spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েঅবরুদ্ধ সময়ের কবিতা

লিখেছেন : শাহাদাৎ সরকার

অবরুদ্ধ সময়ের কবিতা

শাহাদাৎ সরকার

আমি কারো শত্রু নই
সাজ্জাদ বিপ্লব
প্রথম প্রকাশ: ২০১৭
প্রচ্ছদ : রাজীব দত্ত
প্রকাশক: কথারা, বগুড়া
মূল্য: ১৫০ টাকা

অবরুদ্ধ সময়ের কাব্যগ্রন্থ ‘আমি কারো শত্রু নই’। কাব্যগ্রন্থটি সৃজন করেছেন নব্বইয়ের অন্যতম কবি সাজ্জাদ বিপ্লব। এই কাব্যগ্রন্থটির ভেতরদেশে রয়েছে সাম্প্রতিকালে ঘটে যাওয়া ঘটনার সমাবেশ। আর অবরুদ্ধ সময়ের ছবি তুলে ধরায়, তাকে বলা যেতে পারে অবরুদ্ধ সময়ের কবি। কেন, তাঁকে অবরুদ্ধ সময়ের কবি বলে উল্লেখ করছি তার একটা ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার। তিরিশের কবি বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) ছিলেন বাম বিরোধী। তবুও তিনি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে সৃজন করেছিলেন অসাধারণ রচনা এবং তরুণতম কবি হিসেবে তাকে অভিনন্দন জানাতেও কার্পণ্য করেননি। কিন্তু সাজ্জাদ বিপ্লব এমন এক সময়ের কবি যখন স্বাধীন বাংলাদেশে কবিদের পরিচয় তার কবিতা দিয়ে না হয়ে; একজন কবির পরিচয় হচ্ছে তিনি কোন মতে বিশ্বাসী বা কোন রাজনৈতিক দলের আদর্শে বিশ্বাসী তার ভিত্তিতে। যা একটি জাতির জন্য লজ্জাকর। তবুও এই অবরুদ্ধ সময়ের মধ্যে থেকেই কবিতা সৃজন করে কবি সাজ্জাদ বিপ্লব আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন জীবিত কবিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদকে। কবি আল মাহমুদ তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, “যে সহজতা উত্তর আধুনিক কবিকুলের গন্তব্য, এ কবি যেন মায়ের পেট থেকেই তা আয়ত্ত করে এসেছে।’
এই হলো সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতার বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ তিনি যা বলেন তা সহজ করেই বলেন। তবে সেই সহজতায় থাকে এক রকমের প্রলেপ। ঠিক তুলোর মতো; যা নরম, কিন্তু ভাসমান। আবার আকৃষ্ট করে আমাদের।

‘আমি কারো শত্রু নই’ কাব্যের কবিতা পাঠে পাঠক মাত্রই কবি সাজ্জাদ বিপ্লবের দীপ্র দেশপ্রেমের পরিচয় পাবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। যদিও বর্তমানে কবি জীবিকার তাগিদে প্রবাসে জীবন কাটাচ্ছেন। তবুও কবির দেশের প্রতি যে ভালোবাসা, তার কোন কমতি নেই। বরং রয়েছে অফুরান টান। এই ভালোবাসার টান থেকে স্বদেশের বুকে কোন অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য ঘটতে দেখলেই কবি হয়ে ওঠেন অস্থির, সেই অস্থির চিত্তের বহিঃপ্রকাশ ঘটান কবিতা সৃজনের মাধ্যমে। শুধু দেশের ভিতরের ঘটনা সমূহই নয়, পাশাপাশি দেশ যখন বহিশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়, মুখোমুখি হয় প্রতিবেশী দেশের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যবস্তুতে, যখন তার স্বপ্নের স্বদেশভূমিকে নিয়ে দানা বেঁধে উঠতে থাকে কোন ষড়যন্ত্র তখন কবি হয়ে ওঠেন প্রতিবাদী। আর তার এই প্রতিবাদী সত্তার পরিচয় মিলবে এই কাব্য পাঠে।
কাব্যগ্রন্থটির প্রথম কবিতা ‘বেঁচে আছি’’–তে দেখি কবির বাস্তববাদী মনোভাব। তিনি অতীত-ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত নন।

তিনি কোন কালের তা নিয়ে নেই কোন মাথা ব্যথা। তার পিছনের প্রতি নেই কোন পিছু টান সামনে চলার গতিই একমাত্র সঙ্গী। যদিও প্রথম স্তবকে একটু সংশয় মিশ্রিত কণ্ঠে কবি প্রশ্ন ছুড়ে
দিচ্ছেন এভাবে “আমি তবে কোন কালের?” শেষ স্তবকে নিজেই ঘোষণা করছেন নিজের অস্তিত্ব এই বলে:

সামনে ছুটে চলা দুরন্ত গতি, আমার সাথী। স্বজন।
দু’পাশে দিয়ে শা শা করে কিম্বা
ধীর গতিতে কেউ হেঁটে গেলে, আমি টের পাই…
আমি জানি না, আমি কোন কালের
শুধু, বেঁচে আছি বা ছিলাম, এটুকুই…

(বেঁচে আছি, পৃ. -৯)

নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে কবি স্বদেশের চিন্তায় মশগুল। যখন দেখছেন তার দেশের মধ্যে মানুষ মানুষ হত্যা করছে, হেয় করছে আর সেই সুযোগে পাশ্ববর্তী দেশ কবির প্রিয় মাতৃভূমিকে নিয়ে
খেলায় মত্ত সেই চিত্র কবি এভাবে তুলে আনছেন:

পিষ্ট করে দিচ্ছে তথাকথিত চেতনাবাজগণ
আমায় নিয়ে খেলছে একাধিক বন্ধুরাষ্ট্র
আমার বন্দর আজ বন্ধক বিবেকের মতো
আমার সীমানা অরক্ষিত পিলখানার মতো
আমার আকাশ আজ অন্ধকার, একাত্তরের মতো
আমার কণ্ঠনালী কার পদপিষ্টে চাপা, জানো?

স্বদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে কবি যেমন শঙ্কিত। তেমনি
বিশ্বমানবতার ক্ষয়িষ্ণুতা কবিকে ভাবিত করে, ‘বিশ্বাস ও ভালোবাসা’ কবিতায় তার পরিচয় পাই:

আজ, আমরা কেউ শান্তিতে নেই
না আইসিস না জাকির নায়েক।

এই যে শান্তিহীনতা, তা শুধু মাত্র বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের মধ্যেই নয় কবির নিজের রাষ্ট্রেও তার নগ্নরূপ আরো গভীর পর্যায়ে চলে গেছে, সেখানে ছড়িয়ে পড়েছে দলীয় সাম্প্রদায়িকতা, মানুষ হয়ে উঠেছে
আত্মবাদী। কেউ তার বিপরীত মত মেনে নিতে নারাজ, আরপাশাপাশি তৈরি হয়েছে সুবিধাবাদী একটি শ্রেণি:

আমি বদলে নিচ্ছ আমায়
আগে নিজে বাঁচলে, তবে না বাপের নাম।

আমার নাম, নিশানা ও চিহ্ন
ওরা মুছে ফেলতে চায়

ছেঁটে ফেলতে চায় বাংলাপিডিয়া থেকে
আমার কর্ম ও অবদান, আমার স্বীকৃতি

উচ্ছেদ করতে চায় আমার ভিটেমাটি থেকে আমাকে।

(বদল, পৃ. ৩০)

সকল জায়গা থেকে কবিকে উচ্ছেদ করলেও তিনি ভালোবাসায় বিশ্বাসী। তিনি ভালোবাসতে জানেন, মানুষকে আপনার করে নিতে জানেন। আর তাই তো কবি বলেন,

এখন আমার যুদ্ধ তবে কার বিরুদ্ধে? কাদের নিয়ে? কার সঙ্গে?
পাশের বাড়ির যে দরোজা, সেটি আমার ভাইয়ের
পাশের পাড়ার যে টিনের চালা বা ছাদ,
সেটি আমার বন্ধুর,
আমার আত্মীয়ের,
আমার নিজের
এরা কে আমার শত্রু?
কাকে আমি হত্যা করবো?
বুলেট চালাবো যার দিকে লক্ষ্য করে সেতো আমি-ই
আমি-ই বাংলাদেশ
বাংলাদেশকে নিয়ে তোমরা কেউ ক্রসফায়ারে দিও না, প্লিজ।

(আমি-ই বাংলাদেশ, পৃ. ১২)

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. আলোচনা বেশ ভালো লাগলো। কবি
    সাজ্জাদ বিপ্লবের সহজ, কিন্তু গভীর– গভীরতায় ঋদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ