লাবনী মন্ডল
‘উদ্যান’ একটি ছোটকাগজ। সম্পাদনা করেন তৌফিক জহুর। যিনি মানুষের মননে গেঁথে থাকে এমন কবিতা এবং প্রবন্ধ লিখেন। সম্প্রতি এটি হাতে আসে। আমি হলাম হাজার কাজে ব্যস্ত থাকা মানুষ দুলাইন লিখে যে নিন্দা বা কৃতজ্ঞতা জানাব সে সুযোগ হয়ে উঠছিল না।
এ দেশে ছোটকাগজের ইতিহাস খুব সমৃদ্ধি। এখনও পর্যন্ত আমরা আস্থা রাখতে চাই এই ধরনের কাগজের উপর। যাতে পাওয়া যাওয়া লুকিয়ে থাকা কোনো এক প্রবন্ধকারের বা গল্পকারের লেখা। ছোটকাগজের কাজই হলো মূলকে তুলে ধরা। যেখানে আবেগ থাকে, প্রেম থাকে এবং বিশাল মন নিয়ে এ ধরনের কাজ করতে হয়।
‘উদ্যান’ হলো সাহিত্য-সংস্কৃতি ও দর্শনবিষয়ক ছোটকাগজ। যে সংখ্যাটি নিয়ে লিখছি—প্রবন্ধ সংখ্যা। তার মানে আমার বিষয়। গল্প-কবিতা যেহেতু কম বুঝি, সেহেতু প্রবন্ধই বুঝতে হয়।
এ সংখ্যাটি পড়ে শেষ করা মানে কতগুলো মানুষের সৃষ্টি সম্পর্কে জানা। যে জানাই মানুষকে সমৃদ্ধ করে। না পড়ে কথাবলাটা শোভনীয় নয়। তাতে দেরি হলে হোক।
কবি ও কবিতা ভাবনাবিষয়ক প্রবন্ধ সংখ্যা সমৃদ্ধ অনেকভাবে। কবির ভেতরের চিন্তা, মননেন ভাবনা উঠে এসেছে। এপার বাংলা-ওপার বাংলার লেখকদের এক মলাটে সম্মিলন ঘটিয়েছেন সম্পাদক। যে তালিকায় আমার পাঠ করা বা পছন্দের বেশ কয়েকজন ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। যাদের লেখা পাঠককে ছুঁয়ে যায়। পাঠকের ভেতরে নাড়া দেয় বা সে চেষ্টা চালায়।
গোলাম কিবরিয়া পিনুর প্রবন্ধ ‘কবিতার জগৎ নিয়ে কিছু বোধভাষ্যি’ এখানে তিনি ‘কবিতা কী’ ‘এই সময়ের বাস্তবতা’ এবং ‘স্বভাব কবি ও আধুনিক’ কবি নামে সাবহেড করেছেন। এছাড়া বেশ কয়েকটি সাব-হেড করে সুবিস্তৃতভাবে বুঝিয়েছেন কবিতার বোধভাষ্যি।
প্রায় সময় শোনা যায়, লিখি আনন্দ পাওয়ার জন্য বা অবসর সময় কাটানোর জন্য। এ বিষয়টি কোনো জাত কবি বা লেখক বলতে পারেন না। কবিতা নিছক আনন্দ পাওয়া বা দেওয়ার জন্য লেখা হয় না। এটা ভেতরের তাড়না। চিন্তার জগতের দহন। জীবনের খণ্ড খণ্ড চিত্রপট। জীবনেলাখ্য। সুতরাং আমাদের আরো গভীরে ভাবতে হবে। যে বিষয়ে এ প্রবন্ধটি লিখেছেন লেখক।
উনি একজন, কবি, ছড়াকার এবং প্রাবন্ধিক। তার ভেতরের বোধশক্তি-চেতনাশক্তি পাঠককে প্রাণসঞ্চারী করে তুলে। কবিতা এমন এক তীব্র অনুভূতি যা মানুষকে—ভাবায়, জাগায়, শেখায় এবং অপরকে ভাবাতে সহযোগিতা করে। লেখার ভেতরে যদি সময়ের অনুভূতি না থাকে, সময়ের দহন না থাকে; তাহলে তা অচিরেই হারিয়ে যায়। কিন্তু এ ধরনের লেখকরা হারায় না, জাগায়। তিনি এ প্রবন্ধে লিখেছেন—‘কবিতা তো মানুষ ও জীবনের জন্য। কবিতায় কবির অভিজ্ঞতা, তার সমাজচেতনা ও বিভিন্নমুখী বোধ শিল্পের সৌকর্য নিয়ে উজ্জ্বল হয়। আমরা বলছি না—কবিতা একেবারে উদ্দেশ্যমূলক হয়ে উঠবে, কোনো শিল্পশর্ত থাকবে না, সৌন্দর্য থাকবে না, হবে নিরাভরণ! কিন্তু কবিতাকে নৈরাজ্যের মধ্যে ফেলে দেওয়ার দায় কোনো কবি কখনো বহন করেন না। একদিকে তরলতা আর অন্যদিকে নিরীক্ষার নামে ভয়াবহভাবে কবিতাকে উন্নাসিকতার কবলে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত করা; শুধু কবিতার পাঠককে বিভ্রান্তির মধ্যে ঠেলে দেওয়া নয়, ভালো কবিতার বিকাশকেও বাধাগ্রস্ত করে।’
এ প্রশ্নে তার ভাবনা সুপ্রসারিত। কেন এত কথা বলছি—ছোটকাগজের এমন প্রবন্ধ পড়লে জানা যায় নানান আঙ্গিক থেকে। চিন্তার ভেতর স্থবিরতা কেটে যায়। আমরা পড়ি না বা পড়তে চাই না। তবে এ ধরনের ছোটকাগজ খুঁজে খুঁজে পড়া উচিত। হ্যাঁ, সবগুলো লেখা বা লেখক আপনাকে টানবে না, সেটা আমাকেও টানছে না। এখানে সম্পাদকের দায়বদ্ধতা রয়েছে—যা আপনি-আমি জানি না। তবে যেটুকু ভালো, তার রসাস্বাদন কেন করব না?
‘উদ্যানে’র এ সংখ্যাটি হয়তো আজ থেকে আরো বিশ বছর পর কাজে লাগবে। এই ‘কবিতা কী’ লেখাটুকু রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করবে । কোনো গবেষক তার গবেষণা কাজকে সমৃদ্ধ করতেই খুঁজবে। মানে কতকিছু হতে পারে, তবে এ পথ সাবলীল করে দিয়ে যেতে হবে আমাদেরকে।
তৌফিক জহুর লিখেছেন ‘কবিতার ঘরবাড়ি-২’ শুরুটা একটু তুলে ধরছি—“একজন শব্দশ্রমিককে চিরটাকাল একাই পথ চলতে হয়। পাঠক একজন শব্দশ্রমিককে সম্মান দিয়ে ‘কবি’ অভিধায় সম্বোধন করেন। কবির চলার পথ মসৃণ নয়। একটা ভাবনার মধ্যে দিয়ে, একটি স্বপ্নের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একজন কবি, প্রকৌশলীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।”
পাঠক হিসেবে যদি প্রশ্ন রাখি এই একাই পথ চলা’ বলতে উনি কী বুঝিয়েছেন। কেন একা পথ চলতে হয়? একজন শব্দশ্রমিকের সঙ্গে আরেকজন শব্দশ্রমিকের সম্পৃক্ততা হচ্ছে না কেন কিংবা আদৌ কি হয় না? বিষয়টা আরো সুগভীরে। ভাবনার ভেতর ভাবনা থাকে। যাকে খুঁজে বের করতে হয়। একজন পাঠকের এটুকু দায়বোধ থাকাটাও জরুরি। লেখক কেন এ বাক্যটা রচনা করলেন, পাঠক তার গভীরে গিয়ে খুঁজে বের করবে।
তার এ লেখার শৈল্পিক বুননশৈলী আপনাকে প্রাকৃতিক কোনো অপরূপ সৌন্দর্যে নিয়ে যাবে। যেখানে বসে হয়তো আপনি ভাবছেন—কবিতা কই থাকে? গ্রামে-শহরে-পাহাড়ে-সমুদ্রে কিংবা মানুষের ভেতরে। প্রশ্ন করলেই না উত্তর বের হবে। তৌফিক জহুর প্রশ্ন রেখেছেন, কারণ প্রশ্ন করাটাই এখন কাজ। না হলে আমরা হারিয়ে যাচ্ছি, আমাদের ভিত নড়বড় হচ্ছে।
নাহিদা আশরাফী লিখেছেন ‘নব্বইয়ের কবিতা : দশক নিমগ্ন চেতনা নাকি নিমগ্ন চেতনার দশক’ প্রবন্ধটি। যেটির ভেতর প্রশ্ন রয়েছে, জিজ্ঞাসা রয়েছে। একটা দশকের জিজ্ঞাসা। যে দশকটা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ। যে সময়টায় অনেক ইতিহাস রচিত হয়েছে। ইতিহাস যারা রচনা করেছেন, তারা কোনো না কোনোভাবে সৃষ্টিশীলতার মোহে আচ্ছন্ন ছিলেন।
আবার তিনি আশির দশককে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন সাম্য-ভালোবাসার সমাজ নির্মাণের অবস্থান থেকে। ওই দশকের কবি-সাহিত্যিকর যতটা তেজস্বী চিন্তাধারার ছিল, নব্বইয়ে আসে তার অবস্থান কিছুটা হলেও স্তিমিত হয়েছিল। যেটি আমরা ইতিহাসের দারস্থ হলেই দেখতে পাই। তিনি লিখেছেন—আশির দশকের কবিতায় স্বৈরাচারবিরোধী যে প্রতিবাদী তৎপরতা কবিতার পরতে পরতে আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম নব্বইয়ে বহু বিশ্লেষণেও তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। কিন্তু কেন? তবে কি নব্বইয়ের কবিরা রাজনীতি বা গণতান্ত্রিক স্লোগানমুখী কাব্যধারা থেকৈ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন নাকি কথিত গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অর্থব ও অনগ্রসরমান অবস্থায় তাদের উপরে স্থবিরতা, হতাশা ও বিষন্নতা ভর করেছিল যাতে রাজনীতি সচেতন কাব্যভাব সৃষ্টিতে নব্বইয়ের কবিরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন।…’
এর উত্তর নব্বইয়ের দশকের কবিরা দিবে। আমি আমার পাঠপ্রতিক্রিয়ায় অংশটুকু তুলে ধরলাম। প্রশ্ন তো আমরাও জাগতে পারে কিন্তু শক্ত রেফারেন্সেই তুলে ধরাই যৌক্তিক।
যাহোক, এরকম একটি সংখ্যা এরপর আর উদ্যান প্রকাশ করেছে কিনা আমি জানি না। যদিও তাদের ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করার কথা। এটি প্রতিশ্রুতি থাকলেও, বাস্তবতা কতটা নির্মম তা জানা রয়েছে। তবে ধরনের লড়াই টিকে থাকুক।
শব্দেরা খেলা করুক। ছোটকাগজের যে বোধ তা টিকে রাখার দায়ভার যারা নিয়েছেন, তারা টিকে থাকার সংগ্রামে পরাজিত না হোক—একজন পাঠকবোধে এটুকুই জাগ্রত হওয়া জরুরি।
এছাড়া ওপারবাংলার শান্তিময় মুখোপাধ্যায়, মৃণাল চক্রবর্তী, মৃণাল বসু চৌধুরীর প্রবন্ধ আমাকে টানে। যাদের প্রবন্ধের গতিতে ফাটল ধরে না। মাঝপথে ঝিমিয়ে যায় না বা ভেঙে পড়ে না।
একটা ছোটকাগজের একটা প্রবন্ধ বা লেখা নিয়েই বিশাল ফিরিস্তি দেওয়া যায়। এর আঙ্গিকের বর্ণনা দেওয়া যায় কিন্তু সেটি আজ তোলা থাক্। ছোটকাগজের প্রতি বোধ বাড়ুক। মানুষ তার ভেতরের জমে থাকা রাগ-ক্ষোভ-দুঃখ-যাতনা এবং ক্লান্তিবোধ ঢেলে দিক তার লেখার মধ্য দিয়ে। একজনের জীবনে যখন আরেকজনের দুঃখ খুঁজে পাওয়া যায়, তখনই সম্মিলন ঘটে, বন্ধন দৃঢ় হয়।
আমরা আমাদের বন্ধন দৃঢ় করাতেই মনোযোগ দেই। ভাঙাগড়ার এমন এক দুঃসময়ে দুচার কথা হোক ছোট ছোট সাহিত্য সাময়িকী বা ম্যাগাজিন নিয়ে।
দুঃখ না বাড়িয়ে যাতে এরা টিকে থাকতে পারে শব্দের মিছিলে। বাক্যের মোহনায়। দৃশ্যপট আঁকার মতো দৃশ্যশিল্পীদের সংখ্যা বাড়াতে হলে, এ ধরনের ম্যাগাজিনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
সমালোচনা বা পর্যালোচনা রয়েছে, সেটা লেখক তালিকা নিয়ে। তা আজ নয়। লেখক তালিকা দুচারজন একেবারেই বেমানান, যা একটা কাগজের জন্য ক্ষতিকরও হতে পারে। সেটির দায় অবশ্যই সম্পাদক নিবেন। আমি তাদের লেখাগুলো এড়িয়েছি।
উদ্যান ম্যাগাজিন টিকে থাকুক…। গোষ্ঠীবদ্ধ না হয়ে সামগ্রিকভাবে সৃষ্টিশীলতার মোহে আচ্ছন হোক। এটুকু চাওয়াটা খুব বেশি চাওয়া নয় বৈকি।
১৩ এপ্রিল ২৪