হাফিজ রশিদ খান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে (১৮৬১-১৯৪১) একাল কী চোখে দেখছে? কেবল বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের নয়, সামগ্রিকভাবে গোটা ভারতের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী, ভাষাভাষী, সংস্কৃতি ও সভ্য সহবতধারী একালের জনমানুষের মনের ভেতরে প্রশ্ন ও আগ্রহভরা আবর্তিত চোখগুলোর ভাষার কথা এ প্রসঙ্গে ভাবা যায় নিশ্চয়। সম্প্রতি ভারতের ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল কিংবা হিন্দুত্ব বা জনতোষণবাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি’র এক নেতা রবীন্দ্রসাহিত্যের বিরাজমান ও সুদূরপ্রসারী মানবীয় এবং বঙ্গীয় জাতীয়তাবোধের গুণাবলির সমালোচনা করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। ওই নেতাটি হিন্দিভাষী হিন্দুত্ববাদী ধ্যানধারণার প্রবল ধারক-বাহক অর্থাৎ ওই রাজনৈতিক চিন্তার বিশ্লেষক। অন্যদিকে ওই বৃহত্তর ভারতেরই বাণীর অমৃতপুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষার বিশ্ববিশ্রুত কবির মর্যাদায় বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সংগীতের স্বতোৎসারী প্রণেতাই শুধু নন, ধর্মবর্ণগোত্রকাল নির্বিশেষে আদি ভারতীয় চিন্তাচেতনা ও সমৃদ্ধ দার্শনিক, উদাত্ত ঐশ্বর্যের গুরুত্বপূর্ণ, সৃজনশীল বিস্তারকারী ও নান্দনিক ভাষ্যকার বিশ্বপরিসরে।
উনিশ শতকে বহুবিশ্রুত ঔপনিষদিক ব্রহ্মজ্ঞানের নির্যাস থেকে রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) পৌত্তলিক হিন্দুধর্মীয় কাঠমোর বাইরে এসে নতুন ধর্মমত ‘ব্রাহ্মধর্ম’-এর আলোকে ১৮২৮ সালে ‘ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই ধর্মপথের মৌলনীতি ছিল ‘একোমাবো দ্বিতীয়ম’ অর্থাৎ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা এক, তাঁর কোনো দ্বিতীয় সত্তা নেই। পরবর্তীকালে রাজা রামমোহন প্রবর্তিত এই ধর্মমত ও আদর্শের উত্তরসূরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) হিন্দুধর্মের মূলভিত্তি ‘বেদ’-এর অভ্রান্ততা ও অপৌরুষেয়ত্ব অস্বীকার করেন। এই অস্বীকৃতির মাধ্যমে ব্রাহ্মসমাজ বা রামমোহন ও দেবেন্দ্রনাথের অনুসারীরা মূলধারা হিন্দুধর্মের আবহ থেকে বেরিয়ে আসেন। ১৯০১ সালে ব্রিটিশ-ভারতের প্রিভি কাউনসিল ঘোষণা করে যে, ব্রাহ্মরা হিন্দু নয়, তাঁদের নিজস্ব ধর্মীয় নীতি ও আনুগত্য রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমত ও প্রধানত তাঁর পিতৃপদাঙ্কের এই ব্রাহ্মধর্ম ও তার নীতি-আদর্শের কাব্যিক ও সাংগীতিক রূপকার ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে’র ‘একোমাবো দ্বিতীয়ম’-এর সম্ভ্রান্ত, বিশালায়ত অনুরণনের আর্তিকে কেন্দ্রে রেখে। বলা যায়, মৌলভাবে এই ব্রাহ্মত্ব ধারণ করেই ভারতীয়তার বিশ্ববিদ্যায়তনিক ও নিখিল সাংস্কৃতিক তথা সাহিত্যিক পরিচর্যার পসর প্রান্তরে রবীন্দ্রনাথ এককভাবেই সুপরিসর ভূভারতের এক ক্লান্তিহীন ‘পথিকপরান’। এ নিশ্চয়ই এতদিনে সর্বদিকের বিবেচনায় এক সুদৃঢ় ও গভীরতর প্রত্যয়। ভারতবর্ষীয় জাতপাতের অটল ইতিহাস-ঐতিহ্যের ওপর থেকে নিচের দিককার সমস্ত সম্ভ্রান্ত ও সন্তপ্ত কালপুরুষেরাও তাঁর চিন্তন ও সৃজনী প্রতিভার বাঁকে-বাঁকে হাজির থাকেন নিজেদের কালোত্তীর্ণ, কান্তিমান কলাসুন্দর ও ভাবনাবিভূতির মানবিক গরিমা ও আবেদন নিয়ে তাঁরই নিজস্ব অমল দ্যুতিভরা অক্ষয় বাচন ও রচনাসমগ্রে।
কিন্তু প্রসঙ্গটি নিয়ে ভাবতে-ভাবতে অনেকদিন কেটে গেল। কিছুতেই তা অক্ষরের ছাঁদে ধরা যাচ্ছিল না। এই অস্বস্তিকর ও ঔৎসুক্যময় যাপনের আঁধারে পূর্ণিমাবিভা ছড়ালেন যেন চিন্তক নন্দগোপাল সেনগুপ্ত। এই অধমের হয়ে তিনি যেন বলছেন : “রবীন্দ্রনাথ বাল্যে পিতার সাহচর্য থেকে উপিনষদের মর্ম-পরিচয় লাভ করেছিলেন, এ ত সুবিদিত ঘটনা। তাঁর সারা জীবনের রচনায় যে আনন্দবাদ, অনন্তবাদ, যে বিশ্বমৈত্রীবাদ পরিস্ফুট, তার মূলে যে উপনিষদ, এ কথা নিশ্চয় প্রমাণ করতে হবে না। আর যে নির্মুক্ত বিবেক ও করুণার, যে উদার মানবাত্মবাদের প্রচারকরূপে তিনি বিশ্ববিখ্যাত, তা তিনি আহরণ করেছিলেন বৌদ্ধ নীতিশাস্ত্র থেকে, এ-ও সম্ভবত বলে দিতে হবে না। তাঁর মধ্যমাগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ বুদ্ধজীবন ও বৌদ্ধশাস্ত্র বিষয়ে সুপণ্ডিত ছিলেন। তাঁর বুদ্ধকথা নামক এক কালপ্রসিদ্ধ বই-ই তার প্রমাণ। রবীন্দ্রনাথ কৈশোরে সত্যেন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সংস্রবে অনেকদিন ছিলেন। অনুমান করলে ক্ষতি নেই যে বৌদ্ধ জীবনদর্শনে তাঁর দীক্ষা হয় সত্যেন্দ্রনাথের কাছেই প্রথম। আর যে সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়া প্রতিদান, কামনাহীন প্রেমের বাণী তাঁর গানে ভাষা পেয়েছে, তা তিনি পেয়েছেন গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের ও উত্তর ভারতীয় সন্তদের কাছ থেকে, এ ত বলাই অনাবশ্যক। কম বয়সে লেখা ভানুসিংহের পদাবলী থেকে শুরু করে পরিণত বয়সের গীতাঞ্জলি গীতিমাল্য পর্যন্ত, সর্বত্র তাঁর প্রেম-সঙ্গীতে বৈষ্ণবীয় নতি ও আত্মসমর্পণের বাণী ধ্বনিত হয়েছে। বাউল ও উদাসী সম্প্রদায়ের প্রভাবও অল্প নয় তাঁর রচনায়। জগৎ ও জীবন রহস্যের ব্যাখ্যানে যে মরমিয়া তত্ত্বকে তিনি বারবার ব্যক্ত করেছেন, তার উৎস নিঃন্দেহে বাউল সংস্কৃতি।
জীবন ও মৃত্যুকে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন এক অফুরন্ত প্রাণপ্রবাহের লীলারূপে। প্রকৃতিকে দেখেছেন প্রাণসত্তার আধারীভূত এক অনন্ত শক্তিরূপে। প্রেমকে দেখেছেন সীমার বন্ধন থেকে অসীমে যাওয়ার সেতুরূপে। সুখ-দুঃখ হাসি-অশ্রু মিলন-বিরহকে দেখেছেন জীবন-সমুদ্রে ফেনায়িত বিচিত্র ভাবতরঙ্গরূপে। এ যে বিরতিহীন অম্লান-অফুরন্তের খেলা, এর পেছনে তিনি উপলব্ধি করেছেন এক লীলাময় জীবন-দেবতার অস্তিত্ব। এই জীবন-দেবতার স্বরূপ নিয়ে অনেক পণ্ডিতী তর্ক আছে। তিনি কি প্রকৃতির অন্তর্লোকে গুহায়িত অনির্বচনীয় প্রাণময়তা, বার্গসোঁ যাঁকে বলেছেন ‘এলান ভিটাল’, অথবা উপনিষদ যাঁকে সমস্ত জগতাধার ব্রহ্ম বলেছেন, তিনি? এ বিতর্কের সমাধানে শক্তিক্ষয় করে লাভ নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি সময় যে ভাববাদী চিন্তা ও জীবন-দর্শনের অনুগামিতা করেছেন, এ তারই অনতিক্রমণীয় প্রতিক্রিয়া, এটুকু বললেই যথেষ্ট হবে।”
:: ‘প্রাচীন ভারতীয় ভাবাদর্শ ও রবীন্দ্রনাথ’। রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ : রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রবন্ধ সংকলন। তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার। পৃ. ৬২-৬৩। প্রথম প্রকাশ : ২৫ শে বৈশাখ, ১৩৯৫।
এই উদ্ধৃতির মর্মতলে শায়িত সমন্বয়-সূত্রের প্রসঙ্গটির সামান্য বিস্তারের অভিপ্রায়ে এখানে যোগ করা অসমীচীন হবে না বোধ করি যে, রাবীন্দ্রিক মনীষা ভারতভূমির যে-মাতৃময়ীরূপের আল্পনা এঁকেছিলেন তাঁর প্রাতিস্বিক কাব্যে-সংগীতে, দর্শনচেতনায়, সুধীসমাজে উপস্থাপিত বিবিধ জ্ঞান ও প্রজ্ঞাময় অভিভাষণে– তাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দিশপাশ থেকে ভারতাগত নানা মানুষের মিলনের জয়গানও ধ্বনিত হয়েছে অকপট অভিব্যক্তিতে, যেমন :
কেহ নাহি জানে, কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা,
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা।
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন–
শক-হুনদল, পাঠন-মোগল একদেহে হল লীন।
পশ্চিম আজ খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার।
দিবে আর নিবে, মিলাবে-মিলিবে, যাবে না ফিরে–
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।
রণধারা বাহি জয়গান গাহি উন্মাদ কলরবে
ভেদি মরুপথ গিরি-পর্বত যারা এসেছিল সবে.
তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে, কেহ নহে, নহে দূর–
আমার শোণিতে রয়েছে ধ্বনিতে তার বিচিত্র সুর।
হে রুদ্রবীণা, বাজো, বাজো, বাজো
ঘৃণা করি দূরে আছে যারা আজো
বন্ধ নাশিবে– তারাও আসিবে, দাঁড়াবে ঘিরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।
:: ‘ভারততীর্থ’, সঞ্চয়িতা (১৯৫৫)।
এই অনুধ্যানের পথ ধরেই রবিঠাকুর ভারতের মোগল রাজবংশের অন্যতম প্রতাপশালী সম্রাট শাহজাহান (শাহাবুদ্দিন মুহাম্মদ খুররাম : ১৫৯২-১৬৬৬)-এর সুমহান ইহজাগতিক হৃদ্যকীর্তি ‘তাজমহল’ নির্মাণে তাঁর অন্তর্গত স্পন্দনের সুবেদী অনুভবকে কাব্যিকরূপ দিয়েছেন তাঁর বিখ্যাত ‘শা-জাহান’ কবিতায় :
এ কথা জানিতে তুমি ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান,
কালস্স্রোতে ভেসে যায় জীবনযৌবন, ধনমান।
শুধু তব অন্তরবেদনা
চিরন্তন হয়ে থাক্, সম্রাটের ছিল এ সাধনা
রাজশক্তি বজ্রসুকঠিন
সন্ধ্যারক্তরাগসম তন্দ্রাতলে হয় হোক লীন,
কেবল একটি দীর্ঘশ্বাস
নিত্য উচ্ছ্বাসিত হয়ে সকরুণ করুক আকাশ,
এই তব মনে ছিল আশ
হীরামুক্তামানিক্যের ঘটা
যেন শূন্য দিগন্তের ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধনুচ্ছটা
যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক
শুধু থাক্
একবিন্দু নয়নের জল
কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল এ তাজমহল \
:: শা-জাহান, সঞ্চয়িতা (১৯৫৫)।
দুই
উনিশ শতকে কলকাতাকেন্দ্রিক অর্ধস্ফুট নবজাগরণের অন্যতম ঋত্বিক কবি-গীতিকার ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (ডি এল রায়, ১৮৬৩-১৯১৩) ওই একই মহামানবের স্রোতে ‘শক-হুনদল, পাঠান-মোগল একদেহে হল লীন’ হবার এক অনিন্দ্যসুন্দর আখ্যানকে চিরস্থায়ীরূপ দিয়েছেন, বিশেষত মোগল-মাহাত্ম্যকে সসম্ভ্রমে গুরুত্বের অর্ঘ্য দিয়ে। তাঁর চিন্তা-চেতনায় তিনি যে অসাম্প্রদায়িক, সমসত্তাময় উদার মনন লালন করতেন তার পরিচ্ছন্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাঁর দুই বিখ্যাত নাটক ‘সাজাহান’ ও ‘নূরজাহান’-এ। এখানে তিনি নিজস্ব দৃষ্টিকোণে মোগল জমানার প্রখ্যাত রাজপুরুষ ও রমণীদের জীবনধারা ও অভিরুচির বিচার করেছেন ঠিকই কিন্তু তাঁদের ভারতসত্তাকে অবহেলা বা ‘অপর’ পরকলায় দূর থেকে দেখার মানসিকতা বর্জন করেছেন পুরোপুরি। বাংলা নাট্যসাহিত্যে ডি এল রায়-এর ওই দুটি নাট্যকর্মই অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বের তকমাধারী, বহুল মঞ্চায়িত ও সুধীজন সমাদৃত মনস্তাত্তি¡ক ঘটঘটার অপূর্ব চরিত্রায়ণের পারঙ্গমতায়। বস্তুত ডি এল রায়-এর উচ্চাঙ্গিক প্রবুদ্ধ ভারতীয় মননে ধর্ম, পরকাল ও দেবদেবীর স্থান ছিল গৌণ। সর্বমানবীয় সাযুজ্যের বোধ ছিল তাঁর সহজাত। ইতিহাসভিত্তিক নাটক রচনা করতে গিয়ে ইতিহাসের প্রতি দায়বব্ধ ছিলেন– চরিত্র বা ঘটনাবলয়ের দিকে অন্যায্য কালিমালেপন বা উপেক্ষার ভারে হেলে পড়েননি কোনো ধর্মবর্ণ-জাতপাতের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত দুর্বলতায়। মোগল সম্রাট আওঙ্গজেব (মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব : ১৬১৮-১৭০৭) প্রসঙ্গে তিনি লেখেন : ‘ঔরংগজীবকে আমি পিশাচরূপে কল্পনা করি নাই– যেরূপ টড ও অর্ম করিয়াছেন। আমি তাঁহাকে সরল ধার্মিক মুসলমান-রূপে কল্পনা করিয়াছি।’
ভারতের উত্তরপ্রদেশ– মুসলমান শাসনকালে যার নাম ছিল জৌনপুর– এখন যেটি হিন্দুত্ববাদের আধ্যাত্মিক রাজধানীর নামান্তর, তার সেকালের ইতিহাস জানাচ্ছেন সুবিখ্যাত ‘আকবর’ (মহান মোগল বলে পরীকীর্তিত সম্রাট জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর (১৫৪২-১৬০৫)-এর শাসনকাল ও জীবনী যেখানে বিধৃত) গ্রন্থের প্রণেতা, ভারতের রাষ্ট্রীয় ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৬৩) পদকে সম্মানিত বিশিষ্ট সাহিত্যিক, ভ্রমণবিদ ও ইতিহাসবেত্তা রাহুল সাংকৃত্যায়ন (১৮৯৩-১৯৬৩) : “অধুনা উত্তরপ্রদেশ ও উত্তর বিহারের অধিকাংশ অঞ্চল জৌনপুরের অন্তর্গত ছিল। মুহম্মদ বিন তুঘলক (শাসনকাল : ১৩২৫-১৩৫১)-এরই অন্যনাম জৌনা শাহ, তাঁর নামেই জৌনপুর শহরের প্রতিষ্ঠা। জৌনপুর মুসলমান শাহের রাজধানী। কিন্তু সেই বাদশাহী ব্যবস্থা এমন যে, তাতে হিন্দু-মুসলমান উভয়েই অন্তর্ভুক্ত ছিল। দরবারে হিন্দুরা সমান মর্যাদা লাভ করত। দিল্লিতে হিন্দুরা সেই মর্যাদা পায় দেড়শো বছর পরে, আকবরের আমলে, যখন তিনি নিজের হাতে শাসনক্ষমতার বল্লা তুলে নেন। পঞ্চদশ শতাব্দী জৌনপুরের আধিপত্যের শতাব্দী। জৌনপুর ভারতীয় সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। আওধী ভাষা ও সাহিত্যের সমাদর করেছে, তার প্রমাণ আওধী ভাষার প্রথম শ্রেষ্ঠকবি মঞন, কুতুবন, জায়সী জৌনপুরের দরবার অলঙ্কৃত করেছিলেন। জৌনপুরের শাসকেরা সকলেই মুসলমান ছিলেন। কিন্তু তাঁরা দেশের ভাষা, কাব্যশৈলী আত্মস্থ করেছিলেন। জৌনপুর হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। মুসলমানেরা নিজেদের অহংকার বিসর্জন দিয়েছিল। হিন্দুরা নিজেদের হারানো আত্মসম্মান পুনর্লাভ করেছিল। একপক্ষ একধাপ নিচে নেমেছিল, অন্যপক্ষ একধাপ উপরে উঠেছিল। উভয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল”।
এই সুবিস্তৃত সত্যসন্ধ ইতিহাসবোধ, দার্শনিকতা ও কল্পনা-মাধুর্যের সর্বপ্রশংসিত প্রতিভান্বিত ভারতীয়ত্বের সুষমা নিয়ে বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বজয়ী অধিষ্ঠান সম্পন্ন হয় ১৯১৩ সালে তাঁর নোবেলপ্রাপ্তির মাধ্যমে। সেই ঘটনার শতবর্ষেরও অধিককাল পেরিয়ে গেল। সেই সঙ্গে তিনি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অমোচনীয় চিরকালীন জ্যোতির্ময় পুরুষরূপে থিতু হয়ে আছেন প্রত্যেক বাংলাভাষীর অন্তর্লোকে। একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বৃহত্তর ভারতীয় জাতিসত্তারই সুদীপ্ত, বরেণ্য সন্তান। আবার জন্মসূত্রে ও ভাষা-সংস্কৃতির অধিষ্ঠানে একজন আপাদমাথা বাঙালি– এই বরাভয়ে ভারতবর্ষের বহুভাষিক জনপদের হিন্দিবলয়ের হিন্দুত্ববাদীদের কাছে একই সঙ্গে কিঞ্চিৎ ঈর্ষা, সম্ভ্রম ও দূরবর্তী মানুষও কি তিনি? তিনি তো আবার মনস্তাত্বিক গহনের কোনো এক স্তরে তাঁদের কাছে ভারতীয় সংখ্যালঘু ব্রাহ্মসমাজেরও সদস্য বা প্রতিনিধি! ব্রাহ্মদের উদার বিশ্বচেতনা, সুগভীর দেশপ্রেমিকতা, অপার-অসাধারণ সহনশীলতা, তাঁদের মনোলোকের স্বর্গোপম অবারিত আকাশ সীমায় মানুষ ও ভূমণ্ডলে স্থিত সকল প্রাণ ও জীববৈচিত্র্যের নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি যে-পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণ করেছে ইতিহাসের পাতায় তাতে রবীন্দ্রপ্রতিভা সাবলীলভাবে বিকশিত হলেও তাঁর সংখ্যালঘুত্বের ডানাই কি আজ তাঁরই পয়দার জন্মভূমে আক্রান্ত, খণ্ডিত হতে চলেছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, হিন্দুত্ববাদের খড়্গতলে!
চলমান ভাষাগত সাম্রাজ্যবাদের যুগে, যেখানে ধর্ম ও জাতিবিদ্বেষ তার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সেতুবন্ধনের সূত্রে, সেখানে রবীন্দ্রনাথ যুগপৎ এত দেদীপ্যমান মানবিক আর এত আলোকিত বাঙালি যে, তাঁকে খোঁচাতে ক্ষমতা নামক জন্মান্ধ, রক্ষণশীল যাগযজ্ঞের অরণি ব্যস্ত হতে চাইবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কারণ, ওঁরা তো চায়, ভূভারতের সকল সত্তা তাদের হাজার বছরের ধর্ম ও ধর্মকেন্দ্রিক বনেদি ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক-নান্দনিকতার সমস্ত শেকড়বাকড় উপড়ে একটি মাত্র অন্ধ, গণ্ডিবদ্ধ স্রোতোধারায় ঘুরপাক খেয়ে পড়ুক বহু দেবদেবীবেষ্টিত ধর্মাবতারগুলোর পদতলে। যার রাজনৈতিক নাম ‘হিন্দুত্ববাদ’। আর রবীন্দ্রনাথ সেখানেই প্রাতিস্বিক বুদ্ধত্বে ভাস্বরতার নিশানবাহী উজ্জ্বলতম ব্যতিক্রম। তিনি উদার, উন্মুক্ত আর পূর্ণমানবিক ধ্রুবনক্ষত্রসম খরশান আলোদায়ী। তাঁর রচনাবলি ও চিন্তার গ্রন্থিল আলয়ে তিনি তো মানবের বৈচিত্র্যময় অস্তিত্বের সপক্ষে উত্তম-অনুত্তম, উঁচুনিচু স্পষ্টকরণ আর সেই স্পষ্টতায় ইতিবাচকতার পক্ষেই প্রবল পৌরুষ নিয়ে দণ্ডায়মান।
তিন
অন্য আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে একাল কি হতে চলেছে মহত্বের, বিরাটত্বের বিরুদ্ধে সম্মিলিত ক্ষুদ্রের বৈনাশী সুনামির নাম? ভঙ্গুরতা আর হ্রস্বতার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রাণান্তকর চেষ্টার সময়ও বটে এটা। বিগতকালই যেন আজ মহত্বের শিরোপাধারী হয়ে একালের সৎচিত্তকে রিক্ততার অনুভূতিতে ভরিয়ে দিয়ে অঝোরে কাঁদাচ্ছে। দেশে-দেশে মহৎ মানবতার ভূলুণ্ঠন আর অবনমন আর সংকীর্ণতাকেই ইঙ্গিত করে যেন এই বর্বর, বুভুক্ষু, ঘাতকতাময় বাস্তবতা। আর ঠিক এখানেই তথাকথিত খল-প্রবঞ্চক বিশ্বায়ন-প্রপঞ্চ এখানে মুখ থুবড়ে পড়ে তার অসাড় অসারতায়। এ বিষয়েও সন্দেহ নেই যে, মানবজাতি নতুন এক মহাক্রান্তিকালে উপনীত হতে চলেছে এখন। একালের প্রধান ভাবনা কি তবে উত্তর-কাঠামোবাদ? যার তাত্ত্বিকেরা বলছেন, আগের কাঠামোবাদীরা কোনো কিছুকে উচ্চাঙ্গে পৌঁছে দেয় কিন্তু তারপরও যে আরও এগোনো যায়, তা নিয়ে ভাবে না। এ জায়গায় উত্তর কাঠামোবাদীরা বলেন– আরও এগোনো যায়। তাঁদের মতে ভাষা যেমন অভিজ্ঞতাকে রূপদান করে, তেমনি অভিজ্ঞতাও ভাষাকে রূপদান করে। তাঁদের আরও অভিমত, বিশ্বে বস্তুগত জিনিস আছে ঠিকই কিন্ত এগুলো অর্থধারণ করে কথাবার্তা বা আলাপচারিতা, ডিসকোর্সের মাধ্যমে জ্ঞানের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। উত্তর কাঠামোবাদীরা শুধু ভাষায় জোর না দিয়ে জ্ঞান ও ক্ষমতাকেও কাজে লাগানোর কথা বলেন। এসব তত্ত্বের উদ্গাতাদের কেউ-কেউ বলছেন, বিশ্বব্যাপী একটা বিরাট শামিয়ানার (তত্ত্ব) তলে জগতের সকল মানুষকে একত্র করবার কোনো ব্রত, মতবাদ বা লড়াই আর কার্যকর নেই কোথাও। ওই সম্ভাবনা নাকচ হয়ে গেছে সমাজতন্ত্রবাদের আপাত পতনের ভেতর দিয়ে। এখন সকলের তরে একটা-একটা ছোটো ছাতাই বরাদ্দ করা হোক। নানারঙে, নানাভাবে-ভঙ্গিতে ওরা নিজেদের মতো করেই বিস্তারিত হয়ে টিকে থাকতে চেষ্টা করুক। এই উত্তর-কাঠামোবাদী দাবানলেই কি পুড়ছে রবীন্দ্রভুবন, ভারতের গোঁড়া ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে? মানবতাবাদ আর অগ্রাবলোকী জাতীয়তাবাদ তাই কি উগ্র ধর্ম ও কালাপাহাড়ি ধর্মতত্ত্ববাদীদের রোষানলে দগ্ধ হচ্ছে? বহু আগে স্কটিশ কবি ইয়েটস তাঁর কবিতায় যেমন উচ্চারণ করেছিলেন :
Things fall apart; the centre can not hold:
Mere anarchy is loosed upon the world…
প্রথাবিরোধী চিন্তক হুমায়ুন আজাদও একদা সতর্ক করেছিলেন আমাদের, ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ বলে। এই নষ্ট কারা? যে-ধসের কথা কবি ইয়েটস বলেছিলেন, সেই ধসের মর্তবাই বা কী? নিঃসন্দেহে মানবজাতি চিন্তাজগতের নানাদিকের ভাঙনপ্রবণ আলোড়নে নতুন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়াতে চাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী নানা ভূরাজনৈতিক মেরুকরণ, নানা কিসিমের আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত সে-কথা বেশ জোরালো ভঙ্গিতেই জানান দিতে চাচ্ছে, সন্দেহ নেই। এ থেকে কাব্য, শিল্পকলা, দর্শন তথা মানব-মনীষার মঙ্গলময় প্রতিন্যাস সমূহও দূরে থাকতে পারছে না যেন। তবে রাজনৈতিক কুরুক্ষেত্রে সে কোন্ মন্ত্র, সে কোন্ শক্তিমত্তের দাপটে এই পরিবর্তন তার আভাস-ইঙ্গিত উল্লিখিত ঘটনাবলির আলোকে কিছুটা মালুম করা গেলেও, তার সার্বিক অবয়ব ও চরিত্র এখনও পষ্ট নয় তেমন, ফলে– ‘Mere anarchy is loosed upon the world …। বিশেষ করে এই দক্ষিণ এশীয় পরিমণ্ডলে তা দানবীয় আকার নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে এখানে বিচিত্র সব পশ্চাৎপদ ও গোঁড়া তত্ত্ব ও মতবাদের খোঁয়াড় গড়ে উঠেছে। এমনিতেই এখানে বিভিন্ন বৈনাশিক চিন্তনের জান্তব চোরাস্রোত নানা বঙ্কিম ও সূচালো মুখ নিয়ে বিদ্যমান ছিল সেই আদিকাল থেকেই। এসবের বিরুদ্ধে সংশপ্তক কায়দায় মননের-সৃজনের শস্ত্রে লড়েও গেছেন এই বৃহত্তর ভূখণ্ডের ধর্মবর্ণগোত্র-জাতপাত নির্বিশেষে অসংখ্য আলোকিত সন্তান। এসবের বিপক্ষেই সংবেদী-সপ্রতিভ, হাজার সুন্দর, সতর্ক-সশস্ত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারত তথা ভুবনজুড়েই এখনও আছেন প্রচিত মানবিকতার দিব্য ও আলোকিত আদর্শ হয়ে। তাঁরা থাকবেন এই ডামাডোলের ভেতরে চির নতুন অথচ চির কল্যাণীভাবনার সূর্যাবর্ত হয়ে। আমরা তার নাম রাখবো– রাবীন্দ্রিক বাংলায়ন– বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের আবহমান মনস্বিতায়, লোকায়ত সভ্যতার ধারা বরিষায়। নব্যকালের এই উদ্বেগভরা ভাবনার বিপ্রতীপ আলোকে যা দূষ্য তো নয়ই, বরং সর্বৈব নমস্য শরণ।