নয়ন আহমেদ
প্রত্যেক কবিই নিজেকেই নির্মাণ করেন। অস্তিত্বের সন্ধান করেন। সম্ভবত মানুষের
মধ্যে এই প্রবণতাই তাকে মানুষ হিশেবে মর্যাদায় অভিষিক্ত করে; মানুষ নামে যোগ্য করে তোলে। শিল্প, সাহিত্যে, কাব্যে তাই আত্মজিজ্ঞাসা আছে।
আছে এক মানবিক বোধ। বিপর্যয় আছে। কিন্তু, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার হিশেবে যে আনন্দ — তার আবেদনও কম নয়। কবি আবু তাহের সরফরাজকে দেখি, আত্মজিজ্ঞাসায় অধীর। আবার জীবনে তিনি যথেষ্ট আস্থাশীল। এ আস্থা গাছের পাতার মতোই সবুজ। প্রথমে দেখবো একটি কবিতার কয়েকটি চরণ:
“আমার যে সে কোথায় থাকে
কোথায় বাড়ি-ঘর?
তার সাথে কি বদলেছে এই
আমার টিনের ঘর?”
— এখানে কবিতার উপকরণসমূহ লৌকিক। এতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনের একটা চিত্রকল্প এসে গেছে।
আবার, আত্মজিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিকতার স্ফূরণ হয়েছে। কবিতার মায়াজাল নিঃসন্দেহে নান্দনিক এবং জীবনমুখী।
মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে লোভ-মোহ ত্যাগ করতে হবে।
আত্মানুসন্ধানী মানুষ জানে –” ফিরে এলাম বিস্ময়কর চিহ্নের কাছে/ মহাবিশ্বের কাছে বিলীন হওয়াই তার কাজ”।
পরিচিত কোনো “রিপা খাতুনের মুখ ” তাকে আকৃষ্ট করবে। কারণ, অমল-ধবল পার্থিবতা কেউ এড়াতে পারে না।
পৃথিবীর এই নিয়ম মেনেই চলতে হয় মানুষকে। সে জীবন আনন্দময়। নানান ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পাওয়া যায় সে জীবন। মানুষকে আশাবাদী হতে হবে। একটি কবিতায় সরফরাজ বলেন:
” আশা-আকাঙ্ক্ষার রেণু পথে পথে ছড়ানোই আসলে মানুষের কাজ।”
— জীবনকে মানবিক করা, সুন্দর আর রসনিবিড় করার ব্রত গ্রহণ করেছেন সরফরাজ।
জীবনকে পেতে হবে ও বোধ ও বোধির সমবায়ে; সাধনার অংশী হয়ে। সরফরাজ তাই ধ্যানী; সংসারে থেকেই সাধক। নিজেকে পরিশুদ্ধ করাই
তার কাজ। চর্যাপদের কবিরাও ছিলেন ধ্যানী; জীবনের মূলে প্রবেশ করেই জীবন উপভোগ করেছেন। কবির নির্মিতি :
“বোধের ভেতর বোধিলতা সে
ফুটেছিল উষারাঙা পাপড়ি খুলে, যেন সে লাবণ্যগোলাপ,
যেন সে সৌন্দর্য-গর্ভের রেণু
তুলে দিতে চায় তোমার মুখে
তুমি নত হও
যদি চিনে থাকো তবে নত হও হে মহাত্মন
তবে ধীরে। তোমার খুব তাড়া থাকতে পারে
বোধের অপেক্ষাকাল অনন্ত।”
— সরফরাজ মূলত প্রজ্ঞার কবি; বোধের কবি।
মানুষ চায় ঐশ্বর্যবান হতে, সম্পদশালী হতে। সেজন্য সে পার্থিবতাকে রঙিন করে।
কিন্তু সে নিজের দিকে তাকায় না। ন্যায়-অন্যায় মানে না। পরিণামে ধ্বংস হয় সে। শস্যহীন জমির মতোই তার জীবন। আবার যারা নিজেদের আলোকিত করে, নিজেকেই ফসলের মতো উপস্থিত করে– সফল তারাই।
” দুই পথিক” কবিতায় কবি এমন একটি সুন্দর দিক তুলে ধরেছেন।
” দুই পথিক সাঁতরে নদী পেরোতে থাকে
তবে একজন ডুবতে থাকে
তার ঝুলিতে এত ভার যে, সে ডুবতে থাকে
আরেক পথিক দিব্যি সাঁতরে যেতে থাকে
কেননা, পৃথিবীর কিছুই সে জমা করেনি
তার নিজের অস্তিত্ব ছাড়া।”
— এরকম প্রজ্ঞাশাসিত কবি সরফরাজ। রূপকের আবরণে তিনি নির্মাণ করেন উজ্জ্বল দিনের বাংলা কবিতা।
আবু তাহের সরফরাজ প্রধানত গদ্যছন্দ বা ভাবপ্রধান ছন্দকেই মান্য করেছেন।
এর মধ্য দিয়ে তিনি উপস্থাপন করেছেন জীবন ও জগতের গভীর উপলব্ধি।
তাঁর কবিতাপাঠে সুন্দর ও সহজ জীবনের প্রতি অনুরাগ জন্মে।
একটি কবিতায় তিনি বলেছেন–
” সুতরাং, জীবন সহজ
জীবনের দিকে সহজ চোখে তাকাও।”
সরফরাজের কবিতার চিত্রকল্প বর্ণিল; রঙিন।
আবু তাহের সরফরাজের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র; সবখানে।
স্বল্পায়তনের গদ্যে আমার কবিতার মোটামুটি একটি নির্যাস ধরা পড়েছে। নয়ন আহমেদ লিখেছেন, ‘সরফরাজ প্রধানত গদ্যছন্দ বা ভাবপ্রধান ছন্দকেই মান্য করেছেন।’ এটা ঠিক নয়। আমার বেশিরভাগ কবিতা স্বরবৃত্ত নয়তো মাত্রাবৃত্ত। ‘ভাবপ্রধান ছন্দ’ বলে কিছু আছে কিনা, আমি জানি না। কবিতার উদ্ধৃতিতেও শব্দ মিসিং। সবকিছুর পরও নয়ন আহমেদকে আমার শ্রদ্ধা। বাংলা রিভিউয়ের সাথে যুক্ত হওয়ার পর নতুন রূপে সাজ্জাদ বিপ্লবকে চিনতে শুরু করেছি। কবি হিসেবে তিনি অনন্য, এটা আমি আগে থেকেই জানি। এবার জানতে পারছি, সম্পাদক হিসেবে তিনি আহসান হাবীব কিংবা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতোই মেধাবী। অবশ্যি আজকের সময়ে সেভাবে তার সম্পাদনার মুনশিয়ানা প্রশংসিত হবে না। তবে আমি ধ্রুব সত্যের মতো উচ্চারণ করছি, বাংলা রিভিউয়ে নিত্যনতুন যেসব কনটেন্ট তিনি তুলছেন তা তার বিপুল শক্তিমত্তার পরিচয় বহন করে। তার মতো সম্পাদকের বড় অভাব এখন বাংলা সাহিত্যের পোর্টালে।