spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যকিবরিয়া স্যার

লিখেছেন : রফি হক

কিবরিয়া স্যার


রফি হক

কিবরিয়া ( জ. ১ জানুয়ারি ১৯২৯ – মৃ. ৭ জুন ২০১১) স্যারের সঙ্গে আমার অজস্র স্মৃতি। যখন চোখ বন্ধ করে ভাবি, স্যারকে মনে করি তখন শুধু তাঁর সৌম্য চেহারাটা চোখে ভাসে : ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, পয়জামা, অথবা কিবরিয়া কালারের পাঞ্জাবী পরে বসে আছেন ধ্যানস্থ হয়ে তাঁর স্টুডিও কাম প্রশস্থ বারান্দায়। ধানমন্ডির লেকের পাড়ে গাছগাছালির ছায়া ঘেরা বাড়ি।
.
স্যারের বাসায় আমার যাওয়া-আসা ছিলো অবাধ। ফলে ছোটো-বড়ো-মাঝারি নানা রকমের নিরীক্ষামূলক পেইন্টিং, কোলাজ, এচিং, লিথোগ্রাফের কাজ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে খুব কাছ থেকে। এবং সে-সব কাজ নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। আমি যেমন স্যারের কথা শুনতে পছন্দ করতাম, স্যারও আমার কথা শুনতে খুব পছন্দ করতেন।
.
আমার পড়ালেখার প্যাশন আছে বলে স্যার তাঁর ডাক্তার বন্ধু ডা. মাহবুবকে নিয়েও আমার বাসায় চলে এসেছেন । ডা. মাহবুবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে । আমি অবাক হয়ে স্যারের দিকে চেয়ে থেকেছি। পরে বলেছেন, ডাক্তার সাহেবে বইয়ের ভালো কালেকশন আছে, ডাক্তার সাহেবও পড়তে পছন্দ করেন– এজন্যে তিনি আমার সঙ্গে ডাক্তার সাহেবের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।
.
পরে দেখা গেল– ডাক্তার মাহবুব, স্যার ও আমি মিলে প্রতি সপ্তাহে স্যারের বারান্দায় গল্প করছি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত!
.
শেষের দিকে প্রায় প্রায় স্যারকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হতো। চিকিৎসা নিতে হতো। যত রাতই হোক স্যারের অসুস্থতার কথা শুনলেই আমি বেরিয়ে পড়তাম। একবার প্রায় সাড়ে রাত তিনটা দিকে ভাবি ফোন করলেন, রফী স্যারকে হাসপাতালে নিতে হবে। আমি সেবার ভয়ই পেয়েছিলাম। আমিও কান্ডজ্ঞানহীনভাবে অত রাতে মনির স্যারকে (বিখ্যাত শিল্পী মনিরুল ইসলাম) ফোন করে বসেছিলাম। মনিরস্যার ও আমি স্যারকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। মনির স্যারের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ যে স্যার হাসিমুখে আমাদের সঙ্গে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। তিনি স্যারকে বরং ভীষণ যত্ন করেছিলেন।
.
কিবরিয়া স্যারের মতো আধুনিক চিন্তার মানুষ আমি জীবনে কম দেখেছি। তিনি যেমন নরম, শান্ত, স্বল্পভাষী মানুষ ছিলেন তারচেয়ে অনেক বেশি ছিলেন অসাধারণ সৌজন্যবোধসম্পন্ন সমকালীন একজন আধুনিক মানুষ। স্যারের কাছাকাছি ছিলাম প্রায় পঁচিশ বছর। অনেকসময় আমাকে ছবি দিতে চেয়েছেন। আমি নিই নি। তাঁর ছবির এত মূল্য ! এত টাকার ছবি উপহার নিব? তখনই তাঁর ছবির মূল্য দশ বারো লক্ষ টাকা !!
.
তাঁর বিদায় নেবার বেশ কয়েক মাস আগে স্যার একটি পেইন্টিং নিজে হাতে নিয়ে আমার বাসায় এসেছেন, পেইন্টিংয়ের পেছনে লেখা : ‘আমার স্নেহের ছাত্র প্রিয় রফি হকের জন্য এই ছবিটি’…

.

আমরা যে জীবন যাপন করি, সেখানে সম্পর্ক মানে অদ্ভুত সব রঙ । কখনও আনন্দ, কখনও দুঃখ, কখনও অন্ধকার, অবসাদ । এমনকী ক্ষোভ । অবিশ্বাস । ঈর্ষা । কত রকমের সতর্কতা । গা বাঁচিয়ে চলা । এমনকী কত জনের নিজের একান্ত সম্পর্কও লুকিয়ে রাখা । এমন কত কি !!
.

এভাবে মানুষ ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত হয়ে ওঠে । জীবনানন্দের হাজার বছর ধরে পথ হাঁটা আর বন্দরে বন্দরে ঘোরার বদলে দিনশেষে সারাদিনের টেনশন, সারা সপ্তাহের ভার, সারা মাসের দুশ্চিন্তা দু’দন্ডের শান্তি থেকে বহু দূরে নিয়ে যায় । জীবন যেন তুচ্ছ কিছুর জন্য বসে থাকা !
.
দিন আসে, দিন যায় । সারাদিন । একজন মানুষের বসে থাকা । নীরব, নিরবচ্ছিন্ন বসে থাকা । ঐ কবিতাটির মতো:
.
‘…তুচ্ছ কিছু কাজের জন্য বসে আছি
সন্ধ্যে সকাল
দুদিকে দুই আকাশ যখন মোরগে লাল
বসেই আছি
…দিকদিগন্ত লুটিয়ে পড়লো কাছাকাছি
রহস্যময় ঘর গড়েছি
বসেই আছি…
.
আজ সারারাত বসেই ছিলাম । ঘুম এলো না । বসেই ছিলাম । ভোরের আলো লুটিয়ে পড়লো জানলা গলে। ছোটবেলায় নিয়ম করে মা খুব ভোরে ডেকে দিতেন আমাদের । আমরা বরান্দায় গিয়ে বসতাম । নিম গাছের হাওয়া এসে জুড়িয়ে দিত গা । কী শীতল স্পর্শ! তখনও ভোরের শিশির পড়ছে টুপটাপ । তখনও আকাশ নীলচে অন্ধকার ।
.
মায়ের সঙ্গে নানাবাড়ি যাওয়া হতো বছরে দুবার । ঝড়ো বাতাসের ঢেউয়ের মতো আমাদের মধ্যে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যেত । আমার কাছে নানাবাড়ি মানে বিশাল পদ্মা নদী । কূল-কিনারাহীন পদ্মা । ওখানে মা আমাদের ভোরে ডেকে দিতেন না । মা নিজেই ঘুমোতেন বেলা পর্যন্ত । ওখানে মায়ের শান্তি । ভোর হলে টের পেতাম । দেবদারু গাছে বাদুর ফিরে আসত । কুয়োতলায় সারি সারি সুপোরি গাছের মাথায় স স আওয়াজ, আওয়াজের ভেতর বেলায়েৎ খাঁ…। আমি বেতফলের মতো ঘোলা কুয়াশা আর শিশিরে পা রেখে লেবুতলা পেরিয়ে নদীর কিনারায় বসে থাকতাম । দিকদিগন্ত লুটিয়ে পড়তো ।…
.
অত বড়ো নদীতে তখন দূরে একটি বা দুটি নৌকো আবছা দেখা যেত । আবছা আবছা । দক্ষিণের বিস্তীর্ণ মাঠে দিগন্ত জোড়া সবুজ । অত বড়ো মাঠের এক প্রান্তে তারকোভস্কির সিনেমার মতো নিঃসঙ্গ একটি গাছ দাঁড়িয়ে । অত বড়ো মাঠে ঐ একা থাকা একটি গাছ, অত বড়ো নদীর মাঝে ভেসে থাকা ঐ একটি নৌকা আমার বুকে হু হু করে হিম জমায়, তবু ভালো লাগে । এতো ভালো লাগে— !!

‘…আজ সাধ্যাতীত ভালোবাসবো বলে
সকাল আমার ভালো লাগে…
না কি ঊর্ণাময় স্বপ্নের ফোয়ারা
আমি বসে আছি, আমি শুয়ে আছি
আমি ভালোবাসবো, আমি হই হই করবো সারাদিন।‘…
.
ছবি আঁকা আমার কাছে ভালোবাসার । যেদিন ভালোবাসবো না ছেড়ে চলে যাবো । কোনোদিন কোনো কিছু আঁকড়ে থাকি নি । কোনোদিন কোনো কিছু নিয়ম মাফিক করি নি । ছবিও যখন এঁকেছি নিয়ম ধরে করি নি । আমি প্রিন্টমেকিংয়ের ছাত্র, কিন্তু প্রিন্টমেকিংয়ের প্রচলিত নিয়ম মানি নি । আমার সঙ্গে তাই কারো কাজের মিল নেই । ক্লাসে, ডিপার্টমেন্টে অন্যরা ভ্রু কুঁচকাতো । আমার প্রফেসর কিবরিয়া স্যার পাশে দাঁড়াতেন । বলতো, ‘ও কাজ করছে । ওর মতো করুক না ।..’
.
কিবরিয়া স্যার আমাকে বুঝতেন । একদিন ক্লাসে কাজ করছি, আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন । এমন তো প্রায়ই দাঁড়ান । সেদিন হাতে এক শ টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘এটা রাখো, খেয়েছো ?’ এ কথা বলে নিজেই যেন লজ্জা পেয়েছেন, দ্রুত বের হয়ে গেলেন ক্লাস রুম থেকে । আজ এ কথা যখন লিখছি দুচোখ ঝেঁপে জল আসছে । এই মানুষটা আমাকে এত ভালোবাসতেন !…
#

.
ফোটোগ্রাফি : রফি হক
ছবি : প্রফেসর এমিরিটাস শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া,
*পহেলা জানুয়ারি ছিল কিবরিয়া স্যারের ৯৫ তম জন্মদিবস ।

মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪
৩১ বৈশাখ ১৪৩১

রফি হক : শিল্পী, ছাপচিত্রী, শিল্পলেখক, সম্পাদক। ভিজিটিং আর্টিস্ট এণ্ড লেকচারার, ইউভার্সিটি অব শিকাগো।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. লেখাটা ভালো লাগলো।
    পাঠককে নিশ্চিত মুগ্ধ করবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমির মুখোস উন্মোচন
কাজী জহিরুল ইসলাম on বাংলা একাডেমি এবং আমার গ্লানি
কাজী জহিরুল ইসলাম on ‘প্রথম আলো’র বিকল্প
পথিক মোস্তফা on মানবিক কবি ফররুখ আহমদ
মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন on ক্রান্তিকাল
এ্যাডঃমনিরুল ইসলাম মনু on গুচ্ছ কবিতা : বেনজীন খান
পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা