spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতাগুচ্ছ কবিতা : শাহীন খন্দকার

গুচ্ছ কবিতা : শাহীন খন্দকার

বাংলাদেশ একটা একাকি নিমগাছ
……..

বহুদিন পর আব্বা স্বপ্নে আসলেন। আড়মোড়া ভেঙে নামলেন খাটিয়া থেকে। আব্বা আমার দিকে তাকালেন। তাঁর চোখে ভীষণ ক্ষুধা। আব্বা কথা বলেন না। মৃত্যু থেকে জেগে উঠবার পর যেন তিনি বোবা হয়ে গেছেন।

স্বপ্নে তিনি তৃতীয়বারের মতো। আর বরাবরের মতো তাঁর কোন আদেশ আমার জন্য নাই। এবং বরাবরের মতো তাঁর চোখ আমার চোখে তাকিয়েই আছে। তাঁর চোখে রাজ্যের ক্ষুধা। আব্বা আপনি বসেন, আপনি বসেন আমার দস্তরখানায়। বহুরকম আপনার পছন্দের খাবারগুলো লাল নীল পটে রাখা আছে। আপনার সামনে পেশ করি।

ত্রিমোহনীর হাট থেকে গুড়ের জিলেপি কিনেছিলাম। আব্বা পছন্দ করতেন। সন্ধ্যায় ফেরার পথে তাজের মোড় থেকে জলিলের বারোভাজা আর সাধনকাকার চটপটি। আব্বার মৃত্যুর পর গরুর গোস্ত খুব একটা কেনা হয় না। সামর্থ্যে কুলোয় না। তবু কেন জানি গতকাল তাঁর প্রিয় গরুর গোস্ত ধারে কিনেছিলাম! আব্বা আপনি খান। আমার সকল বিনয় আপনার জন্য। আপনি খান এবং আদেশ করেন। আপনার একটা আদেশের জন্য আমার রুহ তেরটা বছর ধরে ক্রন্দনরত, আপনি জানেন?

আব্বা আপনি জানেন না, আপনাকে কেউ কেউ এখন বাংলাদেশ ভাবে। আপনি জানেন না, আপনাকে বাংলাদেশ ভাবলে আমি কতোটা দেশপ্রেমিক হয়ে উঠি। আপনার সবিনয় কন্ঠটা বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য বড়। সেই কন্ঠ আমাকে অমায়িক করে। আমি তাই রেহেলে আপনাকে রেখে পড়ি। আমি তাই রেহেলে বাংলাদেশ রেখে পড়ি।

আমি পড়ি- আব্বা পৃথিবীতে জন্ম নেয়া একটা একাকি নিমগাছ। কারা যেন তার ডাল ভেঙে নিয়ে যায়! আমি পড়ি- বাংলাদেশ পৃথিবীতে জন্ম নেয়া একটা একাকি নিমগাছ। কারা যেন তার ডাল ভেঙে নিয়ে যায়! সেখানে শাহীন নামের পাখিগুলো আর বসতে পারে না। সাথী কিংবা শাহনাজদের জন্য তার আর কোন সবুজ থাকে না।

বহুদিন পর আব্বা স্বপ্নে আসলেন। বহুদিন পর বাংলাদেশ স্বপ্নে আসলেন। আড়মোড়া ভেঙে নামলেন খাটিয়া থেকে। তার চোখে ভীষণ ক্ষুধা…

আহা স্বপ্নগুলোই পরমাত্মীয়। আহা পরমাত্মীয় স্বপ্নগুলো! স্বপ্নগুলো ভেঙে গেলে আব্বাকে দেখি না। তাঁর কবর দেখি। স্বপ্নগুলো ভেঙে গেলে বাংলাদেশ দেখি না। তার কবর দেখি।

…….
রোডম্যাপ
……..

বধুর ওষ্ঠের মতো লোভ নিয়ে সূর্যাস্তে আছি
আমি জানি এভাবেই প্রতীক্ষা করতে হয়…

সভ্যতাকে সভ্য পোশাকে চিনবো বলে
বাজার থেকে কিনে আনি প্রথম সূর্যের মতো জামদানী সুতো
পাইজাম চালের মতো ফুরফুরে সুঁচে সেলাই চলুক…

একটা পোশাক তৈরি হবে মানবিক!

যার হাত হবে খোরাসানের… সেলাই চলুক।
গলা হবে গাজা কিংবা নাজাফের… সেলাই চলুক।
সিনা হবে রামাল্লার… সেলাই চলুক।
আমি এ পোশাক পড়েই হবো জাতিসংঘের মহাসচিব।

তারপর আমি হেটে যাবো সাবসাহারার দুই লক্ষ কুড়ি হাজার নরকঙ্কাল পায়ে মাড়িয়ে, দেবদূতের মতো আমার হাতে থাকবে লোভনীয় রুটির গন্ধ। মেঘের দঙ্গল থাকবে চোখের মোড়কে। তারপর- আমি হেটে যাবো মায়ের মুখের মতো রূপকথা নিয়ে আল-আকসার মহাবিহ্বল প্রান্তরে। সেখানে প্রণয়ের গজল রোপন করে সিত্তুই আর কিরকুকের মহাহিংসা আমি মুখস্থ করতে থাকবো। আমি মুখস্থ করতে থাকবো আমার পিতার হিস্যার দলিল। সবুজ জরায়ুর আয়ুগুলো, বিপর্যস্ত রক্ত-মাংশের ভূমিগুলো আমি মুখস্থ করতে থাকবো। আমি মুখস্থ করতে থাকবো নিপীড়িত আগুনের বিদ্যা। তারপর …

একটা পোশাক তৈরি হবে আনবিক!

যার হাত হবে হোয়াইট হাউসের… সেলাই চলুক।
গলা হবে ব্রিটেনের… সেলাই চলুক।
সিনা হবে তেলআবিবের… সেলাই চলুক।
আমি সে পোশাক না পড়েই হবো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৈনিক।

জেনে রেখো আজীবন বিক্ষুব্ধ কবিই একদিন ট্রিগার টেনে দেবে।

…….
এপিটাফ
……..

[ট্রেনটি চলে গেলে আমরা জানতে পারি, সে আত্মাহুতি ছিল সন্তান কর্তৃক প্রহৃত মা’র মৌন প্রতিবাদ]

দ্রুতযান চলে গেলে কাটা পড়ে স্নেহ-
অপত্য মমতা। রেললাইনের ওমে
ছড়ায় মায়ের কেশ কালের শরমে
হাত পা মগজ আর খন্ড খন্ড দেহ।
মগ্ন অবেলায় করে হৃদয়-বিগ্রহ
সন্তান প্রহার করে মাকে! দুঃখ জমে
স্মৃতির সম্পর্ক ভাঙে সে ভুল বিভ্রমে
হুইসেলে চাপা পড়ে মায়ের বিদ্রোহ।

দুধের লবন খেয়ে বেড়ে ওঠা ছেলে
স্তনের লাবণ্যে ভুলো রক্তের ধ্রুপদী?
সুবর্ণ জন্মের ঘাম বেদনা জাগালে
শোকগ্রস্থ মানচিত্র উল্টোরথে যদি
তোমাকেও নিয়ে যায়, তোমার আমলে
শোকের শরীর হবে সন্নিহিত নদী।

……..
সভ্যতা
……..

ছোট্ট ছিন্নভিন্ন দেহটি একটি কালো পলিথিনে করে ফেলে দিয়ে আসলেন নাজাফের নার্স
পাশে একটি কুকুর খাদ্যের খোঁজে…

কুকুরটি ক্ষুধার্ত
কুকুরটির চোখে একটি কালো পলিথিন
কুকুরটি হিংস্র
কুকুরটির চোখে শিশুটির শাদা হাত

কুকুর জানে না মুখে তার মনিবের হাত
আমিষের ঘ্রাণে অভুক্ত সে করে ফেলে পেটের আবাদ”

……..
সভ্যতা-০২
……..

আমার টিশার্টে একটি ছোট্ট ফুটো ছিল ।
অতি ব্যবহারে দিন দিন ফুটোটা বড় হচ্ছে ।
আর চুরি হয়ে যাচ্ছে কারিগরের যাবতীয় প্রজ্ঞা ।

আমি জানি টিশার্টটি এভাবেই একদিন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়বে…

…….
নমস্কার
…….

উদোম কর্ণিয়া জুড়ে দেখি কাঁটাতার
খুনের সীমান্তে নাচো মাতাল কোরাশ
অসুর শিকারী – ধ্যানে বালিকার লাশ
মগজ মুখস্থ করে প্রাণদায়ী ভার।
বালিকা তরুণী তাই প্রজাতি ভিত
রচিত হতেই পারে ফলবতী বায়ু
দাদারা খেলছে নিয়ে দাদাদের আয়ু
প্রাণে প্রাণে গোনো তবে প্রাণের গণিত।

লাশের কীর্তন গায় প্রতিবেশী সাপ
কাঁটাতারে ঝুলে থাকে এক বধুমন
আমার হিস্যাতে চাই প্রতি ইঞ্চি মাপ
বোধের গভীরে কাঁদে শোধের প্রোটন।
ফেলানি ফ্যালনা মেয়ে- ভেঙে সীমা পার
মানবিক বোধে বিঁধে ধিক্-নমস্কার।

………
নমস্কার -০২
………
এভাবে ঝুলাও মানচিত্র, চিত্তে বাড়ুক শ্রদ্ধার মাঠ
বায়ুতে ছড়াক শহীদের শ্বাস,বায়ুতে ছড়াক হাহাকার
এভাবেই দেশ অন্ধ হোক, এভাবেই নেব ভয়ের পাঠ
বায়ুতে ছড়াক আহত কান্না, বীরের শাদা নমস্কার।।

………
এখানে প্রসাব করুন
………

এখানে প্রসাব করা নিষেধ – লেখা দেখে নুনু বের করে সেখানেই হিসু করি বিবেক।সম্ভ্রান্ত অংক বোঝা যে মহাজন কর্তৃক চাকুরিচ্যুত আমার সবুজ ধানক্ষেত, আমি তার মুখে প্রসাব করি ঘনবেগে অবিরাম।
নিরাপত্তার অজুহাত – অগণিত মৃত্যুর চাষ শেষে হাত বাড়ালে বনেদী সীমায়, আমি সেই ক্ষুধিত পশ্চিমের মুখে প্রসাব করি। তেলের বিজ্ঞাপনে মেতে আণবিক রুখতে পারমাণবিক কারুকাজ বেছে নেয় যে সাম্রাজ্যবাদ আমি সেই মুখে প্রসাব করি বোমার সমান। ভয়ের উরত নিয়ে বেঁচে থাকা যৌবন, আমি সেই মরদের মৃতদেহে প্রসাব করি আত্মাজজ্ঞানে।

গণতন্ত্রের নুন খেয়ে বেড়ে ওঠা অবোধ বালক, চলো এভাবেই
প্রসাবের লোকালয় বানিয়ে ফেলি ওআইসি, জাতিসংঘ,
এভাবেই চলো প্রসাবের লোকালয় বানিয়ে ফেলি হোয়াইট হাউস…

ঠিকানা :

শাহীন খন্দকার
আটচালা সাহিত্য আড্ডা, আলুপট্টি – নওগাঁ।
যৌথ সম্পাদনা ছোট কাগজ “বোল”
ই-মেইল : sbdlislam@gmail.com

আরও পড়তে পারেন

3 COMMENTS

  1. কবিতাগুলিতে আমাদের জীবন, বিশ্বাস এবং সুন্নাহের প্রতি অগাধ আনুগত্য প্রকাশ পেয়েছে। খুব স্বচ্ছ এবং পরিশীলিত মনের ছবি হৃদয়কে স্পর্শ করে। দরদ মাখানো প্রতিটি শব্দের মধ্যেই জেগে ওঠে এক আলোকময় প্রাচুর্য। খুব সুন্দর লাগলো প্রতিটি কবিতাই।

  2. উপমা ও রূপকে কবিতাগুলো অনবদ্য।
    শাহীন খন্দকারের কবিতা সহজেই মুগ্ধ করে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ