ভা র ত ব র্ষ
অস্থিরতার ভিতর রোজ একটা লোকাল ট্রেন ঢুকে যায়। টিকিট না কেটেই উঠে পড়ি। কোনো সাদা শার্টের টিটি নেই। লোকজনহীন ট্রেন। ট্রেন চলে। মাঝেমধ্যে থামে। তেমন কেউ নামার থাকে না। মাঝেমধ্যে বাদাম বা ডালমুট নিয়ে হকার ওঠে। আমাকে জিজ্ঞাসা করে, দাদা দেব নাকি? নিশ্চুপ আমাকে দেখে, হতাশ হয়। তারপর কখন যে ট্রেন পৌঁছে যায়…
রোজ এমনই ট্রেনে চাপি। তারপর পৌঁছে যায়। কিন্তু, কোথায় যাই, কোথায় পৌঁছাই! একইরকম হুইসেলে ঘুম ভাঙে। একইরকম ট্রেন শুধু আমাকে না, যেন গোটা ভারতবর্ষকে বয়ে নিয়ে যায়!
মে য়ে টি
১
বিবাহের বয়স হল, কিন্তু মেয়েটি কোনোদিন খোঁপায় ফুল গুঁজল না। যেদিন ইচ্ছে হল, সেদিন জঙ্গলে হারিয়ে গেল। পরে জানা গেল— মেয়েটিকে সাপে কেটেছে। তবে তখন তার খোঁপায় ছিল লাল কৃষ্ণচূড়া… ফুলগুলো এত সুন্দরভাবে খোঁপায় গোঁজা, কিছুতেই চোখ ফেরানো যায় না… ছলছল করে…
২
মাথার গণ্ডগোলে মেয়েটি শিশুর মতো থেকে গেল। বুঝল না, কোনটা ভালো বা মন্দ… মেয়েটি আসলে শিশু থাকতেই চেয়েছিল, সবাই তাকে প্রাপ্তবয়স্ক ভেবে রাঙিয়ে দিতে চেয়েছিল সিঁথি…
৩
মেয়েটির আর কেউ নেই। একা। একটা গাছ তার বন্ধু। সে গাছটিকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদে। যেদিন ঝড়ের রাতে গাছটি ভেঙে গেল, সেদিন মেয়েটি সারারাত গাছটিকে পাহারা দিয়েছিল। তবে সে পারেনি।
পাতাগুলো উড়ছিল, ভীষণভাবে উড়ছিল।
জুতোকাহিনি
১
ধারাবাহিক রক্তপাতের ভিতর একটি শিশু খেলে বেড়াচ্ছে। শিশুটি কি গোলদেবে? পায়ে জুতো নেই। তার লাল পা ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটি খেলায় জিতলে একটি জুতো কিনতে পারবে…
২
ছেলেটিকে থামানোর জন্য জুতো কিনে দেওয়া প্রয়োজন। জুতো কিনলেই কি ফিতে পাওয়া যাবে? ছেলেটি জানে না… ছেলেটি জুতো কিনবে এটুকুই ইচ্ছে…
৩
সবার জুতোর গল্পে পথ থাকে। ছেলেটির জুতোর গল্পে কিছুটা গোল, কিছুটা চ্যাপ্টা। পৃথিবীর মতো।
স্লো গা ন
স্মৃতি, সে এক দোকানদার। তার কাছে মাসের শেষে বসি। তার শান্তমুখ। মুখে বাঁকা রেখা। বলি, নুন দাও। ডাল দাও। তেল দাও। চাল দাও। সে বলে, ঋণ মেটা। আগে তুই ঋণ মেটা। মাসের শেষদিনে স্মৃতিরা হিসেব চায়। এই হিসেব আমি ঘুঘু পাখির কাছে শিখতে চেয়েছিলাম। সে সামনে কয়েকটা দানা ছড়িয়ে বলেছিল, এটুকু নিয়েই শান্ত থাক। ঘুঘুর থেকে শান্ত থাকা শিখিনি। গাছের পাতায় লেগে থাকা রোদে বয়স পেরিয়ে গেছে। পাকা ফলে ডুবে গেছে অনেক চঞ্চু। আমি সেই ফলের ভাগ নিতে গিয়ে দেখছি, এগিয়ে এসেছে হালখাতা, নতুন বছরের সূচনা নিয়ে।
মুখ মিষ্টি করতে হবে। পিঁপড়ের সারি থেকে শিখে নিতে হবে শৃঙ্খলতার স্লোগান। এটুকুই নাকি জয়গান!
র বি বা র
কোনো কোনো রবিবার ইচ্ছে করে, মৃত কোনো মানুষের ভূমিকায় অভিনয় করি। ঠোঁটে লেগে থাকা মাংসভাতের এঁটো দেখেও কেউ যেন সন্দেহ না করে। ফোনের ওপারে থাকুক সকল মানুষ। প্রেমিকারা সংসার করুক। বাড়ির লোকজন ভুলে যাক, ছেলের কথা। শুধু পথ আসুক ঘুমের ঘোরে। এক জনপদ থেকে আরেক জনপদে চঞ্চল শিশুর মতো ধুলোবালি মেখে পালিয়ে বেড়াই…
রবিবার, একার। অথচ, রবিবারই হল্লা বাজিয়ে আসে। হেমন্ত গলা ব্যথা নিয়ে গান থেকে থাকে দূরে।
আমিও অভিনয় ভুলে, যাত্রাপত্রে এঁকে দিই, স্মৃতির লাল ছেঁড়া ব্লাউজ…
ব মি
কখনো কখনো গলা চিরে বমি ওঠে। নাড়িভুঁড়িসহ। প্যাঁচানো নাড়িভুঁড়ির সঙ্গে লেগে থাকে রক্তমাখা উচ্ছিষ্ট খাবার। ওই খাবার কখন খেয়েছি জানি না। তবুও খাবারের প্রতি মায়া নিয়ে হজম করি খিদে। গলায় পুঁটুলি বাঁধে দেনা। সংসারের কর্তার মতো নীচু গলায় হাঁটি। কলে টপ টপ করে জল পড়ে। মাছি বসে। আশেপাশে কোথাও ঝাঁটা খুঁজে পাওয়া যায় না।
ব ই মে লা
যে আসতে চায় না, তার সঙ্গে দেখা হয়। সে কেন আসে জানে না। সে বই কেনে না। ফিসফ্রাই খায় না। জলের পাউচ নেয় না। ভিড়ের মধ্যে হনহন করে হাঁটে। পিছন থেকে দেখলে মনে হয়— তার ভীষণ তাড়া। তার কোনো তাড়া নেই। সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরবে। বড়োজোর কয়েক কাপ লিকার চা খাবে। ‘জাগো বাংলা’র সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাববে, একটা সেলফি নেবে কিনা। সে গান ভালোবাসে। ভাবে— খোলা মাঠে গিটার নিয়ে উচ্চস্বরে গান করা ছেলেটির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে কিনা। তার কিছুই ভালো লাগে না৷ সন্ধ্যার সময় যে যখন বাড়ি ফেরে, দেখে পায়ে ধুলো। জল দিলেও যায় না। এত ধুলো! সে কষ্ট পায়। পথকে আহত করার কষ্ট৷ জলকে অপসৃত করার কষ্ট।
র বী ন্দ্র না থ
প্রত্যেক পাড়ায় একজন করে রবীন্দ্রনাথ থাকেন। তাঁকে দেখলেই পাড়ার লোকজন বলে ওঠেন— ওই যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আসছেন। লোকটি কিছুটা রাগান্বিত হন। কারণ, রবীন্দ্রনাথের নাম দিয়ে তাঁকে তুচ্ছ করা হচ্ছে। তিনি কবিতা লেখেন, এই তাঁর অপরাধ… অথচ, লোকটি লিখতে এসে রবীন্দ্রনাথ হতেই চেয়েছিলেন। তাঁর লম্বা চুল, ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি তাঁকে রবীন্দ্রনাথ করেনি। তবু তিনি এই ভেবে আনন্দ পেয়েছিলেন— কবিতালেখকদের ‘রবীন্দ্রনাথ’ বলে, পাড়ার লোক তা জানে…
বা বা র জ ন্ম দি নে
বাবার জন্মদিনে শহরজুড়ে বৃষ্টি হয়। বাবা, জানালা দিয়ে দেখে— কত কী ভেসে যাচ্ছে। বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দিন পেরিয়ে যায়। বাবা, আরেকটু ঝুঁকে পড়ে। ততক্ষণে মেঘ কেটে যায়। আকাশে তারা ওঠে। মিটমিট করে জ্বলে। বাবা, সেই তারাদের পিঠে হাত বোলায়। তারারা তবু খসে পড়ে। বাবা, সাদা ক্রিমের কেকের মতো বৃষ্টিধোয়া আকাশে ছড়িয়ে দেয় তার পেলবতা…
ক্লো ন
আমার দুটো ক্লোন। একজনের সঙ্গে সকালে ঘুম থেকে উঠে, আরেকজনের সঙ্গে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে দেখা হয়। দু-জন রোজই এক প্রশ্ন করে—
প্রথমজন: আজও বেরিয়েছেন?
দ্বিতীয় জন: আজ বেরিয়ে কী হল?
আমি কাউকেই কোনো উত্তর দিই না। যতটা পারি এড়িয়ে যাই।
একদিন এক অনুষ্ঠান বাড়িতে নিমন্ত্রণ পড়ল। গৃহকর্তা অবাক! তিনি একজনকে নিমন্ত্রণ করেছেন। আর এই তিনজনকে মধ্যে কাকে সেটাও তো বুঝতে পারছেন না।
তিনজন একই টেবিলে খেতে বসলেন। ক্যাটারারগুলো মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন। কখন কার পাতে কোন খাবার পড়ছে কেউ বুঝতে পারছেন না। তবে সকলে একই সঙ্গে উঠলেন পাত ছেড়ে। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, সকলের পাতেই দেখা গেল অবশিষ্ট হয়ে পড়ে আছে মুখরোচক জোয়ান আর আধখাওয়া একটা করে রসগোল্লা।