তৈমুর খান
কবি দিশারী মুখোপাধ্যায় বাংলা কবিতার নতুন দিশা অন্বেষণেই বারবার পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি তাঁর দুটি কাব্যে — ‘একটি বাড়ির বায়োপিক’(জানুয়ারি ২০২৩) এবং ‘নির্বিষ চন্দ্রবোড়া ও প্রিয় নির্বাসন’(জানুয়ারি ২০২৪)-এ তার পরিচয় পাওয়া যায়। কবিতা যে একান্ত অন্তর্জীবনের গতি নির্ধারক এবং জীবন প্রবাহের এক বিস্ময়কর ভাঙন তা সহজেই বোঝা যায়।
‘একটি বাড়ির বায়োপিক’ কাব্যে কবি আত্মউৎসের প্রবল অস্মিতাকে ধারণ করেই তাঁর যাপন ক্রিয়ার ভেতর প্রবেশ করেছেন। কবি জানিয়েছেন ‘দীর্ঘ রাস্তা হেঁটে আসার পর এই বাড়ি।’ তখন বোঝা যায় এই প্রবাহের শেকড় কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু এই বাড়িতে পৌঁছেও স্থিরতা নেই। আরও দীর্ঘ রাস্তা হাঁটতে হবে। দীর্ঘ বন্যায় সাঁতার কেটে দীর্ঘ মরুতে পুড়তে হবে। তারপর এই বাড়ি। বাড়ি এক অবস্থানের ধারণা মাত্র। যেখানে একান্নবর্তী পরিবার, তুলসী মঞ্চ, সিংহ দরজা,ঢেঁকিশাল, গোয়ালঘর, বৈঠকখানা, ড্রেসিং টেবিল, আয়না সবকিছুরই আয়োজন আছে। সেখানে রাত্রির অন্ধকার এবং দিনের আলোও আছে। অন্দরমহলের আভিজাত্য, সর্বোপরি ইতিহাস ঐতিহ্যের ভেতর গড়ানোর চক্র আছে। কবির যাপনের সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে নানা প্রসঙ্গ ও প্রসঙ্গান্তর। প্রবৃত্তির বিভিন্ন স্তর থেকে আধ্যাত্মিক উপলব্ধিও। কেমিস্ট্রি ল্যাব থেকে ইতিহাসের জাদুঘরও। ‘বাড়ি বড় বিচিত্র এক জগৎ।’ তাই বাড়ির বায়োপিকে সমূহ জীবনচারণায় অতীত ও বর্তমান যেমন আছে, তেমনি সময়ধারার পরিবর্তনও। ইতিহাস ও পৌরাণিক নানা চরিত্রের সমাবেশের সঙ্গে নিজস্ব বৃত্তের অভিমুখও সঞ্চারিত হয়েছে নানা ক্রিয়ার মাধ্যমে। লৌকিকতারও অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ মোক্ষম হয়ে উঠেছে। কবি ডিসকভারি শব্দ ব্যবহার করে বাড়ির খনিজ আবিষ্কারেই মগ্ন হয়েছেন। কালো পর্দায় শিল্পীর এক বিন্দু সাদা যেভাবে পুরো পর্দাকে সাদা করে তুলেছে—এই বায়োপিকও সেই সাদারই বিস্তার। সেখানে ‘কোনো ক্রিয়াপদেই ফাইনাল হুইশেল বাজে না।’ কিন্তু কবি সবই দেখেন, সবই লেখেন—
“বাড়িতে যে কয়জন মানুষ আছে তারা সবাই কথা বলে। কেউ কম, কেউ বেশি। সেসব কথা সে সংগ্রহ করে। কথাগুলোকে অক্ষরের শরীর দেয়। পশুপাখিদের কথা, জড় বস্তুদের কথাও লিখে রাখে।”
এভাবেই বায়োপিকে জীবনের ছবি তুলে ধরেন। সেখানে সত্যবোধের উপলব্ধির সঙ্গে বাস্তবকে ধারণ করেই প্রতিফলিত হয় জীবনের ডকুমেন্টারি ছবিগুলি। রহস্যময়তার সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় যাপনের এই নির্মাণে যে গতিময়তা,যে রহস্যময়তা তা নিজসত্তার বহুমুখী বিপর্যয় থেকে আত্মবিশ্লেষণের পর্যবেক্ষণও। ইতিহাস, ঐতিহ্য, পারিবারিক পরম্পরার প্রেক্ষিত থেকেই সমালোচনা ও মূল্যায়নও একইসঙ্গে ধারণ করেছেন। কাব্যের শেষপর্যায়ে পৌঁছে অনন্তের এই বিশ্বচরাচরে বাড়িটিকে বিস্তৃত করে দিয়েছেন। তাই বাড়িটি ভেঙে পড়ার আগেই হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-পাঞ্জাবি, সাদা-কালো, বেঁটে-লম্বা, অধ্যাপক-টিপসইকে এক পিকনিকের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন। তখন সমস্ত বাড়িই পৃথিবী হয়ে উঠেছে। কবিও পৃথিবীর কবি হয়ে নিজস্ব মুক্তি রচনা করেছেন। প্রায় ৭১ টি কবিতায় সহজ ভাষায় কথন ভঙ্গিতে গদ্য চালে এক কমফোর্ট জোনের অবস্থানকেই উন্মোচন করেছেন। বিখ্যাত আমেরিকান লেখক, অভিনেতা ও চিত্রনাট্যকার নিল ডোনাল্ড ওয়ালশ বলেছিলেন: ‘জীবন শুরু হয় তোমার কমফোর্ট জোনের শেষে।’ আলোচ্য কাব্যটিও সেই শেষ থেকেই শুরু করেছে তার সূচনা।
কবি ও কবিতার জগতে নিজেকে আলাদা করে চেনাতে পারেন দিশারী মুখোপাধ্যায়। ‘নির্বিষ চন্দ্রবোড়া ও প্রিয় নির্বাসন’ কাব্যেও প্রচলিত রীতির বাইরে তিনি নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছেন। সময়ের কাছে, সভ্যতার কাছে নিজেকে উপযুক্ত করে তোলা এবং বোহেমিয়ান জীবনের কাছে দায়বদ্ধ থাকা কবির কাম্য নয়। তাই নিজেকে খননের সঙ্গে জীবনের প্রজ্ঞা, দার্শনিক চিন্তনও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।তিনি নিজে কী ও কেমন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নিজেরই মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন—
“আমি না থাকলে আলো নিজেকে খুঁজে পেত না”
অর্থাৎ তিনি নন, বরং আলোরই প্রকাশ তার মাধ্যমে। নির্জনেরও অধিক কিছু স্থান নির্বাচন করে নিজেকে আলাদা করেছেন। গোপন ফাটলের আলোয় নিজেকে আবিষ্কার করতে পেরেছেন। কিন্তু আলোয় উদ্ভাসিত হওয়া একেবারে অপছন্দের। কেননা আলো চিহ্নিত করতে পারে পরিচয়, উদ্ধত করতে পারে প্রকাশ, প্রকৃতিগতভাবে হিংস্র ও অহংকারী করতে পারে। কিন্তু কবির তো নিজেকে নির্বিষ করার সাধনায় সব ইন্দ্রিয়কে ভোঁতা করে তোলা। সভ্যতার আলোয় সকলের মতো কবিও চন্দ্রবোড়া একথা অস্বীকার করেন না। কিন্তু স্পষ্ট করেন নির্বিষ চন্দ্রবোড়া বলে—
“স্থবির দেহখানি নিয়ে সে এখন দেখে চারদিকে উঁচু উঁচু গাছ আর প্রচুর শূন্যতা মাটির নীচে অনেক গভীর পর্যন্ত শেকড় আর মাঝে মাঝে নির্বাক জল”
কবি তো এখানেই আলাদা। যে নিজস্ব বৃত্ত রচনা করেছেন একান্ত আত্মগত নির্বাসনের ভেতর তা পরম উপলব্ধির সাধনাপ্রয়াস। ইন্দ্রিয়ের ক্ষত আড়াল করা যন্ত্রণা নিয়ে তিনি শরীর চর্চায় অভ্যস্ত হতে চান না। তাই ‘অন্য এক তথাগত’ হয়েই উপস্থিত হয়েছেন। রাজপথের চন্দ্রবোড়া দেহে বহুবচনের নগ্ন আলোর মাখামাখি যেমন বিব্রত করে, তেমনি এই নিস্তব্ধ সাধনার বিন্দু বিন্দু ক্ষরণে নিজের স্থিতি ফিরে পান। আলোই তখন প্রতারক, নিস্তব্ধতাই তখন সেতু। গাছেদের ভাষাই তখন বোধের সংকেতে জারিত। নির্বাসনই প্রকৃত নিরাপত্তার দেয়াল। এভাবেই নিজেকে চিনিয়ে দিয়েছেন। দূরত্ব দিয়েই নিজের বিশ্বাসকে সম্মান জানিয়েছেন। বিশ্বাসকে আঁকার জন্যই রংও খুঁজেছেন। এই কাব্যের ৭২ টি কবিতায় আত্মচারী কবি নিজসত্তার সামনেই নিজেকে যেমন দাঁড় করিয়েছেন, তেমনি এই অবক্ষয়িত সময়ের বিলাস ও বীভৎস থেকে আড়াল করেছেন। সময়ের ডাকনাম অনন্ত হলেও বাঁশি রেফারির হাতেই বাজে। তাই অনেক কিছুই করার ইচ্ছাও না করার ইচ্ছায় পরিণত হয়। প্রতিটি কবিতাতেই এক সহজ সুন্দর বিমূর্ততার খেলা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কবিকে চালিত করেছে। এক বিস্ময় বিমূঢ়তার ঘোরও কবিতার ভাষা ও ভাবনায় গতি সঞ্চার করেছে।
১) একটি বাড়ির বায়োপিক: দিশারী মুখোপাধ্যায়, প্রচ্ছদ: দয়াময় বন্দ্যোপাধ্যায়, সাঁঝবাতি, মশিয়াড়া, বাঁকুড়া, মূল্য ২০০ টাকা।
২) নির্বিষ চন্দ্রবোড়া ও প্রিয় নির্বাসন: দিশারী মুখোপাধ্যায়, প্রচ্ছদ:ফয়সল অরফিয়াস, দিবারাত্রির কাব্য, ১৯ কলেজ রো, কলকাতা ৭০০০০৯, মূল্য ২০০ টাকা।