আমান আবদুহু
প্রতি বছর রমজানের শেষ দিনগুলোতে মন খারাপ হয়ে যায়। বিষাদের দিন। ছোটবেলায় যখন ফাইনাল পরীক্ষার পর অনেকদিনের জন্য নানাবাড়ি বেড়াতে যেতাম, ফিরে আসার সময় এমন মনে হতো। তখন মনে হতো যদি সারাজীবন নানার বাড়ি থাকতে পারতাম। এখন মনে হয় যদি আল্লাহর সাথে স্পেশাল যোগাযোগ থাকতো তাহলে বছরের প্রত্যেকটা দ্বিতীয় মাসকে রমজান মাস বানানোর জন্য লেগে থাকতাম। এক মাস রমজান মাস, আরেক মাস অন্য মাস, তারপর আবার রমজান মাস। অবশ্য ঈদের দিন এই মন খারাপ কেটে যায়। মানুষের মন আজব, কত সহজে বদলে যায়।
এই শেষ দিনগুলোতে আবার আছে শবে কদর। কেউ বলেন, যে কোন বেজোড় রাত। কেউ মনে করেন সাতাশের রাতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কেউ বলেন, দশদিনের যে কোন রাত হতে পারে। ইবনে উমর রা. দেখলাম বলেছেন, পুরা বছরের প্রত্যেকটা রাতের যে কোন রাত হতে পারে।
এই শবে কদর নিয়ে কবি আল মাহমুদ একটা কবিতা লিখেছিলেন, কদর রাত্রির প্রার্থনা। আজকে ঈদের দিনে রমজান মাস, শেষ নয়/দশ দিন, শবে কদর সব কিছু মিস করতে করতে সেই কবিতার কথা অনেক মনে পড়ছে।
কবিরা না কি অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ হয়। সময়ের সীমা পেরিয়ে আগের ও পরের সময়কে ধারণ করতে পারেন। আল মাহমুদ কদর রাত্রির প্রার্থনা কখন লিখেছিলেন? সম্ভবত এরশাদের আমলে। তাহলে তো ত্রিশ বছরেরও বেশি সময়। অথচ এই কবিতা আজ হাসিনার আমলে তখনকার চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক।
“না, আমি তো পড়তে পারছি না এই অন্ধকারের অন্তস্থলে
বিদ্যুতের ঝলকানি কোন্ অক্ষর আর ইঙ্গিতময় বাণী ক্রমাগত লিখে যাচ্ছে
শুধু আমার মাতৃভূমিকে পেঁচিয়ে আবর্তিত হচ্ছে
এক কুটিল অন্ধকার।”
আশির দশকের ঐ প্রার্থনাগুলো আজ বেশি সত্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ এখন গোলামদেশ। তখন অন্ধকার নেমে আসছিলো। এখন অন্ধকার হয়ে গেছে। সামনে অন্ধকার আরো গাঢ় হবে। ভারতদাদার এই করদরাজ্যে আজকে আমাদের প্রার্থনা তাহলে কি হতে পারে?
“হে আল্লাহ,
পবিত্রতম মহাযামিনীর অধিপতি,
তুমি তো একের পাপ অন্যের ঘাড়ে বর্তাও না।
পিতার পাপ পুত্রকে স্পর্শ না করার, হে প্রতিশ্রুতিদানকারী
দ্যাখো সহস্রাধিক মানুষের লাশ নিয়ে আমরা পবিত্র কোরআন নাজিলের
পুণ্য রজনীতে এখন সিজদারত”
মনে পড়ে যায় কত মানুষের কথা। যাদের জীবন শাপলা চত্বরের অন্ধকারে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিলো। তারও আগে অথবা পরে। যাদের চোখ তুলে নেয়া হয়েছে। যাদের পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। যাদেরকে গুম করে ফেলা হয়েছে। যাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ধর্ষণ করা হয়েছে। কত মানুষের জীবন, স্বপ্ন, পরিবার, সম্ভাবনা সব শেষ করে দিয়েছে পশুর দল।
“আমাদের রাজ-রাজড়াদের পাপে তুমি যেন আমাদের ধ্বংস করে দিয়ো না।
কেন এক প্রাচীন তৌহীদবাদী জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার রজ্জু
তুমি পরাক্রান্ত পৌত্তলিকদের হাতে তুলে দিতে চাও?
আমরা কি বংশানুক্রমে তোমার দাস নই?
আমরা তোমার নামের কোনো জেহাদেই অতীতে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিনি।
তোমার অনুগ্রহ থাকলে
আমাদের সিজদারত সন্ততিরাও রক্ত ও বারুদের সমাধানই
শেষ পর্যন্ত বেছে নেবে
এই পুণ্য রজনীতে আমাদের আবরিত স্ত্রী ও কন্যাদের সমস্ত গোনা প্রভু
মাফ করে দাও।”
কবি আশাবাদী। কিন্তু আমি গুনাহগার। গোলামদেরকে নিয়ে আমি আশাবাদী না। তারা রাজ-রাজড়াদেরকে চেটেই আনন্দিত। সুতরাং এমন কি কদরের মতো মহান রাতগুলোতেও এই আশা খুঁজে পাইনি। ক্ষমাশীল খোদার কাছে তাই মাফ চাই। বরং স্বার্থপর আমার প্রার্থনা হলো রাব্বানা আখরিজনা মিন হাযিহিল ক্বারিয়াহ। সম্ভব হলে আমাকে ভুলিয়ে দাও হে প্রভু।
“হে অনুকম্পার মহান অধিপতি,
এই মহানগরীর ভদ্রবেশী বেশ্যা, লম্পট, হিরোইনসেবী ও ছিনতাইকারীর
প্রাত্যহিক পাপের দেনায় আমরা এমনিতেই অতিষ্ঠ,
এর সাথে যোগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান পণ্ডিতেরা
শিক্ষার প্রতিটি প্রাঙ্গণ কিশোর হত্যার মহাপাপে এখন রক্তাক্ত, পঙ্কিল।
প্রকৃত পাপীদের বিনাশ ত্বরান্বিত করতে তুমি কি বাংলাদেশের
প্রতিটি বিদ্যাপীঠকেই বিরাণ করে ফেলবে?”
মনে হয়, কবি কি “ভবিষ্যতদ্রষ্টা” হয়ে উঠেছিলেন? আল মাহমুদের উপর কি ইলহাম এসেছিলো? আবরার ফাহাদের মৃত্যুর কথা কিভাবে তিনি জেনে গিয়েছিলেন?
“আমরা তো চুপ করেই আছি, তবু হে পরোয়ারদিগার
জানতে সাধ জাগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি ডাকাতদের গ্রাম?
বাল্যে যেমন কোনো গাঁয়ের পাশ দিয়ে নাও বেয়ে ফিরতে গেলে
মুরুব্বীরা বলতেন, ওপথে যেও না অমুকটা হলো ডাকাতের গ্রাম।
প্রভু —
ডাকাত, ছিনতাইকারী, পন্ডিত ও বেশ্যাদের হাত থেকে
তুমি কি ইলমকে রক্ষা করবে না? — রাব্বি যিদনী ইলমা
প্রভু, আমাদের জ্ঞানদান করো।”
আবৃত্তিটা আজ আবারও শুনে এসব প্রশ্নই আসলো মনে। আবৃত্তিটা আছে। কদর রাত্রির প্রার্থনাগুলো কবুল হোক বা না হোক, তারপর ঈদ এসে গেছে। এইরকম জিল্লতির ঈদ মানুষের জীবনে খুব একটা আসে না।
ফিলিস্তিনের হাজারো শিশু, নারী ও মানুষদের আত্মা আমাদের দিকে তাকিয়ে আজ ব্যাঙ্গের হাসি হাসে। আসলে ভুল চিন্তা, তারা তো খুশি। আমাদের ঈদ অথবা কোন কিছুর বিন্দুমাত্র পরোয়াই তারা আর করে না। বাংলাদেশের কোটি কোটি ভুখা মানুষও আমাদের ঈদ দেখছে।
নেতানিয়াহু-হাসিনা-মোদীদের দৌরাত্ম্যে জর্জরিত এমন ঈদ আর কোন প্রজন্মের জীবনে না আসুক, এটাই প্রার্থনা।
……
প্রবাসের ঈদ
……
অনেক বছর আমি বাংলাদেশের বাইরে। যেহেতু বিদেশে পড়তেই হবে এই টার্গেটে অন্ধের মতো লেগে ছিলাম, তার ফলে অল্প বয়সে বাংলাদেশ ছাড়তে পেরেছিলাম। বর্তমানে আমার বয়স যত, তার ঠিক অর্ধেক বছর ধরে এখন আমি বাংলাদেশ ছাড়া। এর মাঝে সম্ভবত একটা বা দুইটা ঈদ দেশে করেছি। সুতরাং নানা দেশে নানা মানুষের মাঝে বিভিন্ন রকম ঈদ করার সুযোগ পেয়েছি। অনেক সময় মন খারাপ হয়েছে, অনেক সময় আনন্দে দিন কেটেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসে অতীতের ভালো খারাপ সব কিছুর জন্যই খোদাতায়ালার হাজারো শুকরিয়া।
দেশের ঈদের মতো ঈদ আসলে নাই। নিজ পরিচিত পরিবেশে, আজন্ম বেড়ে ওঠা সংস্কৃতি ও সমাজে, সর্বোপরি আত্মীয় স্বজনদের সাথে ঈদই হলো এই পার্থিব জীবনের সবচেয়ে বেশি আনন্দের ঈদ। তখন বুঝা যায় না। পরে কখনো এমন ঈদ গেছে, ভার্সিটির হোস্টেলে একা একা কেঁদে বালিশ ভিজায়া দিওয়াস করে ফেলছি থুক্কু ভিজায় ফেলছি। এখন মনে পড়লে হাসি পায়। স্মৃতি ভালো লাগে। বাবা মা ভাই বোনদের জন্য কত আকূলতা ছিলো তখন। আবার কখনো এমন ঈদ গেছে, প্রবাসী কমিউনিটির সাথে ঈদের নানা দৌড়াদৌড়িতে কখন ঈদ চলে গেছে বুঝতে পারিনাই। কখনো ঈদের দিন সারাদিন কাজ করেছি। ম্যানুয়াল লেবারের কাজ, এখনকার মতো না যে ইচ্ছা করলে কাজ বাদ দিতে পারতাম। আবার কখনো পুরাপুরি ভিনদেশী পরিবারে ভিন্ন সংস্কৃতিতে ঈদ করারও ভাগ্য হয়েছে। কখনো ঈদ কেটেছে প্রিয়জনদের সাথে। এক জন্মের স্মৃতির সঞ্চয়। আবার কখনো সুন্দর সুশীল দায়িত্ববান সৌজন্যবোধসম্পন্ন সম্ভ্রান্ত বাংলাদেশী মুসলিম পরিবারের সদস্যের মতো ঈদ গেছে, যথাযথ জায়নামাজ হাতে নিয়ে টুপি পাঞ্জাবী আতর সহকারে নামাজ পড়তে যাওয়া থেকে শুরু করে দাওয়াত পাল্টা দাওয়াতে গভীর রাত হয়ে গেছে। আবার যেমন এইবার ঈদের গত দুইটা দিনই মোবাইল ছিলো ওয়ার্ক ফোকাসে দেয়া, অনেক কল আর মেসেজ দেখার সুযোগ হয়নাই। তারা হয়তো আগামী ঈদে আর বৃথা শ্রম দেবে না। অন্যদিকে কাজকর্ম হয়েছে যথেষ্ট, মোটামুটির চেয়ে বেশি। বসের সাথে রিভিউ শেষে আজ বিকেলে তার একান ওকান দুইকান চওড়া হাসি দেখে বাসায় ফিরেছি। আজকে উনি একটু বেশিই সন্তুষ্ট ছিলেন। নন-মুসলিম হয়েও ঈদ মোবারক বলে সম্ভাষণ জানাইছে হাসতে হাসতে। বেতন বৃদ্ধি চাই কি না কৌতুকের ছলে এই প্রশ্ন করছে। আমিও হালকা কথার ছলে হাসিঠাট্টা করে বলছি আমার ওয়ার্কিং ডে আরো কমানোর চিন্তা করতেছি। নিজের ব্যবসায় সময় বেশি দিতে চাই। হাসাহাসির ছলে সমস্যাজনক কথাবাত্রা বলা একটা সুন্দর টেকনিক, ছোটবেলায় এটা জানতাম না।
এখন কালকে শুধু বিশ্রাম আর বিশ্রাম, সাথে জুমার নামাজ। বাসার লোকজনকে সম্ভবত একটু ঘুরাফিরা করতে নিয়ে যাবো। আমার একটা লাক্সারি কার হইছে, এইটাতে চড়লে ওরা আনন্দে লাফায়। এই সম্ভাব্য পরিকল্পনার কথা বাসায় জানেনা, এখানে ফট করে করে বলে দিলাম আর কি। আপনি যদি আমার মতো স্বার্থপর হন তাহলে অবশ্য আপনার পরিবারের সদস্যদেরকে কিছুটা সাফার করতে হবে। এটা পুরোপুরি পুরণ করা সম্ভব না, তবে টাকা দিয়ে কিছুটা কাভার করা যায়। তারা মনের খুশিগুলো পুরণ করুক। নট এন আইডিয়াল সলিউশন, বরং সম্ভবত ওয়ার্স টাইপ অফ সলিউশন। কিন্তু সব কিছুরই কিছু ট্রেড অফ থাকে, বাছাই করার স্বাধীনতা যেহেতু আছে, কনসিকুয়েন্সও মেনে নিতে হবে। আল্লাহ করিম।
মানুষের জীবনে সমস্ত পরিবর্তনের পরও সম্ভবত শৈশবের ছাপ সবচেয়ে বেশি থেকে যায়। যখন আমি তেমন কিছু বুঝতে শিখিনাই, সেই সব বছরগুলোতে বাবার সাথে ঈদের দিন কিছু বিশেষ পরিবারে যেতাম। উনারা অর্থনৈতিকভাবে ভালো অবস্থায় ছিলেন না, বেশিরভাগেরই আশা ভরসার মূল জায়গাটা বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির কবলে পড়ে শেষ হয়ে গেছে। বড় হওয়ার পর জীবনের সবগুলো ঈদে তাই যেসব মানুষের জীবনে নানা কারণে ঈদ অন্য সবার মতো স্বাভাবিক আনন্দ আনে না, না চাইলেও তাদের দিকে বারবার চোখ চলে যায়। এইটা মনে হয় ভালো জিনিস না, ঈদের আনন্দ অনেক সময় কমিয়ে দেয়। যাইহোক, দুইদিনের দুনিয়া। হান্ড্রেড পার্সেন্ট ফুর্তি না হলেও সমস্যা নাই।
আমার দেখায় প্রবাসীদের মাঝে সবচেয়ে কষ্টের ঈদ করে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীরা। তাদের জন্য খারাপ লাগে। আর স্বার্থপরের ঈদ করে পশ্চিমা দেশের স্থায়ীরা। তারা কি কিনছে এইসব নিয়ে অনেক সময়েই উৎকট ও বিভৎস প্রতিযোগিতার ঈদ পালন করে। জাফর ষাড়ের মতো হড়হড় করে বমি আসে।
যাইহোক, এখন আমার পরিকল্পনা হলো আর আট থেকে দশ বছরের মধ্যে রিটায়ারমেন্টে যাওয়া, ইনশাআল্লাহ। আশা করা যায় বাচ্চাকাচ্চাগুলো এবং আহলিয়ার (এ সুযোগে এক চামুচ গায়রত মেরে দিলুম) তখন আমাকে আর প্রয়োজন হবে না। তখন রাসুল সা. এর মতো কোন হেরা গুহায় যেতে পারলে সবচেয়ে ভালো হবে। গুহা পাওয়া সম্ভবত কঠিন হবে, এই যুগে জঙ্গলে কেবিন পাওয়া যেতে পারে। আমি ইন্ট্রোভার্ট কিন্তু একইসাথে খুব এক্সপ্রেসিভ বা এসার্টিভ টাইপের মানুষ। সুতরাং এই পরিবর্তনটা আমার জন্য কঠিন হবে। এইটা হবে আমার দুনিয়াবী জীবনের নিজেকে নিজের শেষ চ্যালেঞ্জ। তখন হবে আসল ঈদের জন্য অপেক্ষা। মানুষের জীবনে সত্যিকার ঈদ হলো যেদিন আল্লাহর সাথে দেখা হবে। খোদার দীদার। উনার সাথে আমার অনেক জরুরী আলাপ আছে। অনেক প্রশ্ন আছে। কিন্তু যদি দেখা হয়, যদি সেই কপাল থাকে, তাহলে যা শুনেছি তাতে মনে হয় আগের সবকিছু ভুলে যাবো। হাইওয়ানে নাতেক্ব হিসেবে মানবজন্মের এই এক প্রহসন। তার কত চাওয়া, অথচ আখেরে সবই অর্থহীন নিকলায়।
আবারও ঈদ মোবারক। ভালো খারাপ যাই হোক, সব মিলে আনন্দে থাকুন এই দোয়া। আসেন আমাদের দোয়ায় ফিলিস্তিনীদের স্মরণে রাখি। আজকে শহীদ কামারুজ্জামানের বিদায়ের দিন। এই ঈদ ইসমাঈল হানিয়ার তিন সন্তানের একসাথে শহীদ হওয়ার ঈদ। আরো কত মানুষের কত ত্যাগ আছে, আমরা জানিনা। তাদের সবার জন্য দোয়া।
ভালো লেখা