spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যমৌলাধুনিকতা

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

মৌলাধুনিকতা

কাজী জহিরুল ইসলাম 

১৮ শতকের জার্মান দার্শনিক গিয়র্গ ভিলহেল্ম ফ্রিডরিখ হেইগল, ইংরেজরা যাকে বলেন জর্জ উইলিয়াম ফ্রেডেরিক হেগেল, সবাই যাকে শুধু হেগেল নামেই চেনেন এবং যার দর্শন তত্ত্ব হেগেলিয়ান দর্শন নামে পরিচিত, তার বিখ্যাত দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব “থিসিস, এন্টি-থিসিস এবং সিন্থেসিস” ব্যপকভাবে সমাদৃত। এটি একটি চক্রাবর্ত। খুব সহজ করে যদি বলি, যা আছে তা হচ্ছে থিসিস, এই ‘আছে’র যা কিছু মন্দ তা হচ্ছে এন্টি-থিসিস এবং সেই মন্দের সমাধান হচ্ছে সিন্থেসিস। থিসিস থেকে এন্টিথিসিস বের করে সিন্থেসিসে পৌঁছানোর পরে একধাপ উন্নয়ন ঘটে। এবং সেই অবস্থানে পৌঁছানোর পরে এটি আবার নতুন সময়ের জন্য থিসিস হয়ে যায়। সেই থিসিসের সমালোচনা করে ত্রুটিগুলো খুঁজে বের করাটাই নতুন এন্টি-থিসিস এবং তার সমাধানই নতুন সিন্থেসিস। এই চক্রাবর্তের মধ্য দিয়ে সব কিছু আবর্তিত হতে থাকে এবং পৃথিবী ক্রমশ এগিয়ে যায়। হেগেলের এই মতবাদ আমরা যে কোনো ক্ষেত্রেই কাজে লাগাতে পারি। সব কিছুই একটি কক্ষপথে ঘোরে আর ঘোরে বলেই চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী সব গোল। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, শিশুরা শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখে, এরপর বার্ধক্য আসে, তারপর মৃত্যু। ওখানেই কি শেষ, এই মৃত্যু? আবার আসবে না শিশুকাল? চক্রাবর্তের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস থেকেই হয়ত প্রাচীন দার্শনিকেরা, ধর্মাবতারেরা পুনর্জন্মের কথা বলেছেন। 

পোস্ট মডার্ন বা উত্তরাধুনিক কবিতা নিয়ে বাংলাদেশে নব্বুইয়ের দশকে খুব হৈ চৈ দেখেছি। বিষয়টি হেগেলের এন্টি-থিসিসের মত। ত্রিশের দশকের বাঙালি কবিরা ইউরোপীয় ধারার কবিতা আমদানী করে বাংলা কবিতাকে আধুনিক করে তোলেন। নব্বুইয়ের কবিরা কলোনিয়াল চিন্তা বাদ দিয়ে উত্তরাধুনিক কবিতা লেখার কথা বলেন। আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন কবিতার অধ্যাপকের সঙ্গে উত্তরাধুনিকতা নিয়ে কথা বলেছি, তারা কেউই এর সঠিক কোনো সংজ্ঞা দিতে পারেননি বা দিতে চাননি। আসলে উত্তরাধুনিকতা মানুষের ক্রমবিকাশমান চিন্তা-প্রক্রিয়ার একটি স্তর এবং তা অবশ্যই দেশে দেশে ভিন্ন। বাংলাদেশের কবিদের কাছে কলোনিয়াল চিন্তা, কাঠামো পরিহার করা সঙ্গত কারণেই উত্তরাধুনিকতা, কারণ বাংলা কবিতার অন্তরে কলোনিয়াল চিন্তা এবং কাঠামো বাসা বেঁধে আছে বহুকাল ধরে। বাংলা কবিতা গণবিচ্ছিন্ন হয়েছে ছন্দহীনতা, অন্ত্যানুপ্রাসহীনতা এবং দুর্বোধ্যতার কারণে। এগুলোই হেগেলের এন্টি-থিসিস এবং এটিই উত্তরাধুনিকতা। এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার যে উপায়, মানে সমাধান, হেগেল যাকে বলেছেন সিন্থেসিস তা হলো মেটামডার্নিজম বা মৌলাধুনিকতা। ১৯৯৫ সালে বাংলা ভাষার কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম এই দেশে মৌলাধুনিকতার কথা বলেন। মেটামডার্নের বাংলা প্রতিশব্দ মৌলাধুনিকতা তিনিই তৈরি করেন।

আমাদের এখানে ইউরোপীয় চিন্তা ও কাঠামো পরিহার করার ডাক যখন উত্তরাধুনিকতা, আমেরিকায় বা ইউরোপে তখন বর্ণবাদ-বিরোধী চিন্তা, অভিবাসীদের অধিকার, গে-রাইটস ইত্যাদি নিয়ে কথা বলা উত্তরাধুনিকতা, কারণ এগুলো আধুনিক কবিতায় উপেক্ষিত হয়েছিল। 

নুরুল হুদা মৌলাধুনিকতার একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি মনে করেন আধুনিকতাকে একদল গ্রহন করেন আবার একদল তা প্রত্যাখ্যান করেন। এই দুই দলের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে একটি নতুত সত্ত্বা জন্ম নেয়, এই নতুন সত্ত্বাটিই হলো মৌলাধুনিকতা বা মেটা মডার্নিজম। হেগেলের সূত্রের মতোই তিনি মনে করেন নতুন টাইম-স্পানে মৌলাধুনিকতা হয়ে উঠবে আধুনিক এবং একদল কবি এই আধুনিকতার নতুন ধরণের ত্রুটি আবিষ্কার করে লিখবেন নতুন উত্তরাধুনিক কবিতা। সেই সময়েও আধুনিক এবং উত্তরাধুনিকের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে তৈরি হবে নতুন ধরণের কিছু স্বাতন্ত্র, সেগুলোর সমষ্টিই হবে নতুন সময়ের মৌলাধুনিকতা এবং এই চক্রাবর্ত চলতেই থাকবে।

যখন ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ঘটলো, উড়োজাহাজ আবিস্কার হয়ে গেল, মানুষ মহাকাশ বিজয় করতে শুরু করল, একের পর এক বিজ্ঞানের অগ্রগতি সাধিত হতে থাকলো, পৃথিবীর মানুষ এসবের মধ্য দিয়ে ডিগনিটি অর্জনকেই আধুনিকতা হিসেবে গ্রহন করলো। কিন্তু কুড়ি শতকের ষাটের দশকে এসে শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা ভাবতে শুরু করলো বিজ্ঞানের অগ্রগতিই সব নয়, এই ছুটে চলার মধ্যে ত্রুটি আছে। উপেক্ষিত হচ্ছে সুবিধা বঞ্চিত মানুষের অধিকার, পিছিয়ে আছে নারী সমাজ, কলোনিগুলোতে দারিদ্র, ক্ষুধা, পশ্চাৎপদতা, উন্নত বিশ্বে ইমিগ্রান্টরা অবহেলিত, সমকামীরা নিগৃহীত এসব নিয়ে ভাবতে হবে, কাজ করতে হবে। শুধু পথকুকুরের দিকে এক টুকরো রুটি ছুঁড়ে দেয়া নয়, কলোনিগুলোকে দিতে হবে পূর্ণ অধিকার, সমকামীরাও সমাজে আর সকলের মত মাথা উঁচু করে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াবে, নারীরাও কয়লার খনিতে কাজ করবে, ট্রেন, লরি চালাবে, প্রতিষ্ঠানের প্রধান হবে, বিভেদ, বৈষম্য দূর করতে হবে সকল স্তর থেকে। এইসব চিন্তাই হয়ে উঠল উত্তরাধুনিকতা। উত্তরাধুনিকতা এইসব চিন্তাকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিল, বাস্তবায়নের সূত্রপাত ঘটাল। এসবের পূর্ণ বাস্তবায়নের পর্যায়টি হলো মেটামডার্ন যুগ। মেটামডার্ন বা পোস্ট-পোস্টমডার্ন বা মৌলাধুনিকতা  প্রথাগত, আধুনিক এবং উত্তরাধুনিক সকল চিন্তার সমন্বয় ঘটিয়ে পৃথিবীর মানুষের জন্য বৈষম্যহীন একটি অবস্থা সৃষ্টি করে। এখন কথা হচ্ছে সেই ইউটোপিয়া কি আদৌ সম্ভব? উত্তরাধুনিকতা যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে, মৌলাধুনিকতা তার সব একসঙ্গে বাস্তবায়ন করে ইউটোপিয়া বা স্বর্গরাজ্য তৈরি করতে পারবে না কিন্তু পর্যায়ক্রমে এসবের বাস্তবায়ন হতে থাকবে। যার ফলে সব টাইম-স্পানেই একই সঙ্গে প্রথাগত, আধুনিক, উত্তরাধুনিক এবং মৌলাধুনিক অবস্থান করবে। সব কালেই হেগেলের থিসিস, এন্টি-থিসিস এবং সিন্থেসিস থাকবে। পার্থক্য হলো আজকের এন্টিথিসিস আর ৫০ বছর আগের এন্টিথিসিস এক হবে না। অর্থাৎ একেক সময়ের সমস্যা ভিন্ন এবং এর সমাধানও ভিন্ন। সম্পদ আহরণের জন্য ১০০ বছর আগে মানুষ অন্যের দেশ দখল করত, এখন বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক প্রাধান্য বিস্তার করে। ৫০ বছর পরে তাও করবে না, কারণ তখন মহাকাশ থেকে, সূর্য থেকে, সমুদ্র থেকে অফুরন্ত সম্পদ আহরণ করা সম্ভব হবে, অন্যের দেশের দিকে হাত বাড়াতে হবে না।

ফিরে আসি বাংলা কবিতায়। ইউরোপীয় চিন্তা, ভাষা এবং কাঠামো পরিহার করে লালন, চণ্ডিদাসে ফিরে যাওয়া কি উত্তরাধুনিকতা?  একদম না। পুরনোকে ফিরিয়ে আনা উন্নয়ন নয়, ইউরোপকে পরিহার করে লিখতে হবে আজকের কবিতা কিংবা ভবিষ্যতের কবিতা। আধুনিক বাংলা কবিতার মূল সমস্যা গণবিচ্ছিন্নতা। আমাদের তৈরি করতে হবে গণসম্পৃক্ততা, আজকের কবিতা লিখে, মধ্যযুগের কবিতা লিখে নয়। তাহলেই উত্তরাধুনিক কবিতা হয়ে উঠবে।

মুহাম্মদ নুরুল হুদার মতে আধুনিকতা এবং উত্তরাধুনিকতার দ্বন্দ্ব থেকে যে নতুন ধারণা তৈরি হচ্ছে বা হয়েছে সেগুলোই মৌলাধুনিক চিন্তা। একটি দৃষ্টান্ত আমি দিতে পারি, ধর্ম এবং ধর্মহীনতার দ্বন্দ্বটিই আমাদের উপমহাদেশে প্রকট এবং এর মধ্য থেকে সর্বধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীলতার একটি ধারণা বেশ বেগবান হয়ে উঠছে, এটিই মৌলাধুনিকতা। এর মধ্যেই বৃহৎ মানবিক কল্যাণের ইঙ্গিত নিহিত আছে। 

মেটামডার্নের ধারণা প্রথম দেন আমেরিকান অধ্যাপক মাসুদ জাভারজাদে ১৯৭৫ সালে। অধ্যাপক মাসুদ বলেন ১৯৫০ সাল থেকেই আমেরিকার শিল্প-সাহিত্যে মেটামডার্ন ধারণা ডেভেলপ করছে। কানাডার তাত্ত্বিক লিন্ডা হাচিওন ১৯৯৫ সাল থেকে মেটামডার্ন নিয়ে কথা বলছেন।

এই সময়ের মেটামর্ডান কবিতা কোনগুলো এসব বিষয় নিয়ে, কিছু কবিতার উদ্ধৃতিসহ পরে আরো এক কিস্তি লিখবো।

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৭ আগস্ট ২০২২।

আরও পড়তে পারেন

2 COMMENTS

  1. লেখাটি আগেও পড়েছি, আবার পড়লাম।বেশ ভালো লেগেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ