spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যব্যাকরণ শিখে কবি হওয়া যায়?

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

ব্যাকরণ শিখে কবি হওয়া যায়?


কাজী জহিরুল ইসলাম

কবি কি হওয়া যায়? কেউ কি কাউকে কবিতা লেখা শেখাতে পারেন? এই জাতীয় আলোচনা, মাঝে-মধ্যে বিতর্ক এবং হঠাৎ তুমুল কুতর্ক চায়ের টেবিলে, ফেইসবুক লাইভে, আয়োজিত অনুষ্ঠানে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার স্ট্যাটাসে প্রায়শই চোখে পড়ে। আবার একদল আছেন, তারা বলেন, কোনটা কবিতা আর কোনটা কবিতা না, মহাকাল ঠিক করবে, এই বিষয়ে আপনি কথা বলার কে? তারা এও বলেন, বড়ু চণ্ডীদাস, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদদীনকে কবিতা লেখা কে শিখিয়েছে?

আজ এইসব বিষয় নিয়ে আমার মত করে কিছুটা আলোকপাত করবো। বড়ু চণ্ডীদাসদের সময়ে কবিতা লেখা শেখার প্রাতিষ্ঠানিক স্কুল হয়ত ছিল না কিন্তু গুরু নিশ্চয়ই ছিল। মধুসূদন তো বিলেতে, ফ্রান্সে গিয়ে ইউরোপীয় সাহিত্য পড়েই শিখে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথও পারিবারিকভাবে সাহিত্য রচনার শিক্ষা পেয়েছিলেন। জসীম উদদীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরবর্তী ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের অধীনে লোকজ সাহিত্য নিয়ে কাজ করেন। ব্যতিক্রম একমাত্র কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন স্বশিক্ষিত সাহিত্যিক। তবে সাহিত্যিক বা কবি হয়ে উঠতে উঠতে তিনি ব্যাপক পড়াশোনা করেন এবং এর মধ্য দিয়ে সাহিত্যের সকল শাখার ব্যাকরণ-প্রকরণ আয়ত্ব করে ফেলেন।

যে কয়জনের নাম এখানে উল্লেখ করলাম তারা সকলেই ছিলেন খুব বড়ো মাপের সাহিত্য প্রতিভা। তাদের সমকালে নিশ্চয়ই আরো কয়েক’শ মধ্য মাপের বা ছোটো মাপের লেখক-সাহিত্যিক ছিলেন, যারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছেন, যাদের নাম আমরা কেউ জানি না। যদি সাহিত্যকর্ম শেখানোর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা মধ্যযুগে থাকত তাহলে মধ্য বা ছোটো মাপের প্রতিভাদের কেউ কেউ হয়ত লেখক হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতেন। বড়ো প্রতিভা যারা তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দরকার হয় না, নিজেরাই লিখতে লিখতে ভালো লেখার বৈশিষ্ট্যগুলো আয়ত্ব করে ফেলেন এবং ক্রমশ তারা নিজেরাই প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেন। কিন্তু যারা লেখক হতে চান অথচ তেমন বড়ো মাপের প্রতিভা নন, তাদের জন্য সাহিত্য রচনা বা কবিতা লেখা শেখার দরকার আছে। না শিখে তারা বেশি দূর এগুতে পারবেন না।

এখন কথা হচ্ছে কবিতা লেখা কি শেখানো যায়? কেউ কবিতা লেখা বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করলে কি একজন বড়ো কবি হতে পারবেন? আমাদের দেশে বাংলা সাহিত্য এবং ইংরেজি সাহিত্য এই দুটি বিষয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করা যায়। যারা এসব বিষয়ে পড়াশোনা করেন তারা সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেন। আমেরিকায় আরো সুনির্দিষ্ট করে শুধুমাত্র কবিতা লেখা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ রয়েছে। আমার যে কয়জন আমেরিকান কবি-বন্ধু আছেন তারা সকলেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃজনশীল রচনা বা কবিতার অধ্যাপক এবং এক সময় এই বিষয়েরই ছাত্র ছিলেন।

একজনের কথা বলি, তার নাম মেরি জো বাং, তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কবিতার অধ্যাপক, একজন স্বনামধন্য মার্কিন কবি। আমি তার সাক্ষাৎকার নিয়েছি, তার কবিতা অনুবাদ করেছি। তিনি প্রথম জীবনে ফটোগ্রাফির ওপর পড়াশোনা করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেবার পরে এই বিষয়ে পেশায়ও আত্মনিয়োগ করেন। ১০ বছর পরে তার মনে হলো, ‘আমার মন অন্য কিছু চায়’। সেই অন্য কিছুর নাম কবিতা। তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। আমেরিকার বিভিন্ন পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে কবিতা পাঠাতে শুরু করেন, প্রকাশকদের কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠান কিন্তু কেউ তার লেখা প্রকাশ করে না। একদিন তার মনে হলো তাহলে বোধ হয় আমার লেখাগুলো হয়ে উঠছে না। তিনি কবিতা লেখা শেখার জন্য কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস বিভাগে ভর্তি হন। মূল বিষয় হিসেবে নেন, কবিতা। তিনি আমাকে বলেন, ‘এই ডিগ্রিটা না করলে আমি জানতেই পারতাম না আমার কবিতাগুলো কেন কবিতা হয়ে উঠছিল না’। এখন নিউইয়র্ক টাইমস, নিউ ইয়র্কারসহ আমেরিকার সব বড়ো বড়ো কাগজে তার কবিতা ছাপা হয়।

কবিতা লেখার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করলেই একজন মানুষ কবি হয়ে উঠবেন না, কিন্তু তিনি যদি এই শিক্ষাটি গ্রহণ করেন তাহলে শিক্ষা না গ্রহণ করার চেয়ে অধিক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন। এক’শ জন মানুষ কবিতা লেখার কোর্স করলে হয়ত দশজন অর্জিত জ্ঞানের প্রতিফলন কবিতায় ঘটাতে পারবেন, এই দশজনের মধ্যে হয়ত এক বা দুইজন মানোত্তীর্ণ কবিতা লিখতে পারবেন। কিন্তু একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় শ্রেষ্ঠদের বাইরে যারা তারাও যা লিখবেন তাও কবিতাই হবে, হয়ত ভালো কবিতা হবে না। কিন্তু তারা যদি কোর্স না করে লিখতেন তাহলে সেগুলো মোটেও কবিতা হয়ে উঠত না।

চেষ্টা করে কেউ কবি হয় না, কবিরা কবি হয়েই জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রখর কল্পনাশক্তি জন্মগত, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তাল, লয়, গতি তিনি চোখ বন্ধ করলেই টের পান। কিন্তু ভালো কবিতা লেখার জন্য তাকে ক্রমাগত অনুশীলনের মধ্যে থাকতে হয়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ বা গুরুর কাছে শেখা এই অনুশীলনেরই অংশ।

শব্দসমূহের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাসের যে তাগিদ স্যামুয়েল কোলরিজ দিয়েছেন এর মধ্যেই কবিতার সকল প্রকরণ রয়েছে। একটি ভালো চিত্রকল্প যখন কবিতায় নির্মিত হয়, তখন আমরা পঙক্তির মধ্যে বিন্যস্ত শব্দসমূহে আকর্ষণীয় বিন্যাস দেখতে পাই। যখন ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ পংক্তির মধ্যে অনুপ্রাসের কারুকার্য দেখি তখন বুঝি শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাস ঘটেছে। যখন ‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার’ এর মতো উপমা এবং একই সঙ্গে চিত্রকল্প পাঠ করি তখন মনে হয় এটাই শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাস। যখন পড়ি ‘বন্যশূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা/ মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ/ কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা/ ঘন জঙ্গলে ময়ুর দেখাবে নাচ’ তখন এই ছন্দের দ্যোতনা আমাদের নিশ্চিত করে শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাস। এই প্রকরণগুলো জন্মগতভাবে যিনি কবি তার পক্ষে অধ্যয়ন ছাড়া জানা সম্ভব নয়। কেউ কেউ নিজস্ব ধ্যান, অনুশীলন এবং মগ্নতার মধ্য দিয়ে কবিতার এইসব ঐশ্বর্য আবিস্কার করে ফেলতে পারেন কিন্তু সেজন্য অতি মেধাবীরও বহুকাল সময় লেগে যেতে পারে, তবে অধিকাংশের পক্ষে তা একা একা, পঠন-পাঠন ছাড়া, আবিস্কার করা সম্ভবই না। এ-কারণেই কবিকে যত দ্রুত সম্ভব কবিতার ইতিহাস, ব্যাকরণ-প্রকরণ শিখে নিতে হয়। অধ্যয়নকালে যিনি সবচেয়ে দ্রুত ও সফলতার সঙ্গে প্রকরণ শিখতে পারবেন তিনিই সবচেয়ে বড়ো কবি হবেন এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। ভালো ব্যাকরণ জানা ব্যক্তি পণ্ডিত হতে পারবেন, কাব্য-সমালোচক হতে পারবেন কিন্তু কবি হতে পারবেন কি-না সেই নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। কবি তিনিই হবেন যার কল্পনা শক্তি, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তীব্র ও ধারালো।

যারা কবিতার ব্যাকরণ-প্রকরণ জানেন না, জানার চেষ্টা করেন না, কিন্তু কবিতা লেখেন, তারা মূলত মূর্খ কবি এবং তারাই এমন কথা বলেন, শিখে কেউ কবি হয় না, অথবা কোনটা কবিতা কোনটা কবিতা না তা আপনি বলার কে। শিখে সকলেই কবি হয় না তবে কেউ কেউ হয় কিন্তু যারা শেখে না তাদের কেউই কবি হতে পারে না।

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১০ এপ্রিল ২০২৪

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা