spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধকবি নাসের হোসেন দীর্ঘ কবিতা যাপনে নির্মাণ করেছেন এক অলৌকিক সাঁকো

লিখেছেন : আবু রাইহান

কবি নাসের হোসেন দীর্ঘ কবিতা যাপনে নির্মাণ করেছেন এক অলৌকিক সাঁকো


আবু রাইহান

বাংলা ভাষায় আশির দশকের অন্যতম প্রধান কবি নাসের হোসেন বাংলা কবিতায় নিজস্ব একটি জগত নির্মাণ করতে পেরেছেন! যেখানে ভিন্ন , ভিন্ন বাকভঙ্গিমা ,নতুন বিষয়বস্তু আর সেইসঙ্গে মহৎ কিছু অনুভূতি কবিতায় উপস্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিলেন! যা তাঁর কবিতাকে মহৎ উত্তরণের পথে নিয়ে গেছে!জীবজগতের যা-কিছু বৈপরীত্য সেসবকে একসূত্রে গেঁথে বেঁধে জীবনের প্রবহমানতার সঙ্গে মিশিয়ে নাসের হোসেন বাংলা কবিতায় নির্মাণ করেছেন স্বতন্ত্র, আশ্চর্য এক কবিতা জগত। সহজ সত্য সুন্দরের মত বিরাজিত এই কবির মাথার উপরে বিস্তৃত এক ব্রহ্মাণ্ড, চারপাশে দিগন্তরেখা ছুঁয়ে গভীর শূন্যতা। অথচ তিনি কখনোই ব্রহ্মাণ্ড ও শূন্যতা নিয়ে ‘অপার হয়ে বসে’ থাকেননি। তাঁর দীর্ঘ কবিতা যাপনে তিনি তৈরি করেছেন এক অলৌকিক সাঁকো ।
“ভেসে আছি, ওই যে দূরে পৃথিবী, চাঁদ আর গ্রহতারকা
হাতের দিকে তাকালাম- শূন্য। পায়ের দিকে তাকালাম- শূন্য।”
(শূন্য)
নিজের কবিতায় যেমন ছিল তাঁর মৃদু উচ্চারণ, তেমনি জীবন যাপনে ছিলেন শুভদ্র,মৃদুভাষী ,শান্ত অথচ আত্মপ্রত্যয়ী!সব কবির জীবনেই স্বপ্ন ও শূন্যের মধ্যে এক বিস্তৃত প্রাঙ্গণ অনাবৃত পড়ে থাকে! সব সাধ রূপ পায় না! আবার সব শূন্য ও ফাঁকি হয়ে যায় না! কবি নাসের হোসেন তাঁর কবি জীবনের অধরা মাধুরী প্রসঙ্গে এক স্বাক্ষাৎকারে বলেছেন- ‘স্মৃতি ও শূন্যতা! যে কোনো ভালো কবিতার ভিতরে সব সময় ক্রিয়া করে এর অভিঘাত! শিল্পকে তার জমাট দমবন্ধতা থেকে মুক্তি দেয়! যার ফলে হাওয়া বাতাস খেলে! খেলতে থাকে কুয়াশার নিভৃত ব্যাপ্তি! শিল্প তার একরূপতা থেকে এগিয়ে যেতে পারে বহুরূপতার দিকে! এক ধরনের অন্তর্হিনতা সারা শরীরে! কবিতার সীমার মধ্যে অসীম বিচ্ছুরিত হয়! কবিতা এভাবেই গড়ে উঠতে চেয়েছে আমার হাতে! নানান ভাবে রূপ পাল্টাতে চেয়েছে, গতি পাল্টাতে চেয়েছে! নদীর মতো! আমি নিজেও একটা প্রবহমান নদীর মতো সেইসব নানা রূপ ও গতিকে নিয়ে ক্রমাগত বয়ে গেছি! বয়ে যেতে চেয়েছি!’
“বৃক্ষের পাশে দাঁড়িয়ে আছে পা, চতুর্দিকে
ঝরে যাচ্ছে বৃষ্টি, অবিশ্রাম….
প্রতিটি মুহূর্তের মধ্যে বয়ে যায় হাড়গোড়, কার্বনকনা…
মাথার উপর আরো বেশি কানায়-কানায় জমে ওঠে জল…
অন্ধকারে পিঁপড়েরা সারিবদ্ধ ভাবে বের হয়ে আসে-
যেন স্মৃতি, স্মৃতির অবগুণ্ঠনে তেজস্বী স্তব্ধতা!
হায়, মানুষের কত রকম রূপ থাকে, কত পিচ্ছিল সাধ!”
(অবগুন্ঠন)
কবি নাসের হোসেনের জন্ম 2 জানুয়ারী 1958 সালে কলকাতায় (মৃত্যু 9 নভেম্বর 2020)!কলকাতায় কর্মরত থাকলেও শৈশব-কৈশোর স্কুল কলেজ সবই কেটেছে বহরমপুরে!নাসের হোসেন শুধু কবি নন, চিত্রশিল্পীও ছিলেন! তাঁর একক চিত্র প্রদর্শনী হয়েছিল 1984 সালে কলকাতার বিড়লা অ্যাকাডেমিতে!কলেজে পড়ার সময় ‘দ্য লাস্ট পেজ’ নামে একটি দ্বিভাষিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন! দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময়
ধরে ‘কবিতা পাক্ষিক’ পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন!
তাঁর প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা 26 টি!
তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: ‘অপারেশন থিয়েটার’(1990)! পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ গুলি হল-‘ডানা’(1994), ‘জামার ভুবন’(1994), ‘কৃষ্ণগহ্বর’(1995), ‘আলপিননামা’(1996), ‘গ্যাব্রিয়েল’(1997), ‘জবরদখল’(1998), ‘ছায়াপুরাণ’(2000), ‘কপিলা ও পিতৃতন্ত্র’(2001), ‘আছে এত’(2002), নির্বাচিত কবিতা-প্রথম খন্ড(2004), ‘কিছুদিন, তবেই’(2006), ‘কোমা, অন্তিম পর্যায়’(2006), ‘প্রেম পদাবলী’(2006), ‘বেঁচে, বর্তে’(2006), ‘দ্রাবিড় সোনাটা’(2009), ‘স্ক্র্যাপস অফ স্কুলবুকস’(2009), ‘লাফ’(2012), ‘শো-কেস(2013), ‘ইষ্টিকুটুম বেড়ালছানা’(2014),’এগারো লাইনের কবিতা’(2014), ‘কথা আছে, ধ্বনিও আছে’(2015), ‘জিমন্যাশিয়াম’(2015), ‘লহমা’(2015), ‘আবার অপেরেশন থিয়েটার’(2016), ‘ছায়ালাহারী সিরিজ ও অন্যান্য কবিতা’(2017), ‘ফেটে যাওয়া গ্রহ’(2017), ‘মিশে থাকা দৃশ্য সিরিজের কবিতা’(2018), নির্বাচিত কবিতা-দ্বিতীয় খন্ড(2019)! কবিতা লেখার পাশাপাশি কবিতা চিত্রভাস্কর্য নিয়ে গদ্য লিখছেন।
তাঁর কবিতায় উপজীব্য মানুষ এবং মাটি ।তাঁর কবিতার অনুভবে উচ্চারিত হয়েছে আনন্দ- বেদনা, সুখ-দুঃখ, জীবন-মৃত্যু, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস এবং আলো-অন্ধকার।কবি নাসের হোসেনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অপারেশন থিয়েটার’ এর ব্লার্ব এ লেখা হয়েছিল- ‘এই কাব্যগ্রন্থটি গ্রথিত হয়ে রইল এই সময়ের স্বপ্ন ও শূন্যতা! সংশয়দীর্ণ মানষ ভূমন্ডল! অপারেশন থিয়েটারের সার্জারিতে উন্মুক্ত ক্ষোভ ও ভালোবাসা, ঘৃণা ও প্রেমের আশ্চর্য দোলাচল! আধুনিক অমঙ্গলবোধের পাশেপাশেই এক তীব্র শুভবোধের অভ্যুত্থান!’
“অন্ধকারের মধ্যে যে আলো
আমি তার অনুসন্ধানে আছি।
গাছের ভিতরে যে অনুভব, পাথরের ভিতরে
যে অনুভব আমি তার অনুসন্ধানে।
হঠাৎ দু হাত টুকরো হয়ে গেলে
কীভাবে মানুষ বেঁচে থাকে,
এ এক অনন্ত জিজ্ঞাসা।
প্রতিটি কোষের মধ্যে যে জীবন-স্পৃহা
তাকে আমি প্রণাম করেছি।”
(স্পৃহা)

তাঁর কবিতা বিবৃতিমূলক, টানা গদ্য ফর্মে লেখা!বাংলা কবিতার প্রচলিত ও জনপ্রিয় পংক্তি বিন্যাস রীতি থেকে কবি নাসের হোসেন সরে গিয়েছিলেন।
“আমরা যা কিছুই দেখি তার সংখ্যা অসীম
তার মানে প্রতিটি জিনিসেরই কোনো সীমা-পরিসীমা নেই
এইমাত্র যে জিনিসটা দেখা গেল বা জন্মগ্রহণ করলো
আসলে সে অজস্র
আমাদের চোখ তো পুঞ্জাক্ষি নয়, এমন কী ইন্দ্রের মতো
সহস্রলোচনও নয়
তবু তা দেখতে পায়, ইচ্ছে করলেই দেখতে পায়
চারপাশের এই শত সহস্র অভিযান
তা দৃশ্য হোক বা অদৃশ্য”
(অগণ্য)
তাঁর কবিতা স্টান্টবাজির চমক থেকে মুক্ত। তিনি যা দেখেছেন,যা কিছু ঘটছে, সেগুলোকেই তিনি এক মরমিয়া সাধকের মত কবিতায় লিরিক্যাল রূপ দিয়েছেন।
“এখন কি পাতা খসানোর পালা,ওই তো গাছেরা
তাদের বাকল ছেড়ে দিচ্ছে,পাতা ছেড়ে দিচ্ছে
পাতা ছেড়ে দেওয়ার দৃশ্যটাও সত্যি অদ্ভুত সুন্দর
অনর্গল গাছেদের উপর থেকে নেমে আসছে
শুকনো পাতাদের অবতরণমালা,এবং সে অবতরণ
নিহিত নিশ্চুপ, তুমি এসময় কথা বলো না,শুধু দ্যাখো
হঠাৎই মনে হল, পাখিরা সব গেল কোথায়,কোন্
দূর দেশে,একটু আগেও তাদের কণ্ঠ
শুনতে পেলাম মনে হল।”
(পাতা খসে পড়ছে)

কবি নাসের হোসেন ছিলেন অকৃতদার! তাঁর যাপিত জীবনে ছিল শুধু কবিতা আর চিত্রশিল্প নির্মাণ! তাই তিনি ‘আকাশ কিংবা সমুদ্র’ নামক কবিতায় সাহস করে বলতে পেরেছিলেন-
“আমার সঙ্গে সব সময় একজন নারী থাকে
অনেকেই বলে সব সময় নারী, এটা কীরকম যেন?
আমি বলি, নারী তো থাকবেই, তোমরা তো বলেই থাকো
নারী অর্ধাঙ্গিনী- সুতরাং অর্ধেক শরীর নিয়ে কী করে
হাঁটি চলি?
আমার সঙ্গে সব সময় একজন নারী থাকে
চার হাত চার পা একত্র হলে তবেই না
সম্পূর্ণ মানুষ-”

তাঁর কবিতায় স্বেচ্ছাকৃতভাবে কবিতাকে কঠিন করার প্রবণতা নেই! কবিতা তার নিজস্ব আদলে ধরা দেয়! মানুষের জীবন চেনা ও অচেনা, নির্দিষ্ট ও অনির্দিষ্ট উপকরণ দিয়ে তৈরি! কবি নাসের হোসেন তাঁর কবিতায় অনেক সময়ই আশ্রমিক পৃথিবী থেকে সংকেত পৃথিবীর দিকে চলে গেছেন! তাঁর কবিতায় কোমল পরিবেশের ভিতর দিয়ে পাঠকেরা এক দুর্নিরীক্ষ্য জীবনবোধের দিকে চলে যেতে পারে!নিজের কবিতা বিষয়ে কবির বিশ্লেষণ ছিল, ‘আশ্রমিক বা গার্হস্থ্য পৃথিবী থেকে আমার সরে যাবার কোনো বাসনা নেই! শুধুমাত্র সংকেত আমার কাছে কষ্টকর অভিজ্ঞতা হবে, যদি সেখানে মানুষের স্পর্শ না থাকে! এই রূপ রস গন্ধের পৃথিবীতে মানুষের হাসি, মানুষের কান্না, নানান চিত্রকল্পে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়! আর এই প্রতিষ্ঠা আমার বিশ্বাস আমার কবিতায় কিছু কিছু বদল নিয়ে আভাসিত হতে থাকে! এভাবেই আমার আগের কবিতা থেকে পরের কবিতায় অনেকখানি তফাৎ দেখা যায় ভাষা ব্যবহারে, চিত্রকল্প রচনায়!… আমি সব সময় চেয়েছি আমার দেখা পৃথিবীর সঙ্গে না দেখা পৃথিবীকে মেলাতে! আমার মানষ-অভিজ্ঞতার ভান্ডারটিকে উজাড় করে নানান রঙে ভরিয়ে তুলতে বিশাল ক্যানভাসে! সেখানে রঙের পাশেই থাকছে বে-রঙ, বস্তুর পাশেই থাকছে শূন্যতা, স্মৃতিও স্বপ্নের মৌন মিশেল!’
“সকলকে আমার রক্তাক্ত ভালোবাসা
দিয়ে যেতে চাই!
কোন সম্পর্কই সম্পর্ক নয়
শুধু এক উপলব্ধি, দহন!
বুকের ভিতর পুড়ছে ধুপগন্ধ
ধাক্কা মারছে শরীরে!
একটু পরেই দগ্ধ গলিত শব
ভেসে যাবে নীল দরিয়ায়!
সম্পর্ক বলে কিছু নেই
শুধু আছে ধুপগন্ধ! আর
একটা পাহাড়ের স্বপ্ন
যা মাঝে মাঝেই ধাক্কা দেয়, যেখান থেকে
শেষ পর্যন্ত ছুড়ে দেওয়া হবে আমাকে
সমুদ্রের ফেনায়!”
(সম্পর্ক)
‘সুন্দর কে সব সময় নতুন করে নির্মাণ করে যেতে হয়! সুন্দর আসলে মহাসমুদ্রের বিশালতায় ব্যাপ্ত, অধরা মাধুরীর মতো! শিল্পী তার থেকে কণামাত্র সংগ্রহ করতে পারেন! এভাবেই পূর্ণতা ও অপূর্ণতার খেলা ক্রমান্বয়ে ক্রিয়াশীল থাকে, থাকতে চায়!’
“আমরা দুই ভবঘুরে অনেক দেশ ঘুরে
শেষ পর্যন্ত হাজির হলাম ভারতবর্ষে
আমি বললাম এখানে একটা শানদার মন্দির বানাবো
তুমি বললে, এখানে বরং হোক একটা বিশাল মসজিদ
আমি মুসলমান আর তুমি হিন্দু
তাতে কী, আমাদের চাওয়াটাই এমন উদ্ভট
মুসলমান চাইছে মন্দির,আর হিন্দু চাইছে মসজিদ
কিন্তু আমাদের হাতে ছিল আরো অনেক কাজ
মাঝে মাঝে মন্দির ও মসজিদের প্রসঙ্গ যে উঠত না এমন নয়
তবু তা ওই পর্যন্তই, আমরা চাষবাসে প্রযুক্তিবিদ্যায়
চিকিৎসায় জ্ঞান-বিজ্ঞান সৌন্দর্যের অধিকারে
নিজেদের ক্ষমতা বারংবার প্রমাণ করলাম
গ্রামে গ্রামান্তরে পৌঁছে দিলাম শিক্ষার উজ্জ্বল আলো
আর প্রতিটি দেহে যুক্তির জাদুকাঠি ছুঁইয়ে করে তুললাম স্বাস্থ্যবান
এখন আমাদের সমস্ত কিছুই বড় কর্মমুখর ”
(ভারতবর্ষ)
অনেকেই কবি নাসের হোসেনকে শুধুমাত্র পোস্টমডার্ন কবি হিসেবে চিহ্নিত করতে চান!যাঁরা এই ধরনের তকমায় বিশ্বাস করেন,তাঁরা আসলে কবি নাসের হোসেনকে সমগ্রতার পরিবর্তে খন্ডিত রূপে দেখতে চান।একথা সত্য তিনি পোস্টমডার্ন কবিতা আন্দোলনের পথিক ছিলেন! সেইসঙ্গে কবিতা নিয়ে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠেছিল! এ বিষয়ে কবির নিজস্ব বক্তব্য, ‘কবিতা লেখা বা যে কোন শিল্প সৃজন মানুষের জন্য! এই মানুষ কারা? যাঁরা কবিতাটা অনুভব করেন, শিল্পটা অনুভব করেন!কেননা অনুভব করাটা প্রধান ব্যাপার! কবিতা বা শিল্প হচ্ছে যাঁরা এটাকে অনুভব করেন তাঁদের জন্য! একজন কবির প্রথম পাঠক তিনি নিজে! এর পরেই তিনি খোঁজ করেন নানান ছোট-বড় পত্রপত্রিকা, যাদের মাধ্যমে বেশকিছু পাঠকের কাছে পৌঁছে যেতে পারেন! এখানে মাধ্যম হিসেবে বেশিটাই লিটিল ম্যাগাজিন, তারপরেই বাণিজ্যিক কাগজ! ভালো কবিতার প্রকৃত পাঠকের সংখ্যা চিরকাল কম! একজন সত্যিকারের সৃজনশীল কবি চিরকালের পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রত্যাশী, নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচনের কারিগর! আমি কতটা সফল তা জানি না! শুধু এটুকু জানি শুরু থেকেই আমি কোন পত্র-পত্রিকাকে অগম্য মনে করিনি! এটাকেই যদি সর্বজনগ্রাহ্য হওয়া বলে ভেবে থাকেন, তা ভাবতে পারেন! তবে আমি সর্বজনগ্রাহ্য হব এরকম ভেবে কিন্তু লিখি না! কবিতায় আমি সব সময় নিজের কাছে বিশ্বস্ত থাকতে চেয়েছি!’
“চাবির আশেপাশে হাঁটি,যদি কোন তালা পাই ঢুকে যাব
খোলা-বন্ধ যাই হোক না কেন, চাবি যা এক অনন্ত মহিমা
কত কিছু খুলে দেয় বন্ধ করে দেয়,–
জানালার বাইরে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে চাঁদ, গোল,
মহামহিম– চাবির অদ্ভুত ছায়া তার বুক ভেদ করে চলে গেল, চারপাশে ঝরে পড়ছে ঢেউ, ঝরে পড়ছে ছাই ও ওষুধ,
তর তর তর তর বাতাস বইছে”
(ছাই ও ওষুধ)
বদলে যাওয়াটাই নিয়ম!কিন্তু সবটাই কি বদলায়?এমন কিছু থাকে সেসবের মধ্যে যা কখনোই বদলায়! না শত পরিবর্তনেও বদলায় না! সেটা হচ্ছে ভালোবাসা! ভালোবাসা কখনো বদলায় না! এটা শুধু বিশ্বাস বললে ভুল হবে, এটা আসলে অভিজ্ঞতা! মানুষ তার দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছি ভালোবাসার অপরিমেয় শক্তি, যা যে কোনো ধ্বংসের কবল থেকে উদ্ধার করে মানুষকে নিয়ে যায় শান্তির আশ্রয়ে! আসলে নাস্তিক বলে প্রকৃত অর্থে কিছু হয়না, সকলেই আস্তিক! জীবনকে যে ভালোবাসে সে যদি পৃথকভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব না-ই স্বীকার করে, জীবনকে ভালোবাসার কারণেই সে আস্তিক! আমি সারা জীবনে বহু নাস্তিক দেখেছি যাঁরা নিজেদের নাস্তিক ঘোষণা করে স্বস্তি পান, অথচ জীবনকে ঘোরতর ভালোবাসায় তাঁরা যে কোনো ঘোষিত আস্তিককে হার মানাতে পারেন!….শ্রেষ্ঠ গুণাবলী আরোপ করে মানুষ তৈরি করেছে তাঁর ঈশ্বর, একটি মহান অস্তিত্ব এবং না অস্তিত্ব! মানুষকে ভালো না বাসলে সে অস্তিত্ব অথবা না অস্তিত্বকে অনুভব করা যায় না! কবি তারই মত! নানান রূপকল্পে বারবার বদলে যায় পরিপার্শ্ব ও কবিতার চেহারা! কিন্তু হৃদয় যেন না বদলায়!মানুষ যেন চিরকালের মমত্বকে অনুভব করতে পারে!
“…………………………….শুভবোধ
এমনই একটা জিনিস যা বিনয়ের নির্মাণ করে
জগতের প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলে
যা বহুপূর্বে জন্মগ্রহণ করেছে অথবা সদ্য-সদ্য
জন্মগ্রহণ করলো, সব-সবকিছুর প্রতি শ্রদ্ধাবনত
থাকতে হবে, এটাই হচ্ছে ভালোবাসা, এটাই হচ্ছে
সুন্দর, এই ভালোবাসারই অপর নাম ঈশ্বর, তাই
কেউ যদি স্বঘোষিত নাস্তিকও হয়, সেও আসলে
জগতের সবকিছুকে ভালোবাসছে বলেই সব কর্তব্যগুলোকে
সমাধার প্রচেষ্টায় রত আছে বলেই, আস্তিক, আর
যে স্বঘোষিত আস্তিক সে আস্তিক্যের শত দাবি করলেও
যদি সে জগতের সমস্ত সৃষ্টিকে ভালো না বাসে
সংসার ও সমাজের করণীয় কর্তব্যগুলোকে না করে
তাহলে তার শত ইবাদাত-আচার সত্ত্বেও সে-ই প্রকৃত
নাস্তিক। আসলে ভালোবাসা আর নমনীয়তা আর
কর্তব্যবোধটাই হচ্ছে বড়ো কথা, সবচেয়ে বড়ো ইবাদাত।
আর, সবচেয়ে বড়ো ইবাদাত হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা
করা, ললিতকলার চর্চা করা, নন্দনতত্ত্বই রুচি গড়ে তোলে।”
(তিনি বলেছিলেন)
কবি নাসের হোসেন ব্যক্তিগত জীবন চর্চায় সারাক্ষণ কিভাবে প্রশান্ত মনে এবং সদা হাস্যময় থাকেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি প্রত্যেকেরই মধ্যে কিছু ভালো দ্বিগুণ দেখতে পাই!আর তাতেই সন্তুষ্ট থাকি! একজন মানুষ বহু রকম চেহারায় সজ্জিত! আমি এইসব চেহারা একটার পর একটা আবিস্কার করি, আর রোমাঞ্চিত হই! এবং শেষমেষ প্রত্যেকের মধ্যেই ভালোবাসাকে সনাক্ত করি! এই কারণেই হয়ত কেউ আমাকে ভুল বুঝে আমার সঙ্গে কথা না বললে আমার কষ্ট হয়! তাঁর সঙ্গে জোর করে কথা বলি! কেননা আমি বুঝি মানুষের সঙ্গে এই পারস্পরিকতা খুব জরুরী শিল্প রচনার ক্ষেত্রে!’
“ভুল হয়তো বা জড়িয়ে ধরছে চারপাশ, হয়তো এটাই সত্যি
আকাশে ঝিকমিক করছে যে তারাগুলো এবং চাঁদ-ওগুলো তো
ওরকমই নয়, একটি মিথ্যে দৃশ্য দেখে তাহলে এতখানি শিহরিত
হতে হয়, হওয়া যায়, তাহলে এর থেকে বড় শক্তি আর কী হতে
পারে, সুতরাং ওটাও সত্যি, সমস্ত মিথ্যে আর সত্যি মিলিয়ে
কোনো বড়ো সত্যি, সত্যি কত বড়ো হয়, মিথ্যে কত বড়ো হয়,কে
কতখানি বুক ভেঙে দিতে পারে, কে কতখানি উল্লসিত করতে
পারে, এত প্রেম ছড়িয়ে আছে, এত অপ্রেম ছড়িয়ে আছে, চারিদিকে”
(আছে, এত)
কবি নাসের হোসেনের এই চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্য ও শিল্পসংস্কৃতির বিস্তৃত প্রাঙ্গণ থেকে চিরতরে হারিয়ে গেল একটা সদাহাস্যময় দয়ালু মায়াময় মুখ । সাহিত্যের বিশুদ্ধ ধারার মহৎপ্রাণ কবি নাসের হোসেনের প্রয়ানের সাথে শেষ হয়ে গেল বাংলা কবিতা চর্চার একটি অধ্যায়!তাঁর কবিতা পাঠের মধ্য দিয়েই আশির দশকের এই শক্তিশালী কবির সঙ্গে আমার আত্মিক পরিচয়! আমি তাঁর কবিতার মুগ্ধ পাঠক!
দৈনিক দিনদর্পণ পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় বছর দুই আগে স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে আধুনিক মুসলিম কবিদের নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে কবি নাসির হোসেনের প্রকাশিত সমস্ত কাব্যগ্রন্থ গুলির কবিতা নিবিড় ভাবে পাঠ করতে হয়েছিল! যা তাঁর কবিতার প্রতি আমার মুগ্ধতাকে আরো বাড়িয়ে তোলে! দৈনিক দিনদর্পণ পত্রিকার সাহিত্য পাতার সম্পাদক হিসাবে তাঁর কাছে কবিতা চাওয়ার সূত্রে প্রিয় কবি নাসেরদার সঙ্গে প্রাথমিকভাবে ফোনে আলাপ হয়েছিল! পরবর্তীতে কলকাতায় এক সাহিত্যের অনুষ্ঠানে মুখোমুখি আলাপ হওয়ার পর আন্তরিক ভালোবাসায় তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন! ফেসবুকে তিনি আমার সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন! ফেসবুকের মেসেজ বক্সে কবিতা চেয়েও সঠিক সময়ে না পাওয়ার অভিযোগ করায় নাসেরদা বলেছিলেন, ‘আমি আসলে নিয়ম করে ফেসবুক দেখিনা! যখন তোমার কবিতার দরকার হবে আমাকে ফোন করবে, আমি ঠিক কবিতা দিয়ে দেবো!’ নাসেরদা তাঁর কথা রেখেছিলেন! এরপর থেকে নাসেরদা কাছে ফোনে কবিতা চাইলেই তিনি হোয়াটস্যাপ এ আমাকে কবিতা পাঠাতেন! আমাদের দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় এ মাসের কবি শিরোনামে নাসেরদার পছন্দের একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল! অসুস্থ অবস্থায় মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা হতো! বলতেন পনেরো দিন ছাড়া ছাড়া হাসপাতালে চেকআপে যাওয়ার বিড়ম্বনার জন্য কলকাতা ছেড়ে কোথাও যেতে পারছেন না! আমাদের মত তাঁর অনুজ গুণগ্রাহীরা নিশ্চিত ছিলাম নাসেরদা সুস্থ হয়ে আবারও স্বমহিমায় কবিতার জগতে ফিরে আসবেন! হায় আমাদের নিঃস্ব করে অমোঘ মৃত্যু আমাদের প্রিয় নাসিরদাকে নিয়ে অনন্তকালের জন্যে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছে! আর বিশুদ্ধ সান্তনার মতো তিনি আমাদের কাছে রেখে দিয়ে গেছেন তাঁর কবিতার মায়াময় ভুবন!
“যেতে পারো, তবু যেতে পারো না, এখন তুমি যে পরিসরে
অবস্থান করছো সেখানকার সব কাজ সব কর্তব্য
সমাধা না করে তুমি যেতে পারো না, একটা পরিসরের
কাজ শেষ করে, সুষ্ঠুভাবে শেষ করে, তবেই পরবর্তী
পরিসরে ঢোকা, তা নইলে সব কাজই থেকে যাবে অসমাপ্ত
আর সকলেই জানে, অসমাপ্ত করে রাখা মোটেই
মানুষের পক্ষে সমীচীন কাজ নয়, তবু কিছু
অসমাপ্তি থেকেই যায়।”
(কিছু অসমাপ্তি)

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ