মুসা আল হাফিজ
এক.
গাযালির সাথে আমার সম্পর্কের উদাহরণ হলো একটি প্রদীপে ঝাঁপিয়ে পড়া একটি পতঙ্গ।
প্রদীপটা গাযালি। পতঙ্গ আমি।
কিন্তু পতঙ্গ তো পুড়ে যায় প্রদীপে ঝাঁপ দিয়ে। আমি কি পুড়ছি?
গাযালি বললেন হ্যাঁ,পুড়ছো। কারণ যখন তুমি আগুনে পুড়তে পুড়তে অভ্যস্ত হয়ে যাবে,ধোয়া তোমার আর ক্ষতি করতে পারবে না।
বললাম,কিন্তু আমার চিন্তা হলো আমি যখন পুড়ছি, তখন আমার বাইরে জ্বলতে থাকা আগুন কি আমার ভেতরকে প্রদীপ্ত করছে?
গাযালি বললেন যখন তুমি জ্বলছো, তখন তৈরী হচ্ছো। সবচেয়ে সেরা লোহাকে সবচেয়ে বেশি আগুনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়!
কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন তুমি পুড়ছো? লক্ষ্য কী?
বললাম, আমি পুড়ছি পুড়বো বলে নয়। বরং আগুনে পুড়ছি হৃদয়ের সেই আগুনের জন্য, যা দিয়ে চারদিকে জ্বলতে থাকা আগুনকে প্রতিহত করা যাবে!
গাযালি বললেন সুরক্ষার সেই আগুন তাহলে কী?
বললাম সেই আত্মশক্তি, ভালোবাসার তন্তু দিয়ে গঠিত যার শিখা , প্রজ্ঞা ও স্বজ্ঞা দিয়ে তৈরী যার রং , নিষ্ঠা, সন্তোষ ও সাধনার মধুরতা দিয়ে সাজানো যার ধোয়া এবং পরমের পবিত্রতায় জ্ঞান ও আত্মনিবেদনের শৈলী দিয়ে সজ্জিত যার তাপ।
গাযালি খুশি হলেন। সেই আগুনে অবগাহনের দরোজা খুলে দিয়ে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেলেন!
আমি তার গমনপথে অপলক তাকিয়ে ছিলাম, এরই মধ্যে দেখি আগুন ছাড়া আর কিছুই কোথাও দেখছি না।
গাছে আগুন,হাওয়ায় আগুন,নর- নারীতে আগুন, খাদ্যে আগুন, মাটিতে আগুন,পানিতে আগুন…
এতো আগুন চারিদিকে,তাহলে জীবন চলছে কী করে? সবই তো ছাই হয়ে যাবার কথা!
অদৃশ্য থেকে ভেসে এলো গাযালির সুর। বললেন, এ আগুন ভষ্ম করবে বলে জ্বলছে না। সবুজ ও সতেজ করবে বলে জ্বলছে।
দুই.
আজ আবারো গাযালীর সাথে দেখা। তন্দ্রায় ছিলাম,যেমন থাকে শেষ রাতের জারুল গাছ।
আমার তন্দ্রা স্বপ্নে কম্পমান, নিদ্রার চেয়ে মধুময়। কারণ তার ভেতর সিদ্ধ হতে থাকে শুদ্ধির তরকারি।
গাযালি এলেন, ঘরটি আমার অন্ধকারাচ্ছন্ন,আলো তালাশ করছি…
তিনি সপ্রতিভ ,বললেন – প্রয়োজনীয় আলো কোথা থেকে আসে বলো তো?
বললাম, পৃথিবীর জন্য আসে সূর্য থেকে, জীবনের জন্য আসে জ্ঞান থেকে আর মানুষের জন্য আসে হৃদয়ের স্বচ্ছতা থেকে!
গাযালি হাসলেন। যেন বনবীথির হৃদয়ে বয়ে গেলো এক ঝলক জ্যোতি।
গাযালির হাসির ভেতর উদিত হলেন নিজামুল মুকল তূসী। যেন প্রশান্ত হাওয়ার নিশ্বাস একটি চলন্ত পাহাড়ের পাগড়িকে আন্দোলিত করলো।
তাকালাম। বললাম, আহা এই যে মহান নেযামুল মুলক…
গাযালি বললেন পুত্র, খুশি হও,তুমি জ্ঞানের পথে আছো!
বললাম কীভাবে বুঝবো?
গাযালি বললেন প্রজ্ঞাবানকে প্রথম দর্শনে চিনেছো। কিন্তু মূর্খতা কখনো জ্ঞানকে চিনতে পারে না। একমাত্র জ্ঞানের নাগরিকরাই চিনতে পারে যথার্থ জ্ঞানীকে!
গাযালি বললেন তোমার কি তাকে প্রয়োজন? কেন প্রয়োজন?
বললাম, তিনি পৃষ্ঠপোষক। যা একটি সচল ছায়া। জীবনে রোদের অত্যাচার যতো বেশি,ছায়ার প্রয়োজন তত তীব্র!
গাযালি বললেন, তোমার কাল তোমার জন্য ছায়া রাখেনি?
বললাম রাখেনি। ছায়া তালাশে হোচট খেতে খেতে এবং সময়ের বিনাশ করতে করতে অবশেষে বুঝেছি এই সময়ে ছায়াহীনতাই আমার একমাত্র ছায়া!
গাযালির প্রশ্ন, এতে কি উপকৃত হচ্ছো?
বললাম, হচ্ছি।কারণ রৌদ্রদগ্ধ আমি এদিকে- ওদিকে দৌড়াই না,ছায়ার তালাশে। শুধু পথ চলি এবং জানি আল্লাহ ছাড়া আমার কোনো ছায়া নেই আর!
নেজামুল মুলক বললেন,সুন্দর বলেছো। এবং তুমি যে এই উপলব্ধিতে যেতে পেরেছো,তোমার উপর ছায়া আছে বলেই সেখানে যেতে পেরেছো। প্রকৃত ছায়া বরাবরই প্রশান্ত করে। কিন্তু দৃশ্যমান হওয়া তার জন্য জরুরী নয়। কিন্তু তুমি কি কালের কাছে ছায়া চাও না?
বললাম চাই আবার চাই না। কাল যদি আমার মাথায় চড়ে আমাকে ছায়া দিতে চায়,আমি নিচু হয়ে তাকে মাথায় চড়াবো না। সে যদি আমার সত্তার সামর্থকে স্বীকার করে পাশে দাঁড়িয়ে ছায়া দেয়,আমি তাকে স্বাগত জানাবো।
গাযালি বললেন কাল তোমার কাছে কী চায়?
বললাম সে চায় তার বশ্যতা।
বললেন,এতে সমস্যা কোথায়?
সবিনয়ে নিবেদন করলাম,হে মহান, আপনার শিক্ষা থেকে যে আলো লাভ করেছি, সে আমাকে দেখিয়েছে, কালের বশ্যতা মেনে নেয়ার পাপ নিজের আত্মশক্তি ও সম্ভাবনাকে হত্যার পাপকে অবধারিত করে।
গাযালির জিজ্ঞাসা,পাপকে কেন ভয় পেতে হবে?
বললাম, তাকে ভয় পেতে হবে সে প্রতাপশালী হবার কারণে নয়। বরং কোন মহাপরাক্রমশালী সত্তার বিরুদ্ধে তা সংগঠিত হচ্ছে, সে দিক বিচারে।
গাযালি বললেন পুন্য সম্পর্কে কী ভাবছো?
বললাম, প্রায় অনুরূপই। প্রতিটি পুন্যই মহান।তা যতোই ছোট হোক। তাকে তার আকার দিয়ে বিচার করা যাবে না। বরং যে মহামহিয়ানের জন্য তা করা হচ্ছে,সেই মহাপ্রভুর ঐশ্বর্যের সীমাহীনতা দিয়ে তাকে ও তার ফলাফলকে বুঝার চেষ্টা করতে হবে।
গাযালি তাকালেন নেজামুল মুলকের দিকে। বললেন,সে কি উত্তীর্ণ হয়েছে?
নেজামুল মুলক সহাস্য ধীরতায় কী বললেন,বুঝতে পারলাম না।
গাযালি বললেন,আমাদের যেতে হবে। তুমি কি যেতে চাও আমাদের কালে, নিজের কালের প্রতি যেহেতু তোমার এতো বিতৃষ্ণা?
বললাম,আপনাদের কালের আমি পর্যটক। সেখানে পর্যটনের জন্য এবং প্রাণশক্তি আহরণের জন্য যাই,যেতে পারি।কিন্তু স্থায়ীভাবে যেতে পারি না,যাবো না।
চোখে বিস্ময় ছড়িয়ে গাযালি বললেন কেন? কিন্তু কেন?
সবিনয়ে বললাম,আমাকে এই অন্ধ ও প্রাণহীন সময়ে পরিকল্পনা ছাড়া পাঠানো হয়নি।আপনাদের পাঠানো হয়েছিলো যে কালে,আপনারা সে সময়ের দুর্যোগ ও কালোরাত মোকাবেলা করেছেন।
আমাকে একালে অবস্থান করেই এখনকার অসুখের প্রতিকারে সচেষ্ট থাকতে হবে!
গাযালির চেহারায় আবারো ছড়িয়ে পড়লো নাক্ষত্রিক স্নেহ।
বললাম, আমাকে সেই সত্যাস্ত্রের সন্ধান দিন,যা আপনি প্রয়োগ করে সাফল্য পেয়েছিলেন।
গাযালি বললেন, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিশ্ববিস্তারী যাত্রা থেকে এ অস্ত্র লাভ করেছি আমি। কিন্তু অস্ত্রটি ছিলো আমার ভেতরেই। সেটা পাবার জন্য নিজেকে হত্যা করে নিজের ভেতরের পরম সত্তা ও সত্যকে জাগাতে হয়েছে। তুমি পারবে হত্যা করতে নিজেকে?
জিজ্ঞাসাটি ছুঁড়ে দিয়ে গাযালিরা হাওয়ায় উড়তে থাকলেন আর আমি নিজেকে খুন করার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে আবারো ধ্যানে ডুবে গেলাম।
তিন.
মনের কাজ নিয়ে ভাবছি। আল্লাহর কালামে তার স্বরূপ কী?
গাযালী ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. হাজির হলেন।
গাযালী বললেন, কুরআন নির্দেশিত মনের কাজ হচ্ছে, তাদাব্বুর। সমর্থন করলেন শাহ ওয়ালীউল্লাহ।
তাদাব্বুর মানে, পরিণতি, পেছনের দিক।
কোনো বিষয়ের পরিণতি কী? এবং বাহ্যদৃশ্যের পেছনের দিক আসলে কী? সেটার ভাবনা তো গুরুতর বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক ব্যাপার। তাদাব্বুরকে যারাই সংজ্ঞায়িত করেছেন, বলেছেন, এ হচ্ছে, কোনো বিষয়ের পরিণতি, তাত্পর্য ও ফলাফল বিষয়ক পদ্ধতিগত গভীর চিন্তা-অন্বেষা ও গবেষণা।
পদ্ধতি ও স্বরূপের সাথে সম্পর্কিত বিজ্ঞান। অন্বেষা ও হাকিকতের সাথে সম্পর্কিত দর্শন।
এ তো আমার পরম অভিপ্রায়। এর প্রতিটি ধাপে আমার অস্তিত্বের খাদ্য। আমি তাদাব্বুর চাই। একে কর্মরূপ দিতে চাই। কারণ আল্লাহর বাণী প্রত্যাখানকারী হতে চাই না।
ইমাম ইবনে তায়মিয়া রহ. বলেছেন-
‘যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ পড়ল না, সে কুরআন শরীফকে প্রত্যাখান করল। যে কুরআন শরীফ পড়ল অথচ তা নিয়ে তাদাব্বুর করল না সে কুরআনকে প্রত্যাখান করল। যে তাদাব্বুর করলো অথচ এর উপর আমল করল না, সেও কুরআনকে প্রত্যাখান করল‘।
গাযালীকে বললাম, তাদাব্বুর আপনার বিচারে কী?
জানালেন, জ্ঞাত দুই বিষয়ের সাহায্যে তৃতীয় অজ্ঞাত বিষয় জানার মানসিক প্রক্রিয়া হচ্ছে তাদাব্বুর।
জানতে চাইলাম, এর স্বরূপ কী?
গাযালী বললেন, পরম আত্মঅভিজ্ঞান।
বললাম, একটু ব্যাখ্যা করেন। ব্যাখ্যা ছাড়া লোকেরা কিছুই বুঝে না।
গাযালী বললেন, যারা তাদাব্বুর করবে, তারা আত্মঅভিজ্ঞান না বুঝলে তাদাব্বুর করবে কীভাবে?
বললাম, যারা বুঝে না,প্রধানত তারাই এখন তাদাব্বুরের দাবিদার। তাফসীরুল কুরআনের জমিদারি দাবি করে তারা। অল্পকথায় যা বুঝানো হয়, তা থেকে তারা এমন কিছু বুঝে নেবে এবং লোকদের বুঝাতে থাকবে, যা শুনলে আপনি বেহেশতেও শান্তি পাবেন না।
গাযালী বললেন, তুমি এই সমাজে টুকরো টুকরো কথা বলো কোন সাহসে?
জানালাম, আমাকে তারা সেভাবে শুনে না এবং গ্রাহ্য করে না। ফলে আমি নিজের মতো করে অল্প হলেও বলতে পারছি। যদি ওদের কাছে গ্রাহ্য হয়ে যাই, নিজের কথাটুকু নিজের ধরণে মোটেও বলতে পারবো না।
গাযালী বললেন, তোমার এই নৈ:সঙ্গ উদযাপন ক্ষতিকর।
নিবেদন করলাম, আমি নিজেই বরং অসুস্থ প্রবণতার কাছে ক্ষতিকর হয়ে আছি। এতে অসুস্থ সমাজ আমাকে আঘাত করে। খারাপ লাগে বটে! কিন্তু তারা আমাকে গ্রহণ করলে এমনভাবে ও ভাষায় গ্রহণ করতো, যাকে আমি আরো বেশি খারাপ মনে করতাম!
গাযালী বললেন, তাহলে তাদাব্বুর তুমি কাকে বুঝাবে?
বললাম, আমি বুঝাবো না। বুঝাবেন আপনি। আমি আপনার হয়ে কথাগুলো ছড়িয়ে দেবো। আপনার নাম শুনতে ও শুনাতে তারা মজা পায়, যদিও আপনার চিন্তাকে ধারণের জায়গায় তারা নেই!
গাযালী বললেন, শুনো তাহলে! ধরো, কেউ একজন ডুবে আছে পার্থিবতার কুহেলিকায়। মোহে ও মায়ায়। তার সামনে হাজির করা হলো পারলৌকিক জীবনের বার্তা। উভয় জীবনের কোনটাকে সে উদ্দেশ্য বানাবে, তা নিয়ে সে ভাবতে লাগলো। সামনে সে দেখতে পেলো সম্ভাব্য দু‘টি পথ।
একপথ হচ্ছে, কারো পেছনে পেছনে হাঁটার। নিজে কিছু বুঝে বা না বুঝে কারো নিকট থেকে পারলৌকিক জীবনের রূপ ও ধরণ এবং মহিমা ও অপরিহার্যতা জেনে বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যে কোনটা উদ্দেশ্য আর কোনটা বিধেয়? সে সিদ্ধান্ত তার কাছ থেকে নেবে। এটি সর্বনিম্ন রকমের মারিফত। যা খুবই দুর্বল।
এ প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস আর সিদ্ধান্ত গ্রহণ মোটেও প্রশংসনীয় নয় এবং এর নাম তাকলিদ।
বললাম, এটি তো আমি সমাজকে শুনাতে পারবো না। ধড়ের উপর মাথা থাকবে না।
গাযালী জানতে চাইলেন, কারণ কী?
বললাম, লোকেরা বলবে, আমি তাকলিদবিরোধী। দা,কুড়াল, লাঠি, মুগুর ইত্যাদির অভাব হবে না। ফিকরী তাকলিদ বা চৈন্তিক অন্ধঅনুসরণ এবং ফিকহী তাকলিদ বা আইনগত অন্ধঅনুসরণের পার্থক্য তারা বুঝবে না। আপনি কোনো কিতাবে কথাটি লিখেছেন?
গাযালী জানালেন, লিখেছি, ইহইয়া-উ উলূমিদদীন এর চতুর্থ খণ্ডে।
বললাম, তাহলে এবার শুনানো যাবে। মানে আপনার তাকলিদ করলেই তারা তাকলিদ না করা বিষয়ক একথা শুনবে।
গাযালী বললেন, দ্বিতীয় পথ হচ্ছে, লোকটি এই প্রতীতি অর্জন করবে যে, ইহকাল-পরকালের দু‘টির মধ্যে একটি হচ্ছে চিরস্থায়ী এবং চিরস্থায়ী প্রাপ্তিটাই হবে উদ্দেশ্য। এরপর সে জ্ঞানসাধনার মাধ্যমে জানলো পার্থিবতার রূপ ও ধরণ, সমস্যা ও সুযোগ, দুর্বলতা ও সবলতা, স্বরূপ ও প্রকৃতি। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে সে বুঝতে পারলো, উভয়ের মধ্যে চিরস্থায়ী হচ্ছে পরকাল। এরপর পরকালের স্বরূপ, তাত্পর্য ও বাস্তবতার জ্ঞান অর্জন করে সে প্রাধান্য দিলো পরকালকে।
এটি হচ্ছে মা‘রিফতের পথ। এটি প্রশংসনীয়।
কিন্তু এই দুই স্থরের মা‘রিফত অর্জন করার পরে তৃতীয় আরেক মা‘রিফত অর্জন বাকি থেকে যায়। সেটা হচ্ছে, উভয় প্রকারের মা‘রিফতকে চিন্তায়, অনুধ্যানে, উপলব্ধিতে, মননে একাকার ও সুস্থির করে নেয়া। এই ‘নেয়া‘টার পথে মনের যে কাজ, সেটা হচ্ছে, তাদাব্বুর।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মনোযোগসহকারে গাযালীকে শুনছিলেন। কী বিনয় তাঁর!
তার সমীপে জানতে চাইলাম তাদাব্বুরের স্তর সম্পর্কে।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ বললেন-
তাদাব্বুরের প্রথম স্তর হচ্ছে, মহাজগতের যিনি নিয়ন্তা, তার সত্তা সম্পর্কে তাদাব্বুর। এই সত্তা তো সীমায়িত নন। সীমার অতিরিক্ত। মনুষ্যবোধের পরিবেষ্টনের উর্ধ্বে। তার সত্তার স্বরূপ এটাই যে, তার স্বরূপকে অধিকার করতে পারবে না মানুষের সসীম জ্ঞান। অতএব তার সত্তাকে নিয়ে তাদাব্বুর আত্মঘাতী। একে নিষেধ করেছেন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। নিষেধ করেছেন সকল নবী ও রাসূল!
তাদাব্বুরের দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে, মহান আল্লাহর গুনাবলী এবং এর প্রকাশ ও হাকিকত নিয়ে তাদাব্বুর। সূফীরা একে বলেন মুরাকাবা। এটি অর্জন করতে হয় সাধনাধারায়। এর জন্য প্রয়োজন জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অনুধ্যানের বিশেষ মাত্রা। তাঁর জ্ঞান, তাঁর করুণা, তাঁর ক্ষমতা, তাঁর সৌন্দর্য ইত্যাদি অনুধ্যান কতো গভীর, কতো অতল! এর স্বাদ কেবল সেই বুঝেছে, যে এ রহস্যসমুদ্রে নিমজ্জিত হয়েছে।
তৃতীয় স্তর হচ্ছে, আল্লাহপাকের ক্রিয়া-কর্ম নিয়ে তাদাব্বুর। তিনি কেন বর্ষাচ্ছেন বৃষ্টি? কেন ফোঁটাচ্ছেন ফুল? কেন পাকাচ্ছেন ফসল? কেন সাজাচ্ছেন সবুজের গালিচা? কেন গড়েছেন জীবনের লীলামঞ্চ?
কী উদ্দেশ্য দিন-রাতের এই আবর্তনের? কী রহস্য ও লক্ষ্য এই আকাশ-পৃথিবী ও মহাজগতের?
রহস্যনিবিড় এই তাদাব্বুর! আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন, চাঁদের সৌন্দর্য গলে পড়ছে, গ্রহ-নক্ষত্র আবর্তিত হচ্ছে নিরন্তর। আপনি অসীমের সাজানো বাগানে ডুবে অনুসন্ধান করছেন তার সৌন্দর্য!
এ অনুসন্ধান, এ ভাবনা এক ইবাদত।
চতুর্থ স্তর হচ্ছে, বিশ্বজগতের ইতিহাস ও সভ্যতা ও জাতিসমূহের ঘটনাচক্র নিয়ে তাদাব্বুর।কোন জাতিকে কীভাবে তিনি উত্থান দিলেন? কীভাবে দিলে বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা? কীভাবে তারা নিয়ে এলো সুন্দর দিন? কীভাবে তারা খারাপের দিকে ধাবিত হলো? কীভাবে পতন ও অবক্ষয়ের মধ্যে ডুবে গেলো? কীভাবে অপমানিত ও লাঞ্চিত হয় জাতিসমূহ? গোষ্ঠীসমূহ? কীসে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক, সামরিক নেতৃত্ব অর্জন করে জাতিসমূহ? কীভাবে হারায়? কীভাবে শাসক হয়? কীভাবে হয় দাস?
এসব নিয়ে তাদাব্বুরে নিহিত আছে আল্লাহর নিদর্শন।
পঞ্চম স্তর হচ্ছে, মৃত্যুপরবর্তী জীবন নিয়ে তাদাব্বুর। মৃত্যু মানুষের জন্য চিরন্তন এক শিক্ষা। এর স্বরূপ ও অমোঘতা মানুষকে নিত্যই বার্তা দিয়ে যায়। মরণপরবর্তী জীবন নিয়ে ভেবে যেতে হবে এবং করতে হবে মনের তৈয়ারী। শেখার জন্য, নিজেকে শুদ্ধ করার জন্য, আলোকলাভের জন্য। পথের পাশে যে কবরস্থান, সে উপদেশ দিচ্ছে। সেখানে ঘুমিয়ে থাকা মানুষের জীবন কেমন, সেটা কী আদৌ জীবন? এ জীবনের ধরণ কেমন ? কেমন হবে হাশর-মহাউত্থান? কেমন হবে জান্নাত-জাহান্নাম? কর্মফল? আত্মপরিণাম? এভাবনা কেবল ভাবনা বিলাশ হবে না, কর্মে নিশ্চিত করবে প্রভাব।
যা আমাদের জীবনকে দেয় এবং দিচ্ছে শুদ্ধ ও বুদ্ধ হবার ডাক!
মাশা-আল্লাহ, দারুণ ভাষ্য, আল্লাহ এই শাণিত কলমের ধারক কে কবুল করেন, মাফ করেন,দীর্ঘ হায়াৎ দিন, উজ্জ্বলতায় ভরে দিন।