সৌমিত বসু’র কবিতা
১. ভাষাজ্বর
দুপুরের রোদে পা ছড়িয়ে বসেছে বাংলাভাষা,
সারাগায়ে সোনালি অক্ষর।
একটা চিল খাবার ভেবে ক্রমাগত
ছোঁ মেরে তুলে নিতে চাইছে অক্ষরগুলো পাহাড়ের ওপরে।
অক্ষর নষ্ট হলে যে কোনো মানুষ নাকি কব্জায় চলে আসে
তখন সহজ হয়ে আসে তার মাংস খুঁটে খাওয়া পর্ব।
চিলটা অন্তত তাই ভাবছে।
আন্দাজ পেয়ে মেয়েটি একটা একটা করে অক্ষর খুলে জড়ো করছে বুকের কাছে
প্রতিবার ছোঁ মারার সময়
সে একটা একটা করে বাড়িয়ে দিচ্ছে
হাত পা দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।
রক্ত গড়াচ্ছে ,কিন্তু চিল কিছুতেই
নাগাল পাচ্ছে না অক্ষরের ,
মেয়েটি আপ্রাণ চেষ্টা করছে দৌড়ে আসা দূরের ছেলেটির কাছে অর্পণ করতে অক্ষরগুলো।
রোদ নেমে আসছে।
আপ্রাণ লড়ে যাচ্ছে মেয়েটি।
মেয়েটির মুখ ক্রমশ বদলে যাচ্ছে
আমার মায়ের আদলে,
ঠিক যেভাবে মা হাত বাড়িয়ে
আমাদের সমস্ত বিপদ তাড়াতেন।
ভাষা ও মা কেমন সমার্থক হয়ে উঠছে দ্যাখো।
২. বাবা
বাবা ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে মাঝদরিয়ায়
নাকি সমুদ্র এসে মিশে যাচ্ছে ঘাটের চাতালে।
চতুর্দিকে মৃত্যুর গন্ধ। চোখের জল সম্বল করে
বাবা দেখবে বলে যে ছেলেটি উঠে এসেছে
বাঁধের ওপর , ঈশ্বর আজ তার সঙ্গে থাক।
চুলের ভেতর ঘন কালো।মনের ভেতর আধো অন্ধকার।কতটা পথ একা চলে আসা।কতটা পথ আরো যেতে হবে একা।ছেলেটি ভাবছে।
বাবা চলে যাচ্ছেন সীমানা ছাড়িয়ে।চুলগুলো পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে অন্ধকারে।
৩. মায়া বৌ ৭৩
এক একটা ফাটলের কাছে
আমরা কখনো কখনো ঋণী হয়ে থাকি
সে অলক্ষ্যে বুঝিয়ে দেয়
এখন পেছনে ফেরার সময় এসেছে।
যে কোনো যুদ্ধ ই আসলে হাত সাফাই
যে কোনো প্রেম ই আসলে তুরন্ত অভিনয়
যে কোনো কান্নাই আসলে
দেয়ালের গায়ে এঁকে রাখা পরাজয়।
ঝাঁক ঝাঁক নৌকো এগিয়ে চলেছে মহাসমুদ্রে
কার যে কাকে ভালো লেগে যায়
ভালোলাগা আসলে একটা সবুজ কলম
দীর্ঘদিন পরেও কালি পুরলে যার মুখ দিয়ে কবিতা বেরিয়ে আসে।
আলোচনা
১. কাজী জহিরুল ইসলাম
ভাষাজ্বর কবিতাটিকে একদিকে যেমন বাকস্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা যায় আবার হিন্দি আগ্রসনকে চিলের রূপকে চিন্তা করা যায়। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষা এখন হিন্দি এবং ইংরেজি নামক চিল-শকুনের কাছে প্রায় পরাস্ত। সেই প্রেক্ষিতে এটি একটি সার্থক রূপকল্প। তবে কবিতাটিতে ছন্দের অনুপস্থিতি আমাকে হতাশ করেছে।
বাবা কবিতাটি মৃত্যু এবং অন্ধকারের পথে সবাইকেই যেতে হবে এইরকম একটি আধ্যাত্মিক চিন্তার খোরাক জোগায়। সৌমিতের কবিতার বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো ভাষার বেশ মোচড় থাকে। চিন্তা করতে চাইলে গভীরে যাওয়া যায় সেই সুরঙ্গপথের দরোজা খোলা থাকে। তবে এই কবিতাটিও ফ্রি ভার্স, মানে ছন্দহীন। অতিমাত্রায় ছন্দহীনতা আমার ব্যক্তিগত অপছন্দ।
মায়া বৌ ৭৩ এ পরকীয়ার ইঙ্গিত আছে, সংসার যৌনতার মায়ায় বাঁধা থাকে, এ কথা আছে। প্রেম বা যৌন চিন্তার উন্মুক্ততার পক্ষে বলেছেন কবি। এটিও ভালো লেগেছে। তবে আবারও একই কথা, ছন্দহীনতা…
২. রেজাউদ্দিন স্টালিন
ভাষাজ্বর কবিতার শেষ লাইনটা কবিতার কৌতুহল নষ্ট করেছে।বাবা কবিতায় ঈশ্বরের ব্যবহার ক্লিশে।মায়া বৌ কবিতাটির ফাটল একটা দূরাগত প্রতীক।অন্যকোনো রূপক খুঁজতে পারেন কবি।এছাড়া তিনটি কবিতায়
বক্তব্য বিস্তারের মুন্সিয়ানা আছে।তবে আমার মনে হয়েছে খুব বেশি
কবিতা লেখার কারণে বক্তব্য ও
দৃশ্যকল্প দানা বেঁধে উঠতে পারে না।
যে কোনো যুদ্ধই হাত সাফাই এটা কবিতার ইঙ্গতকে শক্তি দেয়নি।যুদ্ধের
ভয়াবহতা চিত্রিত হয়নি।তবে সৌমিত যেহেতু একজন অভিজ্ঞ, দক্ষ কবি
তিনি লিখলে একটা সুখপাঠ্য কবিতা হবে এটা স্বাভাবিক।সৌমিতের আরো
উৎকৃষ্ট কবিতা পড়ার অপেক্ষায়।
৩. ফরিদ আহমদ দুলাল
সৌমিত বসুর তিন কবিতা নিয়ে রেজাউদ্দিন স্টালিন যা বলেছেন, তার প্রায় সবটার সাথেই আমি সহমত, তবে ‘ঈশ্বর’র ব্যবহার ক্লিশে হয়ে যাবার সাথে আমি ভিন্ন মত। অবশ্য সৌমিতের বাবা কবিতায় যেভাবে ঈশ্বরের ব্যবহার হয়েছে, তা কিছুটা নাজুক বটে। কবিতা তিনটি প্রসঙ্গে @কাজী জহিরুল ইসলাম যা বলেছেন, তার সাথেও আমি সহমত। আমি এখানে আমার দু’চার পঙক্তি অনুভব বলি—
সৌমিতের এমনি প্রতীকধর্মী বেশকিছু ভালো কবিতা পড়ার অভিজ্ঞতা আমার আছে; আমি বলবো সেগুলোর বিচারে এ তিনটি কিছুটা দুর্বল।
ভাষাজ্বর কবিতাটির কথাই ধরা যাক; এ কবিতায় ভাষা রোদে পা ছড়িয়ে বসে ছিলো, বর্ণগুলোকে একটা চিল খাদ্য ভেবে ছোঁ মেরে তুলে নিতে চাইলো, এখানে চিলের কোন দোষ দেখি না। কিন্তু পাহাড়ের ওপর কেন? নারকেল গাছে বসেও খাদ্য খেতে পারে চিল। পরের চরণে চিলকে আর চিল মনে হলো না, মনে হলো চিল যেন ভাষা-আগ্রাসীর প্রতীক। নির্দিষ্টভাবে ক্ষুধার্ত চিলকে ভাষাআগ্রাসী ভাবা কেন? ভাষার আগ্রাসন নানাভাবেই হচ্ছে। আরও সুচারুভাবে ভাষা-আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে পাঠককে সতর্ক করা উচিত বলেই আমি মনে করি।
সৌমিতের উপস্থাপনশৈলী নিয়ে আমি আশাবাদী, তাঁর কবিতা নিয়ে আমি নাতিদীর্ঘ গদ্যও লিখেছি মনে পড়ছে; তাঁর কাছে আমার প্রত্যাশা অনেক। এ কবিতায় বিষয় নির্বাচনের মুন্সিয়ানা আমায় মুগ্ধ করেছে; তাই কবিতাটিতে তাঁর পুনর্বিবেচনা চাই, বিশেষকরে শেষ পঙক্তিটি।
অন্য দু’টি কবিতার আলোচনা সুযোগ পেলে পরে করবো।