spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধকালজয়ী ওমর খৈয়ামের সুরা ও সাকি

স্মরণ। লিখেছেন : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

কালজয়ী ওমর খৈয়ামের সুরা ও সাকি


আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

ওমর খৈয়ামের (১০৪৮-১১৩১) রুবাইয়াত বিশ্ব সাহিত্য ভাণ্ডারের এমন এক সম্পদ, যা মূল ভাষা ফারসি এবং এর ইংরেজি অনুবাদ ক্লাসিক সাহিত্যের অন্তর্ভূক্ত। রুবাইয়াতের বড় প্রতিপাদ্য প্রেম, সুরা, সাকি, আল্লাহ ও মহাজাগতিক অস্তিত্ব। প্রায় দেড়শ বছর আগে ইংলিশ কবি ও লেখক এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড (১৮০৯-১৮৮৯) যখন ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, তখন তাঁর পক্ষে ধারণা করা সম্ভব ছিল না যে, তিনি পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক কাব্যপ্রেমিকের চিত্তে ঝড় তোলার মতো একটি কাজ করে যাচ্ছেন। শুধু সাধারণ কবিতা প্রেমীরা, পাশ্চাত্যের অনেক বড় বড় সাহিত্য প্রতিভা খৈয়াম দ্বারা প্রভাবিত হন। কোনো অনুবাদিত সাহিত্যের এমন জনপ্রিয়তা বিশ্বে বিরল।

অস্কার ওয়াইল্ড (১৮৫৪-১৯০০) রুবাইয়াতকে ‘সেরা শিল্প’ হিসেবে বর্ণনা করে শেক্সপিয়রের সনেটের মতো তাঁর সেরা সাহিত্য প্রেমের অংশ বলেছেন। একইভাবে মার্ক টোয়াইন ও টি,এস এলিয়ট খৈয়ামের ভাবনার মহত্ব ও মধুরতা এবং ফিটজেরাল্ডের পরিশ্রমের উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন। ইংলিশ চিত্রকর জন রাসকিন (১৮১৯-১৯০০) প্রথম যখন রুবাইয়াতের কপি হাতে পান, তিনি তাঁর অনুভূতি বর্ণনা করেছেন, “আজ পর্যন্ত আমি রুবাইয়াতের মতো এত মহিমান্বিত কিছু পাঠ করিনি।

একাদশ শতাব্দীর ইরানি সর্বজ্ঞ ওমর খৈয়াম আমাদের কাছে রুবাইয়াতের স্রষ্টা বিখ্যাত কবি হিসেবে নন্দিত হলেও কবিতার চেয়েও তার বেশি অবদান জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতে। তার অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮২ সালে নাসা চাঁদের একটি গহ্বরের নামকরণ করে ওমর খৈয়ামের নামে। খৈয়াম ছিলেন ইসলামী জগতের সক্রেটিস হিসেবে খ্যাত দার্শনিক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানি আভি সিনা বা ইবনে সিনার শিষ্য, যার অধীনে তিনি দর্শনের পাঠ গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হন।

পারস্যের অন্যান্য কবির মতো ওমর খৈয়াম কবিতায় তার দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টিকে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করেন, যা ইতোমধ্যে সমৃদ্ধ ফারসি সাহিত্যের তালিকায় ব্যতিক্রমী এক ধারার সংযোজন ঘটায়। রুবাইয়াতকে একই সঙ্গে পবিত্র ও অপবিত্র বলে বিবেচনা করা হয়। জীবন ও মৃত্যুর মতো চূড়ান্ত বিষয়গুলোকে রুবাইয়াতে অধিক গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়নি বলে এবং দৈহিক সুখভোগের বর্ণনার আধিক্যের কারণে তিনি নিন্দিত ও সমালোচিত হয়েছেন এবং এখনো রুবাইয়াত ইসলামী শুদ্ধাচারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত নয়। সুফি সাহিত্য সাধারণভাবে যে ধরনের আধ্যাত্মিক সীমা অতিক্রম করে খৈয়াম তা ছাড়িয়ে ইরোটিক বা যৌন উপভোগমূলক বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহ ও বেহেশত সম্পর্কে আমাদের লালিত বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন বলে বিতর্কের অবসান ঘটেনি।

খৈয়ামকে দোষারূপ করে লাভ নেই। কারণ তিনি তাঁর হৃদয়ে অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন এবং ধর্মের প্রতিশ্রুতি, যেমন বেহেশক ও দোজখ, আল্লাহ অস্তিত্বের ওপর বাধ্যতামূলক বিশ্বাস স্থাপনের প্রতি তাঁর আস্থা ছিল বলেও মনে হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তিনি মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকেও সমালোচনা করেছেন, যারা মনে করেন যে, সকল প্রশ্নের উত্তর তাদের কাছে আছে এবং বাদবাকি মানুষ অজ্ঞ, ক্ষুদে মানব। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, ব্রিটিশ-আমেরিকা লেখক-সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচেনস (১৯৪৮-২০১১) খৈয়ামের একটি রুবাইকে তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী মএক নিবন্ধের শিরোনামে ব্যবহার করেছেন, “ঈশ্বর মহান নয়।” রুবাইটি হলো:

“তোমার কি মনে হয় যে তোমার মতো
পোকার ডিমের মানসিকতার ক্ষুধার্ত, ধর্মান্ধকে
ইশ্বর একটি রহস্য বললেন, আর আমাকে অস্বীকার করলেন?
ভালো, খুব ভালো – কি আসে যায়! এটাও বিশ্বাস করো!”

খৈয়াম তাঁর রুবাইয়াতের বাইরে এক কবিতায় বলেছেন:

“আমাকে বলো, কে তোমার আইন কখনও লংঘন করেনি?
পাপ ছাড়া জীবনের কি স্বাদ আছে, আমাকে বলো।
আমার পাপে ক্ষুব্ধ হয়ে তুমি যদি আমাকে শাস্তি দাও,
তাহলে তোমার আর আমার মধ্যে কি পার্থক্য থাকে?”

অথবা এই রুবাই:

“আমি কি জাত-মাতাল? আমি তা হলেই বা কি?
আমি কি জরথুস্ত্র না কাফির? ধরে নাও, আমি তাই?
প্রতিটি গোষ্ঠী আমাকে গালি দেয়, আমি পাত্তা দেই না,
আমি আমার আপন, এবং আমি যা, আমি তাই।”

খৈয়াম আরেকটি রুবাইয়ে বলেছেন:
“আমাকে তৈরি করার সময় আল্লাহ ভালো করেই জানতেন,
আমার ভবিষ্যত নিয়ে প্রত্যেকে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবে;
তাঁর ইচ্ছার বাইরে তো আমি কোনো কাজই করিনি;
তাহলে কি শুধু আমাকেই জাহান্নামে শাস্তি পেতে হবে?”

অথবা এই রুবাইয়ে তিনি কি বলতে চেয়েছেন:
“কোরআনের কথা! আচ্ছা, আমাকে পরীক্ষা করতে দাও,
ভয়ানক লুকানো ভুলের চমৎকার পুরোনো গ্রন্থ,
বিশ্বাস করো, আমিও কোরআনের উদ্ধৃতি দিতে পারি,
অবিশ্বাসীই তার কোরআন সবচেয়ে ভালো জানে।”

খৈয়ামের খোলামেলা প্রকাশ্য সংশয়ের কারণে তাঁকে মুসলিম বিশ্বে অনেক সময় অস্বীকার করা হয়, যেন তারা খৈয়াম সম্পর্কে কিছু পাঠ করেননি। এর বিপরীত চিত্রও আছে, খৈয়ামের কবিতা ধর্মীয় মননশীলদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর রুবাইয়াত আল্লাহর বহু রূপের অন্বেষণ ও উপলব্ধি করার তাগিদ দিয়েছে, যা মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে অনুভব করে এবং যার সর্বোচ্চ রূপ ফারসি শব্দের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার ব্যবহার করে ‘প্রেম ও আলো’র বর্ণনা করা হয়েছে। খৈয়াম বলেছেন:

“আমার মাঝে তোমার অস্তিত্বই পেছন থেকে কাজ করে;
মহাবিশ্বের পর্দা খুঁজে পাওয়ার জন্য আমি কেঁদেছি;
অন্ধকারে আমাকে পথ দেখানোর একটি প্রদীপ ছিল;
এবং তখন কোনোকিছু বলে উঠেছে, ‘বুঝেশুনে অন্ধ।”

পর্দা এবং প্রদীপের রূপক সুফি সাহিত্যে প্রায়ই ব্যবহার করা হয়েছে ‘স্রষ্টার কাছ থেকে নৈতিক বৈশিষ্টসহ সৃষ্টির উদ্ভবের মতবাদ’ বর্ণনা করতে। স্রষ্টার মাঝে মানুষের বিলীন হয়ে যাওয়ার অর্থ এমন একটি ধারণা, যা স্রষ্টার কাছ থেকে মানুষের বিদায় নেয়া এবং অবশেষে মহাজাগতিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে স্রষ্টার সঙ্গে পুনর্মিলিত হওয়ার মধ্য দিয়ে এক হওয়া।

ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতে এমন রূপকের সমাহার কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। তার রুবাই অথবা সুফি কবিতায় সম্ভবত সাধারণভাবে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী বিষয় হলো সুরার ব্যবহার এবং আল্লাহর সঙ্গে চিরন্তন সম্পর্ক। খৈয়াম প্রায়ই ‘পানপাত্র’, ‘সুরাভর্তি সোরাহি’ অথবা ‘সাকি’ বা সুরা পরিবেশনকারী সুন্দরী তরুণীর কথা বলেছেন, যা সুফি পরিভাষায় আল্লাহর ধারণাকে ব্যক্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। খৈয়াম তার প্রথম দিকের একটি রুবাইয়ে বলেছেন:

“ভোরের বাম হাত যখন আকাশে, তখন আমি স্বপ্ন দেখছিলাম;
হঠাৎ আমি শুড়িখানার মধ্যে একটি কণ্ঠ শুনতে পেলাম;
‘জাগো, আমার সন্তানেরা, পানপাত্রে জীবনের তরল
ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই পানপাত্র ভরে নাও।’”

মহানবী সা: এর মৃত্যুর পর প্রথম চার খলিফার শাসনের অবসানে ইসলামী খিলাফতের যে যুগের সূচনা হয়, তখন থেকে সুরা পান আরবি ও ফারসি কবিতার অন্যতম মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। এমন কিছু কবিতা স্বয়ং খলিফারাও লিখেছেন বলে প্রমাণ পাওয়ভা যায়। যাদের মধ্যে একজন ছিলেন খলিফা আল-ওয়ালিদ ইবন ইয়াজিদ ইবন আবদ আল মালিক(৭০৯-৭৪৪)। তিনি কিছু চমৎকার এবং কিছু নিন্দনীয় কবিতা রচনা করেছেন। তার একটি কবিতা ছিল:

“আমি আল্লাহ, ফেরেশতা, তাঁর বান্দাদের;
সামনে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি গান গাইতে
এবং পানপাত্র সুরা পানের আকাক্সক্ষা করছি,
এবং মুখে স্পর্শ করতে চাইছি সুন্দর গাল।”

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on দু’টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on পাখিমানুষ