spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধআমার সম্পাদক

লিখেছেন : তৌফিক জহুর

আমার সম্পাদক


তৌফিক জহুর

আমার সম্পাদক: প্রথম পর্ব

আমার পথ গেছে বিশ্বাস আর ধর্মের ভিতর দিয়ে, অন্যটি প্রজ্ঞা আর ইন্দ্রিয় গুলোর মধ্যে দিয়ে। একটা পথের মধ্যে বিশ্বাস আর প্রত্যাদেশের পথই নিঃসন্দেহে সবচে সঠিক। কারণ স্রেফ প্রজ্ঞার উপর ভরসা করলে খুব সহজেই পথ ভুল করার সম্ভাবনা থাকে। আমি প্রথম পথেই হেঁটে চলেছি উপর দিনরাত-রাতদিন। যে পথটি আমাকে চিনিয়েছিলেন আমার সম্পাদক সাজ্জাদ বিপ্লব। কি করে আমি সম্পাদক কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে শুরু করলাম এই জগতে অন্যভাবে পদচারণা তা আজো আমাকে বিস্মিত করে। মাঝরাতে একাকী হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমি হারিয়ে যাই সোনালী অতীতে।
সাহিত্যের লাভা উদ্গীরণ হচ্ছিল মধ্য নব্বইয়ে বগুড়া শহরের নাজ কমপ্লেক্সের ‘পার্বণ’ থেকে। বগুড়ায় সাহিত্য চর্চার যে নব যুগের সূচনা তাও ‘পার্বণ’ থেকে। ‘পার্বণ’ এর প্রতিষ্ঠাতা কবি ও সম্পাদক সাজ্জাদ বিপ্লব। কিন্তু তিনি যে একজন মহৎ সংগঠক তা জানলাম যখন তার নিকটে গেলাম। সেদিন স্বপ্নে বিভোর, চেতনায় কবি মানস নিয়ে যারা সার্বক্ষণিক সাজ্জাদ বিপ্লবকে ঘিরে বসে থাকত, দীর্ঘ সময় পরে তারা অনেকেই আজ ভেজিটেবল স্যালাডের পরিত্যক্ত অংশ হিসেবে রান্না ঘরের ঝুড়িতে শেষ ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন। আমার সম্পাদক সাজ্জাদ বিপ্লবকে সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাস ( Saint Thomas Aquinas) (১২২৫-১২৭৪) মনে হয়। যিনি রোম আর নেপলস এর মাঝ খানে ছোট্ট শহর অ্যাকুইনোর লোক। তিনি যে সময় প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন সে সময় দর্শন আর ঈশ্বরতত্ত্বের মধ্যে সে রকম বড় ফারাক ছিল না। সংক্ষেপে বলা যায়, অ্যারিস্টটল এর উপর অ্যাকুইনাস ঠিক যেভাবে খ্রিষ্টত্ব আরোপ করেছিলেন, সেন্ট অগাস্টিন মধ্যযুগের প্রথম দিকে সেভাবেই অ্যাপ্লাই করেছিলেন প্লেটোর উপর। মজার বিষয় হল, মহান দার্শনিকদের এই উপমায় সাজ্জাদ বিপ্লবের মধ্যে সাজুয্য কোথায়? আছে। সেন্ট টমাস অ্যারিস্টটলের উপর খ্রীস্ট্রিয় মতবাদ নিয়ে অ্যাপ্লাই করেছিলেন, আর সাজ্জাদ বিপ্লব করেছিলেন সাহিত্যের যেসব শাখায় যে জন পারদর্শী, তাকে সে পথেই ধাবিত করে। বই দিয়ে, জাতীয় পত্র-পত্রিকার সাময়িকী উপহার দিয়ে, তিনি অনবরত সাহিত্যের ঘোরের মধ্যেই রাখতেন সাহিত্যকর্মী যশঃপ্রার্থী সব তরুণদের। আমার ভেতরে আল মাহমুদের যে ভিত্তিমূল আজ গ্রোথিত, তার পেছনে রয়েছেন সাজ্জাদ বিপ্লব। আমার মনে পড়ে, আল মাহমুদের ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কাব্যগ্রন্থের মধ্যে দিয়ে আমি প্রথমবারের মত কবি আল মাহমুদ নামক মহাসমুদ্রে সাঁতার আরম্ভ করি। আল মাহমুদ নিয়ে পড়তে পড়তে, লিখতে-লিখতে আমি ‘আল মাহমুদ ও অন্যান্য’ নামক একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ বের করেছি। আমি মনে করি এই গ্রন্থের জন্মদাতা আমি হলেও এর মুখ্য ভূমিকায় সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাসের মত সাজ্জাদ বিপ্লবের ভূমিকা আছে। কারণ ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কাব্যগ্রন্থটি তিনিই আমাকে পাঠ করার জন্য হাতে তুলে দেন।
সূচ বানাবার উপায় থেকে কামান তৈরির পদ্ধতি পর্যন্ত অর্থ্যাৎ বলতে চাচ্ছি সাহিত্যের পাঠশালায় অ.আ.ক.খ জ্ঞান শিখে যদি কেউ গৃহত্যাগী হয় এবং গৃহের দরোজায় বেতমিজ সারমেয়র মত হিসু করে এতে ঐ গৃহ শিক্ষকের কোন ক্ষতি হয় না।
মাঝখানে (২০০৩-২০০৪) বগুড়া শহরের সাহিত্যের আকাশে এতোটাই দুর্যোগের ঘনঘটা লক্ষ্য করেছি যা গ্রাস করেছিল ডার্টি রাজনৈতিক চাদর। সে সময়ও হিমালয়ের মত অবিচল ছিলেন সাজ্জাদ বিপ্লব। কারণ হিসেবে মনে হয়েছে, শত-শত বছরের পথ পরিক্রমার পর মানবজাতি বর্তমান স্তরে এসে পৌঁছেছে। লাখো মনের চৈন্তিক সংগ্রামের ফলশ্রুতি হচ্ছে আজকের সমাজ দর্শন। সমুদ্র সৈকতে খেলতে গিয়ে ছেলেমেয়েরা যেভাবে বালি ও নুড়ি দিয়ে ঘর তৈরি করে সেভাবে বংশ পরম্পরায় মানব জাতি হাতের কাছে পাওয়া উপাদান নিয়ে গড়ে তোলে আদর্শ। এই গড়ার কাজে বংশ পরম্পরায় ওটার সংযোজন করে। আবার কোনটা পরিত্যাগও করে। ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার এ কাজে এটা– ব্যবহার করে স্বার্থকভাবে। সে যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে তা পুরোপুরি নতুনও আবার পুরোপুরি পুরাতনও নয়। প্রত্যেক সচেতন বোদ্ধাই তার পূর্ব-পুরুষদের সংস্কৃতির ওপর গড়ে তোলে তার নিজস্ব আদর্শিক প্রাসাদ। সাজ্জাদ বিপ্লব তার আদর্শিক প্রাসাদে ২০০৩-২০০৪ সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়ের মৌসুমে ব্যক্তিগত আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, অনুভূতি ও বিশ্বাসে ছিলেন ইতিহাসের প্রবাহমান স্রোতধারা। বরঞ্চ আমরা যারা অকৃতজ্ঞ নই অথচ জটিল বস্তুবাদী সভ্যতায় আলেকজান্ড্রিয়ান উপমা ব্যবহার করে বেঁচে আছি, বেঁচে থাকতে হয়– তারা অনবরত সাজ্জাদ বিপ্লবকে গ্রীক সাহিত্যের এপোলো, ডায়োনিসাস, পসিডন, জিউস, ইরেখটিউস এর মত দেবতাদের বিরুদ্ধে ইলিউসিস, ইউবুলিউসিস থ্রোপোনিউসের মত কাল্পনিক বীরদের ব্যবহার করার জন্য পুরোহিতের পোশাক পড়তে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু উনি আমাদের কথাকে সাহিত্যে রূপ দিলেন। আমি লক্ষ্য করলাম, অন্ধকার জগতে একিলিস এর আত্মা ওডিসিউসকে যেন বলছে, “মৃত ব্যক্তিদের রাজা হবার পরিবর্তে আমি বরং একজন স্বল্প আয়ের ভূমিহীন মজুর হিসেবে বাস করতে প্রস্তুত।” হোমারের কবিতার মত সাজ্জাদ বিপ্লব যেন বলতে চাইলেন, “মানুষ প্রতারিত করছে। মরণশীল মানুষের পরিণতি এটাই, গোশত আর হাড়গোড় একত্রিত হয় না। সাদা হাড়গুলো থেকে জীবন যখন চলে যায়, তখন আত্মা স্বপ্নের মত নিকটেই উড়ে বেড়ায়।”
সাজ্জাদ বিপ্লবের সম্পাদনার বিষয় নিয়ে কথা বলার পূর্বে তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্য, বৈশিষ্ট্য আর একটু বলা উচিত জ্ঞান করি। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, তার বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন আত্মিক সত্তা। যা প্রতিভা, সৌন্দর্যানুভূতি, দার্শনিক প্রজ্ঞা (চিন্তা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে), পৃথিবী জ্ঞান (সাম্প্রতিক চিন্তা), শুধু নয় বরং ব্যক্তি সত্তা পেরিয়ে ইন্দ্রিয়ানুভূতির উর্ধে উঠে সর্বজনীন, বস্তুনিষ্ঠ এবং পরলোকের বিষয়-আশয়ের সঙ্গে তার ভাব বিনিময়ের একটা যোগ্যতা রয়েছে। আর তার ধর্ম বিশ্বাস কোন আন্দাজ অনুমান নয়, যা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার প্রতি হৃদয়ের গভীর এক অনুভূতি। একে তার চারপাশের নাবালক অর্বাচীনরা যে ভাষায়ই ব্যাখ্যা দিক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তা হচ্ছে এমন এক মনোভাব যা বুদ্ধিকে দান করেছে নৈতিক উন্নতি, সাধাসিধে বিষয়ের চারদিকে গড়ে তুলেছে এক আধ্যাত্মিক মহত্ত। সে তখন অসীম ও সর্বব্যাপ্ত শক্তির কাছে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে। আত্মার গভীরে ডুব না দিলে এই সত্য উদঘাটন সম্ভব নয়। বস্তু জগতে জীবনের যে সুর-বেসুরো সঙ্গীতে বেজে চলেছে তাতে আত্মার ওপরে অবসাদের প্রভাব কী ভীষণ তা সবাই টের না পেলেও কেউ কেউ পায়। তখন বুদ্ধির হত দরিদ্রভাব আর বিবেকের দংশন তাদের স্বাধীন কর্মে আনে ক্যাথলিসিজম। আমার সম্পাদক ক্যাথলিসিজমে আক্রান্ত নন বরং সমাজের ক্রমঃবিকাশ ও মানুষের বুদ্ধি বৃত্তিক জীবনের দিকে অগ্রগামী করার প্রগাঢ় মহৎ প্রচেষ্টা তার মাঝে খুঁজে পাই, যা আমাকে সভ্যতার পাদ প্রদীপের নীচে দাঁড়িয়ে কবি এস্কিলাসের কথা স্মরণ করিয়ে দ্যায়। অলিমপাসের দেবতারা যেভাবে জিউসের কুমারী কন্যাকে সম্মান জানাতো খৃষ্ট পূর্ব ৭০০ সালে যা পাওয়া যায় হিমিউস-এ, আমাকে ২০০৭ এ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য’- পত্রিকার সম্পাদক সাজ্জাদ বিপ্লবকে ও রকম সম্মান জানাতে কোন কার্পণ্যে ভুগি না। খৃষ্টপূর্ব ৮০০ সালে বিখ্যাত গ্রীক কবি সোলোন এর কবিতাতে দেখা যায় ধর্মীয় রূপ। সোলোনের এই ধারণাই প্লেটো ও এরিস্টোটল এর রাজনৈতিক দর্শনে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। প্লেটো বিশ্বাস করতেন, জন্মগত বিশেষ মানসিক গুণ এবং স্বাভাবিক যোগ্যতার অধিকারী হওয়ার কারণে আমাদের প্রত্যেকেরই সুনির্দিষ্ট কাজ বা বৃত্ত রয়েছে। একটা যৌক্তিক সমাজ জীবনে প্রত্যেক ব্যক্তিই একটা বিশেষ এবং কার্যকর অবদান রাখতে পারে। নৈতিকতা ও সুবিচার সে বৃত্তকে উৎকৃষ্ট ও একনিষ্ঠভাবে সম্পন্ন করতে সহায্য করে। এভাবে জীবন যাপন করার অপর নাম আত্মিক স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া। এর বিপরীতে জীবন-যাপনের মানে হল আত্মিকভাবে ব্যাধিগ্রস্ত। প্লেটোর ‘Republic’ গ্রন্থের পাঠক সুবিচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে অনুপ্রাণিত হয়। সে দেখতে পায় সুবিচার, ধর্মপ্রাণতা, সামঞ্জস্য এবং আত্মার বিভিন্ন অংশের ক্রিয়াশীলতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সভ্যতার ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয় যুগের মধ্য অন্যতম গ্রীক টাইম। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ইমারত গড়েছে গ্রীক সভ্যতা এতে কোন সংশয় নেই। তেমনি মধ্য নব্বই থেকে বগুড়া শহরের সাহিত্য চর্চার যে আধুনিক মেজাজ তার পথ নির্দেশক সাজ্জাদ বিপ্লব। আজকের বগুড়া শহরে নন্দন চর্চার যে পজিশন এবং নন্দন কাননে যাদের বিচরণ সেই তরুণদের উৎপত্তিস্থল ‘পার্বণ’ থেক। যার মূলে সংগঠক সাজ্জাদ বিপ্লব।
নব্বই দশকের বাংলা সাহিত্যে ‘উত্তর আধুনিকতা’ তুখোড়ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু পাশ্চাত্য জগতের তুলনায় আমাদের দেশে ‘উত্তর আধুনিক’ বিষয় নিয়ে আলোচনা, সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হয়েছে কম। উত্তর আধুনিক নিয়ে পাশ্চাত্যে আলোচনা, সমালোচনা, পক্ষে-বিপক্ষে অসংখ্য লেখালেখি হয়েছে। আমরা তার অনেক খবর পাই না, কিছু খবর পাই। এসব আলোচনা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আমাদের ভাবজগতেও আলো ফেলে। অনেক সময় আমরা বিভ্রান্ত হই। বগুড়া শহরে ‘উত্তর আধুনিক’ তত্ত্বের কনসেপ্ট সাজ্জাদ বিপ্লব ঢাকা থেকে নিয়ে যান। ঢাকায় যেখানে শাহবাগের উত্তর আধুনিক টেক্সটের ব্যাখ্যা এক রকম, টিকাটুলীতে এক রকম, ধানমন্ডিতে এক রকম, ফকিরাপুলে এক রকম অর্থ্যাৎ যে ব্যক্তি যেভাবে বুঝেছেন তিনি সেভাবেই প্রচার চালিয়েছেন। কিন্তু সাজ্জাদ বিপ্লব ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য’ পত্রিকায় ‘উত্তর আধুনিক ভাবনা’ শীর্ষক একটি সংখ্যা প্রকাশ করেন। সেখানে বেশ কিছু লেখা Reprint করে উত্তর আধুনিক তত্ত্বের একটি আলো-আঁধারী Text পাঠককে উপহার দেন। ১৯৩৪ সালে ফেদেরিকো ওনিস মাদ্রিদে তাঁর কবিতা সংকলনে পোস্টমডার্নিজম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। এর পুনর্ব্যবহার মেলে ডাডলি সম্পাদিত ‘সমকালীন লাতিন আমেরিকার কবিতা’ সংগ্রহ (১৯৪২)। এরপর ১৯৫৯, ১৯৬০ সালে আরভিঙ হো ও হ্যারি লেভিন পরবর্তীতে ইহাব হাসান ও লেসলি ফিল্ডারের পথ ধরে একাডেমিক জ্ঞান চর্চায় যে তোলপাড় তা থেকে সাজ্জাদ বিপ্লব নব্বই দশকে এই লেবেল নিজের লিটারেরি গার্ডেনের দোরগোড়ায় সেঁটে দিলেন। জ্ঞানকাষের এই এলাকাতে তার বিচরণ নিয়ে কোন কথা না বললেও ইতোপূর্বে তার কাজ দেখে তাকে মনে হচ্ছিল ঐতিহ্যবাদের প্রতিভূ হিসেবে। কিন্তু ঐতিহ্যবাদ, মডার্নিজম, পোস্টমডার্নিজমের ত্রিমুখী পদচারণায় তার বিনিময় প্রক্রিয়ায় সংস্কৃতির এই বাঁধন কোন দিকে যাবে তা এখনই বলা মুশকিল। তবে এখন উচিত তার সৃষ্টিশীল সকল উদ্যম পুনর্বার পাঠ করা তা পুনর্বিচার করে সাহিত্য ও নন্দনতত্ত্বের নতুন পথ গুলো খুঁজে বের করা।

দুই সংস্কৃতি : সম্পাদনা ও সৃজনশীলতা

সাজ্জাদ বিপ্লব সম্পাদিত ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য’র সম্পাদনা বিষয়ে কথা বলবার আগে আমরা একটু ইতিহাসের দিকে তাকাই। ফরাশী বিপ্লব ও আধুনিক এনলাইটমেন্টের সূত্রে বামপন্থীরা যুক্তির সমর্থনে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন। অন্যদিকে ফ্রয়েডের মত ডানপন্থীরা যুক্তির ভালোত্বে স্থির আস্থা রাখতে পারেননি। দার্শনিক ফ্রয়েড যুক্তির অন্ধকার, ভয়ঙ্কর ও ভূতুড়ে উৎসের কথা বলেছেন, হাইডেগার, নীটশে বলেছেন যুক্তির সমস্যার কথা। নীটশে হাইডেগার বলতে চান; যুক্তি কখনো উদ্ধার করে, কখনো ধ্বংস করে। ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য’ প্রকাশনাকে প্রাথমিক পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় এটি একটি ঐতিহ্যবাদী ছোট কাগজ। পত্রিকার স্কেচানুযায়ী যেখানে সম্পাদকীয় নেই, (দু একটি সংখ্যা ব্যতীত)। অর্থ্যাৎ বামপন্থীদের যুক্তির আলোকে উদ্ভাসিত নয় বরং ফ্রয়েডের মত সকল বিষয়ে গতানুগতিকতার উপর স্থির আস্থা তার সম্পাদনায় খুঁজে পাওয়া যায় না।
‘স্বল্পদৈর্ঘ্য’র এক দশকের বেশি সময় ধরে ষোলটি প্রকাশনা অনুসন্ধিৎসু পাঠক সমাজ পড়েছে। চেতনার উৎকর্ষ ও মেকানিজম যেভাবে সাজ্জাদ বিপ্লব তার পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন তা ঐতিহ্যবাদী ও উত্তর আধুনিকতার ভাবনামালার পরম বৌদ্ধিক সেতুবন্ধ বলে আখ্যায়িত করা যায়। তার আত্মচেতনার আইডিয়া ও সংযমী বোধ আমাদের পাঠের জিহ্বাকে আল্গা করে দেয়। বগুড়া সংখ্যা, নব্বই দশক সংখ্যা, উত্তর আধুনিক ভাবনা সংখ্যা, আল মাহমুদ সংখ্যা- ১ ও ২– শিল্পের সব শিরা-উপশিরা ছাপিয়ে আমাদের অভিজাত মনোবিশ্লেষণ (সাইকোএনালাইসিস) কে করেছে সমৃদ্ধ। কাল মার্কসের মূল বক্তব্য ছিল, মানুষ উদ্ভূত হয়েছে, তারপর সে নতুন ক্ষমতা অর্জন করেছে, নিয়ন্ত্রণের একটা নতুন বোধ লাভ করেছে, অতঃপর সৃষ্টি হয়েছে নতুন চাহিদা নতুন প্রয়োজন। সম্পাদনায় যেমন মেক-আপ, গদ্য চয়ন, কবিতা বাছাই প্রতিটি ক্ষেত্রে বলা যায় নতুন এক ক্ষমতা সে অর্জন করেছে। যা বগুড়া শহর থেকে প্রকাশিত অনেক লিটল ম্যাগ সম্পাদকবৃন্দকে করেছে বিস্মিত। অ-ইউরোপীয়, অ-পশ্চিমী সংস্কৃতি চর্চা সম্পর্কে এবং নানান দেশের প্রতিষ্ঠিত ধারণা, বিশ্বাস ও দৃপ্ত প্রত্যয়ে প্রকাশিত অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিন পড়াশুনা করে তিনি প্রডিউস করছেন ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য। এডওয়ার্ড ডব্লুউ সাঈদ ‘অরিয়েন্টালিজম’ বা ‘প্রাচ্যতন্ত্র’ লিখে পশ্চিমের বহুদিনের প্রকল্প যেমন এলোমেলো করে দিয়েছেন এবং এ বই কেন্দ্রচ্যুত প্রতিরোধাত্মক ভাষ্যের উল্কা প্রতিম বিস্ফোরণ, একথা পশ্চিমা তাত্ত্বিক, দরবেশগণ স্বীকার করে নিয়েছেন। বগুড়া শহরে ঢাউস-ঢাউস, চিকন, এক ফর্মা, তিন ফর্মা, আট ফর্মা লিটল ম্যাগের শিল্প বিপ্লবের কালে আলাদা মাজেজায়, আলাদা ডিসকোর্সে, ইন্দ্রিয়ের বোধ ও অনুভবের দৃঢ়তা দিয়ে Text এর ভেতরকার রাজনীতি, সমাজ, প্রতিবেশ ও বাস্তবতাকে পুঁজি করে নির্মাণ করা হয়েছে ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য’র স্থাপত্য কলা। অর্থাৎ সোজা কথায় বলা যায়, লিটল ম্যাগ জগতে বহুদিনের পশ্চিমা লালিত সমাজ সংস্কৃতির উপনিবেশিকতা ছিঁড়ে এক নতুন কাউন্টার ডিসকোর্স। সে কারণেই ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য’ নিয়ে আলোচনার চাইতে সমালোচনা বেশি। কারণ সমালোচনাকারীরা ঔপনিবেশিক প্রভুর আজ্ঞায় কথা বলেন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে অতীতের কোন গৌরবময় রেনেসাঁস কিংবা এনলাইটমেন্ট কিংবা শিল্প বিপ্লব চোখে পড়ে না, শুধু পড়ে কলোনি আর তার মহান প্রভুর স্মৃতি। ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য’র বিশেষ সংখ্যাগুলো বিশেষত আল মাহমুদ ১ ও ২ সংখ্যা বাংলা সাহিত্যে নতুন সংযোজন যা নান্দনিক প্রাক্টিসের দিক থেকে বহু রকম বৈচিত্র্যে অনুপ্রবিষ্ট। তবে ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য’র সাধারণ সংখ্যাগুলোতে রুচির ছাপ আছে কিন্তু কতোটা সময়োত্তীর্ণ তা নিয়ে কথা বলার যথেষ্ট ফাঁক-ফোকর আছে। জননন্দিত শিল্পকর্মের জনয়িতা যেমন আছে তেমনি চিত্তে সংশয় জাগে এমন শিল্প কর্ম নিয়ে বহুমুখী জিজ্ঞাসা শিল্প বোদ্ধারা করতেই পারেন। সেসব প্রশ্নের যথার্থ উত্তর আমরা সম্পাদককে করলেই পাবো বলে আশা করি। যেমন জোশেফ কনরাড ঔপন্যাসিক হিসেবে অনেক বড়; কিন্তু কনরাডের সীমাবদ্ধতা আছে। সেই সীমাবদ্ধতা কনরাডের মনোভঙ্গিতে, যে মনোভঙ্গি সাম্রাজ্যবাদের পক্ষপুটে লালিত। কনরাড ভেবেছেন পৃথিবী বলতে শুধু ‘আটলান্টিক ওয়েস্ট’। নন ওয়েস্টার্ন পৃথিবী সম্পর্কে পশ্চিমাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি তার সঙ্গে ঔপন্যাসিক কনরাডের মিল একশ ভাগ। ফলে প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক কনরাডের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকারও নিজস্ব জীবন আছে, স্বতন্ত্র সংস্কৃতি আছে এবং সেই সংস্কৃতির মৌলিকতা আছে। আমি বলছি না সাজ্জাদ বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে ওকালতি করছেন। আমি বলছি, তার দৃষ্টিভঙ্গিরও সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু তিনি প্রতিভাবান ও যথেষ্ট দক্ষ, একথা বলতে কোন সংকোচ নেই।
টিএস এলিয়ট একদা বলেছিলেন, “কিছু কবির সমগ্র কবিতা পাঠযোগ্য, আর কিছু কবির সমগ্র রচনাবলী পড়ার দরকার হয় না। প্রসঙ্গ ও বক্তব্যে, বিন্যাসে ও প্রকরণে যে কবি বারবার নিজেকে অতিক্রম করে এসে নতুন দিগন্তের দরোজা খুলে দিয়েছেন, নিরন্তর বিবর্তনে যিনি পূর্ণাঙ্গ তারই সমগ্র রচনাবলী দাবী করে পাঠকের অভিনিবেশ, সূচ্যগ্র পরিমাণ দাবি কেউ ছাড়ে না। পক্ষান্তরে, যে কবি একই ভাবনা-বেদনায় আসীন সারা জীবন, একই প্রকাশ ভঙ্গির একনিষ্ঠ সেবক, তার রচনার অংশই কাব্যমোদির অপরূপ উত্তেজনার স্বাদ মেটাতে পারে। “সাজ্জাদ বিপ্লবের কবিতায় ছন্দ আছে, আছে বিষয় বৈচিত্র। তবুও একটা কথা বলতেই হয়, কবিতা আসলে ভালো লাগার বিষয়। নজরুল, জীবনানন্দ, জসীমউদ্দীন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী কিংবা রফিক আজাদ সবার কবিতাই প্রত্যেককে টানে না। আলাদা রুচির, আলাদা মেজাজের আলাদা রসের মানুষ বসবাস করে। পাঠকের এই ভালো লাগাটা আসলে কবির সাথে সাক্ষাত না হলেও কবিতার মধ্য দিয়ে ভালোবাসাবাসি হয়ে যায়। আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি সাজ্জাদ বিপ্লবের আধুনিক বাংলা কবিতার চাইতে আমি তার ‘ছড়া’ সাহিত্যের একজন অনুরক্ত পাঠক। তার ছড়ার সহজাত প্রবৃত্তি ও উপস্থাপন ভঙিমা আমাদের বিস্মিত করে। স্পেনের ভূস্বর্গ থেকে নিউইয়র্ক শহরে এসে লোরকা যেমন একদিন জটিল জ্যামিতিকে স্বীকার করে নিতে পারেননি, ‘নিউইয়র্কে মৃত্যু’ গ্রন্থে যে বিরূপতার তেতো স্বাদ ও স্বাক্ষর পড়ছে, তেম্নি লক্ষ্য করে দেখা যায় সাজ্জাদ বিপ্লবের ‘চলো সবে লড়ি’, ‘টুকটুকাটুক’, ‘সাম্প্রতিক ছড়া’ গ্রন্থের পাশে ‘কবিতাং শরণং গচ্ছামি’ কাব্যগ্রন্থ পাঠকের বিশ্বগ্রাস ক্ষুধাকে করে দিল নিম ফলের স্বাদ। যা উপকারী কিন্তু পাঠকের গিলতে চোখ, মুখ কুচকে যাচ্ছে। তবে ‘পৃথিবী তোমার নয়’ কাব্যগ্রন্থে যে আশার প্রদীপ শিখা জ্বলতে দেখেছি তার আলো পরবর্তীতে খুঁজে পাই না। হতে পারে তা সংসারে অসুস্থ গৃহস্বামীর দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু সাজ্জাদের কবিতা শিল্পসমগ্র নিয়ে কথা বলার কিংবা মন্তব্য করার উপযুক্ত সময় এখন নয়। কারণ, ঐতিহ্যবাদী, উত্তরআধুনিক ও প্রাচ্যতন্ত্রের মিশেল স্রোত ভবিষ্যতে কি দাঁড়ায় তা অন্তত দেখে আমাদের মন্তব্য করা উচিত জ্ঞান করি।

প্রত্যাবর্তন: পর্ব দুই

ফিরে আসতে হয়– একজন সৎ সৃষ্টিশীল মানুষকে– ফিরে আসতেই হয় তার নিজস্ব শেকড়ে, মৃত্তিকায়, বাসভূমে। যতক্ষণ তিনি সৃষ্টিশীল জীবন্ত, ততক্ষণ কিংবা বলি ততদিন তিনি নিরন্তর ব্যস্ত নিজেকে আবিষ্কারের সাধনায়। ফলে কখনো অন্বিষ্ট তাঁকে হাতছানি দেয় দূরে–যেখানে মোহন চোরাবালি; কখনো সেই ভূগোলে– যার অপরিচিত রহস্যময় জলবায়ু তরুলতার সঙ্গে কথোপকথনের ভাষা খুঁজে পেতে তিনি আহত হন, রক্তাক্ত হন, তবুও আকাঙ্খিত সুন্দরের জন্য এই নিরুদ্দেশ যাত্রা কিছু নতুন কথা নয়, অস্বাভাবিক তো নয়ই। অবশ্য সৃজনশীল মানুষ তারপরেও সেই অধরা দেবীকেই মিনতি জানান– এবার ফিরাও মোরে। কিন্তু কোথায়? যেখানে মানুষের সংসার, শ্রমে-স্বেদে- সংগ্রামে- শক্তিতে মানুষের সংসার যেখানে প্রতিদিন কল্লোলিত। দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। কিন্তু থাকতে পারেননি। সৃজনের উন্মাদনা তাকে নিজ বাসভূমে প্রত্যাবর্তনে বাধ্য করেছে। তার এই প্রত্যাবর্তনে লাভ হয়েছে সাহিত্যের চাকা।

আমিহীন বিশ্ব নেই, চরাচরে আমিই বিম্বিত:
প্রকৃতি ও কাল শুধু নটনটী, আমি নাট্যকার,
এবং দ্রষ্টাও, আমি- যতক্ষণ শেষ বজ্রপাতে
বিলুপ্ত না হয় সত্তা, মহাবিশ্ব আর ভগবান”

[মরত্বসঙ্গীত, মরচে পড়া পেরেকের গান: বুদ্ধদেব বসু।

রচনাকাল : ২০০৮

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on কবিতার জন্য নির্বাসন
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ