——————————————–
মোরশেদ শফিউল হাসান
আমার প্রায় অর্ধশতাব্দীকালের পুরানো ও অকৃত্রিম বন্ধু এবং এক সময়ের কমরেড মানযারে হাসীন মুরাদ সম্প্রতি ফেসবুকে আহমদ ছফার একটি টুপিপরা ছবি সংযুক্ত করে লিখেছেন : “এই ছবিটিতে যে আহমদ ছফা, এইটি ছফা ভাইয়ের সঠিক পরিচয়ের ছবি।“ দু-একজন বন্ধু ছবিটি এবং সংযুক্ত মন্তব্যের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণের পর এ বিষয়ে কিছু বলা আমি আমার নৈতিক কর্তব্য বিবেচনা করছি। বন্ধু মুরাদ এবং তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়ে আরও যাঁরা আহমদ ছফার টুপির প্রতি ইঙ্গিত করে সেটাকেই তাঁর ‘সঠিক পরিচয়’ বলে শনাক্ত করেছেন, প্রথমেই তাঁদের কাছে জানতে চাইব : এই ‘সঠিক’ পরিচয় বলতে আসলে তাঁরা কী বোঝাতে চেয়েছেন : মুসলমান, মৌলবাদী না কি সাম্প্রদায়িক? টুপি পরা বা দাড়ি রাখার কারণে যদি কাউকে মৌলবাদী বা সাম্প্রদায়িক গণ্য করতে হয় (এই প্রবণতাটি আমাদের এক শ্রেণির অতি-প্রগতিবাদীদের মধ্যে বরাবর লক্ষ করেছি), তবে তো রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সুভাষ বসু, নজরুল, কাজী মোতাহের হোসেন, আবুল ফজল, আবুল হাশিম, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ সহ অনেককেই সেই অপরাধে অভিযুক্ত করতে হয়। আর যদি গাদ্দাফি স্টাইলের টুপি বা জামা পরে আহমদ ছফার ছবি তোলাই তাঁদের আপত্তির কারণ হয়, তবে সে বিষয়টিকে আমি খুব বেশি গুরুত্ব দিতে রাজি নই (কারণ আমাদের জ্ঞান হবার পর থেকে এদেশেও অনেককে মাও বা কাস্ত্রো স্টাইলের টুপি পরতে তো আমরা দেখেছি)। হয়তো লিবিয়া ঘুরে এসে কিংবা সে দেশ থেকে কারো এনে দেয়া গাদ্দাফি স্টাইলের টুপি ও শার্ট পরে আহমদ ছফা একটি ছবি তুলেছিলেন বা কয়েকদিন সে বেশ নিয়ে ঘোরাফেরা করেছিলেন। এমনিতে স্রেফ মজা করার বা দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আহমদ ছফা অনেককিছু করতেন (নজরুল যেমন তাঁর নিজের রঙিন কাপড় পরার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন)। কিংবা সেটা ছিল তাঁর জিনিয়াস-সুলভ ‘পাগলামি’র অংশ। যেমন তিনি টিয়া পাখি কাঁধে নিয়ে ও বাঁশি সঙ্গে করে ঘুরে বেড়াতেন। এ কারণে কি আমরা তাঁকে ‘পাখাল’ বলবো, না কি বংশীবাদক হিসেবে কখনো তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছি?
তবে আহমদ ছফা অন্তত সামাজিক-সাংস্কৃতিক অর্থে তাঁর মুসলমান পরিচয়টিকে গৌণ করে দেখতে রাজি ছিলেন না, এটাই যদি তাঁর ব্যাপারে আমার বন্ধুদের ক্ষোভ বা আপত্তির মূল কারণ হয়, তবে সে অন্য কথা। বাঙালি হয়ে হিন্দু বা বৌদ্ধ হওয়া যদি যায়, তবে ‘বাঙালি মুসলমান’ পরিচয়ে দোষ কোথায়? (আমি নিজে প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রথাগত অর্থে ধর্মাচারী না হয়েও, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক দিক বাঙালির পাশাপাশি আমার মুসলমান ও বাংলাদেশী পরিচয়টিকে গুরুত্ব দিই।) পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানবাদী সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি বা ধারণার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ের পটভূমি বিবেচনায় আমাদের প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবী বা সংস্কৃতিজনদের মধ্যে যাঁরা মনে করেছিলেন (বা এখনও মনে করেন) যে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয়টি বড় হয়ে বা উপরে উঠে আসায়, তার নিচে এদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মুসলমান পরিচয়টি চিরতরে চাপা পড়ে গেছে, কিংবা বাতিল হয়ে গেছে, তাঁরা যে আসলে বোকার স্বর্গে বাস করছিলেন, সে দোষ তো আহমদ ছফার নয়! আর তাঁদের সে ভুল ধারণা বা প্রত্যাশার মুখে ছাই নিক্ষেপ করেছিলেন তো প্রথম খোদ বঙ্গবন্ধুই ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া তাঁর প্রথম ভাষণেই (উদ্ধৃতি দিতে হবে কি?)। এবং পরেও (ভারতের সম্মতি নেয়া বা তাদের সঙ্গে যোগাযোগের ন্যূনতম প্রয়োজনবোধ ছাড়াই) ওআইসি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে। এছাড়াও পাকিস্তান আমলের ইসলামিক একাডেমিকে ইসলামি ফাউনডেশনে উন্নীত করা, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন সহ আরও একাধিক উদাহরণ দেওয়া যায়। যা বঙ্গবন্ধুর বাস্তববুদ্ধি এবং রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়।
এই লেখাটি লেখার পর্যায়েই মনে পড়লো, মুরাদের সঙ্গে আমার কমরেডশীপের দিনগুলোতেই এক সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির পেছনের বারান্দায় আমাদের তখনকার আড্ডায় বসে আমি বলেছিলাম, ‘আপনাদের কথা শুনলে মনে হয় বুঝি এদেশের মানুষ কেবল রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার স্বাধীনতার জন্যই (সেটাও একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল বটে, স্বীকার করি) যুদ্ধ করেছিল। কিংবা রবীন্দ্র সংগীত গেয়েই দেশটা স্বাধীন হয়েছে।‘ আমি সেদিন তাঁকে যা বলতে বা বোঝাতে চেয়েছিলাম, তা হলো, এদেশের হাজার হাজার গাঁও-গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা (যাঁদের অনেকে স্কুল-কলেজের চৌকাঠও ডিঙ্গোননি) হয়তো যুদ্ধের আগে কোনোদিন একটা রবীন্দ্রসংগীত শোনারও সৌভাগ্য লাভ করেননি। আমাদের সে আড্ডায় উপস্থিত সিনিয়র কমরেড নন্তু ভাই (মনজুর আলী নন্তু) সেদিন, যদিও মৃদুকণ্ঠে, আমার সে বক্তব্যকে সমর্থন করেছিলেন। কারণ মাঠের অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। আজ নন্তু ভাই প্রয়াত, তাঁকে স্মরণ করছি। কিন্তু মুরাদ সেদিন আমার বক্তব্যে যে বেশ কূপিত হয়েছিলেন, টের পেয়েছিলাম।
চ্যানেল আই টিভিতে দীর্ঘদিন ধরে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাতকার ভিত্তিক একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল (এখনও হয় কি না জানি না)। অনুষ্ঠানটির নাম ছিল খুব সম্ভব ‘হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধ’ বা এরকম কিছু। আর অনুষ্ঠানটি উপস্থাপন করতেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ। আমি ছিলাম সেই অনুষ্ঠানটির একজন নিয়মিত শ্রোতা বা দর্শক। বাসায় উপস্থিত থাকলে পারতপক্ষে অনুষ্ঠানটি মিস করতাম না। তো সেই অনুষ্ঠানটি দেখার সময়ই আমি লক্ষ করি (কিংবা একে আবিষ্কারও বলা যায়) যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে প্রায় শতভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোনো বিশেষ অপারেশন বা ঘটনার উল্লেখ করতে গিয়ে ‘আল্লাহর কী কুদরত’, ‘খোদার রহমতে’ — এ ধরনের শব্দ বা শব্দবন্ধ ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ তাঁরা তাঁদের মুসলমান পরিচয়টিকে (ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক যে-অর্থেই আমরা তাকে নিই না কেন) বাঙালি পরিচয়ের বিপরীতে স্থাপন করেননি। পাকিস্তানিদের প্রচারণার উল্টোদিকে বরং নিজেদেরকেই খাঁটি মুসলমান বলে গণ্য করেছেন। এবং সে অবস্থান থেকে জুলুমের বিরুদ্ধে এবং স্বদেশমুক্তির সংগ্রামকে তাঁদের ইমানি কর্তব্য বলে গ্রহণ করেছিলেন।
আমার বন্ধু মুরাদ কিংবা তাঁর মতো অন্যরা আহমদ ছফার রচনা (সাতটি বা আটটি খণ্ডে এ পর্যন্ত তাঁর রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে) কিংবা তাঁর চিন্তাচর্চার সঙ্গে কতটা পরিচিত বা আদৌ পরিচিত কি না আমি জানি না। কিন্তু একজন লেখক, বুদ্ধিজীবী বা চিন্তককে তাঁর রচনার ভিত্তিতেই বিচার ও মুল্যায়ন করা উচিত। এর কোনো বিকল্প নেই। তিনি কবে কোন আড্ডায় বসে, কারো সঙ্গে বিতর্ক করতে গিয়ে বা ঝগড়ার মুডে কী বলেছিলেন তা দিয়ে যেমন নয়, তেমনি তাঁর মরণোত্তরকালে তাঁর কোনো স্বঘোষিত শিষ্য বা অনুরাগী তাঁর বরাত দিয়ে কী বলছেন বা প্রচার করছেন, তা দিয়ে নয়। এটা মার্কস বা রবীন্দ্রনাথ সবার বেলায়ই প্রযোজ্য। পরের মুখে ঝাল খেয়ে ‘উহ-আহ’ করা প্রকৃত জ্ঞানী বা রসিকজনের পক্ষে মানানসই নয়। আহমদ ছফা তাঁর কোন লেখায় কোন কথাটা বলেছেন, যা দিয়ে তাঁকে নিঃসংশয়ে ধর্মান্ধ, মৌলবাদী বা সাম্প্রদায়িক প্রমাণ করা যায়, কেউ দয়া করে জানাবেন কি? ভারত বিরোধিতা কিংবা ১৯৭২-৭৫ আমলে আওয়ামী লীগের সমালোচনাই কি আহমদ ছফার ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক বা মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক? কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকার মূল্যায়ন করে সবচেয়ে ভালো, গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন বা দার্শনিক দিক থেকে মূল্যবান লেখা কয়টি তো এদেশে বা বাংলা ভাষায় মনে হয় আহমদ ছফাই লিখেছেন। আহমদ ছফাকে গালমন্দকারী বন্ধুদের কি সে লেখাগুলো পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে?
কী বলেছেন আসলে আহমদ ছফা, যা আমার বন্ধুদের গাত্রদাহের কারণ? তিনি বলেছেন বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের হাজার হাজার মাদ্রাসায় পড়া কিংবা তা থেকে বেরিয়ে আসা (মাদ্রাসাগুলো তো আর আহমদ ছফা প্রতিষ্ঠা করেন নি) লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতি উপেক্ষা বা ঘৃণার মনোভাব বজায় রেখে, এবং এভাবে তাদেরকে বাধ্যতামূলক শত্রু শিবিরে ঠেলে দিয়ে, সমাজতন্ত্র দূরের কথা, প্রগতির পথে আমরা সামান্যও অগ্রসর হতে পারবো না । সময়ের ব্যবধানে আমরা কি আজ তাঁর সে বক্তব্যের যথার্থতা এবং সমাজচিন্তক হিসেবে তাঁর দূরদর্শিতার প্রমাণ পাচ্ছি না? প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছি না? (শুধু আহমদ ছফাই তো নন, স্বাধীনতার পর একই প্রশ্নে অনুরূপ অভিমত প্রকাশ করেছিলেন ‘বাঙলার বিবেক’ নামে খ্যাত আবুল ফজলও।) আহমদ ছফার সে বক্তব্যের তাৎপর্য কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম বলেই, সেদিন সিপিবির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঘরানার উত্তরাধিকার নিয়েও আমি, (প্রয়াত) আলতাফ আলী হাসু, (প্রয়াত) কাজী আকরাম হোসেন এবং দিলওয়ার হোসেনের মতো কয়েকজন আহমদ ছফার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিলাম এবং কোনো না কোনো পর্যায়ে তাঁর সঙ্গে কাজকর্মে যুক্ত হয়েছিলাম।
হ্যাঁ, উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে তিনি যে কৌশল অবলম্বন করেছিলেন, তা হয়তো ভুল ছিল। আর সেটা বোধহয় শেষদিকে তিনি উপলব্ধিও করতে পেরেছিলেন। আমার নিজের কথা বলতে পারি, লিবিয়ার টাকা নিয়ে পত্রিকা চালানো কিংবা গাদ্দাফির গ্রীন বুক ছাপার কাজ করা নিয়ে তার সঙ্গে মতদ্বৈধতার পরিণতিতে এক পর্যায়ে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কের দারুণ অবনতি ঘটে এবং আমি তাঁর পরিচালিত ও সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘উত্তরণ’ পত্রিকার প্রথমে নির্বাহী সম্পাদকের পদ ত্যাগ এবং শেষ পর্যন্ত পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করি। অনেকেই সে পর্বের কথা জানেন এবং ছফা ভাইয়ের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে লেখা আমার ‘ছফা ভাই : আমার দেখা আমার চেনা’ বইয়ে (প্রকাশক : মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা) আমি এ বিষয়ে কিছুটা আলোকপাতও করেছি। কিন্তু কৌতুক বোধ করি যখন দেখি, এদেশে বিপ্লব করার নামে বছরের পর বছর রাশিয়া, চীন বা উত্তর কোরিয়ার টাকা খাওয়ার পরও অনেকে আজ মুখ মুছে আহমদ ছফার সমালোচনা করার সময় নিজেদের সে অতীত ভূমিকার জন্য বিন্দুমাত্রও লজ্জিত হন না বা বিবেকবোধের পীড়া অনুভব করেন না।
এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম করার আগে আগে আমি ‘ইসলাম ও মৌলবাদ’ নামে একটি দীর্ঘ গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখি। প্রবন্ধটি আমি লিখেছিলাম, তখন আমরা (আমি, সোহরাব হাসান, জাহাঙ্গীর কবীর প্রমুখ) মূলভূমি নামে যে লিট্ল ম্যাগাজিনটি বের করতাম, তার পরিকল্পিত ‘ সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বিরোধী সংখ্যা’র জন্য। কিন্তু সে সংখ্যাটি আর প্রকাশিত হয়নি। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রধর্ম বিল পাশ হয়ে গেছে। আমি কোথাও লেখাটি ছাপতে পারছি না। কয়েকজন পড়ে লেখাটির উচ্চপ্রশংসা করলেও, এবং ‘খুবই সময়োপযোগী’ বলে অভিমত প্রকাশ করলেও (আমি তাঁদের নাম আপাতত উল্লেখ করছি না), পত্রিকায় বা বই আকারে লেখাটি ছাপার ব্যাপারে তাঁদের ‘অসুবিধা’ বা অক্ষমতা প্রকাশ করেন। আমি ততদিনে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছি। ছফা ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই বললেই চলে। ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম ভাই ছফা ভাইয়ের সঙ্গে মিলে ‘উত্তরণ’ বের করছেন। দিলওয়ার হোসেনও খণ্ডকালীন পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করছেন। হয়তো দিলওয়ারের কিংবা অন্য কারো কাছ থেকে শুনে ছফা ভাই একদিন দিলওয়ারকে আমার বাসায় পাঠিয়ে আমার কাছ থেকে পাণ্ডুলিপিটি সংগ্রহ করেন এবং দুই সংখ্যা ধরে লেখাটি তাঁদের পত্রিকায় প্রকাশ করেন। লেখাটি পরে বই আকারে প্রকাশিত হয় এবং এ পর্যন্ত তার পাঁচটি সংস্করণ হয়েছে (আরেকটি সংস্করণ প্রকাশের অপেক্ষায়)। যাঁরা বইটি পড়েছেন (‘ইসলাম’ নাম থাকায় মুরাদ নিশ্চয় পড়েননি) তাঁরাই আশা করি বুঝবেন, আহমদ ছফা যদি সত্যি সত্যি ধর্মান্ধ, মৌলবাদী বা সাম্প্রদায়িক হতেন, তবে ওই সময়ে, কিছুটা হলেও ঝুঁকি নিয়ে, আমার ওই লেখাটি তাঁদের পত্রিকায়, তাও প্রধান রচনা হিসেবে, ছাপতেন না। এজন্য কাজী আকরাম ভাইয়ের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। তবে আমার চাকরিগত ও অন্য নিরাপত্তার কথা ভেবে ছফা ভাই দিলওয়ারকে নির্দেশ দেন, আমার মূল নামের পরিবর্তে ছদ্মনামে লেখাটি ছাপতে। কাজী আকরাম ভাই আজ পৃথিবীতে নেই, নেই আবু বকর সিদ্দিক ফণি, কিন্তু সাক্ষী হিসেবে দিলওয়ার আজও আছেন।
আমাদের দেশের দুজন শ্রদ্ধেয় ও শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী (আমি তাঁদের নামোল্লেখ করতে চাই না) শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন, দেশের সমস্ত মাদ্রাসা অবিলম্বে বন্ধ করে দিতে। আমাদের দেশের অনেক তথাকথিত প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিজন আজও সেরকম মনোভাবই পোষণ ও প্রকাশ করেন। আহমদ ছফা তাঁদের এই হঠকারী দাবির সঙ্গে কখনো একমত হতে পারেননি। দেখা যায় এসব প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিজনরা মাদ্রাসা শিক্ষার (যে ব্যবস্থার অধীনে দেশের গরিব ও এতিম ছেলেমেয়েরা পড়ে) বিরুদ্ধে যতটা সোচ্চার, ইংরেজি-মাধ্যম শিক্ষার বিষয়ে ততটাই যেন নিরুচ্চার। এঁদের মধ্যে যারা সভামঞ্চ থেকে ‘কায়মনে বাঙালি’ হওয়ার আহ্বান জানান, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাঁদের ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনিরা ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করে (না, তাদের নিজেদের পছন্দেও নয়, অভিভাবকদের সিদ্ধান্তে)। হয়তো দেশেই থাকে না তারা। অনেকের এমনকি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামান্যতম পরিচয়ও নেই। একেই বলে দ্বিচারিতা বা অন্য কথায় ‘মোনাফেকি’। দেশের মানুষ তাঁদের এই দ্বিচারিতার সঙ্গে পরিচিত বলেই তাঁদের কাছে এঁদের কথা কানাকড়িও মূল্য পায় না।
হেফাজত, জামায়াত বা সমধর্মী সংগঠনগুলোর প্রভাব বৃদ্ধিতে এঁরা উদ্বিগ্ন (আমিও এ ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে একই অবস্থানে রয়েছি)। কিন্তু বাংলাদেশে ইসকনের তৎপরতায় তাঁরা উদ্বেগের কিছু দেখেন না। এদেশে আরএসএস-এর ছাত্র সংগঠন চালুর সংবাদ তাঁরা রাখেন কি না জানি না। কিংবা সে সংবাদ জানলেও, তাতে দুশ্চিন্তা করার মতো কিছু আছে বলে তাঁরা হয়তো মনে করেন না।
আহমদ ছফা একজন খাঁটি মানুষ, খাঁটি লেখক, খাঁটি বুদ্ধিজীবী। দালালরা তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়। তারা ভণ্ড এবং ডাবল স্টান্ডার্ড লোক। তাদেরকে বহু আগেই চিনেছিলেন কবি : ” মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পণ্ডিত সমাজ “( সোনালি কাবিন)
এই লেখাটি আমাকে আরো একটি গদ্য লিখতে উস্কে দিচ্ছে। দেখি, হয়ত লিখে ফেলবো।