোঝার চেষ্টা এখন আর সাধারণের খুব একটা নেই। খুব অল্প সংখ্যক পাঠকই আধুনিক কবিতা পড়ার আগ্রহ রাখেন। তাও আবার সকল কবির কবিতা নয়। পাঠকের নিজস্ব পছন্দ অপছন্দের জায়গা থেকেই গ্রহণ করেন কবিতা!
এখন গোড়ার প্রশ্নটিতে আসা যাক। আধুনিক কবিতার পাঠক কেনো কম?
অবশ্য কবিরাও বেশ চালাকি উত্তর প্রস্তুত করে রাখেন বা রেখেছেন। কবিদের ভাষ্য- আধুনিক কবিতা পড়তে হলে পাঠককে অগ্রসর পাঠক হতে হবে। যৎসামান্য পাঠ-অভ্যাস দিয়ে আধুনিক কবিতা পাঠ করা যায় না। যাবে না। গভীর জ্ঞান থাকা চাই আধুনিক কবিতা পাঠকের। নইলে কবিতার ভেতর রহস্য উদ্ধার করা যাবে না।
কবিতা লেখার জন্য যেমন জ্ঞান দরকার, অভিজ্ঞতা দরকার, ঠিক তেমনই কবিতা পাঠের জন্যেও প্রয়োজন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। জীবন ও জগতের আধুনিক সমস্যা বুঝলে তবেই বোঝা যাবে কবিতাও।
তবে পাঠকের তরফ থেকে অভিযোগ আছে বিস্তর। এবং পাঠকের অভিযোগগুলো ফেলনা নয় মোটেই।
পাঠক বলতে চান- আধুনিক কবিতা দুর্বোধ্য! প্যাঁচানো। রহস্যময়! বোঝা যায় না সহজে। অনেক সময় ছন্দও থাকে না। কখনও কখনও ছন্দ থাকলেও অন্তমিল তো নেই-ই। শব্দও কঠিন। বুঝে আসে না আবার কঠিন শব্দের মর্মার্থ বোঝাও কঠিন। সুতরাং কে এত কঠিন বিষয় বুঝতে যাবে! কীভাবেই বা বুঝবে। একদিকে কবিতার গভীর জ্ঞান নেই। অন্যদিকে পাঠ করার জন্য অভিধান ঘাটাঘাটি কি সহজ! আবার অভিধানে আধুনিক কবিতার শব্দ খুঁজে পাওয়া যাবে কি! কিছু শব্দ হয়তো পেলেও পেতে পারে। কিন্তু একটি আধুনিক কবিতার সকল শব্দ অভিধানে জুটবে না। তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম শব্দের অর্থ পাওয়া গেলো। কিন্তু অভিধানের সেই অর্থ দিয়ে কবিতা বোঝা কি সম্ভব! না, সম্ভব নয়। কারণ, আধুনিক কবিতায় যে চিত্রকল্প এবং উপমা ব্যবহার করা হয়, সেসব উপমা চিত্রকল্প অভিধান পড়ে বোঝা যাবে না মোটেই। এখানে প্রশ্ন জাগে কেমন করে বুঝতে হবে আধুনিক কবিতা? আসলে আধুনিক কবিতা বোঝার জন্য পাঠককে আধুনিক মানস পোষণ করতে হবে। জীবন সম্পর্কে জগৎ সম্পর্কে আধুনিক ধ্যান- ধারণা থাকতে হবে। মানুষের জীবনে নতুন গতি নতুন আয়োজন যোগ হচ্ছে। নতুন ডিভাইস জেঁকে বসেছে। প্রতিনিয়ত নতুন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে মানুষ। কবিরা তাদের কবিতায় এসব বিষয় আসয় যোগ করছে। তাই পাঠককেও বুঝতে হবে এসব। জানতে হবে। তবেই বোঝা যাবে আধুনিক কবিতা।
আবার কবিদেরও দায় আছে। কবিতাকে দুর্বোধ্য মুক্ত করার চেষ্টা করতে হবে। তরল না করে সরল করতে হবে। সহজতার সৌন্দর্য জড়িয়ে লিখতে হবে কবিতা। অবশ্যই শিল্পের দিক বজায় রেখেই লিখতে হবে।
হ্যা এটি সত্য আধুনিক কবিতা অন্তমিলে বিশ্বাস করে না। আবার অন্তমিল থাকলে সেটি আধুনিক হবে না তেমনও নয়। সত্যি হচ্ছে কবিতা আধুনিক হয়ে ওঠার সাথে ছন্দ আর অন্তমিলের সম্পর্ক নয়। সম্পর্ক হলো কবিতার আঙিক, উপমা, চিত্রকল্প ও উপস্থাপনার ওপর।
সব মিলিয়ে আধুনিক কবিতা আধুনিক জীবনের জটিলতা ধরেও জটিলতা মুক্ত হলে তবেই তা সুখ পাঠ্য হবে।
এটি সত্য কবিতার পাঠক গোটা পৃথিবীতেই কম। আগেও কমই ছিলো। ভবিষ্যতেও হয়তো কমই থেকে যাবে।
প্রবন্ধটি সুলিখিত। পড়ে ভালো লেগেছে। কবিতাকে নিশ্ছিদ্র দুর্গ না বানানোর পরামর্শ আমি দিয়ে থাকি। দুর্গে কিছু জানালা রাখবেন যাতে এর ভেতরের সৌন্দর্যের ঝিলিক বাইরে থেকে কিছুটা দেখা যায়। এই ঝিলিকই পাঠককে ভেতরে যেতে সাহায্য করবে।