spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যস্মৃতির ঈদ

লিখেছেন : পথিক মোস্তফা

স্মৃতির ঈদ

পথিক মোস্তফা

এই মনে আছে তো, কাল কিন্তু শবে বরাত। শবে বরাতের পনেরো দিন পরেই কিন্তু রোজা। বেশির ভাগ সময়ই চাচাতো ভাই ইকবাল এসে মনে করিয়ে দিতো। ইকবাল ভাই আমার চেয়ে দুবছরের বড়ো, আবার স্কুলে এক বছরের ছোটো। আমাদের আলোচনা চলতো, শবে বরাতের পর পনেরো দিন, তারপর একমাস রোজা আর রোজার পরেই ইদ। আজ থেকে কতো দিন পর ইদ তাও আমরা গুণে ফেলতাম। তখন প্রাইমারি স্কুল পড়ি। ক্লাস থ্রি কিংবা ফোরে। গ্রামের মধ্যে আমাদের বাড়িটা ছিলো উল্লেখযোগ্য, জনসংখ্যার দিক থেকে। বাড়ি থাকতো আমাদের মতো ছেটো ছোটো ছেলে-মেয়ের হৈ-হুল্লড়ে মুখরিত। বাড়িতে সব মিলিয়ে আমার বয়সী চাচাতো ভাই-বোনের সংখ্যা ছিলো কমপক্ষে বিশ জন। আমার থেকে পাঁচ-ছ বছরের বড়োর সংখ্যাও দশের কাছাকাছি। আর যারা পুরোই বড়ো ছিলেন, চাকরি-বাকরি করতেন এমন সংখ্যা পাঁচ-ছয় হবে। আর টুকটাক নিজস্ব স্বার্থদ্বন্দ্ব ছাড়া ভাই-বোনের মধ্যে খুব একটা বাদ-বিসংবাদ ছিলো না। তাই রোজার পরে ইদের হিসাব করার মানেই হলো, নতুন নতুন জামা-কাপড়ে আবার একটা আনন্দদিন কাটবে। 

আমরা চার ভাই-বোনের মধ্যে আমি দ্বিতীয়। বড়ো বোন, তারপরে আমরা দুভাই আর ছোটো বোন। ইদ উৎসবে ছোটোবেলায় ভাইবোনের সংখ্যা ত্রিশ ছাড়াতো। রোজা আসলে প্রতিদিনই সন্ধ্যার পরে হিসাব মেলাতাম আজ কতোতম তারাবির নামাজ পড়লাম। আরো কতোদিন পড়লে, ইদ। দেখতে দেখতে চলে আসতো, বিশ রোজা, এখান থেকেই বেশি করে গোনাগুনি শুরু হতো। এই গোনার সাথে যোগ হতো, আব্বার ইদে বাড়ি আসা, না আসার হিসেব। সেই নব্বই দশকের কথা। চিঠিপত্র ছাড়া যোগাযোগের কোনো মাধ্যম নাই। আব্বা চাকরি করতেন বিডিআরে। তার চিঠির জন্য অপেক্ষা করতে হতো, সোমবার আর বৃহস্পতিবারের জন্য। কারণ, এই দুদিন ছিলো আমাদের হাটবার। বরিশাল জেলার, আগৈলঝাড়া উপজেলা, মোল্লাপাড়া গ্রামের সাহেবেরহাটে সপ্তাহে দুদিন হাট মিলতো। আর এই হাটেই ডাকপিয়ন সকলের চিঠি বিলি করতেন। 

আব্বার মতোই আমাদের অতি প্রিয় ছিলেন, কাকা। আব্বার ছেটো ভাই। তিনি হাট থেকে ফিরে আসতেন ইফতারের আগমুহূর্তে, আবার কখনো সন্ধ্যা হয়ে যেতো। আব্বার চিঠি পেলে সবসময় তিনি তার শার্টের বুকপকেটে রাখতেন। ডাকবিভাগের হলুদ খাম। হাট থেকে ফেরার পর আমাদের ভাইবোনদের নজর থাকতোÑ প্রথমে কাকার পকেটের দিকে, তারপর বাজারের থলের মধ্যে আমাদের জন্য স্পেশাল কোনো খাবার তিনি হাট থেকে নিয়ে এসেছেন কি না, তার দিকে। চিঠির খাম দেখলে চোখ চকচক করে উঠতো। কাকার কাছে জানতে চাইতাম, আব্বা আসবেন কবে? তবে বেশির ভাগই জবাব আসতো, ‘তোর আব্বা আইতে পারবে না, হে নাকি সবাইরে ছুটি দিয়া দিছে, হে কোরবানিতে আইবে।’ কিছুটা মন খারাপ হলেও আবার সবার সাথে মিশে মন ভালো যেতো।

বিশ রোজার পর হিসাব করতাম, কদরের রাত। সে সময় আমাদের সোজা হিসাব ছিলো, ছাব্বিশ রোজার রাতেই কদর। আর কদরের পরই ইদ একদম নিকটে। তার মানে সব হিসাবের শেষ ছিলো, ইদ কবে হবে!  দেখতে দেখতে চাঁদ দেখার দিন চলে আসতো। আমাদের বাড়ির চতুর্দিকে ছিলো খোলা মাঠ, কৃষি জমি। বাড়ির পশ্চিম পাশে আসরের নামাজের পরই জড়ো হতে থাকতাম। প্রতিযোগিতা চলতো, কে কার আগে চাঁদ দেখতে পারে। চাঁদ ওঠার আগেও আনন্দে কয়েকবার চাঁদ দেখে ফেলতাম। মেঘের জন্য চাঁদ দেখতে না পারলে অপেক্ষায় থাকতাম, প্রিয়কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর সঙ্গিত ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ইদ’ রেডিওতে শোনার জন্য। এই গানই আমাদের ইদের আগামনী বার্তা দিতো। আমরা নেমে পড়তাম, ইদ মোবারক জানাতে। শুরু হয়ে যেতো আনন্দে মাতামাতি। রাত অনেক হয়ে যেতো চোখে ঘুম নেই। তবুও জোর করে আম্মা ঘুম পাড়াতেন। সকালে উঠে ফজরের আগে বড় ভাই, মিয়া ভাই ও কাকার সাথে খালের ঘাটে গোসল করতে যাবো। সেই আনন্দ স্মরণ করেই তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যেতাম। বড় ভাই, মিয়া ভাই দুজন চাচাতো ভাই; আমার আব্বা ও কাকার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। তারা চাকরি করতেন, ইদের ছুটিতে বাড়িতে আসলে তাদের পিছ ছাড়তাম না, আর আমার কাকার সুবাদে তাদেরও আড্ডা ছিলো আমাদের ঘরে। আর গরমের দিনে ইলেক্ট্রিসিটি ছাড়া আমাদের দখিনদুয়ারি ঘর ছিলো বাড়ির সকলের আড্ডাস্থল। আমরা দরজা-জানালা খোলা রেখে হেরিক্যান জ্বালিয়ে রাখতে পারতাম না, বাতাসের জন্য। যাই হোক, খালের ঘাটে গোসল সেরে ফজরের নামাজও আমরা পাড়ার ইদগাহে পড়তাম। কারণ, তখনও আমাদের মসজিদ নির্মাণ হয়নি। 

ফজরের নামাজের পরই শুরু হয়ে যেতো আমাদের মিষ্টিমুখ করার পালা। ইদগাহের পাশেই ছিলো পাড়ার ছলিমউদ্দিন দাদার ঘর। ছলিমউদ্দিন দাদার স্ত্রী, আমাদের দাদি ছিলেন খুবই ভালোমানুষ। তিনি বলেই রাখতেই, ফজরের পর সবাই আমার বাসায় মিষ্টিমুখ করবে। সেই মিষ্টিমুখ শেষ হলে, ওই বাড়ির অন্যান্য ঘর মিলে পাঁচ-ছ ঘরে চলতো সেমাই খাওয়ার পালা। বেশি খেতে না পেরে কখনো কখনো পালিয়ে যেতাম, পরে খাবো এই কথা বলে। এদিকে ইদের নামাজের আগে বাড়িরও সকল ঘরে তৈরি হয়ে যেতো সেমাই, ফিরনি, পায়েশ। এই কাকি, ওই কাকার ডাকে ভাই-বোনেরা দলবলে ইদের নামাজের আগেই ভরপেট মিষ্টিমুখ চলতো। 

ইদের নামাজের শেষে আমাদের পুবধার বাড়ি, সিকান্দার কাকার বাড়ি, গাছঘর বাড়ি কোনো বাড়িই ছাড়তো না সেমাই না খাইয়ে। নামাজের পর দলবেধে সকলকেই যেতে হতো সকলের বাড়ি। তারপর চলতো নতুন জামাকাপড় পরে ঘোড়াঘুড়ি। দুপুর হয়ে গেলে যোহরের নামাজের পর আবার ধারাবাহিকভাবে শুরু হতো, দুপুরের খাবারের বাড়াবাড়ি আয়োজন। নিজের ঘরের খাওয়ার কোনো সময়ই নাই। পাড়ার কোনো ঘরই বাদ যেতো না। সকলের মুখেই এক কথা, ওরে বাবা ইদের দিন কোনো ঘরই তোমার পর না। এই দিন নিজের ঘরে খেতে হয় না, তোমরা খাবে আমাদের ঘরে, আর আমরা খাবো তোমাদের ঘরে। এমনই চলতো, প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত। রাতের খাবারটা ছিলো একটু ব্যতিক্রমধর্মী; বাড়ির সকলের খাবার এক জায়গায় জড়ো করা হতো। উঠোনের মাঝে হোগলা বিছিয়ে বাবা-চাচা, মা-চাচি, ভাই-বোন সবাই বসে যেতাম। রাতের খাবারও একত্রে খেতে হতো। রাতে ঘুমুতো যাওয়ার আগে আফসোস হতো, ইদের দিন শেষ।

উনিশশ নব্বই সাল। আমাদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেলেন সকলের প্রিয়, আমার কাকা গাজী আব্দুল করিম। উনি মারা গেলেন ইদের কয়েকদিন আগে। তারপর থেকেই কেমন যেনো আমাদের ইদ আনন্দ ফিকে হতে শুরু করলো। তিনি আমার আপন চাচা হলেও অন্যান্য সকলের কাছেই তিনি ছিলেন খুবই প্রিয়মানুষ, প্রিয়ব্যক্তিত্ব। তারপর আব্বার চাকরির সুবাধে তিনি তো দূরে দূরে থাকতেন, আমরা গ্রামেই থাকতাম, চাচাই ছিলেন আমাদের অভিভাবক। তাই তার মৃত্যুর পর একপ্রকার অভিভাবক শূন্য হয়ে যাই। এক বছরের বেশি সময় ধরে তিনি ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ভুগছিলেন; তার এই অসুস্থতা ও চলে যাওয়া থেকেই আমাদের আনন্দে ভাটা পড়ে গিয়েছিলো। তারপর সব বাস্তবতা মেনে নিয়ে, জীবন আবার সচল হতে থাকে। আমিও পড়াশুনার তাগিদে শহরে চলে আসি। অন্য চাচাতো ভাইয়েরাও যে যার মতো করে দূরে চলে যায়, বোনদের বিয়ে হতে থাকে; কেমন যেনো সব রঙ ধূসর হতে থাকে। বড় হয়ে যাই আমরা, অনার্স পাস করি অতঃপর মাস্টার্স; বাড়িতে ইদ করতে যেতাম, কিন্তু আগের মতো ছলিমউদ্দিন দাদার বউয়ের আদর করে মিষ্টিমুখ করানো আর অবশিষ্ট রইলো না। পাড়ার যে-সব চাচা-দাদারা ছিলেন, মাঝে মাঝে দুয়েক ঘরে ডাক দিলে যেতাম, শৈশবস্মৃতি মনে করে। 

এখন গ্রাম উন্নত হয়েছে, প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে। এখনকার ছেলেপুলেরা মোবাইল ফোনে সব খবর রাখে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নতুন নতুন বন্ধুত্ব তৈরি করে, নিজের ভাইবোন কিংবা চাচাতো, পাড়াতোদের খবর নেয়ার সময় তাদের নেই। গ্রামে বা শহরে যেখানেই থাকুক, তাদের বন্ধুত্বের নেটওয়ার্ক বিশ্বময়। আমরাও ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছি বাপ-চাচাদের জায়গায়, কিন্তু কোনো ভাবেই আমাদের বাবা-চাচাদের স্নেহার্দ্র হৃদয়ের অধিকারী হতে পারিনি। আবার অন্য ভাবে বলা যায়, আমাদের সন্তানরাও আমাদের উষ্ণতা প্রাপ্তির প্রত্যাশায় বসে থাকে না। তাদের জীবনচিন্তা এখন ভিন্নভাবে গড়ে উঠছে। 

আমাদের প্রত্যাশায় যে শৈশবের ইদ, সেখানে ফিরে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবে সামাজিক সম্প্রীতি ও সংহতি গড়তে বছরে দুটো ইদ অনেক বড়ো ভূমিকা পালন করতে পারে। সেকালে সামাজিক অনেক দ্বন্দ্ব-কোন্দল, বড়ো বড়ো বিবাদও বিচার-সালিশি ছাড়া শুধু একই ইদের জামাতে নামাজ পড়ে কোলাকুলির মাধ্যমেই মিটে যেতো। বুকে বুক মিলিয়ে মিটে যেতো অনেক হানাহানি। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ছোটো বড়োর কাছে ক্ষমা চেয়েছে, বড়ো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে, ইদের নামাজে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আর নামাজ শেষে কোলাকুলিতে বুকে বুক মিলিয়ে। সেই সুন্দর সম্প্রীতির ইদ আজও আবেশে দোলা দেয়, করে তোলে স্মৃতিকাতর। ইদ বয়ে আনুক সকলের জীবনে অনাবিল আনন্দ। আল্লাহ সকলকে তাঁর রহমতের চাদরে আবৃত্ত করুন, আমিন।  

৩১ মার্চ ২০২৪খ্রি. 

আরও পড়তে পারেন

4 COMMENTS

  1. ঈদের স্মৃতি নিয়ে লেখাটা খুব ভালো লাগলো।

  2. কবি সাজ্জাদ বিপ্লব, একজন সৃষ্টিশীল ও সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষ। তিনি আমার শ্রদ্ধাজন, প্রিয়কবি ও সম্পাদক। কবি সাজ্জাদ বিপ্লব বেড়ে উঠতে চান তার সাহিত্যের পরিজন নিয়ে, যিনি কখনো একক চিন্তায় মশগুল নন। সাহিত্য ও সাহিত্য পত্রিকা সম্পর্কে যখন অত বোধ জন্মায়নি তখন থেকেই তার সাহিত্যপত্রিকা দেখে মুগ্ধ হতাম। বিশেষ করে কবির সম্পাদিত ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য’ বাংলাদেশের লিটলম্যাগ অঙ্গনে একটি বিপ্লবের নাম। এই পত্রিকার শৈল্পিক উপস্থাপন ও লেখক নির্বাচন ছিলো অনির্বচনীয়। কবি এখন প্রবাসে কিন্তু তিনি যেন অতি নিকটেই আছেন। এবার তার প্রকাশিত ওয়েব মাগ্যাজিন আবারও তার সাহিত্য পরিজনদের গ্রন্থিত করছে। তিনি সর্বদায় সাধারণের মাঝে থেকে অসাধারণ সৃষ্টির উদাহরণ তৈরি করেন। ভালোবাসা, প্রিয়কবি ও সম্পাদককে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ