spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যশিহাব সরকারের কবিতা

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

শিহাব সরকারের কবিতা


কাজী জহিরুল ইসলাম

বাংলা কবিতায় ব্যাপকভাবে শ্লোগানের অনুপ্রবেশ ঘটেছে সত্তুরের দশকে। এই দশককে উচ্চকিত, কেউ কেউ আরো একধাপ এগিয়ে, শ্লোগান সর্বস্ব কবিতার দশক হিশেবেও সনাক্ত করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই দশকে শ্লোগানসর্বস্ব কবিতা যা লেখা হয়েছে তার অধিকাংশই লিখেছেন পঞ্চাশ এবং ষাটের কবিরা। কবিতায় শ্লোগান কতটা গ্রহণযোগ্য সে এক অন্য বিতর্ক, আমরা আজ সেই বিতর্কে না গিয়ে এই দশকের ক’জন প্রধান কবির একজন কবি শিহাব সরকারের কবিতা নিয়ে আলোচনা করবো, তার কবিতায় শ্লোগান কতোটা এসেছে তা দেখার চেষ্টা করবো এবং তার কবিতার বৈশিষ্ট্য শনাক্তকরনে সচেষ্ট হবো। হেলাল হাফিজ, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং দাউদ হায়দার এই দশকের কবি হলেও এই তিনজন কবিকে সত্তুরের কবি হিশেবে যতোটা না দেখা হয় তার চেয়ে বেশী দেখা হয়, আলোচনা/সমালোচনা করা হয়, তাদের অন্য বৈশিষ্ট্যের কারনে। সত্তুরের কবি কে কে? এই প্রশ্নের জবাবে, বাংলা কবিতার দশকওয়ারী খোঁজখবর যারা রাখেন তাদের মুখে, প্রথমেই যে দুটি নাম উচ্চারিত হয় তারা হচ্ছেন আবিদ আজাদ এবং শিহাব সরকার। আবিদ আজাদকে নিয়ে অন্য নিবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। আজকের আলোচ্য কবি শিহাব সরকার।

সত্তুরের কবিতার মূল সুর থেকে শিহাব সরকার বিচ্ছিন্ন থেকেছেন, সম্ভবত সচেতনভাবেই। অর্থাৎ শিহাব সরকারের কবিতা উচ্চকিততো নয়ই, বরং খানিকটা যেন বেশিমাত্রায় ম্রিয়মান। তিনি মূলত রোমান্টিক ধারার কবি। এক ধরণের মুগ্ধতার ঘোরে আচ্ছন্ন তার কবিতা। ভাষাটি সাবলীল কিন্তু নিস্তরঙ্গ।

হাইরাইজ উঠে গেলো, কোথায় মাটি, গাছতলা
আমাদের গলির মুখে ট্রাক থেকে
নামে ইট কাঠ লোহা বালু
উঠছে ছ’তলা শপিং কমপ্লেক্স
হলুদ বাড়িটা ভাঙা হয়ে গেছে
নন্দী কুটিরের নাম মুছে যাবে পাড়ায়,
কোন সালে উঠেছিলো এ বাড়ি
জানা যেতো বরুণ নন্দীর কাছে
তাঁর ছেলেরা আছে কলকাতা, শিলিগুড়ি

শ্যাওলা-ভেজা প্রাচীন ইটের স্তূপ সুরকি।
বাড়ি ভাঙা হয়ে গেছে
ফটকে বকুল গাছ লাল ধুলোতে ছাওয়া
দীর্ঘশ্বাস চাপে তরুণ স্থপতি-
দালান না ভেঙ্গেও দালান তোলা যায়
শতাব্দীর ধ্বনি লেগে ছিলো বাড়িটার গায়ে

কোনো বাড়ি থাকে না চিরতরে
বৃষ্টি রৌদ্র হাওয়ার নুন বুনো গুল্মলতা
আর সময়ের ক্ষুধার কাছে দালানের
স্পর্ধা ও যৌবন নিভে আসে

(কবিতাঃ এইসব বাড়ি, কাব্যগ্রন্থঃ মেরিলিন ঐ যে গুহা)

‘সময়ের ক্ষুধার কাছে দালানের/ স্পর্ধা ও যৌবন নিভে আসে’ এই পঙক্তিদ্বয়ের মধ্য দিয়ে এই কবিতাটি পৌঁছে যায় এক ভিন্ন উচ্চতায়। তিনি পাঠকের বোধে প্রচন্ড নাড়া দিয়ে শুনিয়ে দেন নির্মম সময়ের ঘণ্টাধ্বনি। সকল স্পর্ধাই শেষ পর্যন্ত সময়ের কাছে অসহায়, নতজানু। একই গ্রন্থের অন্য একটি কবিতায়ও তিনি সময়কে টেনেছেন নির্মমতার চালিকা শক্তি হিশেবে। ‘অবশেষে স্মৃতি সব খায়, যদিও/ থাকে চকিত মুখ, গানের কলি, অন্ধকার নদীও/ সহজ ঘুমের রাত্রিকে খুব টালমাটাল করে,/ ধুসর ক্যানভাসে অবিরল পাতা ঝরে/ মধ্যরাতে ঘুমুবার আগে শুভ্র রুমালে হলুদ/ স্মৃতির নিঃশ্বাস পড়েছে, বুকে কোথাও বুদবুদ,/ দাগ থেকে যায়, তিন যুগ পরেও মুছবে না?/ স্মৃতির ভিতরে পরম বাঁচা, ভাঁড়েরা তা বুঝবে না’ (ক্রিসেন্থিমাম)। কবিতাটির শেষ শব্দগুচ্ছ, ‘ভাঁড়েরা তা বুঝবে না’অভিব্যক্তিটি বাহুল্য, অনভিপ্রেত। এই শব্দগুচ্ছে কবির অসহিষ্ণু ব্যক্তিচরিত্রের প্রকাশ ঘটেছে।

তিয়াত্তুর সাল থেকে বিরাশি সাল পর্যন্ত রচিত কবিতাগুলো নিয়ে বেরিয়েছে শিহাব সরকারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লাল যৌবন দিন’। এই গ্রন্থটিই মূলত আমাদের সাহায্য করে খুঁজে পেতে সত্তুরের শিহাব সরকারকে। গ্রন্থটির শিরোনামে সত্তুর পুরোপুরি উপস্থিত। সদ্য স্বাধীন দেশের কুড়ি উত্তীর্ণ এক টগবগে তরুণের কাব্যগ্রন্থের শিরোনামে ‘লাল যৌবন’ খুবই সঙ্গত এবং তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু কাব্যগ্রন্থটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই ‘লাল যৌবন’ কোথাও হারিয়ে যায়, সেখানে ভেসে ওঠে শান্ত, স্নিগ্ধ, ধীর-স্থির এবং বেশ খানিকটা পরিণত কবির অবয়ব।

নদীর ধারে যেতে যেতে মনে হয় যাচ্ছি জলভ্রমণে
বহতা স্রোতের প্রতি তোমার কী অদ্ভুত গাঢ় টান,
নদী একদিন পাহাড় তছনছ করে ছুটে এসেছে
আমাদের লোকালয়ে
তার দু’ধারে সমাহিত নিগুঢ় জনপদ।
দেখে আমরা চিত্তে খুব সুখ পাই

মানুষের পদ্মা ভোলগা দানিয়ুব ইত্যাদি প্রচুর
টলটলে উদ্দাম নদী আছে
জল আমাদের পূর্বপুরুষের ধমনীতে
কামনার ঝড় তুলেছিলো
এক সঙ্গে অনেক জল দেখে উদাস হয়ে পড়ি
বুকের ভিতরে এমন করে!
(চাঁদের আশ্চর্য ভূত)

মধ্যদুপুরে এইসব মিশ্র তৎপরতা দেখে
আমার পায়ের ডিম শক্ত হয় ক্রমশ
উদ্ধত হয়ে ওঠে শিরদাঁড়া
চিৎকার করে বলি, আমার কোনো স্মৃতি নেই দাহ নেই
আমি শুধু বাঁচবো।
বন্ধু পরমাত্মীয় থেকে রক্তবৈরী
যেখানে যাই খুব ভালোবাসা-টান মমতা-টান
তারপর সন্ধ্যা হয়, রাত যত বাড়ে
আকাশ কেবলি উঁচুতে উঠতে থাকে
(রাত যত বাড়ে)

মোমবাতি জ্বেলে তুমি বসে আছো, আমাকে
গতরাতের উল্টানো ইজেল, তছনছ দোপাটি বাগান
দেখাবে বলে আলো উঁচু করে ধরেছিলে
চেতনা চৌচির করে কেন
এইসব আশ্লীলতা, রক্ত, জালিয়াতি…

তাঁর চেয়ে ওষ্ঠে বিষ ছোঁয়ালে না কেন?
(অন্ধকারে হরিৎ প্লাবনে)

প্রথম কবিতাটিতে কবি নদীপ্রসঙ্গে মানুষের ভেতরের নদীর উদ্দামতাকে তুলে এনেছেন। ‘মানুষের পদ্মা ভোলগা দানিয়ুব ইত্যাদি প্রচুর/ টলটলে উদ্দাম নদী আছে’। সেই নদীতে ঢেউ ওঠে, কখনো উথাল-পাথাল ঢেউ, সেই ঢেউয়ে পাড় ভাঙে, মন ভাঙে আবার জেগে ওঠে প্রত্যাশার নতুন চর। নদী যেমন ভাসিয়ে নিয়ে যায়, আবার আমাদের ফসলের/প্রত্যাশার ভূমিকে করে তোলে উর্বরা, নদীতে জেগে ওঠা নতুন চরে নতুন জীবনের উন্মেষ ঘটে। কবিতাটি পাঠককে এমন অনেক ভাবনার গভীরে নিয়ে যায়, এলোমেলো করে দেয়। ‘রাত যত বাড়ে’ কবিতার কয়েক ছত্রে খানিকটা বিপ্লবের আভাস দেখা গেলেও তা মোমের স্নিগ্ধ আলোর মতোই রোমান্টিক। ‘আমার কোনো স্মৃতি নেই দাহ নেই/ আমি শুধু বাঁচবো।/ বন্ধু পরমাত্মীয় থেকে রক্তবৈরী/ যেখানে যাই খুব ভালোবাসা-টান মমতা-টান/ তারপর সন্ধ্যা হয়, রাত যত বাড়ে/ আকাশ কেবলি উঁচুতে উঠতে থাকে’ পঙক্তিগুচ্ছে, যেন অবধারিত কোন নিয়মের টানে, মুখ থুবড়ে নেতিয়ে পড়ে বিপ্লব, সমর্পিত হয় প্রেমে। কখনো কখনো প্রেমেও মানুষ হয়ে ওঠে বিপ্লবী, হয়ে ওঠে আগ্রাসী। ‘অন্ধকারে হরিৎ প্লাবনে’ কবিতায় সেই আভাস জেগে উঠলেও তা ‘চেতনা চৌচির করে কেন/ এইসব অশ্লীলতা, রক্ত, জালিয়াতি…’ প্রশ্নের ঘায়ে যেন আত্মহননের পথই বেছে নেয়।

সত্তুরের দশকের এই কবি বিপ্লবের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেন, ‘বিপ্লব ও ক্লোরোফরমে’ কবিতাটি লিখে। ‘আমাদের মাঝখানে আর কখনো ছিল না এমন মসৃণ সেতু/ পুরুষ তার নারীকে নিয়ে যাচ্ছে গহীন মধুচন্দ্রিমার তীরে/ এসব আবোল তাবোল বশীকরণের চাপে/ রক্তে জমে গিয়েছে অনেক চোলাই মদ/ তুমি কি জানো বিপ্লব ও ক্লোরোফরমে দূরত্ব খুব বেশী নয়?’ এরপর ক্লোরোফরমের প্রভাবে কবি শিহাব সরকারের বিপ্লব ঘুমিয়ে পড়ে চিরদিনের মতো।

রোমান্টিক ধারার এই কবি পয়ার রচনায় দক্ষতা অর্জন করেছেন একেবারে গোড়া থেকেই। অক্ষরবৃত্ত এবং মুক্তক ছন্দেই তিনি লিখেছেন তার আধিকাংশ কবিতা। আঙ্গিকগত বৈচিত্রহীনতা কবি শিহাব সরকারের একটি দুর্বল দিক। গদ্যছন্দে পয়ার রচনা করতে গিয়েও তিনি তাঁর নিজস্ব একটি কাব্যভাষা নির্মাণ করতে পারেন নি। তাই তাকে একজন স্বতন্ত্র কবি হিশেবে শনাক্ত করা উত্তর প্রজন্মের জন্য কষ্টসাধ্য হবে। ত্রিশের এবং পঞ্চাশের কবিদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে তার কবিতায়।

কদাচিৎ দেখি তিনি তার নিজস্ব আঙ্গিনা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছেন, তবে সে চেষ্টা খুব সফল হয়নি। অল্প কিছু সমিল পঙক্তি রচনার চেষ্টা করেছেন সেখানেও নবিশসুলভ ভুল রয়ে গেছে। এরকম কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে।

মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত ‘জয় হবে দীর্ঘশ্বাসে’ কাব্যগ্রন্থের ‘দেখতে দেখতে’ কবিতায় তিনি ‘মেঘে’র সাথে ‘চেখে’ এবং ‘দীঘি’র সাথে ‘লিখি’ অন্তমিল ব্যবহার করেছেন। ‘বসন্ত বাছে মানুষ’ কবিতায় ‘ডাকি না’ এর সাথে তিনি অন্তমিল দিয়েছেন, ‘মাছিকে না’। ‘স্যুভেনির’ কবিতায় তিনি ‘নীরব মৃত্যু’র সাথে ‘আমারও মৃত্যু’ অন্তমিল দিয়েছেন। ‘শান্তি যা তা বনগহনে’ কবিতায় তিনি ‘কুশলী’র সাথে ‘বুলি’ এবং ‘পাতা ঝরা’ র সাথে মিল দিয়েছেন ‘সালোমেরা’ শব্দের।

শিল্পতরু থেকে প্রকাশিত ‘করো গান বন জ্যোৎস্নার’ কাব্যগ্রন্থের ‘এ মুকুটে’ কবিতায় যখন তিনি ‘দাড়ান রাজা’ র সাথে ‘মানায় রাজা’ মিল দেন তখন এটাই স্পস্ট হয়ে ওঠে যে অন্তমিল নির্মাণে এই কবি একেবারেই আনাড়ি।

যে গদ্যছন্দ পঞ্চাশের কবিদের বিচরণক্ষেত্র তাকেই আরাধ্য হিশেবে বেছে নিয়েছেন শিহাব সরকার। সেখানেই তিনি স্বাচ্ছন্দ। গদ্যছন্দের ভুবন থেকে বেরিয়ে এসে কৌশলগত দিক থেকে সফল যে মাত্রাবৃত্তের কবিতাটি আমার নজর কেড়েছে সেটি এখানে পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করলাম।

সহসা আমার ইচ্ছে হলো এক লহমা থামি
ফণীমনসায় রক্তাক্ত, জানেন অন্তর্যামী
ভুল বুঝবার অবকাশে রাত্রি দীর্ঘ হয়
ফুল থেকে দূরত্ব বাড়ে, খারাপ হাওয়া বয়।

‘এই বিরতি ভুডু নৃত্যের, খুলিতে মদ খাওয়ার
তড়িতি ওকে ত্যাজ্য করো, সব নগ্ন-অনাচার’,

কথায় কথায়, ভ্রমণে বা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে
ঝরায় ওরা মরিচগুড়ো পতিতজনের ত্বকে
এমন হবে জেনেই খুঁজি অমাবশ্যার কোল
তেমন পাপ করেছি কই, অযথা কল্লোল।

বিস্মরণের মুহূর্তগুলো কোন নদীতে যায়?
বনগহনের হাতছানিতে যুবতী নিরুপায়।

এ ধরণের রহস্য কিছু থাকুক ধমনীতে
মনপবনের নাও ছুটেছে প্রলয় রজনীতে।

এমনও হতে পারে কিন্তু, ফিরে আসবো না
সে মনও মরে, শখ ছিলো যার নির্জনে জাল বোনা।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ