চলো আর একবার
চলো আর একবার শুরুতে ফিরে যাই।
শুরুর শুরুটা কেমন ছিল
মনে আছে নিশ্চয়ই ,
আমি তো স্পষ্ট মনে করতে পারি ,
বারংবার তীব্র হোঁচট।
কিছুদিন ভুলভ্রান্তি নিয়ে ঘর করা হল ,
তাতে হয়তো অধিকাংশ ইলেকট্রনই খরচ হয়েছে।
দুএকটি যা কানাকড়ি এখনও রয়েছে
চলো তাকে ফের অশেষ ভাবতে শুরু করি ,
চলো আর একবার , অসংখ্যবারের কথা
নাটকের অঙ্কে অঙ্কে বলি ।
ওস্তাদ ফতে আলি খাঁ সদলবলে যেভাবে জীবনকে বাজায় ,
আর একবার শীতের গাঁদা উচ্চারণ করি ।
ছাড়ো ওর কথা
ছাড়ো ওর কথা , ওকে ভুলে যাও।
ভুলে যাওয়াকে আর সম্ভাবনার অধীনে না রেখে
নিজের ইচ্ছেকেই তার দায়িত্ব নিতে বলো ,
ছাড়ো ওর কথা।
ওকে ওর পবিত্রতার নোট ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে
স্বর্গের জমি কিনতে দাও।
অনেক আলোকবর্ষ পথ
আমাদের অপবিত্র পায়ে পায়ে ধন্য হয়েছে ,
সেইসব পথ আজ
আমাদের জীবনের একমাত্র রাস্তাটি
বানানোর দায়িত্ব নিয়েছে ।
মাছের ভেড়ির পাশে
রাস্তা এক পাখির বিশ্বাস ,
পৃথিবীকে একমাত্র পৃথিবী বলে চিনতে পেরেছে ।
আমাদের সব সিঁড়ি উঠতে উঠতে
উল্টোদিকে বারবার মাটিতে নেমেছে ।
পাশের বাড়ির ছেলেগুলো
পাশের বাড়ির ছেলেগুলো
তাদের অনেক অনেক টাকার পেট্রোল কেনা আছে ,
দিনের মাথায় তারা বারবার
বাইকে স্টার্ট দেয় ।
ওদের বাইকের পিছনের সিটগুলো
চালকের দিকে ঝুঁকে থাকে ঝুঁকি নিয়ে , তাই
পিছনে যে ফলওয়ালাদের ওরা বসায়
তাদের ফলের ঝুড়ি ওদের স্পর্শ করে ।
বাইকে স্টার্ট দেওয়ার সেই বারংবার শব্দে
আমার ঘুম ভেঙে যায় , আর
প্রত্যেকটি ভাঙা ঘুমের ভেতর থেকে
বেলিফুলের গাছ বার হয়ে আসে হাসতে হাসতে ।
সময় কাটাবার জন্য
সময় কাটাবার জন্য আমি পাঁকে নেমে পড়ি ,
নানা রঙ আর গন্ধের পাঁক
গোড়ালি ছেড়ে হাঁটু অব্দি ওঠে ।
হঠাৎ হঠাৎ পাশের বাড়িগুলোতে গেট খোলার শব্দ না হলে
পাঁক-সমাধিও হতে পারত আমার।
আদিত্য-এল-ওয়ান যখন পা গুনে গুনে সূর্যের দিকে যাচ্ছে
পৃথিবীতে তখন খানাখন্দ ,খালবিল ,কাঁচা নর্দমা কমে গেলেও
আধুনিক ডিভাইসগুলো সব পাঁকে ভরা ।
আমি সেসব ডিভাইসের সৌজন্যে
দিন দিন অপুষ্টির পুষ্টিতে পুষ্ট হয়ে উঠি ।
এইসব কথা জানবার শুনবার জন্য
পৃথিবীতে আর কোনো তুমি পড়ে নেই।
সময় কাটানোর কাটা-সময়গুলো
আমার বাড়ি ,রাস্তা আর শ্রীচৈতন্যে
ডাঁই হয়ে পড়ে আছে দুর্গন্ধে ভরা কুরুক্ষেত্রের মতো ।
আরও কিছুটা নষ্ট
আরও কিছুটা নষ্ট করে নিই নিজেকে ।
আদাজল খেয়ে যারা নেমে পড়ে বাথটবে
সাবানের ফেনায় নিজেকে নির্মল রাখবে বলে ,
আমি তাদের দলের কেউ নই।
এত যে মালিন্য সৃষ্টি হয়েছে মহাবিশ্বে
সে কি কেবল মলিনতার কথা বলার জন্য ?
সাদাকালোয় ভরা সংসারে
কাকে বেশি আদর করব ভেবে পাই না ।
নষ্টের মাহাত্ম্য আমি কী বলব কবি !
সে আমার বড়ো প্রিয়জন, কেবল আমার।
যে রাস্তা শাপদ খুব ,প্রচণ্ড ভয়াল ,
সে আমাকে কাছে পেলে
হয়তো গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছাবে একদিন ,
হোক না তা সহস্র আলোকবর্ষ পর।
অকথিত ,অশনাক্ত কিছু কথা
অকথিত ,অশনাক্ত কিছু কথা পথে চলেছিল ,
তাদের শরীরে ,চলায়, দৃষ্টিতে ভয় ছিল গাঢ় অ্যাক্রেলিকে
যেন তারা তাড়ায় তাড়িত হয়েছে
সমাজবিরোধী কোনো রাষ্ট্রের দ্বারা।
সেসব কথাকে কেউ শুনতে চায় না,
কণ্ঠে বা মনে বা শ্রুতিতে ধারণ করতে চায় না,
ভয় পায়।
কথারাও ভয়ে থাকে,
মানুষেও ভয়ে থাকে,
অরণ্যের উৎসর্জনে তারা আশ্রয় নেবে বলে
খুব দ্রুত হাঁটছিল।
আরও কত অশরীরী-কথা
ভ্রুণ-জন্মও পেল না, মারা গেল।
সেসব কথার জন্য
একজন সংগ্রাহক অত্যন্ত জরুরি।
আমি সেদিন এক চার্চে
আমি সেদিন এক চার্চে গিয়েছিলাম ,
প্রার্থনার নির্দিষ্ট ঘরেও ঢুকেছিলাম।
সে ঘরে তখন মা মেরি আর যীশু
দুজনেই উপস্থিত ছিলেন।
প্রার্থনা জানানোর মতো আমার যে কিছু ছিল না
তেমন নয় ,
অথচ জানানো হল না ।
সে ঘরে তখন মেরি ,যীশু আর আমি
আর কেউ ছিল না ।
আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেককে দেখছিলাম ,
দেখতে চাইছিলাম।
সন্দেহ করছিলাম আর
সন্দেহ করতে করতে একটা মায়ার মধ্যে
জড়িয়ে পড়ছিলাম।
সে চার্চের প্রধান যাজক তখন
ফুলের বাগানে ঘুরছিলেন আর ফুল দেখছিলেন।
তিনি জানতেও পারলেন না
চার্চের মধ্যে তাঁর দুই আরাধ্য
একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে কী কী কথা বলছিলেন।
অপেক্ষা একটি অসমাপিকা ক্রিয়া
অপেক্ষা একটি অসমাপিকা ক্রিয়া ,
তার শরীর এক অদৃশ্য পৌনঃপুনিকতা দিয়ে তৈরি ।
হ্যাঁ নেই , নাও নেই –
কায়া নেই , ছায়া নেই –
সে এক অদ্ভুত রকমের তারযন্ত্রের সুর।
অথচ সেতার , সারেঙ্গি – এসবও
বলে না তাকে কেউ।
এত যে লোকের সঙ্গে আমার ওঠা-বসা ,
আলাপ-পরিচয় , বাদ-বিবাদ –
তারা কেউ তাকে আদৌ চেনে না ;
একমাত্র সময়ের সঙ্গে তার পানীয় ঘেঁষা সম্পর্ক।
তার জন্য একটা বড়ো আবাস বানাতে হবে ,
যাতে সে সছল-বছল করে শুতে বসতে পারে ।
এই সামান্য কয়েক কোটির গ্যালাক্সিতে
একটু অসুবিধাই হচ্ছে তার ,
উঠতে বসতে হাত পা ঠেকে যাচ্ছে দেওয়ালে ।
পাথর কেটে বানিয়েছিল
পাথর কেটে বানিয়েছিল কেউ একটি মূর্তি ,
সে মূর্তিকে দেখার আগে থেকে ,দেখার সময়কাল ও
হারিয়ে ফেলার পরও কিছুদিন মিলিয়ে
একটা হাজার বছরের সময়কাল পেরিয়ে গেছে ।
এখন সে সংক্রান্ত কোনো কথা আর বাকি নেই।
পৃথিবীর সব রাস্তা পৃথিবী ছাড়িয়ে
বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে গেছে ,
সে পথে হাঁটতে হাঁটতে আমি কোথায় পৌঁছাব
তা ভাবতে চাই না ,
কেবল হাঁটতে চাই আজ।
যদি কেউ সামনে থেকে ডাক দেয় ,
যদি বলে – এইখানে এসে খুঁজে নাও নিজেকে ,
আমি যাব সেই দিকে ।
গিয়ে যদি দেখি
সেও একটি পাথর কেবল , হতাশ হব না ;
অন্য কোনো রাস্তা খুঁজে নেব।
হয়তো পৃথিবীর অন্য সব পাথরেরাও
একদিন হাঁটতে বার হবে , যাদের সবাইকে
পাথর কেটে পাথর বানিয়েছিল কেউ।
শীতের মরশুমে
শীতের মরশুমে গাঁদাগাছ জন্ম নিয়েছিল
তার নিজের তাগিদে ।
পুজোর ফুল যারা ফেলে দিয়ে যায়
বাসি হলে ,বাড়ির বাইরে ,ফাঁকা জায়গায়
নজরে আসেনি তাদের তাকে ,
উপেক্ষাই দস্তুর বলে নিশ্চয় ।
আমি ফুল কিনি না , পুজো করি না ,
বাগানও করি না কখনও।
কখনো সামান্য শ্রম দিতে হলে
সবজির বাগানে দিয়ে আসি ,
অন্ন ব্যঞ্জনের পাতে তারা
সেই শ্রম শোধ করে দেয় ।
সেই গাঁদা গাছ , ছোটো ছোটো
ফুলের কাহিনি গাইছিল ,নির্জনে ,
একা একা , সাধ্যমতো ।
উপযাচক আমি গিয়ে বলি – ওহে গাঁদা গাছ
সুন্দরী ,সুঠাম হওনি কেন তুমি –
কেয়ারি করা বাগানের অন্যদের মতো ?
পারোনি ফুটাতে ফুলও ঠিকমতো ।
উপেক্ষার গাঁদা গাছ
নীরবে উপেক্ষা করে আমার কথাকে।
আমাকে যারা ভালোবাসেন
আমাকে যারা ভালোবাসেন তাদের জন্য
আমার আজকাল কষ্ট হয় খুব।
কেননা ,সঠিক পণ্য আমি কোনোদিন
সঠিক মূল্যে বিক্রয় করিনি তাদের।
পণ্যের ক্রোমোজোমে ক্রোমাটিডগুলো
প্লাস্টিক দিয়ে নিখুঁত তৈরি করে গুঁজে দিই।
এ পৃথিবী চিরকাল ,সরল মানুষ যারা তাদের বিরুদ্ধে
ষড়যন্ত্র তৈরি করে নতুন নতুন ,
আমাকে তাদের সামনে বন্ধু বলে পেশ করা
সেরকমই জঘন্য এক কাজ।
এ বছর বড়দিনে আমি সেই বন্ধুদের বালিশের পাশে
নতুন মোজার মধ্যে রেখে আসব
অতি মনোরম এক আত্মনিকেশের প্রার্থিত খবর।
যারা আমাকে বারবার অলৌকিকভাবে পুরস্কৃত করে
আল্লার দোহাই , ঈশ্বরে শপথ ,
তাদের পায়ের নিচ থেকে
টারসিয়ারি ,গন্ডোয়ানা চুরি করে নেব।
অবশ্যই সেইসব গুণমুগ্ধদের জন্য
চোখের কোণায় একটু চিকচিক করবে দুঃখবোধ।
সকালেই পাড়ায় পাড়ায়
সকালেই পাড়ায় পাড়ায় চিৎকার করে
জানিয়ে গেল একদল ছেলে –
খিড়কি-জানালা বন্ধ রাখবেন ,
মৌচাক ভাঙা হবে ।
পাড়ায় পাঁচ শতাংশ লোকের
জানালা দরজা খোলা ছিল ,
তাদের মধ্যে কারো কারো ঘটনাচক্রে
বা আনুষ্ঠানিক কারণে ,
মাত্র দুএকজনের হাট করে খোলা থাকে
অকারণে ,সবসময় ।
যাদের দরজা জানালা কখনও খোলা হয় না
তারা মৌমাছি বা তার সঙ্গে সম্পর্কিত
কোনো বিষয়ে কিছুই জানে না ,
তারা কেবল প্রতিক্রিয়াহীন এক ঘুমের পাহাড়কে চেনে ।
মৌচাক ভাঙা মৌমাছিরা
দরজায় দরজায় এল আশ্রয়ের জন্য ,
কার্ডিয়াক-চর্চাহীন এ পাড়ায় কেউই
তাদের আমন্ত্রণ জানাল না চায়ের টেবিলে ।
নিজেকে অপ্রিয় করে
নিজেকে অপ্রিয় করে তোমাদের চোখে
দাঁড়িয়ে রয়েছি এই অনতিদূরেই ,
বুঝে নিতে চাইছি বন্ধু কীরকম লাগে এই খেলা ।
কতটা হাতুড়ি ঠিক সহ্য হয় আমাদের সামান্য প্রেমে ,
রোষের কামারশালে কতক্ষণ টিকতে পারে প্লাস্টিক-মন।
আমার শরীর থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে বেড়াই ,
দেখতে চাই অতিষ্ট হওয়া কত দ্রুত শিখে নিতে পারো।
এত এত রঙ আছে পৃথিবীতে
শুধুমাত্র সফেদ সাজ পছন্দ হয় না আর ,
কালোকেও একবার সাধ হয় আলিঙ্গন দিতে ।
আমার কর্কশবাক্যে নাইই যদি খুশি হও নাইই হবে ,
অখুশির বিভা লাগলে
তোমাদের জামার প্রিন্ট কীরকম হয় , জানা হবে ।
আমি যদি একবারও বিষদাঁত ব্যবহার করি , দেখা হবে
মৃত্যুর ঠুনকো ঘায়ে
তোমাদের অমিয়-রূপ কতটুকু টেকে ।
চলো সূর্যের সঙ্গে
চলো , সূর্যের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে আসি ।
অস্থির ভেতর যত জড়তা ,দুর্বলতা ,অভিমান সঞ্চিত হয়েছে ;
তার কাছে বিস্তারিত বলি সেইসব।
কতদূর যাওয়ার কথা ছিল আমাদের এই মানুষ-জীবনে,
কতটুকু যাওয়া হল ,
বাকি রয়ে গেল আরও কত বেশি ,
সেইসব নিয়ে সফেন আত্মস্মৃতি লিখে লাভ নেই।
চলো , তাকে সব খুলে বলি ।
সর্বাঙ্গ দিয়ে যদি তাকে করি আলিঙ্গন ,
সে তার উষ্ণতা দিয়ে আমাদের সব অপারগতা
ছাই করে দেবে ।
আর কোনো যন্ত্রণা , কোনো অনটন
আমাদের ভাঁড়ারের বাড়ন্ত সামর্থ্য নিয়ে
ব্যঙ্গ করতে সাহস পাবে না ।
চলো , সূর্য-সঙ্গমে কিছু রতি
যথাযথ ব্যবহার করি ।
ওহে নিশ্চয়তা ,আর কতদূরে
ওহে নিশ্চয়তা , আর কতদূরে তুমি ঘাপটি মেরে আছ ?
পৃথিবীর সব পথ হাঁটতে হাঁটতে শেষ হয়ে এল ,
ঠিকানা কি কোনোদিন পরিচিত হবে না আমার সঙ্গে
এ জীবনে ?
মধ্যাহ্নে ছাদের কার্নিশে বসে
বিজাতীয় পরিচয়হীন দুটো পাখি
পরস্পরের কথা নিজ নিজ বোধ দিয়ে বুঝে নিচ্ছে ঠিক ,
তাদের তো ধরা দাও তুমি সহজেই আপন গরজে।
ভাষা দিয়ে তৈরি হয় আমাদের যত ভালোবাসা ,
ভাষার অভাবে তারা মারা যায় ইতিহাস জুড়ে ।
এই নিয়তির অন্য কোনো অন্যথা হবে কি কখনো ,
নিশ্চিত বাড়ির খোঁজ আসবে কি আমাদের কাছে ?
দিশারী মুখোপাধ্যায়
আশির দশকের কবি হিসাবে পরিচিত । মূলত ছোটো এবং অখ্যাত কাগজের লেখক । প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৮ । এছাড়াও ২০২৩ প্রকাশিত হয়েছে কবিতা সংগ্রহ প্রথম পর্ব । কর্মজীবনে ডাকঘরের কর্মচারী । ২০১৬ তে স্বেচ্ছায় অবসর । মাঝে গদ্য ,গল্প লিখলেও তা সংগ্রহে রাখতে অনাগ্রহী। কবিতা নিয়েই নীরবে থাকতে চাই । জন্ম হুগলির উত্তরপাড়ায় । স্থায়ী নিবাস পূর্ব বর্ধমান । বর্তমান নিবাস পশ্চিমবর্ধমান ।