এ কে আজাদ
মানবেতিহাস বলি আর সাহিত্যের ইতিহাস বলি– এক দিনে কোন যুগের শেষও হয় না, সৃষ্টিও হয় না। ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে একটা যুগের শেষ যেমন হয়, শুরুও তেমন হয়। একটা যুগ শেষ হবার আগেই আরেকটা যুগের সূচনা–মোড়ের সৃষ্টি হয়। ঠিক একইভাবে সাহিত্যের আধুনিক যুগ শেষ হবার আগে থেকেই উত্তরাধুনিক যুগের সূচনা হয়েছিল। ইতিহাসের এই টার্ন– কিভাবে বুঝব আমরা? আধুনিক যুগের যে বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা লক্ষ্য করেছি, তা থেকে আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য, আলাদা কিছু ধরণ আমরা লক্ষ্য করতে থাকি আধুনিক যুগ শেষ হবার আগে থেকেই। বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষিতে ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগ থেকে সাহিত্যের যে ধারা শুরু হয়েছিল, বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকেই, অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই সে ধারা ভিন্ন পথে মোড় নিতে থাকে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব থেকে শুরু করে যুদ্ধের অব্যবহিত পরপরই রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি এবং মানুষের মানসিকতার পরিবর্তনের সাথে সাথে পূর্ণরূপে সাহিত্যের চেতনা, বিষয়বস্তু ও গঠনশৈলীতেও একটা বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিশ্ব সাহিত্য তথা ইংরেজি সাহিত্যে পরিবর্তন আগে শুরু হলেও সে পরিবর্তনের ঢেউ বাংলা সাহিত্যে এসে লাগে পরে। কাজী নজরুল ইসলাম যেহেতু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেহেতু বিশ্বের খবরাখবর এবং পরিবর্তন সম্বন্ধে আগে থেকেই তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। একজন বাঙালি সাহিত্যিক হিসেবে তিনিই প্রথম বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগান। বাংলা সাহত্যি অনুভব করে এক বিপ্লবী অনুভূতি। সে কারণে সকল তর্ক বিতর্ককে মাথায় নিয়েই বলতে চাই যে, কাজী নজরুল ইসলামের হাত দিয়েই বাংলা সাহিত্যে উত্তরাধুনিকতার যাত্রা শুরু হয়েছিল। তিনিই বাংলার মানুষের মননশীলতায়, শিল্প-সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে ও সামাজিকতায় উত্তরাধুনিক চিন্তার পথিকৃৎ। হয়তো এ কথায় অনেকের মনেই খটকা লাগতে পারে। তা তো লাগবেই– কেননা অনেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কে যখন উত্তরাধুনিকদের উত্থান বলছেন, তখন আমি বলছি — নজরুলের হাত দিয়ে উত্তরাধুনিকতা শুরু! হ্যাঁ আমি বলছি এ কারণে যে– বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শুরুতেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, বৈজ্ঞানিক নানান অভিনব আবিষ্কার, মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা ও চিন্তা-চেতনার বিকাশ এবং আধুনিক যুগের অর্থনৈতিক শোষণ ও যুদ্ধসহ নানান হতাশা মানুষকে উত্তরাধুনিকতার দিকে ঠেলে দেয়। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, তথ্যের-আদান প্রদানের সহজলভ্যতা উত্তরাধুনিকতাকে করে ত্বরান্বিত। বিংশ শতকের শুরু থেকেই যে চিন্তা-চেতনা মানুষের মনে বিকাশ লাভ করতে থাকে, তা জীবন ও জগতের উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে সাহিত্যেও প্রভাব বিস্তার করতে থাকে অত্যন্ত প্রবলভাবে। ঠিক সেই সময়েই কাজী নজরুল ইসলামের উত্থান। শুধু তাই নয় একজন সৈনিক হিসেবে নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। সে সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাহিত্য সংস্কৃতির সংস্পর্শ তিনি লাভ করতে সক্ষম হন। একজন যোদ্ধা হিসেবে পৃথিবীর উন্নতি, অগ্রগতি, প্রযুক্তির প্রভাব সবই তিনি পরখ করেছেন সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু বেশী এবং বহুলাংশে সাধারণ মানুষের আগেই। যার কারণে একজন কবি হিসেবে সে সময়ের সাহিত্যের পরিবর্তনের ছোঁয়া তাঁকেই আগে লেগেছিল নিশ্চিতরূপে। সুতরাং আমি বলব যে, বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষিতে আধুনিক যুগের চেতনাগত যাত্রা শুরু হয়েছিল বিংশ শতকের প্রথম দশকেই। এই যাত্রাপথ আরও গতিশীল হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে, অর্থাৎ ১৯২০ এর দশক থেকেই। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার ছোঁয়া পরে লাগলেও বিশ্ব সাহিত্যে এ যাত্রা শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। উত্তরাধুনিকতা যদি মনস্তাত্ত্বিক ও জ্ঞানতাত্বিক দর্শন হয়, তাহলে আমি বলব যে– সে দর্শনযাত্রার অগ্রপথিক ছিলেন হাবিলদার কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যার কারণে উত্তরাধুনিক সাহিত্যের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় বর্তমান ছিল প্রভূত পরিমাণে।
প্রকৃতপক্ষে উত্তরাধুনিকতার কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা না নির্ণিত হলেও, কিছু বৈশিষ্ট্য আধুনিক সাহিত্য থেকে উত্তরাধুনিক সাহিত্যকে করেছে আলাদা । এবার আসা যাক উত্তরাধুনিক সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যগুলোর দিকে। উইকিপিডিয়া মতে—
Postmodernist writers sought to undermine established literary conventions as a way to explore their own intense feelings surrounding the major events that had occurred in the world during their lifetimes. Postmodern literature is a form of literature which is marked, both stylistically and ideologically, by a reliance on such literary conventions as fragmentation, paradox, unreliable narrators, often unrealistic and downright impossible plots, games, parody, paranoia, dark humor and authorial self-reference.
বিভিন্ন পাঠ থেকে উত্তরাধুনিক সাহিত্যের যে বৈশিষ্ট্যগুলো বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, সেগুলো হলো — চলমান সমাজ ব্যবস্থার বিপরীতে প্রশ্ন উত্থাপন, কবিতার গঠনগত বিনির্মাণ (Deconstruction of poetic form), সরাসরি পাঠককে বা প্রধান চরিত্রকে সম্বোধন করে বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ, ভাষার ব্যবহার, সাংস্কৃতিক শংকরতা, রাজরাজড়া ও উঁচু শ্রেণির মানুষের হাত থেকে সাহিত্যকে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের নিয়ে আসা, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষকে সাহিত্যের অনুষঙ্গ করা, প্রান্তজনের জীবন বোধকে সাহিত্যিক মর্যাদা দান, ধর্মীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িকতা, পরোয়াহীনতা বা নিজস্ব চিন্তা চেতনার আলোকে সাহিত্য রচনা, মানবিকতা, বিশ্বজনীনতা, হতাশা ও নৈরাজ্য ইত্যাদি। এ সবই নজরুলের কবিতাকে দান করেছে সমকালীন কবিতা থেকে ভিন্নতা। সুতরাং বাংলা সাহিত্যের উত্তরাধুনিকতার ইতিহাস লিখতে গেলে নজরুলকে দিয়েই শুরু করতে হবে। তা যদি না করা হয়, তাহলে সেটা নজরুল সাহিত্যের উপরে যতটা না অবিচার হবে, তার চেয়ে বেশী আসারতা প্রমাণিত হবে সেই ইতিহাসের। যা হোক, প্রবন্ধের কলেবরের দিকে লক্ষ্য রেখে নজরুল সাহিত্যের অসংখ্য উত্তরাধুনিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে হাতে গোনা দু’চারটার কথা আলোপাত করা যাক এবার।
উত্তরাধুনিক কবি সাহিত্যকদের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো কাঠামো বা ফর্ম ভেঙ্গে বের হয়ে আসা। একটি এন্টিফর্ম বা চক্রহীনতা তৈরী করা। আধুনিকের যে যুথবদ্ধ সিস্টেম, তারা সেখান থেকে বের হয়ে নতুনত্ব ও অভিনবত্ব সৃষ্টি করতে চান। এ ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার যে ফরম বা গঠনশৈলী, তা নিয়ে যদি একটু ভিন্ন আলোচনার দিকে আমরা মনোনিবেশ করি, তাহলে দেখি যে– চলমান কবিতার যে আঙ্গিক গঠন, সেখান থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন। তিনি শুরু করেছেন এভাবে–
বল বীর–
বল উন্নত মম শির।
শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির।
এই যে কবিতার গঠন, এটি বহুদিন ধরে চলে আসা কবিতার গঠন থেকে আলাদা। বাংলা সাহিত্যে যাদেরকে আমরা প্রধান আধুনিক কবি বলছি, সেই পাঁচজনের একজন বুদ্ধদেব বসু তার ‘কালের পতুল’এ লিখেছেন– এ কথা সত্য যে রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষায় নজরুলই প্রথম মৌলিক কবি। তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথের পথ ছাড়াও অন্য পথও বাংলা কবিতায় সম্ভব।”
‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার মাধ্যমে নজরুল ইসলামই প্রথম সমিল-মুক্তক-মাত্রাবৃত্ত ছন্দের প্রবর্তন করেন। এ প্রসঙ্গে ‘নাগরিক সংবাদ’এ ২০২১ সালের ২২শে ডিসেম্বর তারিখে কবি-নাতনী অনিন্দিতা কাজীর “শতবর্ষেও চির উন্নত তব শির” শীর্ষক লেখার অংশ বিশেষ কোট করতে চাই। তিনি লিখেছেন “এ কবিতা সম্পর্কে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতামত জানা যায় সজনীকান্ত দাসের আত্মস্মৃতি থেকে। তিনি লিখছেন– ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা মনে লইয়া একদিন বিকেলে মফস্বলীয় মূঢ়তাসহ ভয়ে ভয়ে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সামনে দাঁড়ালাম এবং সংকোচে মরিয়া হইয়া শেষ পর্যন্ত ‘বিদ্রোহী’ সম্পর্কে আমার বিদ্রোহ ঘাষণা করিলাম। বলিলাম- ছন্দের দোলা মনকে নাড়া দেয় বটে, ‘আমি’র এলোমেলো প্রশংসা-তালিকার মধ্যে ভাবের কোন সামঞ্জস্য না পাইয়া মন পীড়িত হয়। এ বিষয়ে আপনার মত কি? প্রশ্ন শুনে বোধ হয় সত্যেন্দ্রনাথ একটু অবাক হয়েছিলেন। পরে একটু হেসে বললেন– কবিতার ছন্দের দোলা যদি পাঠকের মনকে নাড়া দিয়ে কোন ভাবের ইঙ্গিত দেয়, তাহলেই কবিতা স্বার্থক।’’ অর্থাৎ ছন্দের বিভিন্ন দিক নিয়ে নজরুলের যে নিরীক্ষা-প্রবণতা, তাকে ছন্দের যাদুকর বলে খ্যাত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত সেদিন সত্যয়ন করেছিলেন; যেটা ছিল আধুনিকতার ফর্মের বিপরীতে নজরুলের এক উত্তরাধুনিক বিদ্রোহ।
উত্তর আধুনিকতাকে যদি একটি আদর্শিক সংগ্রাম বলে আমরা সংজ্ঞায়িত করে থাকি, তাহলে নজরুলকেই প্রথম এর দিকপাল হিসেবে ধরতে হবে। কেননা আধুনিকতার দর্শন হলো– ক্ল্যাসিক্যাল যুগের যে যুতসই শৈল্পিকতা, সেখান থেকে সাহিত্যকে বের করে নিয়ে আসা। আর উত্তর-আধুনিক কবিরা চেষ্টা করেছেন প্রাতিষ্ঠানিকতার বিপরীতে নিজস্ব একটা দর্শন দাঁড় করাতে। তারা মনে করেন– একজনের কাছে যেটা সত্য বলে প্রতিভাত হয়, অন্যজনের কাছে সেটা সত্য বলে মনে নাও হতে পারে। এমন কি উত্তরাধুনিক কবিদের কাছে কিছুদিন আগেও যেটা সত্য বলে মনে হয়েছে, পরবর্তীকালে সেটাও মিথ্যা ও বিপরীত বলে মনে হয়েছে। অর্থাৎ নিজের বিরুদ্ধে নিজে বিদ্রোহ করাও উত্তর-আধুনিক কবিদের একটা বৈশিষ্ট্য বটে। নজরুলেই এই বৈপরীত্যের প্রকাশ আমরা প্রকৃটরূপে দেখতে পাই। তাঁর বিদ্রোহী কবিতার বহু লাইনে এমন বিপরীত সত্তার প্রকাশ করেছেন তিনি:
“আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান”
.. .. .. .. .. .. .. .. .. .. ..
“মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য”
কাজী নজরুল ইসলাম একদিকে নিজেকে উন্মাদ বলে দাবি করছেন, আরেক দিকে বলছেন- তিনি নিজেকে চিনেছেন:
“আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, একি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।” [বিদ্রোহী]
মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের সেই দর্শন– Know thyself “নিজেকে চেনো” এর প্রতিধ্বনি যেন নজরুলের কবিতায়, আবার একই সাথে তিনি নিজেকে উন্মাদ বলছেন। উত্তরাধুনিকতার এমন বহু বৈশিষ্ট্য নজরুলের কবিতাকে আধুনিকতা থেকে করেছে আলাদা । তবে নজরুলের সাহিত্য-চেতনা, উত্তরাধুনিক কোন কোন কবির থেকে এক জায়গায় আলাদা হয়ে গিয়েছে যে– উত্তরাধুনিক কবিদের কেউ কেউ বাস্তবতাকে অস্বীকার করেছেন, কিন্তু সেখানে নজরুল বাস্তবতাকে ধারণ করেছেন কঠিনভাবে। তবে তাঁর কবিতা অবাস্তব থেকে কখনো কখনো ম্যাজিক রিয়েলিটির দিকে যেমন মোড় নিয়েছে, তেমনি নিরেট অসম্ভব বাস্তবতার দিকেও ধাবিত হয়েছে।
আধুনিক কবিদের কবিতায় যৌনতা ও নারীপ্রেম এসেছে পরিশীলিতরূপে, কিন্তু উত্তর-আধুনিক কবিদের লেখায় কখনো তা এসেছে অশ্লীলভাবে। উত্তরাধুনিক কবিদের লেখায় পতিতারাও এসেছে শুধুমাত্র মজার ও বিনোদনের বিষয় হিসেবে, কিন্তু নজরুলের কবিতায় পতিতারা এসেছে শুধুমাত্র মজার ও বিনোদনের বিষয় হিসেবে নয় বরং সম্মানীয় নারী হিসেবে। আর এটা করতে গিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের দীর্ঘদিনের বিশ্বাস ও কোন কোন সম্প্রদায়ের দেবতাদের দিকেও আঙ্গুল তুলেছেন তিনি:
কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও গায়?
হয়ত তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়।
নাই হলে সতী, তবু তো তোমরা মাতা ভগিনীরই জাতি,
তোমাদের ছেলে আমাদেরই মত, তারা আমাদেরই জ্ঞাতি;
.. .. .. .. .. .. .. . .. . .. . . . .
স্বর্গবেশ্যা ঘৃতাচী-পুত্র হ’ল মহাবীর দ্রোণ,
কুমারীর ছেলে বিশ্বপূজ্য কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ,
কানীন-পুত্র কর্ণ হইল দানবীর মহারথী,
স্বর্গ হইতে পতিতা গঙ্গা শিবেরে পেলেন পতি।
.. .. .. .. .. .. .. . .. . .. . . . .
পাপ করিয়াছো, বলিয়া কি নাই পূণ্যেরও অধিকার?
শত পাপ করি’ হয়নি ক্ষুন্ন দেবত্ব দেবতার। [বারাঙ্গনা]
আধুনিক সমাজে পতিতাদেরকে আসম্মানের চোখে দেখা হয়। কিন্তু নজরুল একটি আলাদা সাহিত্য প্রোপ (উরংপড়ঁৎংব) তৈরী করে তাদেরকে সম্মানের জায়গায় নিলেন। শুধু তাই নয়, অসতী মায়ের সন্তানকে আধুনিকরা ‘জারজ’ বলে যে নাম দিয়েছেন, যেটা সমাজের চোখে নিন্দনীয়, মজার ব্যাপার হলো, নজরুল এখানে একটা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি দাঁড় করিয়ে বললেন:
শোন ধর্মের চাঁই–
জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোন সে প্রভেদ নাই।
অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ পুত্র হয়,
অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়। [বারাঙ্গনা]
এইখানে এসে নজরুল শুধু আধুনিক বা উত্তরাধুনিক থাকলেন না, উত্তরাধুনিকতাকে ছাপিয়ে নিজেকে দাঁড় করালেন উত্তর-উত্তরাধুনিক রূপে।
আধুনিক সমাজব্যবস্থা বলে যে- কোন যুদ্ধে যে সমস্ত বীর শহীদ হন, তাঁদের সম্মানে শহীদ মিনার বা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী করে তাদেরকে স্মরণে রাখতে হবে। এই যে ধারণা– এই ধারণাকে খানিকটা পুনঃনির্মাণ করলেন নজরুল, যেটাকে আমরা বলছি ডিকনস্ট্রাকশন বা বিনির্মাণ। তিনি বললেন –
কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে,
কত মাতা দিল হৃদয় উপারি কত বোন দিল সেবা
বীরের স্মৃতি স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা!
কোন কালে একা হয়নি ‘ক জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী।
…………………………………………….
পুরুষ হৃদয়হীন,
মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ। [নারী]
আধুনিকতার বিপরীতে এবং সিস্টেমেটিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একমাত্র উত্তরাধুনিকরাই প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। এক্ষেত্রে নজরুল ছিলেন অগ্রগামী। এক সময় পৃথিবীতে দাস প্রথা ছিল, তখন মানুষ কেনাবেচা হত। বিক্রিত মানুষদের দিয়ে যে কোন কাজ করানো যেত ইচ্ছে মত। কিন্তু তাদের অধিকার বলে দাবী করার মত কিছু ছিল না। আধুনিক যুগে এসে একটা সিস্টেম চালু হলো, শ্রমনীতি তৈরি হলো। মানুষের পরিবর্তে শ্রমকে কিনতে শুরু করল মানুষ– বলে দাবী করল আধুনিক বিশ্বব্যবস্থা। কিন্তু আদৌ কি শ্রমিকরা তাদের অধিকার পাচ্ছে ঠিক মত? এই যে আধুনিকতার সংকট — তাকে প্রশ্ন করতে ছাড়েননি উত্তরাধুনিক নজরুল। শুধু প্রশ্নই করেননি, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন শ্রমিকের অবদানের।
বেতন দিয়াছো? চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল,
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল?
রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে
রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
বল তো এসব কাহাদের দান? তোমার অট্টালিকা
কার খুনে রাঙা? ঠুলি খুলে দেখ প্রতি ইটে আছে লিখা।
তামি জানো না কো কিন্তু পথের প্রতি ধুলিকণা জানে,
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে।
………………………………………..
তুমি শুয়ে রবে তেতলার পরে আমরা রহিব নীচে,
অথচ তোমারে দেবতা বলিব- সে ভরসা আজ মিছে! [কুলিমজুর]
আধুনিক পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা, ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার বিপরীতে প্রশ্ন তোলাই যখন উত্তরাধুনিক কবিদের বৈশিষ্ট্য, তখন নজরুল শুধু প্রশ্ন তুলেই ক্ষ্যান্ত হলেন না, এই সমস্ত শ্রমিক, মজুর, মুটে ও কুলিকে তিনি দিলেন আলাদা মর্যাদা। উত্তর-উত্তরাধুনিক কবি হিসেবে প্রশ্ন তুলে দিলেন সমাধান। এই সমস্ত অধিকারহারা নিষ্পেষিত মানুষকে তিনি বসালেন ভগবানের আসনে:
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভঙ্গিল যারা পাহাড়,
পাহাড় কাটা সে পথের দুপাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইলো যাহারা মজুর মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগালো ধূলি,
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদের গান,
তাদেরই ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান। [কুলি মজুর]
শ্রমিক, কুলি, মজুর যাদের রক্তে ঘামে তিল তিল করে গড়ে উঠেছে এই সভ্যতার স্বপ্নভূমি, নজরুল তাদেরকেই মানুষ বলছেন, তাদেরকেই অভিহিত করছেন দেবতা বলে। যারা সভ্যতার সুবিধাভোগী তাদেরকে নজরুল ‘মানুষ’ বলছেন, নাকি কি বলে সম্বোধন করছেন, সেটা একটা চিন্তার বিষয় বটে। এই এখানেই নজরুল উত্তরাধুনিকতাকে যেমন স্পর্শ করলেন, তেমনি প্রকাশ করলেন উত্তর-উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি।
সাহিত্য ও জীবন-জগৎ সমন্ধে নজরুল সৃষ্টি করেছেন একটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। অর্থাৎ ভাঙচুর করেছেন বহু বছর ধরে চলে আসা সামাজিক প্রথাকে। আধুনিক জীবনে একজন মা তাঁর সন্তানকে খাওয়াবেন, ঘুমিয়ে দেবেন, ঘুম থেকে জাগিয়ে দেবেন– এমনই তো দৃষ্টিভঙ্গি আমরা পোষণ করে থাকি। নজরুল এসে এই চিন্তা-চেতনাকে ভাঙলেন। শিশুকে দাঁড় করালেন মায়ের চাইতে সচেতন রূপে। আধুনিক চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে একটা ডিকনস্ট্রাকশন বা চেতনার বিনির্মাণ করলেন তিনি:
বলব আমি– আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাকো
হয়নি সকাল তাই বলে কি সকাল হবে না কো?
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে।
ঝর্ণা মাসী বলবে হাসি– খোকন এলি নাকি?
বলব আমি– নই কো খোকন, ঘুম জাগানো পাখি। [খোকার সাধ]
সারা জীবনই আমরা জেনে আসছি যে, মা-বাবারা বাচ্চাদেরকে বাঘ শিয়ালের ভয় দেখিয়ে ঘুমিয়ে দেন। দুষ্টুমী করলে ভীতি প্রদর্শন করেন জুজুবুড়ির নামে, বিভিন্ন হিংস্র প্রাণীর নামে। এটাই আধুনিক জীবনের সন্তান লালন পালনের ধারা বলে বাপদাদার আমল থেকে আমরা দেখে আসছি। আধুনিক সাহিত্যও এই ধারাতেই রচিত হলো। কিন্তু নজরুল এসে উল্টো একটা দর্শন দাঁড় করালেন। তিনি আইডিয়ার ডিকনস্ট্রাকশন বা বিনির্মাণ করলেন। নজরুলের সেই ডিসকোর্সে তিনি দেখালেন শিশু তার মাকে ভয় দেখাচ্ছে–
মাগো তোরে সত্যি বলি, দেখে এলাম ছাদে গিয়ে
মা-ধরা এক জুজুবুড়ি বসে আছে ঝুলি নিয়ে।
………………………………………………
না বেড়াতে দিয়ে রোদে যে মা ধরে পাড়ায় ঘুম
বললে বুড়ি- “বস্তায় পুরে লাগাই তারে ধমাধুম”। [জুজুবুড়ির ভয়]
উত্তরাধুনিক কবিদের আরেকটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো- অকল্যাণের নিয়োজিত সকল প্রকার আইন, ব্যবস্থা, ও পদ্ধতির প্রতি অনাস্থা। তবে সেটা আইনের দৃষ্টিতে বেআইনি হলেও কবির দাবী যে– তিনি ন্যায়ের পক্ষেই আছেন। এমন উদাহরণ নজরুলে ভূরি ভূরি। ‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’তেও তিনি এমনই দাবী করেছেন। কেউ কেউ এটাকে নৈরাজ্যবাদিতা বলেও অভিহিত করেছেন। যাই হোক, নজরুল লিখেছেন:
আমি দুর্বার
আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার।
আমি অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দলে যাই যত বন্ধন, নিয়ম কানুন শৃঙ্খল,
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা তরী করি ভরাডুবি, আমি টর্নেডো
আমি ভীম, ভাসমান মাইন।
……………………………..
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা। [বিদ্রোহী]
কাজী নজরুল ইসলাম ইসলাম ধর্ম নিয়ে যেমন লিখেছেন, তেমনি হিন্দু ধর্মের শ্যামাপূজা, কালিপূজা নিয়েও লিখেছেন। এ কারণে কিছু সমালোচক তাঁকে আধুনিক কবি বলতেও নারাজ। যদিও তাদের দাবী একপেশে বলে প্রতীয়মান হয়, যখন আমরা দেখি যে, নজরুল ধর্মের নামে অধর্মের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। ধর্মীয় গোঁড়ামী তাঁকে ছুঁতে পারেনি। যার কারণে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও সমাজ ব্যবস্থার কালো অধ্যায়ের পাশাপাশি ধর্মের নামে যে অমানবিকতা ও অনাচার, তার বিরুদ্ধেও নজরুলের অবস্থান একজন উত্তরাধুনিক কবি হিসেবেই। তাঁর কাছে নির্দিষ্ট কোন ধর্মের নামে অন্য কোন ধর্মের মানুষের অধিকারকে হরণ করা বা অন্য কোন ধর্মের উপরে অন্যায় আঘাত ও অবিচার অত্যন্ত গর্হিত কাজ ও ঘৃণ্য অপরাধ। এই অপরাধের বিপরীতে একজন উত্তরাধুনিক কবির অবস্থানকে কেউ কেউ অসাম্প্রদায়িকতা বলে অভিহিত করে থাকেন। যদিও নজরুলের উত্তরাধুনিক মানসিকতার ভেতরে কোন সম্প্রদায়হীনতা নেই, বরং আছে সকল সম্প্রদায়ের ন্যায়সঙ্গত ও সম্প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থান। তিনি লিখেছেন–
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সকল দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা।
হায় রে ভজনালয়!
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!
মানুষেরে ঘৃণা করি,
ও কারা কোরান বেদ বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি,
ও মুখ হতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে
পুজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল!……. [মানুষ]
সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় নজরুল লিখলেন–
গাহি সাম্যের গান–
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গিয়েছে সব বাধা ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম ক্রীশচান। [সাম্যবাদী]
তিনি আরও লিখলেন–
মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান
মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।
সর্ব সম্প্রদায়ের প্রীতি বলি, আর অসাম্প্রদায়িক বলি, যাই বলি না কেন বাংলা সাহিত্যের উত্তরাধুনিক ধারার এই বৈশিষ্ট্য প্রথম আনয়ন করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম।
উত্তরাধুনিক কবি সাহিত্যিকদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো বিজ্ঞান-মনস্কতা। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার এবং সভ্যতা বির্নিমানে বিজ্ঞানের অবদান উত্তরাধুনিক সাহিত্যিকদের মন ও মননকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত ও প্রভাবিত করেছিল। আমি বলব যে- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুলই সব থেকে বহুলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন বিজ্ঞানের অসীম অবদানে। শুধু তাই নয়, যে আবিষ্কার উত্তরাধুনিককালে হয়ইনি সে আবিষ্কারের প্রত্যাশাতেও ছিলেন তিনি।
‘সংকল্প’ কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেছিলেন সম্ভবত ১৯২৪ সালের দিকে। ২০২৩ সালে এসে কবিতটির বয়স প্রায় ১০০ বছর। মানুষ প্রথম চাঁদে অভিযান করে ১৯৫৯ সালে। এর পরে চাঁদের মাটিতে প্রথম মানুষের পা পড়ে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই। জার্মানীর বিজ্ঞানী বার্ণার ফন ব্রাউন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভি-২ গাইড মিসাইল নামে প্রথম রকেট আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে নাসার সহযোগিতায় তিনি ভি-৫ রকেট বুস্টার আবিষ্কার করেন যার মাধ্যমে ১৯৬৯ সালে এপোলো-১১ এর মাধ্যমে মার্কিন মহাকাশচারীগণ চাঁদের মাটিতে প্রথম পা রাখতে সক্ষম হন। অথচ নজরুল এই রকেট আবিষ্কারের ধারনার কথা এবং চন্দ্রাভিযানের প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করেন সেই ১৯২৪ সালেই। মঙ্গলে অভিযান পরিকল্পনা ১৯৪০ এর দশকে শুরু হলেও প্রথম অভিযান হয় ১৯৭১ সালে। মঙ্গলে প্রায় অধিকাংশ অভিযান ব্যর্থ হলেও ২০১৮ সালে প্রথম সফলতা প্রায় মানুষ। অথচ সেই ১৯২৪ সালেই নজরুল লিখলেন–
হাউই চড়ে যায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিনপুড়ে,
শুনবো আমি ইঙ্গিত কোন মঙ্গল হতে আসছে উড়ে। [সংকল্প]
এমনিভাবে আকাশ, বাতাস, চন্দ্র-তারায়, পাহাড় চূড়ে এবং সাগরজলে অভিযানের কথা বলেন নজরুল। নিজের সীমার বাঁধন টুটে অর্ন্তজালের মাধ্যমে দশদিকে ছড়িয়ে পাড়ার বাসনাও তাঁর। মজার ব্যাপার এই যে, ২০০৭ সালে স্মার্ট ফোন আবিষ্কৃত হয় এবং ২০১৪ সালে গুগল এন্ড্রয়েড ওয়ান বাজারে ছাড়ে যা একটি স্মার্ট ফোনের আদর্শ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। এখন গুগল সকল তথ্যের ভান্ডার হিসেবে সারা পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। পৃথিবীর পথ ঘাট থেকে শুরু করে মহাকালের নানাবিধ তথ্য প্রদান করে গুগল এখন মুটে মজুর থেকে শুরু করে মহাজ্ঞানী সকলের কাছে অপরিহার্য্য হয়ে উঠেছে। সকলের হাতে এখন এন্ড্রয়েড ফোন, সকলের নিত্যসঙ্গী এই এন্ড্রয়েড ফোন ছাড়া যেন এক মুহূর্তও চলে না মানুষের। অথচ নজরুল প্রায় একশ’ বছর আগেই লিখেছিলেন :
রইবো না কো বদ্ধ খাঁচায় দেখব এসব ভূবন ঘুরে–
আকাশ বাতাস চন্দ্র তারায় সাগরজলে পাহাড় চূড়ে
আমার সীমার বাঁধন টুটে
দশ দিকেতে পড়ব লুটে,
পাতাল ফেঁড়ে নামব নীচে, উঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে
বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে। [সংকল্প]
আরও মজার ব্যাপার হলো– ২০২২ সালের আগস্ট মাসে চীনের মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ব্যাপক খরা এবং তাপদাহ দেখা দেয়। এশিয়ার দীর্ঘতম নদীপথ ইয়াংশি নদীসহ চীনের জলাধারগুলোর পানি সর্বনিম্ন স্তরে নেমে যায়। ফলে তাদের জলবিদ্যুৎ কারখানাগুলো প্রায় বন্ধে পরিণত হয়। প্রায় দুমাস ধরে সেখানে প্রচণ্ড তাপদাহ চলে। এখান থেকে রেহাই পেতে চীনের হুবেই প্রদেশসহ কিছু সংখ্যক প্রদেশে রকেট দিয়ে ড্রাই আইস ও সিলভার আইওডায়েড দিয়ে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ক্লাউড সিডিং এর মাধ্যমে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়। এখানে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ফ্যান ও এসি আবিষ্কারের মাধ্যমে বাতাসকে নিয়ন্ত্রণের দ্বারা আমরা সুবিধা ভোগ করছি যা ১৯২৪ সালের আগে ভারতীয় উপমহাদেশে আসেনি। অথচ নজরুল বাতাস ও পানিকে নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন সেই সময়ে :
হানিয়া বজ্র-পানির বজ্র উদ্ধত শিরে ধরি
যাহার চপলা মেঘ কন্যারে করিয়াছে কিংঙ্করী,
পবন যাদের ব্যজনী দুলায় হইয়া আজ্ঞাবাহী
এসেছি তাদের জানাতে প্রণাম, তাহাদেরি গান গাহি। [আমি গাই তারি গান]
এখন প্রশ্ন রাখতে চাই– বিজ্ঞানের যে আবিষ্কার হয়ইনি, আবিষ্কারের যে ধারণা মানুষের মাথায় আসেইনি এমন বিষয় নিয়ে যে কবি কথা বলেন– তাঁকে আমরা কি বলে অভিহিত করব? আধুনিক? উত্তরাধুনিক? উত্তর-উত্তরাধুনিক? না কি অন্য কিছু?
উত্তরাধুনিকতা যদি একটি আদর্শিক আন্দোলনের নাম হয়, একটি দর্শনের নাম হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে নজরুল একজন উত্তরাধুনিক কবি; এমন কি তাঁকে উত্তর-উত্তরাধুনিক কবি বললেও মনে হয় অত্যুক্তি হবে না। কেননা তিনি তাঁর কালকে যেমন অতিক্রম করতে পেরেছেন, তেমনি পেরেছেন তাঁর পরবর্তী কালকে অতিক্রম করতে। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, উত্তরাধুনিক কবিদের ভেতরে শব্দের যে দুর্বোধ্যতা বা দুর্ভেদ্যতা লক্ষ্য করা যায়, নজরুলের ভেতরে তা ছিল না। নজরুল তা করেননি। কেননা নজরুল “আর্টস্ ফর আর্টস্ শেক”– শিল্পের জন্য শিল্প– এই তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। নজরুল বিশ্বাস করতেন– “আর্টস্ ফর লাইফস্ শেক”– জীবনের জন্য শিল্প। ফলে তাঁর কবিতাকে দুর্বোধ্যতা স্পর্শ করতে পারেনি। দুর্ভেদ্যতা তাঁর অভিধানে ছিল না। কেননা তিনি ওয়ার্ডসওয়ার্থের মত বিশ্বাস করতেন– এ পোয়েট ইজ এ ম্যান স্পিকিং টু মেন– কবি হলেন একজন মানুষ, যিনি মানুষের উদ্দেশ্যে কথা বলেন। সুতরাং তাঁর ভাষা দুর্বোধ্য হলে, কবি হবার উদ্দেশ্যই তো বিফলে যাবে। একজন কবি তো মানুষের জন্য, মানবতার জন্য। মানুষের উদ্দেশ্যেই তাঁর সকল কথা। তবে ভাব ও ভাষার গভীরতা তাঁকে আধুনিক কবিদের থেকে আলাদা যেমন করেছে, তেমনি করেছে কালোত্তীর্ণ। প্রকৃতপক্ষে নজরুলের ভেতরে আধুনিকতা যেমন ছিল, তেমনি ছিল উত্তরাধুনিকতা ও উত্তর-উত্তরাধুনিকতা এবং বাংলা সাহিত্যে উত্তরাধুনিকতার যাত্রাই শুরু হয়েছিলো নজরুলের হাত ধরে। এখন প্রশ্ন হলো– তাহলে তিরিশের দশকের যে পঞ্চ পাণ্ডব ( অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে এবং সুধীন্দ্র নাথ দত্ত), তাদেরকে আমরা কি আধুনিক কবি বলব না? তাদেরকে আমরা কোন যুগের ক্যাটাগরিতে ফেলব? এক্ষেত্রে কবি আল মাহমুদের কথাকে স্মরণ করতে চাই যে, “তারা ছিলেন বাংলা ভাষার ইউরোপীয় কবি।” কথাটা নিয়ে হয়ত বেশ সমালোচনা হতে পারে, হৈ চৈ হতে পারে। হোক। কেন না আমি তো তাদের বিশ্লেষণে বসিনি, কেবল মাত্র প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি যে– নজরুলের ভেতরে উত্তরাধুনিকতারও বৈশিষ্ট্য ছিল এবং নজরুলের হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে উত্তরাধুনিকতার যাত্রা শুরু হয়েছিল। বাদ বাকি জ্ঞানীগুণী আলোচক ও সমালোকদের হাতেই না হয় ছেড়ে দিলাম।
১২/০৮/২০২৩
[লেখক: এ কে আজাদ, কবি গীতিকার ও প্রাবন্ধিক ]
গ্রন্থসহায়িকা :
১. নজরুল কাব্য সমীক্ষা : আতাউর রহমান
২. নজরুল : কবি ও কাব্য, সম্পাদনায় : প্রণব চৌধুরী
৩. নজরুল রচনাবলী : প্রকাশনায় : বাংলা একাডেমি
৪. বহুমাত্রিক নজরুল, হাসান হাফিজ সম্পাদিত
৫. সঞ্চিতা : কাজী নজরুল ইসলাম
৬. প্রবন্ধ সংকলন: বুদ্ধদেব বসু
৭. ইন্টারনেট : উইকিপিডিয়া