আমিনুল ইসলাম
[কবি হিসেবে তিনি কতো বড়ো, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, তিনি তাঁর বিশিষ্টতায় সমুজ্জ্বল– তিনি একক ও অনন্য। সমসাময়িক কবিদের সঙ্গে তাঁর তুলনা তিনি অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছেন, কারণ অন্যেরা যেখানে শুধুই কবি, তিনি সেখানে তাঁর সৃষ্টির চেয়েও মহত্তর এক ব্যক্তি, তিনি ইতিহাসের স্রষ্টা, এবং ইতিহাসের একপর্বের একজন নায়ক। সমকালকে এভাবে আলোড়িত অভিভূত আর কোনও কবি করেনি। (জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী)]
‘আমায় নহে গো ভালোবাসো শুধু ভালোবাসো মোর গান’ কাজী নজরুল ইসলামের এই বাণী তাঁর জীবদ্দশাতেই আংশিকভাবে ভুল প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল। তিনি তাঁর সৃষ্টি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হওয়ার পাশাপাশি তরুণ বয়সেই বাঙালি জাতি কর্তৃক জাতীয় কবির সংবর্ধনা লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি হয়েছেন বাঙালি জাতির একমাত্র স্বাধীন সার্বেভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তিনি কোটি কোটি বাঙালির প্রিয় কবি-গীতিকার এবং ব্যক্তি। তাঁর কবিতা গান এবং অন্যান্য সৃষ্টি সমান জনপ্রিয়তার পঠিত ও উচ্চারিত হচ্ছে প্রতিদিন। বিবিসি পরিচালিত জরীপেও তিনি হাজার বছরের সকল বাঙালির মধ্যে ৩ নং স্থান অধিকার করেছেন। একশ্রেণির উন্নাসিক বুদ্ধিজীবীর নজরুলবৈরিতা এবং মুখোশপরা নানাবিধ কায়েমী ষড়যন্ত্র নজরুলের জনপ্রিয়তাকে আটকিয়ে রাখতে পারেনি। অর্থাৎ বাঙালি জাতি ব্যক্তি নজরুল এবং কবি-সংগীতকার নজরুল উভয়কে গ্রহণ করেছেন সমান ও যুগপৎ শ্রদ্ধা-ভালোবাসায়।
একজন সৃজনশীল ব্যক্তির প্রিয় হয়ে ওঠার পিছনে দুটি প্রধান কারণ কাজ করে থাকে। এক, তাঁর সৃষ্টির সৌন্দর্য ও তাতে জীবনের নান্দনিক প্রতিচ্ছবির প্রতিফলন এবং সেসবের স্থায়িত্ব এবং দুই, ব্যক্তি হিসেবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা । নজরুল যুগপৎভাবে দুটিরই অধিকারী।
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাসাহিত্যে নবযুগের উদ্বোধক, নতুনবাণীর বার্তাবাহক, নতুন পথের সন্ধানদাতা, নতুন স্বাদ ও রুচির স্রষ্টা। তাঁর কলমেই বাংলা সাহিত্যে বিষয়-ভাবনায় আধুনিকতার সূত্রপাত, যৌবনের জয়গান রচনা, ভালোবাসার পূর্ণ মানবীয় রূপ উন্মোচন, যুদ্ধদৃশ্য-কবিতার প্রচলন, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনাতা, নারী স্বাধীনতা, মানুষের আত্মিক স্বাধীনতা, গণমানুষের কল্যাণ ভাবনা, বিশ্বমানবতাবাদ, এবং সর্বধর্ম-সম্প্রীতির প্রবল পক্ষাবলম্বন। তিনি কবিতায়-গানে নতুন যুগের সূচনা করেন। তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতিতে যৌবন ও বীর্যবানতার প্রচলন করেন। তিনি চিরযৌবনের প্রতীক। তাঁর কলমে বাংলা ভাষা পেয়েছে–কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়: ‘‘অরুগ্ন-বলিষ্ঠ-হিংস্র-নগ্ন-বর্বরতায় অনবদ্য’’ প্রকাশক্ষমতা।
নজরুলের হাতে মানুষের ব্যক্তিত্বের ও অন্তর্নিহিত শক্তির পূর্ণ উদ্বোধন ঘটেছে সাহিত্যে। কবিতায়-প্রবন্ধে-সংগীতে তিনি যে-‘আমি’ কে উপস্থাপন করেন, সে হচ্ছে ‘বীর্যবান আমি’, ‘চিরবিজয়ী আমি’, ‘বিশাল আমি’। নজরুল তাঁর সৃষ্টিকর্মে মানুষের অপরিসীম শক্তিধর ও অশেষ সম্ভাবনাময় ব্যক্তিত্ব ও আমিত্বের শুভ উদ্বোধন ঘটান। নজরুলের ‘আমি’ শুধু ‘অসাম্প্রদায়িক’ নয়, তা হচ্ছে সর্বসাম্প্রদায়িক’, তাঁর আমি হচ্ছে ‘সর্বমানবিক’, ‘বিশ্বমানবিক’, ‘সর্বজাতীয়’, সর্বযুগীয়’ এবং ‘সর্বদেশীয়’। সে আমি ‘চিরউন্নতশির’। সে শির হিমালয় ছাড়িয়ে, খোদার আসন আরশ অতিক্রম করে বিশ্ববিধাতার চিরবিস্ময় হয়ে উঠেছে সবার ওপরে, সবকিছুর ঊর্ধ্বে। সে সর্বজয়ী। ঝড় ঝঞ্ঝা-খরা-সাইক্লোন-ঘূর্ণি-সাপ-হিংস্র পশু-মহামারী-বন্যা-দেবতা-অপদেবতা সবাইকে বশে আনার ক্ষমতা তার বাহুতে মেধাতে। সে পাতাল ফুঁড়ে নিচে নামতে পারে; তেমনি পারে আকাশ ফুটো করে আরশ পেরিয়ে যেতে। তার ‘মুঠোয় পুরে’ বিশ্বলোক। সে ঘুমিয়ে থাকলেই রাত, সে জেগে উঠলেই প্রভাত। কোনো প্রকৃতি বা অতিপ্রাকৃতিক শক্তির ভয়ে সে ভীত নয়, সে কারো অধীন নয়। কারো চরণতলে সে মাথা নোয়ায় না; বরং তার মাথা দেখে মাথা নিচু করে প্রণতি জানায় হিমালয়। যে ভগবান বা কর্তৃপক্ষ অন্যায়কারী, তার বুকে তাৎক্ষণিক পদাঘাত করতে সে সুসক্ষম ও সুসাহসী। কোনো কায়েমী বিধিবিধান সে মানে না। সে কুর্নিশ করে শুধু তার মতো বলিষ্ঠ ও ঐশ্বর্যবান ‘আমি’-কেই, আর কাউকে নয়। ব্যক্তির সকল ভীরুতা দূর করে সে অকুতোভয়- অসীম সাহসী।
সারা পৃথিবীতে আজকে যে আধুনিকতার জোয়ার এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিজয়–তার সর্বোত্তম কণ্ঠ নজরুলের কবিতা ও গান। ইউরোপে সূচিত ও নন্দিত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ মানুষকে দিয়েছে যুগবাহিত প্রথার খোয়াড় থেকে মুক্তি। মানুষ তার ব্যক্ত্বিত্বে ও অন্তর্নিহিত ক্ষমতায় প্রকাশিত ও বিকশিত হওয়ার প্রেরণা ও সুযোগ লাভ করেছে ব্যক্তিস্বতন্ত্র্যবাদের বিজয়ের কল্যাণে। কাজী নজরুল ইসলাম সেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সমর্থক। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নায়ক নিজেকে ছাড়া কাউকে কুর্নিশ করে না, মানে না কোনো প্রথাসিদ্ধ আইন আর সে তা-ই করে যখন তার মন চায় যা। আর সে কোথাও সীমাবদ্ধ থাকে না। মহাবিশ্বের সর্বত্র পৌঁছে যায় তার উপস্থিতি ও তৎপরতা। সে যুগবাহিত সকল বাঁধন ও বাধাকে ছিন্ন করে মুক্ত মানুষ, আত্ম-পরিচয় উন্মোচনে সফল অস্তিত্ব। এটা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদেরই একটা চূড়ান্ত রূপ। কিন্তু তারপরেও নজরুল ইউরোপীয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের অন্ধ সমর্থক নন, তার সবখানি নির্বিচার অনুসারী নন। । নজরুলের আমি ইউরোপিয়ান ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের স্বার্থপর সংকীর্ণ আমি নয়; ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে সে অবাধ আদিম জৈবিক প্রবৃত্তি, সীমাহীন ব্যক্তিগত ধনলিপ্সা কিংবা বিবেকহীন ক্ষমতালিপ্সার দাস নয়। তার যৌনক্ষুধা-খ্যাতির বাসনা-অর্থের প্রয়োজনবোধ সবই আছে বটে, কিন্তু সে এসবের কোনোটিরও সে গোলাম নয়। আবার সমাজতন্ত্রের শৃঙ্খলিতপ্রাণ বিকাশরুদ্ধপ্রাণীও নয় সে। সে সংসারবিমুখ প্রাচীন ভারতীয় সন্ন্যাসীর আমি নয়। তারও রয়েছে জৈবিক-মানসিক ক্ষুধা এবং উত্তম পন্থায় সে ক্ষুধা নিবারণে তার ইচ্ছা বা চেষ্টা। এই আমি ফ্রয়েডের জন্ম হতে মৃত্যু অবধি যৌনতার দাস আমিও নয়। তার যৌনক্ষুধা রয়েছে; তবে একই সাথে রয়েছে প্রেম-পিপাসাও। যৌনক্ষুধা তার সবকিছুর পরিচালন-শক্তি নয়। সামাজিক দায়বোধ এবং মানবিক বিবেচনা তার কর্মপ্রচেষ্টার পেছনে মূল চালিকা-শক্তি। সে অদৃষ্টবাদী আমি-এর বিপরীত আমি। অতিপ্রাকৃত শক্তির করুণাভিখারী সে নয়; সে নয় প্রকৃতির খাময়োলীর হাতে পরাজিত অসহায় অস্তিত্ব। প্রকৃতির বহুবিধ শক্তিকে জয় করে সে মহাশক্তিধর। সে আপন-আলোকে আপনার সামনে উদ্ভাসিত মহাসম্ভাবনাময় এক আলোকিত সত্তা। সে নিজেকে চিনেই চিনে ফেলেছে কে তার প্রভু, কে তা নয়; কোন্ কোন্ শক্তিকে বশ মানিয়ে নিজের কাজে লাগানোর চাবি তার নিজের হাতে আর নিজবশে আনা যায় না এমন শক্তি প্রকৃতিতে কিংবা প্রকৃতির আড়ালে আদৌ আছে কি নেই। এই আমি সংকীর্ণ জাতীয়তাবোধে আক্রান্ত আমিও নয়– যে আমি অন্যজাতিকে ঘৃণা করে কিংবা তাদের দাবিয়ে রাখার মানসে তাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদী শোষণ কিংবা যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। সে অন্যায় যুদ্ধবিরোধী, সকল প্রকার লোভী আগ্রাসনের প্রতিরোধশক্তি। কিন্তু সে দেবতাও নয়; তারও রয়েছে মাটির মানুষের মনোদৈহিক চাহিদা, ক্লান্তশ্রান্ত হওয়ার মানবীয় সীমাবদ্ধতা। নজরুলের এই আমি কোনো ক্ষুদ্র কালখন্ডে বা ভূগোলে, কোনো পার্টিকুলার নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তায় বা ধর্মীয় বৃত্তে সীমায়িত আমিও নয়। নজরুলের আমি নিজের মধ্যে আত্মস্থ করেছে আন্তঃভৌগোলিক পরিসর, ত্রিকালীয় মহাগভীরতা, বহু ধর্ম-পুরাণ-কিংবদন্তীর সংস্কৃতির উত্তরাধিকার এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজদের কবল হতে মুক্ত (নিঃক্ষত্রিয়) করে শোষণ-নিপীড়ন-বঞ্চনামুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার মহামানবীয়-সর্বমানবীয় সর্বজনীন অঙ্গীকার:“আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।” নজরুলের হাতে উদ্বোধিত ও উন্মোচিত ‘আমি’ বিচারবুদ্ধিপ্রাপ্ত শ্রেষ্ঠতম মানবগোষ্ঠীর আলোক-উদ্ভাসিত প্রতিনিধি। এই রক্তমাংসে গড়া মৃন্ময়-চিন্ময় আলোকিত বিশাল ‘আমি’ আধুনিক মানুষের পছন্দের সত্তা।
একজন আধুনিক মানুষের প্রিয় বিষয় হতে পারে আধুনিক মানুষ ও আধুনিক সৃষ্টি। যারা নজরুলকে ছোট করে দেখতে ভালোবাসেন, তারা যা-ই বলুক, এটাই সত্য যে বাংলা সাহিত্যে নজরুল আধুনিকতার সূচনা করেছেন এবং সে আধুনিকতাকে অনেকখানি প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তার দেখানো পথ ধরেই বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার উৎকর্ষ সাধন। আধুনিকতা শুধু প্রকরণের বিষয় নয়। এটি মূলত কাব্যভাবনার বিষয়। আধুনিকতা হচ্ছে মন ও মানসিকতার ব্যাপার, চিন্তা ও চেতনার ব্যাপার, বোধ ও বিবেচনার ব্যাপার। আধুনিকতা হচ্ছে নতুনকে স্বাগত জানানোর মন, মিথ্যা প্রমাণিত অতীতের দৃঢ়মূল ধারণা ও বিগত-সত্যকে পরিত্যাগ করার সাহস। বোধে ও মননে আন্তর্জাতিকতাকে গ্রহণ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা, অন্যায়-যুদ্ধের বিরোধিতা, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার অধিকার, ব্যক্তির ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অশৃঙ্খলিত উন্মোচন, জনগণের ক্ষমতায়ন, লৈঙ্গিক সমতা, বিজ্ঞান-মনস্কতা, অতিপ্রাকৃত শক্তিতে অবিশ্বাস, ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাত-উপগোষ্ঠীগত কৃত্রিম ব্যবধানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন, জন্মের বদলে কর্মে মূল্যায়ন, যৌনতাকে প্রাণীর স্বাভাবিক চাহিদা হিসেবে গ্রহণ এবং কোদালকে কোদাল জ্ঞান করা–ইত্যাদি হচ্ছে আধুনিক জীবনের প্রধান অনুষঙ্গসমূহ। রোমান্টিকতা হচ্ছে কল্পনাসর্বস্ব আকাশচারিতা; আধুনিকতা হচ্ছে ভূমিলগ্নতা; রোমান্টিকতা বা অনাধুনিকতা হচ্ছে প্রথাবদ্ধতার নিকট আত্মসমর্পণ; আধুনিকতা হচ্ছে প্রথার অচলায়তন ভেঙে বের হয়ে আসা। আধুনিক হচ্ছে ভালো-মন্দে মিশ্রিত জীবনকে তার সমগ্রে গ্রহণ করার মানসিক প্রস্তুতি। নজরুলই প্রথম রোমান্টিক শুচিবায়ুগ্রস্ততাকে পরিহারপূর্বক বাংলা কবিতা-গানে-কথা-সাহিত্যে-অভিভাষণে রক্ত-মাংসের মানুষের মানসিক এবং শারীরিক চাহিদা কামনা-বাসনাকে গভীর ইতিবাচকতায় উপস্থাপন করেছেন; তিনি নারী-পুরুষের সমতার গান গেয়েছেন; তিনি জাতিভেদ প্রথাসহ সকল কুসংস্কার ও মানবসৃষ্ট অসাম্যের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন শক্তহাতে। তিনি বারাঙ্গনা নারীকে মহত্বের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তিনি কবিতায় ও অভিভাষণে মানুষের রাষ্ট্রিক ও আত্মিক স্বাধীনতার কথা প্রথম উচ্চারণ করেছেন। তিনি সকল প্রকার কুসংস্কার ও অন্ধত্বের বিরুদ্ধে কবিতা-গান-অভিভাষণ রচনা করেছেন। নিয়তিবাদী মানুষকে তিনি দিয়েছেন আত্মনির্ভর প্রেরণা, বিশ্বাস ও সাহস। গৃহবধু-বারাঙ্গনা, পাপ-পুণ্য, সতী-অসতী প্রভৃতি প্রচলিত ধারণগুলো তিনি আধুনিক বোধের পক্ষে আমূল পাল্টে দিয়েছেন। তিনি বারাঙ্গনাদের জননী বলে সম্বোধন করেছেন এবং তারা অসতী-অশুচি এমন যুগ-পুরাতন ধারণাকে আধুনিক জীবনের অনুকূলে পাল্টে দিয়েছেন। তিনি সবার উপরে স্থান দিয়েছেন মানুষকে। যুগস্বীকৃত প্রথা ছিল– পতিতা নারীরা খারাপ। নজরুল সে প্রথায় আঘাত করে লিখেছেন ‘বারাঙ্গনা’ নামক মহৎ কবিতা যেখানে তিনি বারাঙ্গনাকে মেরী, অহল্যা, গঙ্গার মতো মহৎ ও নিষ্পাপ জননী বলে আখ্যায়িত করেছেন। শুধু নারী হবে অসৎ অথচ পুরুষ নয়– এ ধারণা ভেঙে দিতে বলেছেন–
শুন ধর্মের চাঁই–
জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোনো সে প্রভেদ নাই!
অসতী মাতার পুত্র যদি সে জারজপুত্র হয়
অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়।
যুগ যুগ ধরে প্রথা ছিল এবং এখনো অনেকটা রয়ে গেছে– নিম্নবর্গের মানুষ বিশেষত হিন্দুধর্মে যাদের ঘৃণাভরে শুদ্র বলে আখ্যায়িত করা হয়, তারা নিম্নজাত এবং অস্পৃশ্য। নজরুল এই প্রথা ভেঙে দিতে লিখেছেন ‘শুদ্রের মাঝে জাগিছে রুদ্র’। তিনি শুদ্রের মধ্যে ভগবানকে দেখেছেন এবং প্রতিষ্ঠা করেছেন। ডোম মেথর কুলি কৃষক মজুর তাঁতী জেলে নাপিত কামার কুমোর মাঝি কুলি– এসকল তথাকথিত নিম্নশ্রেণির মানুষ যে মানুষ হিসেবে নিম্নশ্রেণির নয়, নিম্নজাতের নয়, বরং তারা ভগবানতুল্য পূজনীয়, নজরুল তার কবিতার গানে তা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যে গয়না-অলংকারকে নারীজাতির ভূষণ বলে যুগ যুগ ধরে প্রশংসিত করে আসা হয়েছে, তা যে নারীর জন্য শিকল, তার বন্দিত্বের নিদর্শন, নজরুলই সর্বপ্রথম তা কবিতা-গানে চিহ্নিত করে সেসব পরিহার করার জন্য নারীজাতিকে পরামর্শ ও প্রণোদনা দান করেছেন।
স্বর্ণ-রৌপ্য অলংকারের যক্ষপুরীতে নারী
করিল তোমায় বন্দিনী, বল, কোন্ সে অত্যাচারী?
আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা,
আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা!
চোখে চোখে আজ চাহিতে পারো না, হাতে রুলি পায়ে মল
মাথার ঘোমটা, ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও শিকল!
যে-ঘোমটা তোমা করিয়াছে ভীরু ওড়াও সে আবরণ!
দূর করে দাস দাসীর চিহ্ন ঐ যত আভরণ!
প্রেম করা ‘পাপ’ অথবা ‘ব্যভিচার’ ইত্যাদি ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করে তিনি লিখেছেন ‘জীবনে যাহারা বাঁচিল না’ ‘পাপ’ প্রভৃতি কবিতা। ‘পাপ’ কবিতায় নজরুলের ভাবনা আধুনিকতার শিখর স্পর্শ করেছে। তিনি এ কবিতায় বলেছেন যে– পৃথিবী তথাকথিত পাপেরই জায়গা ‘পাপস্থান’। তিনি বলেছেন ‘‘সাম্যের গান গাই/ যত পাপী তাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই।’’ তিনি বলেছেন ‘‘বিশ্ব পাপস্থান/ অর্ধেক এর ভগবান, আর অর্ধেক শয়তান।’’ অধিকন্তু ‘‘পাপের পঙ্কে পূণ্য-পদ্ম ফুলে ফুলে হেথা পাপ।’’ তিনি এতটাই আধুনিক যে বলেছেন– মানুষ আত্মা ও দেহ নিয়ে পূর্ণসত্তা আর ‘‘পুণ্যে দিলেন আত্মা ও প্রাণ, পাপেরে দিলেন দেহ।’’ দেহ বাদ দিয়ে তো মানুষ হতে পারে না। অতএব পাপ ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। তাই ‘‘সুন্দর বসুমতী/ চিরযৌবনা, দেবতা ইহার শিব নয়, কামরতি’’। এই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাসাহিত্যে নজরুলের আমদানী এবং তাঁর হাতেই এর চূড়ান্ত রূপ লাভ। প্রকাশ প্রকরণে সহজিয়া বটে, কিন্তু বিষয়ভানায় ও জীবনদর্শনে গভীরভাবে চির-আধুনিক।
নজরুল বাংলা কবিতা ও গানকে সকল মানুষের কবিতা-গানে রূপান্তরিত করেছেন। বাংলাসাহিত্য হয়ে উঠেছে গণমানুষের সাহিত্য, বাংলা গান হয়ে উঠেছে গণমানুষের গান। ‘‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রোমান্টিক কবিতাগান বাংলাসাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করে তোলে। সেসব কবিতাগান মূলত শিক্ষিত ভদ্রলোক বা কথিত বিদগ্ধ শ্রেণীর মানুষের জন্য রচিত। সমাজে তারা ক্ষমতায়-প্রতিপত্তিতে-জ্ঞানে-সামাজিক মর্যাদায় ওপরে, তবে সংখ্যার দিক হতে একেবারেই সংখ্যলঘিষ্ঠ। অন্যদিকে ব্যাপকভাবে সাধারণ অনভিজাত মানুষই বাংলার সুখ-দুঃখ-রূপ-রসের মূল আধার। রবীন্দ্রনাথ জীবনের পড়ন্ত বেলায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে সমাজের উঁচুতলায় তার আসন হওয়ায় প্রতিদিনের জীবনযাপননের বেড়াগুলি তাঁকে সাধারণ মানুষের সাথে মিশতে দেয়নি। ‘ওদের সাথে মিলাও যারা চরায় তোমার ধেনু/ তোমার নামে বাজায় যারা বেণু’ বলে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলেও শেষপর্যন্ত তাঁর পক্ষে তাদের সাথে মেলামেশা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। হয়ত তাই তিনি একজন বা একাধিক কবির আবির্ভাব কামনা করেছিলেন যিনি হবেন সাধারণ মানুষের আপনজন; যার কবিতাগানে সমাজের নিচুতলায় খেটে- খাওয়ার মানুষের সুখ-দুঃখ-আবেগ-অনুভূতির ছবি ফুটে উঠবে। যে তাঁতি বসে তাঁত বোনে, যে কৃষাণ হাল দিয়ে জমিতে ফসল ফলায়, যারা উদয়াস্ত মাঠে পরিশ্রম করে, যাদের সম্মিলিত কর্মভারের উপর পা দিয়ে চলছে সমস্ত সংসার, সেই অখ্যাতজনদের কবি আসুক– তাদের নির্বাক মনের বেদনা উদ্ধার করে গান গানে ফুটিয়ে তুলুক–এই ছিল রবীন্দ্রনাথের কামনা।
কৃষাণের জীবনের শরীক যে জন
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন
যে আছে মাটির কাছাকাছি
সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।
…………………………………………..
এসো কবি অখ্যাতজনের
নির্বাক মনের
মর্মের বেদনা যত করিয়া উদ্ধার
প্রাণহীন এ দেশেতে গানহীন যেথা চারিধার
অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক নিরানন্দ সেই মরুভূমি
রসে পূর্ণ করে দাও তুমি।
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই সেই অখ্যাতজনদের কবিগীতিকারের আর্বিভাব ঘটে। সেই কবি-গীতিকারের নাম কাজী নজরুল ইসলাম। উপন্যাস-কবিতা-গান-নাটকে উপেক্ষিত কৃষাণ-জেলে-কুলি-মজুর-নারীশ্রমিক-বেদে-বাউল-সাঁওতাল-পতিতা-হরিজন প্রভৃতি শ্রেণির অখ্যাত উপেক্ষিত মানুষের জন্য কাজী নজরুল ইসালাম কলম ধরেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর হাতে সোনার ফসল ফলে। অবজ্ঞার তাপে শুল্ক নিরানন্দ সেই মুরুভূমিকে তিনি রসে-মাধুর্যে পূর্ণ করে তোলেন। বাংলার লোকায়ত আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে জীবনঘনিষ্ঠ গানের সুরে সুরে। কৃষকের লাঙল, জেলের জাল, কামারের হাঁপর, ছাদপেটা নারীশ্রমিকের হাতুড়ি, বেদের বাঁশি, সাঁওতালের মাদল, বাউলের একতারা, কৃষাণ-বধূর কলস, রাখালের বাঁশি, বেদেনীর কলার মান্দাস, আদিবাসী নারীর ঝুমরা নাচ প্রভৃতি রাতারাতি গৌরবের আসন পেয়ে যায় বাংলা গানের ভুবনে। নবাব-জমিদারের বিলাসী জলসাঘর আর পণ্ডিতদের ড্রয়িংরুম থেকে বাংলাগান নেমে আসে ফসলের মাঠে, নদীর জলে, শ্রমিকের কারখানায়-কয়লাখনিতে, সাঁওতালনীর তালপুকুরে, বেদেনীর শালপাহাড়ে, বাউলের বটতলায়। লোকায়ত জীবনে শুরু হয় উচ্ছ্বল প্রাণরস আর ভাররসের জোয়ার। অবশ্য সে-সুর শিক্ষিত ভদ্রলোদের নাগরিক মনেও আনন্দের ঝড় তোলে। নজরুল হয়ে ওঠেন সর্বশ্রেণীর মানুষের কবি, সর্বশ্রেণীর মানুষর প্রাণের সঙ্গীত রচয়িতা, সুরস্রষ্টা। তখন বাঙালি মসুলমান সমাজ গান শুনতে ও গাইতে ভুলে গিয়েছিল। তারা গানকে অধর্মের কাজ মনে করতো। নজরুলের গানের জোয়ার পৌঁছে যায় তাদের শয়নঘরে,বৈঠকখানায়। আত্মজাগরণের স্রোতে ভেসে যায় তাদের সংগীতবিমুখতা।’’ (নজরুলের গানে অখ্যাতজন/ আমিনুল ইসলাম)। এ প্রসঙ্গে কবি জীবনানন্দ দাশের মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ:
‘‘বাংলার এ মাটির থেকে জেগে, এ মৃত্তিকাকে সত্যিই ভালোবেসে আমাদের দেশে উনিশ শতকের ইতিহাস প্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়তাবাদী কবি নজরুল ইসলাম। তাঁর জনপ্রেম, দেশপ্রেম পূর্বোক্ত শতাব্দীর বৃহৎ ধারার সঙ্গে সত্যিই একাত্ম। পরবর্তী কবিরা এ সৌভাগ্য থেকে অনেকটা বঞ্চিত বলে আজ পর্যন্ত নজরুলকেই সত্যিকারের দেশ ও দেশীয়দের বন্ধু কবি বলে জনসাধারণ মেনে নেবে। জন ও জনতার বন্ধু ও দেশপ্রেমিক কবি নজরুল। এ জিনিসের বিশেষ তাৎপর্যের দিকে লক্ষ্য রেখে বলতে পারা যায় যে, যে সময়ে ও যেখানে জনমানস তার প্রার্থিত জিনিস পেয়েছে বলে মনে করে, সেখানে বাস্তবিকই তা অদ্বিতীয়।’’
নজরুল ছিলেন সাধারণ আমজনতার একজন। তিনি উঁচুতলার বাসিন্দা ছিলেন না কোনোদিনও। কৃষক-জেলে-মজুর-শ্রমিক-তাঁতী-জোলা-নাপিত-কামার-কুমার-ফেরিওয়ালা-মাঝি–এই গণমানুষের মাঝে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তাদের সুখ-দুঃখ ও আবেগ-অনুভূতি তাঁকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। সেজন্যই নজরুলের কবিতা-গানে তাঁদের মুক্তির দিশা রয়েছে। তিনি গণমানুষের কবি, তিনি সম্মিলিত মানবজাতির বলিষ্ঠ কণ্ঠধর। তাঁর কিছু কবিতার চরণ স্মরণ করা যায়:
১.নারী পুরুষের সমতা ও নারী স্বাধীনতার অগ্রদূত কবি
সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
…………………………….
সেদিন সুদূর নয়–
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়।
ক. নারীজাগরণের অগ্নিমন্ত্র রচয়িতা কবি
মেলি শতদিকে শত লেলিহান বসনা
জাগো বহ্নিশিখা স্বাহা দিগ্ বসনা।
খ. কুলি-মজুর সর্বহারা শ্রেণীর কবি
দেখিনু সেদিন রেলে
কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে।
চোখ ফেটে এল জল
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল!
আসিতেছে শুভদিন
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ।
গ. কৃষকের মুক্তির কবি
ওঠ্ রে চাষী জগদ্বাসী র্ধ কষে রাঙল!
ঘ. জেলেদের মুক্তির কবি
আমরা নিচে পড়ে রইব না আর
শোন্ রে ও ভাই জেলে
এবার উঠব সব ঠেলে।
ঙ. গণ মানুষের মুক্তির কবি ও মুখপাত্র
গাহি তাহাদের গান–
ধরণীর হাতে দিল যারা আনি ফসলের ফরমান।
শ্রম-কিণাঙ্ক কঠিন যাদের নির্দয় মুঠিতলে
ত্রস্তা ধরণী নজরানা দেয় ডালি ভরে ফুলে ফুলে।
বন্য- শ্বাপদ-সঙ্কুল জরা-মৃত্যু-ভীষণা ধরা
যাদের শাসনে হল সুন্দর কুসুমিতা মনোহারা।
চ. জনগণের শক্তির পক্ষের অর্থাৎ গণতন্ত্রের কবি
এ আশা মোদের দুরশাও নয়, সেদিন সুদূর নয়–
সমবেত রাজ-কণ্ঠে যেদিন শুনিব প্রজার জয়।
কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্বমানবতাবাদের সবচেয়ে বলিষ্ঠ কবি। তিনি কবি-সংগীতকার হিসেবে শিল্পে-সাহিত্যে-গানে-প্রবন্ধে সমগ্র মানবজাতির ঐক্যের অগ্রদূত। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বনাগরিক এবং কবিতা-গানে বিশ্বমানবতাবাদী কবি। তিনি এক প্রতিভাষণে বলেছেন “এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলে শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের সকল সমাজের। সুন্দরের ধ্যান, তাঁর স্তবগানই আমার উপাসনা আমার সাধনা। যে কূলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি’’। আপন দেশ জাতি এবং একই সাথে বিশ্বমানুষের প্রতি এমন দায়বদ্ধ কবি পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত আর জন্মগ্রহণ করেননি। তিনি কবিতায় উদার মানবিকতাবাদ ও সর্বমানবতাবাদের জয়গান রচেছেন। তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খৃস্টান-পারসিক-অগ্নিউপাসক-ইহুদি-নৃতাত্ত্বিক উপজাতি সকল মানুষকে একই মানুষ হিসেবে দেখেছেন এবং সবার মহামিলনের অভিন্ন মোহনা রচেছেন।
গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম খ্রীশ্চান।
কে তুমি?– পার্সি? জৈন ? ইহুদী? সাঁওতাল ভীল, গারো?
কনফুসিয়াস? চার্বাক-চেলা? বলে যাও, বল আরো!
বন্ধু, যা খুশি হও,
পেটে-পিঠে কাঁধে-মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবলে-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থ-সাহেব পড়ে যাও যত সখ,–
কিন্তু কেন এ পণ্ড শ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? পথে ফোটে তাজা ফুল!
মিথ্যা শুনিনি ভাই
এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই।
কাজী নজরুল ইসলাম সকল মানুষের স্বাধীনতার কবি। রাষ্ট্রিক বা আত্মিক পরাধীনতা তাঁর নয়। কোনো প্রকারের ‘বদ্ধঘরে’ তনি থাকতে চাননি এবং কেউ তাঁকে আবদ্ধ রাখতেও পারেনি। পরাধীন বৃটিশ-ভারতেও তিনি স্বাধীন মানুষ ছিলেন। তিনি মুক্ত প্রাণের কবি, মুক্ত চিন্তার কবি, মুক্ত বিশ্বের কবি। নজরুল সারা বিশ্বের সকল মানুষের স্বাধীনতার পক্ষের কবি, মুক্তির মুখপাত্র। তিনি তাঁর কবিতা-গানে-অভিভাষণে সকল মানুষের স্বাধীনতা মুক্তির পক্ষে কথা বলেছেন। এ স্বাধীনতা রাষ্ট্রিক–এ মুক্তি আত্মিক। তিনি সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে, কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবল কবিকণ্ঠ। তিনি সকল প্রকার অন্যায় যুদ্ধের বিরোধী এবং সেজন্যই বিশ্বকে ‘নিঃক্ষত্রিয়’ করতে চেয়েছেন। তিনি অন্যায়কারী ‘ভগবান’দের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেয়ার সক্ষমতা ও সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। আর পৃথিবীর বুক থেকে অত্যাচার, অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিপীড়ন চিরতরে শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প ঘোষণা করেছেন।
মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না,
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত।
এতটা তেজদীপ্ত, অগ্নিগর্ভ ও প্রত্যয়-উদ্দীপক প্রতিবাদ পাবলো নেরুদা, নাজিম হিকমত, লোরকা, মাহমুদ দারবিশ কিংবা অন্যকোনো কবির কবিতায় ফুঠে ওঠেনি। কবি হিসেবে এখানে নজরুল বিশ্বসাহিত্যে অনন্য, একক ও অতুলনীয়। সারা পৃথিবী এখন যুদ্ধ ও আগ্রাসনে উৎপীড়িত ও পীড়িত; প্রবলের অত্যাচারে জর্জরিত, অতিষ্ঠ ও অসহায় দুর্বল। অথচ অন্যায়ের বিরুদ্ধে তেমন প্রবল কণ্ঠস্বর নেই। আমরা নজরুলকেই প্রতিবাদের কণ্ঠ হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছেন:
‘‘আমরা আগামী সংগ্রামে কবি নজরুলের সঙ্গীত কণ্ঠে ধারণ করিয়া শ্রীমান সুভাষের মতো তরুণ নেতাদের অনুসরণ করব। ফরাসী বিপ্লবের সময়কার কথা একখানি বইতে সেদিন পড়েছিলাম। তাহাতে লেখা দেখিলাম সে সময় প্রত্যেক মানুষ অতি মানুষে পরিণত হইয়াছিলেন। আমার বিশ্বাস, নজরুল ইসলামের কবিতাপাঠে আমাদের ভাবী বংশধরেরা এক একটি অতি মানুষে পরিণত হইবে।’’
সে পথ ধরেই আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের গান ও কবিতা ছিল অগ্নিমন্ত্র। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা যথার্থই বলেছেন:
“‘বাংলার জয় হোক’– এই নজরুলীয় আশাবাদকে জনতা জাতীয় স্লোগানে রূপান্তরিত করে সমুদ্র-নিনাদে উচ্চারণ করেছিলো: ‘জয় বাংলা’। তাই তো একাত্তরের বাঙালি বিজয়ী বাঙালি। আর বিজয়ী বাঙালি মানেই নজরুলের মন্ত্রে দীক্ষিত বাঙালি। নজরুল বাংলার জাতীয় কবি এই কারণেই নয় যে, তিনি বাংলার বা বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় কবি। বরং এই কারণেই যে বাঙালিকে ব্যক্তি ও জাতিগত পর্যায়ে আত্মশক্তিতে উদ্ধুদ্ধ করে চিরবিজয়ী বীর বাঙালিতে পরিণত করার দীক্ষা দিয়েছিলেন একমাত্র তিনিই, যিনি পরাধীন ভূ-ভারতে স্বয়ংশাসিত স্বাধীন নাগরিক। মানবিক, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক পর্যায়ৈ সারা বিশ্বে মানবিক স্বাধীনতার এক শ্রেষ্ঠ ঘোষক কাজী নজরুল এভাবেই তাঁর স্বজাতিকে জাতিসত্তায় উন্মোচিত করে তাকে স্বয়ংশাসিত হওয়ার পথ দেখিছিলেন। তিনি স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বাধীনতা যুদ্ধের আদি নকশার স্রষ্টা।”
বাঙালি জাতির একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে স্বীকৃত। আন্দোলন সংগ্রাম নেতৃত্ব প্রভৃতিতে সবার সামনে থেকে তিনি হাজার বছরেরর লাখো বছরের বাঙালি জাতিকে প্রথমবারের মতো একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিকারী হতে সফল ভূমিকা পালন করেন। কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়নও এখানে সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক ও ও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন:
“নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালির স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার রূপকার। বাংলার শেষ রাতের ঘনান্ধকারে নিশীথ নিশ্চিত নিদ্রায় বিপ্লবের রক্তনালীর মধ্যে বাংলার তরুণরা শুনেছে বিধাতার অট্টহাসি, কালভৈরবের ভয়াল গর্জন—নজরুলের জীবনে, কাব্যে, কন্ঠে। প্রচণ্ড সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মত, লেলিহান অগ্নিশিখার মত, পরাধীন জাতীর তিমির ঘন অন্ধকারে বিশ্ববিধাতা নজরুলকে এক স্বতন্ত্র ছাঁচে গড়ে পাঠিয়েছিলেন এই ধরার ধুলায়। … সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে নজরুলের অগ্নিমন্ত্র বাঙালি চিত্তে জাগিয়েছিল মরণজয়ী প্রেরণা—আত্মশক্তিতে উদ্ধুদ্ধ হওয়ার সুকঠিন সংকল্প।”
শুধু বাংলা নয়, একইভাবে তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতারও কাব্যিক মুখপাত্র। তাঁর আগে কোনো কবি-লেখক ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা এমনভাবে প্রবল কণ্ঠে এমন পরিস্কার ভাষায় দাবি করেননি; রাজনীতিবিদদের কেউ করেছিলেন বলেও অদ্যাবধি জানা যায়নি। কিন্তু শুধু ভারত বা বাংলাদেশ নয়, প্রতীকী অর্থে নজরুল সারা বিশ্বের সকল পরাধীন মানুষের আত্মিক-রাষ্ট্রিক-মানবিক স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্র উচ্চারণকারী কবি। ধর্ম-বর্ণ-জাতি-ভূগোল-যুগ নির্বিশেষে নিরপেক্ষ মন নিয়ে যদি বিবেচনা করা হয়– তবে এটা পরিস্কার যে অন্যায়-অত্যাচার-অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পৃথিবীব্যাপী অসংখ্য স্বাধীনতাকামী বীরমানুষ গড়ে তুলতে হলে আমাদের নজরুলের কবিতা-গান ও জীবনকেই সেধরনের মানুষ গড়ে তোলার অস্ত্র হিসেবে বেছে নিতে হবে।
শুধু গণ-আবেগ আর গণমুক্তির কবি বলেই নয়, তিনি প্রেম ও সমাজভাবনার প্রাতিস্বিক অনভূতির রূপকার কবি ও সংগীত রচয়িতা। নজরুলের কবিতা-গান মানুষের নিভৃত ব্যক্তিসত্তাকেও নিবিড়ভাবে স্পর্শ করে, তাকে ভাবায় ও দোলায়। তাঁর দারিদ্র, প্রেম ও প্রকৃতি ভাবনার কবিতাগুলো সূক্ষ্ম নিবিড়তায় ছুঁয়ে যায় মানুষের ব্যক্তিমন ও মনন। তিনি তাঁর ‘দারিদ্র’ কবিতায় দারিদ্রের যে ভয়ংকর রূপ অর্থনৈতিক সূক্ষ্ণতায়, কাব্যিক চারুতায় ও অনুভূতির নিবিড়তায় তুলে ধরেছেন, তা কোনো অর্থনীতিবিদ বা সমাজবিদের গবেষণা-গ্রন্থে পাওয়া যাবে না। তিনি যখন বলেন– “পারি নাই বাছা মোর হে প্রিয় আমার/ দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে/ মোর অধিকার/আনন্দের মোহে নাহি/ দারিদ্র অসহ/পুত্র হয়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ/আমার দুয়ার ধরি।’’, তখন দুর্ভিক্ষ নিয়ে গবেষণাকারী অমর্ত্য সেনরাও পিছে পড়ে যান। আর যখন দারিদ্র কর্র্তৃক একজন সৃজনশীল মানুষের সৃজনশীলতা ও সৃজনশীলতার স্বপ্নকে কুরে কুরে খাওয়ার (রাষ্ট্রবিদ-সমাজবিদ-অর্থনীতিবিদের সিলেবাসের বাইরে থাকা) আড়ালের অন্তরঙ্গ চিত্র তুলে ধরে বলেন–“বেদনা হলুদ বৃন্ত কামনা আমার/শেফালির মত শুভ্র সুরভি বিথার/ বিকশি উঠিতে চাহে/তুমি হে নির্মম/ দল বৃন্ত কাটো শাখা কাঠুরিয়া সম/ আশ্বিনের প্রভাতের মত ছলছল/করে উঠে সারা হিয়া শিশির সজল/টলটল ধরণীর মত করুণায়/তুমি রবি, তব তাপে শুকাইয়া যায়/করুণা নিহারবিন্দু।’’, তখন বেদনায় ও বিস্ময়ে থমকে যায় মন। অনেক সৃজনশীল ও শুভবাদী স্বপ্ন ভেস্তে গেছে অর্থাভাবে। আজও যাচ্ছে। আজও ‘‘ভালে বেদনার টিকা’’ নিয়ে ‘‘কাঁটাকুঞ্জে বসে’’ অন্তরঙ্গ বেদনার মালা গাঁথে আরও কত লক্ষজন । তারা যদি নজরুলের ‘দারিদ্র’ কবিতাটি পাঠ করেন, দেখবেন কি গভীর নিবিড় অনুভব ও অন্তরঙ্গ অবলোকনের অধিকারী ছিলেন কবি ও ব্যক্তি নজরুল! আর সেসবের প্রকাশ ঘটেছে কত নান্দনিক সফলতায়! পৃথিবীর যাবতীয় অন্যায়-অসুন্দরের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্যস্ত এই কবি কোনো ফাঁকে আসন্ন বসন্তসন্ধ্যার, শিশিরস্নাত শারদপ্রভাতের, দগ্ধ গ্রীষ্মদুপুরের, চৈতালী চাঁদনীরাতের অন্তরঙ্গ রূপ ব্যক্তিমানুষের প্রাতিস্বিক আনন্দ-বেদনার সঙ্গে একীভূত করে উপস্থাপন করেন নিবিড় সূক্ষ্ণতায়, সে উপস্থাপনায় মিশে যায় মানুষের ব্যক্তি-আবেগ। নজরুলের কবিতা মানুষের অন্তরঙ্গ উপলব্ধি ও বেদনাকে আরও বেশি নিবিড় করে তুলতে চেয়েছে।
ধরণী দিয়াছে তার
গাঢ় বদেনার
রাঙা মাটি-রাঙা ম্লান ধূসর আঁচলখানি
দিগন্তের কোলে কোলে টানি।
পাখি উড়ে যায় যেন মেঘ-লোক হতে
সন্ধ্যা-দীপ জ্বালা গৃহ-পানে ঘর-ডাকা পথে।
আকাশের অস্ত-বাতায়নে
অনন্তদিনের কোন্ বিরহিণী কনে
জ্বালাইয়া কনক-প্রদীপখানি
উদয়-পথের পানে যায় তার অশ্রু-চোখ হানি।
নজরুলের প্রেমভাবনা আধুনিক মানুষকে গভীরভাবে স্পর্শ করে, আলোড়িত করে। বাংলাসাহিত্যের ভরা রোমান্টিক যুগে নজরুলের আবির্ভাব। কিন্তু রোমান্টিক শুচিবায়ুগ্রস্ততা ও কল্পনাসর্বস্ব আকাশচারিতাকে তিনি এড়িয়ে আধুনিক জীবন-দর্শনকে গ্রহণ করেছিলেন। রোমান্টিকদের প্রেম-ভাবনা ছিল এই যে– একজন নর ও একজন নারীর মধ্যে প্রেম সর্বদায় পবিত্রশুচিতায় শুভ্র; সেখানে কামের স্থান নেই বললেই চলে। একজন আরেকজনকে শুধু ‘হৃদয়ে’ পেলেই চলে; সে যদি বাস্তবে তাকে ছেড়ে চলে যায়, বা হারিয়ে যায়, তবু একা হয়ে যাওয়া নর বা নারী নতুন করে আর কোনো নর বা নারীর প্রেমে পড়বেন না। কারণ তাতে করে প্রেমের অমর্যাদা হবে। কিন্তু বাস্তবতা এই যে মানুষ জীবনে একাধিকবার কিংবা বারবার প্রেমে পড়তে পারে, পড়ে থাকে। আর প্রেমে দেহজ কামনাবাসনা থাকবেই। কখনো কখনো সেটাই থাকে আড়ালের চালিকাশক্তি। শুধু ‘হৃদয়-নির্ভর’ দর্শনের ওপর বাস্তবের প্রেম প্রতিষ্ঠিত নয়। শুচিবায়ু প্রেমসম্পর্কিত রোমান্টিক ভন্ডামিকে উড়িয়ে দিয়ে নজরুল বলেছেন–
তোমারে দেহের তীরে পাবার দুরাশা
গ্রহ হতে গ্রহান্তরে লয়ে যায় মোরে।
বাসনার বিপুল আগ্রহে
জন্ম লভি লোকে– লোকান্তরে
উদ্বেলিত বুকে মোর অতৃপ্ত যৌবন-ক্ষুধা
উদগ্র কামনা,
জন্ম তাই লভি বারে বারে
না-পাওয়ার করি আরাধনা।..
যা-কিছু সুন্দর হেরি’ করেছি চুম্বন
যা-কিছু চুম্বন দিয়া করেছি সুন্দর–
সে সবার মাঝে যেন তব হরষণ
অনুভব করিয়াছি! ছুঁয়েছি অধর
তিলোত্তমা, তিলে তিলে!
প্রেম সম্পর্কে নজরুলের এই সত্যাপলব্ধি বাস্তবতার প্রাতিস্বিক অভিজ্ঞান। এই যুগান্তকারী উচ্চারণ একবিংশ শতাব্দীর উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা এই আমাদের মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। আধুনিক মানুষ হিসেবে নর-নারীর ভালোবাসার চির-আধুনিক গভীর-নিবিড় কাব্যিক পাঠে ঋদ্ধ হয়ে ওঠে আমাদের কাব্যপ্রেমী ও প্রেমানুরাগী মন।
এবার ব্যক্তি-নজরুলকে একটু দেখে নেয়া যায়। তিনি কেমন ছিলেন? ব্যক্তি হিসেবে তিনি কি তাঁর সৃষ্টির মতো অসাম্প্রদায়িক ও গণমুখি ছিলেন? তিনি কি তার কবিতা গানের মতো উদার ও সর্বমানবতাবাদী ছিলেন? নিজ কবিতার মহত্ত্ব কি তিনি নিজ চরিত্রে ধারণ করেছেন? এসকল প্রশ্নের সবকটিরই উত্তর হচ্ছে হাঁ। তিনি হিন্দু নারী বিয়ে করে হিন্দু নারীর সাথে ঘর করেছেন। তাকে মুসলিম বানাননি। তিনির সকল ধর্মের মানুষকে ব্যক্তিজীবনে শ্রদ্ধা করেছেন।
‘‘নজরুল ধর্মের চেয়ে মানুষকে বড় করে দেখেছেন সব সময়,– তাই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নজরুলের ভালোবাসতে কারো বাধেনি। কতদিন আমাদের বাড়িতে গানের মজলিস বসেছে, খাওয়া করেছি আমরা একসঙ্গে, গোঁড়া বামুনের ঘরের বিধবা মা, নজরুলকে নিজের হাতে খেতে দিয়েছেন– নিজের হাতে বাসন মেজে ঘরে তুলেছেন, বলেছেন—‘’ ও তো আমার ছেলে,– ছেলে বড় না আচার বড়। ‘’ এই যে নজরুল আপনাকে সকলের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর প্রাণের প্রাবল্যে, হৃদয়ের মাধুর্যে- এই তো মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম —বড় আদর্শের কথা।‘’ (সাবিত্রী প্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়) ।
তিনি জেলে কামার কুমার তাঁতী কৃষক মাঝি মেথর ডোম সাঁওতাল সবার সাথে প্রাণ খুলে মিশেছেন- সবার সাথে একাত্ম হয়ে জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর নিজের কথা:
“আমি উঁচু বেদীর উপর সোনার সিংহাসনে বসে কবিতা লিখিনি। যাদের মুক মনের কথাকে আমি ছন্দ দিতে চেয়েছি, মালকোচা মেরে সেই তলার মানুষের কাছে নেমে গেছি। দাদারে বলে দুবাহু মেলে তারা আমায় আলিঙ্গন দিয়েছেন। আমি তাদের পেয়েছি—তারা আমায় পেয়েছে।’’
তিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। বারবার জেল খেটেছেন। কিন্তু আপোষ করেননি। নারীদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি কৃষকের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি পরাধীনতাবিরোধী, শোষণ-নিপীড়নবিরোধী এবং নারী-মুক্তির লক্ষ্যে আয়োজিত বিভিন্ন সভা-সমিতিতে যোগদান করে নিজকণ্ঠে অগ্নিঝরা গান গেয়ে–বক্তৃতা দিয়ে মুক্তির অগ্নীবীণা বাজিয়েছেন। তিনি সাধারণ মানুষের সাথে মিশে সাধারণ মানুষের হয়ে অসাধারণ জীবন যাপন করেছেন।
লোভ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও ভয়ের কাছে বিকিয়ে যান কত প্রতিভা: ‘‘মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পন্ডিতসমাজ।’’ ( সোনালি কাবিন / আল মাহমুদ)। কিন্তু নজরুলকে কোনও আর্থিক লোভ, পুরস্কারের হাতছানি, পদমার্যাদার মোহ কিংবা জেল-জুলুমের ভয় আদর্শচ্যুত করতে পারেনি। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের সময় যখন বড়ো বড়ো কবি সাহিত্যেকদের অনেকেই সুচতুরভাবে চুপ থেকে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মৌনতা অবলম্বন করেছেন, তখন তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে অনতে মাঠে নেমে কাজ করেছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা বিরোধী গান গেয়েছেন মহল্লায় মহল্লায়।‘‘দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার’’ কবিতা বা গান সেভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। তিনি কৃষক-সম্মেলন, নারী-সম্মেলন, ছাত্র-সম্মেলনে সশরীরে শরীক হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘‘জীবনে জীবন যোগ করা/ না হলে বৃথা পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পশরা।’’ নজরুল জীবনে জীবন যোগ করেছেন, ‘‘কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা’’ অর্জন করেছেন। তাঁর কবিতা গান-গল্প-অভিভাষণ মহৎ মানবতাবাদী সৃষ্টিকর্মের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। তিনি ব্যক্তি হিসেবে তাঁর সৃষ্টির চেয়েও মহৎ। তাঁর সৃষ্টিকর্মে ভুলত্রুটি আবিস্কার করা অসম্ভব নয়; কিন্তু ব্যক্তি নজরুল সকল লোভ- লালসা, ভয়-ভীতি ও সাম্প্রদায়িকতা-সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ছিলেন। নজরুল পূর্ণ মানবতার প্রতীক পূর্ণ বাঙালিত্বের প্রতীক। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ধার করে বলা যায়: ‘‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ/তাই তব জীবনের রথ/পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার/বারম্বার।’’ তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন গুণীজনের অভিমত আকাশছোঁয়া।
ক.
ভূল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সব কিছ ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নিকো নজরুল।
এই ভুলটুকু বেঁচে থাক,
বাঙালি বলতে একজন আছে
দুর্গতি তার ঘুচে যাক।
(অন্নদাশংকর রায়)
খ.
খুঁজি না রাস্তার নামে
জানি নেই মর্মর মূর্তিতে
তুমি থাকবে, তুমি আছো
আমাদের নিত্য দুঃখ জয়ের সংগ্রামে।
(সুভাষ মুখোপাধ্যায়)
গ.
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা।
(শামসুর রাহমান)
নজরুল তাঁর শেষ অভিভাষণে কবি হিসেবে তাঁর চাওয়া-পাওয়ার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন:
“হিন্দু-মুসলমানে দিন রাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র, ঋণ, অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা পাষাণ-স্তুপের মতো জমা হয়ে আছে– এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সঙ্গীতে, কর্মজীবেন অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম–অসুন্দরকে ক্ষমা করতে, অসুরকে সংহার করতে এসেছিলাম–আপনারা সাক্ষী আর সাক্ষী আমার পরম-সুন্দর।’’
আমরা অতীতের প্রেক্ষাপটে থেকে যদি বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকাই তো দেখি– সারা পৃথিবী এখন নতুন করে এবং আরও বেশি প্রকটভাবে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক হানাহানি, দখলদারী যুদ্ধ এবং ভেদাভেদজনিত অবিচারের কবলে পড়েছে। ভারত উপমহাদেশে, মধ্যপ্রাচ্যে– কোথাও শান্তি নেই এতটুকু। বিশ্বে অতীতের চেয়েও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে পুঁজিবাদী শাসন ও শোষণ। নারী জাতিকে নতুন কৌশলে একপক্ষে কালো বোরকায় বন্দি এবং অন্যপক্ষে নগ্ন সেক্সপণ্যে পরিণত করার সুচতুর চেষ্টা চলছে। একদিকে সম্পদের পাহাড় ও আকাশছোঁয়া বিলাসিতা, অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষের অনাহার, অর্ধাহার, অশিক্ষা, চিকিৎসাহীনতা ও আশ্রয়হীনতার সীমাহীন কষ্ট। এই প্রেক্ষাপটে যদি পৃথিবীর কোনো কবির সৃষ্টি ও জীবনকে সমস্যা সমাধানের মডেল হিসেবে বেছে নিতে হয়, সেটি হবে নজরুলের সৃষ্টি ও ব্যক্তিজীবন। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সুস্বপ্ন, স্বাধীনতা, সর্বজনীন মানবপ্রেম, ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা, নারী-পুরুষের মাঝে সৃষ্ট কৃত্রিম বৈষম্য দূরীকরণ, এবং সকল মানুষের মধ্যে উদারনৈতিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কবি হিসেবে কথায় ও কাজে, সৃষ্টিতে ও সাধনায়, আদর্শের বহিঃপ্রকাশে ও ব্যক্তিজীবনে অনুশীলনে– নজরুল এক ও অদ্বিতীয় । আর সম্ভবত সেজন্যই নতুন সাম্রাজ্যবাদীরা , একচেটিয়া মুনাফালোভী অর্থনৈতিক বেনিয়ারা, শিক্ষিত রাষ্ট্রীয় মৌলবাদীরা, শিক্ষিত পুরুষতন্ত্রবাদীরা, নিরুঙ্কুশ ভোগবাদী প্রগতিশীলেরা, ধর্ম-বর্ণ-জাতপাতভেদকারী কায়েমী স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী নজরুলকে নানাভাবে দাবিয়ে রাখার এবং উপেক্ষা করার নানামুখি তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সেসব কায়েমী স্বার্থান্ধ গোষ্ঠীর বিপরীতে যাদের নৈতিক, আদর্শিক ও আত্মিক অবস্থান, নজরুল তাদের প্রিয় কবি ও মানুষ।
কাজী নজরুল ইসলামের প্রায় একক অবদান হচ্ছে বাংলাভাষার অনাবিস্কৃত ও অব্যবহৃত তেজগর্ভ ঝড়ীয় প্রকাশ ক্ষমতার আবিস্কার এবং তার সর্বোচ্চ সুপ্রয়োগ। ‘বিদ্রোহী’ , ‘প্রলয়োল্লাস’ , ‘কামাল পাশা’, ‘ আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’., ‘ভাঙার গান’ প্রভৃতি কবিতা পড়ার আগে বাঙালির জানা ছিলো না যে,– বাংলা ভাষায় এমন জ্বালাময়ী কবিতা রচনা করা সম্ভব । ‘‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন’’, ‘‘কারার ঐ লৌহ-কপাট / ভেঙে ফেল, কর রে লোপাট/ রক্ত-জমাট শিকল-পুজোর পাষাণ-বেদী’’ ‘‘ লাথি মার ভাঙ রে তালা / যতসব বন্দীশালায় আগুন জ্বালা/ আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি’’, ‘‘আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত নৃশংস/ মহা-প্রলয়ের নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস’’, ‘‘ আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড, / আমি চক্র ও মহা শঙ্খ, আমি প্রণব নাদ প্রচণ্ড!’’, “ আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে / মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে’’ , “ ‘ময় ভুখা হুঁ’-র রক্তক্ষেপী ছিন্নমস্তা আয় মস্তা আয় মা কালী / গুরুর বাগে শিব-সেনা তোর হুঙ্কারে ঐ ‘জয় আকালী’।’’ – এই ধরনের অগ্নি-পঙক্তি রচিত হতে পারে রোমান্টিক পেলবতায় কোমল লিপিস্টক-গন্ধী বাংলা ভাষায় তা কবি নজরুলের আবির্ভাবের আগে ছিলো অনাবিস্কৃত ও অচিন্তিতপূর্ব একটি বিষয়। নজরুল সচেতন প্রয়াসে ও সক্রিয় অনুশীলনের মাধ্যমে বাংলাভাষার এই শক্তিমত্তার দিকটি আবিস্কার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘ক্রুদ্ধ রোষে রুদ্ধ ব্যথায় ফোঁপায় প্রাণে ক্ষুব্ধ বাণী/ মাতালদের ঐ ভাঁটিশালায় নটিনী আজ বীণাপাণি।’’ তিনি সেই রুদ্ধ ব্যথার ক্ষুব্ধ বাণীকে প্রকাশের যথাযথ ভাষা এনে হাজির করেছেন বঙ্গীয় সাহিত্যের দরবারে। আর বলেছেন,‘‘ ঘোমটা-পরা কলা বৌ-এর গলা ধরে দাও করে দূর’’ । এটা সত্য যে, বাংলাভাষাকে বিদ্যাসগরীয়-বঙ্কিমী সংস্কৃতপ্রধান জগাখিচুড়ি থেকে উদ্ধার করে একটি প্রমিত ও পরিশীলিত রূপ দান করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এটা আজ সর্বজন স্বীকৃত উজ্জ্বল ঘটনা। কিন্তু সেখানেই বাংলাভাষার সীমানা শেষ হয়ে যায়নি। রবীন্দ্রনাথ রূপায়িত সেই বাংলা ভাষা ছিলো পরিশীলিত রোমান্টিক কোমলতায় সীমায়িত । নজরুল বাংলাভাষার ভদ্রলোকীয় কোমল-পেলব মেজাজে যুক্ত করে দিয়েছেন দুর্বিনীত অগ্নিবীণার সুর—দুর্দমনীয় অগ্নিবাণীর তেজ। বাংলাভাষা শৃঙ্গার রসের প্রেমের কবিতা লেখার উপযুক্ততার পাশাপাশি পেয়েছে বীররসের কাব্যরচনা ও প্রকাশের মাধ্যম হওয়ার কালবৈশাখী-গতি, তরঙ্গ-চঞ্চলতা, ভূমিকম্প-শিহরণ ও অগ্নিগিরি-উচ্ছ্বাস। এই উজ্জ্বল অবদানের ঘটনা কিন্তু আলোচনায় আসে না কোথাও।
পুনশ্চ স্মরণযোগ্য যে, নজরুলের নন্দনচেতনা সম্পূর্ণরূপে তাঁর নিজস্ব । সেটা গণমানুষের চাহিদা ও রুচির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। নজরুল পশ্চিমাদের দাবিকৃত আধুনিকতা সম্পর্কে সবখানি সচেতন ছিলেন এবং তিনি সেই লাইনে সাহিত্য রচনায় সমর্থ ছিলেন ষোলআনা। তাঁর কিছু কিছু কবিতা সেই প্রমাণ বহন করে চলেছে উজ্জ্বল রূপেই। কিন্তু তিনি শিল্পের চেয়েও মানুষকে বড়ো করে জানতেন। তিনি সেই ব্যাখ্যা তাঁর ‘‘আমার কৈফিয়ৎ’’ নামক কবিতাতে দিয়েই গেছেন একথা বলে: “পরোয়া করি না বাঁচি না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে / মাথার উপর জ্বলিছেন রবি রয়েছে সোনার শত ছেলে।’’ তিনি আরও বলেছেন ‘‘অমর কাব্য তোমরা রচিও রয়েছো যাহারা সুখে।’’ তিনি সরকার বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনো বৈষয়িক সুবিধা অথবা পুরস্কার-সম্মান আশা করতেন না, চাইতেন না। সেজন্য তিনি ছিলেন আপোসহীন আপন বিশ্বাসে, ব্রতে ও রুচিতে। তোষামোদ, মোসাহেবী, দালালী এসব নজরুলের ছিলো না কোনোদিন। পশ্চিমাদের উদ্ভাবিত, প্রযোজিত ও প্রচারিত প্রাচ্যবাদে আক্রান্ত উপমহাদেশের বুদ্ধিজীবী-পণ্ডিত-সমালোচক সম্প্রদায় নজরুলের প্রাতিস্বিক নন্দনচেতনা ও সৌন্দর্যবোধকে ন্যায্য মর্যাদায় ও যথাযথ উজ্জ্বলতায় গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছেন। মূল কারণ শ্রেণিচরিত্র। পশ্চিমা নন্দনতত্ত্বের অন্ধ অনুসারীতে ভরে আছে বাংলা সাহিত্য। এডওয়ার্ড সাঈদ চিহ্নিত পশ্চিমাদের প্রাচ্যবাদ প্রযোজিত ও প্রচারিত হীনন্মন্যতা বাংলা সমালোচনা সাহিত্যকে আকীর্ণ করে রেখেছে রবীন্দ্র-নজরুল যুগ থেকে অদ্যাবধি। প্রকরণগতভাবে কোনো সাহিত্য পাশ্চাত্যের সাহিত্যদর্শনের সঙ্গে হুবহু না মিললেই তাকে খারিজ করে দিতে চেয়েছেন হীনন্মন্যতায় আক্রান্ত পণ্ডিত-সমালোচকগণ। সেই অন্ধ অনুসরণের মিছিলের বিপরীতে প্রাতিস্বিকতায় উজ্জ্বল আপন মশাল হাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন কাজী নজরুল ইসলাম—একা; তাঁর বাহু দুটি ছুঁয়ে আছে সীমানাহীন দিগন্ত , সাত আসমান ছেদ করে উঁচু হয়ে স্থির তাঁর শির আর চোখ দুটি চেয়ে আছে অপলক নিপীড়ত বঞ্চিত উপেক্ষিত সাধারণ মানুষের কাতারে। এই ছবি যুগপৎ ধারণ করে আছে তাঁর সৃজনশীল জীবন এবং ব্যক্তিজীবন—-অনতিক্রম্য মহিমায় ।
আমিনুল ইসলাম
কবি ও গবেষক
ঢাকা।
কবিতায়-প্রবন্ধে-সংগীতে তিনি যে-‘আমি’ কে উপস্থাপন করেন, সে হচ্ছে ‘বীর্যবান আমি’, ‘চিরবিজয়ী আমি’, ‘বিশাল আমি’। নজরুল তাঁর সৃষ্টিকর্মে মানুষের অপরিসীম শক্তিধর ও অশেষ সম্ভাবনাময় ব্যক্তিত্ব ও আমিত্বের শুভ উদ্বোধন করেন।
ওরে বাবা! এত বৃহৎ লেখা, তবুও পড়লাম পুরোটা । কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান নিয়ে বাংলা একাডেমির প্রকাশনায় আপনার গবেষণা গ্রন্থ ‘নজরুল সংগীত: বাণীর বৈভব পড়েছিলাম,সেখানে আপনি নজরুলের গানের বিশদ বর্ণনা চিত্রায়ণ করেছেন । ঠিক একইভাবে এই বিশাল প্রবন্ধটিতেও আপনি নজরুলের সাহিত্যকর্ম ও তাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন যা আমার মত অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য রিফুয়েলিং হিসেবে কাজ করেছে । আপনার সাথে আমি সহমত যে সাপ্রদায়িক সম্প্রীতি সহ কবি নজরুল জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের পক্ষেই কলম ধরেছিলেন এবং সকলের জয়গান গেয়েছেন সমান্তরালে । কবির ভাষায়
“ওরা হিন্দু না মুসলিম এই জিজ্ঞাসা কোন জন,
কাণ্ডারী বলে ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার” ।
সর্বোপরি আপনার রচিত এই প্রবন্ধটির মাধ্যমে অনেক নতুন কিছু জানলাম । ধন্যবাদ আপনাকে এমন উদারভাবে কবি নজরুল কে কাজ করার জন্য । ভালো থাকেবেন ।
—বাংলা ভাষা ও কথা সাহিত্যের অমর শিল্পী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার সৃষ্টি সম্ভার বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্যের রাজ সভায় স্থান করে দিয়েছে। তারপরও আক্ষেপ থেকে যায়, যদি যথাযথ অনুবাদের মাধ্যমে তার এ সৃষ্টিসম্ভার সকল ভাষা- ভাষী মানুষের কাছে তুলে ধরা যেত,তাহলে হয়ত বাংলা ও বাঙালির সাহিত্য চর্চার ইতিহাস বদলে যেত।
—বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যার গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে।
—তিনি জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র পরিবারের দুখু মিয়া হয়ে। আর মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি। মাঝে ৭৭ বছর জুড়ে ছিল সৃষ্টি ও সৃজনশীলতার এক বিশাল ইতিহাস।
—কখনও তিনি গান গাইছেন, কখনও পত্রিকা সম্পাদনা করছেন, কখনও রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করছেন। নজরুল সম্ভবত ওই সময়ের প্রথম বাঙালি, যিনি বাংলার নবজাগরণের যে ঐতিহ্য সেটা ধারণ করেছিলেন এবং তার মধ্যে দিয়ে তিনি বাঙালিকে একটা শক্ত, সবল নতুন চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।”
—তিনি কখনোই শুধুই সাহিত্যের মধ্যে আবদ্ধ ছিলেন না বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামেও ঝাপিয়ে পড়তেন। কলকাতা থেকে কুমিল্লা। বাদ যায়নি ফরিদপুরও। কবি ছুটেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সেই সাথে চলতো তাঁর ক্ষুরধার লেখনী। অন্ধকারে আলোর ঝলকানি দেখল নিপীড়িত মানুষ। মাত্র ২২ বছরের লেখকজীবনে ইতিহাস গড়লেন। তারপর হুট করে বলা নেই, কওয়া নেই নির্বাক হয়ে গেলেন। জীবনের সব অজানা দুঃখ-কষ্ট তাঁকে কুরে কুরে খেল। মানুষের পৃথিবীতে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। থামিয়ে দিলেন লেখনী। কেউ প্রশ্ন করলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। পরের টুকু শুধুই নির্বাক ও বেদনার করুন কাহিনি —–
—ভালোবাসার স্বপ্নচারিণী সামনে এলেও একবারের জন্যও বলতেন না, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেবো খোঁপায় তারার ফুল’। গাইতেন না আর সাম্যের গান। প্রিয়ার বিরহে লিখতেন না নতুন কবিতা। হয়তো মনে মনে বলতেন-
‘পরজনমে দেখা হবে প্রিয়
ভুলিও মোরে হেথা ভুলিও।
এ জনমে যাহা বলা হলো না,
আমি বলিব না, তুমিও বল না।’
—কবি চিরতরে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। অজানা অসুস্থতা তাঁকে ভর করল। সভ্য দুনিয়ার মানুষের অসততা, ভন্ডামি, নোংরামি, দ্বিচারিতা, মিথ্যাচার, হিংসা, বিদ্বেষ, মুহূর্তে রূপ বদলানো, স্বার্থপরতা তাঁকে স্তব্ধ করে দিল। তাঁর নির্বাক চাউনিতে লুকিয়ে থাকত অজানা বেদনা। হয়তো বলতে চাইতেন অনেক কিছু। কিন্তু বলতে পারতেন না। এভাবে কঠিন অসুখে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট, ১২ ভাদ্র কবি নজরুল মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন।
—মাত্র ২২ বছর লেখালেখি করে দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। জগৎকে জানিয়ে দিয়েছিলেন নজরুল মানে বিদ্রোহ, ঘূর্ণি, প্রেম, বিরহ, ভালোবাসার সুখছাউনি। এত বর্ণাঢ্য লেখনীর বৈচিত্র্য দুনিয়ার আর কোনো লেখকের আছে? আমাদের জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে আছেন নজরুল। তিনি লিখলেন বিদ্রোহের কবিতা, ‘বল বীর’। আবার তিনিই লিখলেন, ‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন, দিল ওহি মেরা ফাসগিয়ে…’।
— তিনি মুগ্ধ হয়েছেন দূর দ্বীপবাসিনীকে দেখে। আবার লাইলির ফিরে আসায় মজনুর আঁখি খোলার বাসনা তাঁর কবিতায়। তিনি লিখেছেন, ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে….
—নজরুলের প্রেমে পড়েননি, এমন পুরুষ কিংবা নারী খুঁজে পাওয়া ভার। তাঁর চরম শত্রুরাও তাঁর ভালোবাসার শক্তির কাছে হার মেনেছেন। কবি বুদ্ধদেব বসু নজরুলকে প্রথম দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। তিনি লিখেছেন, ‘সেই প্রথম আমি দেখলাম নজরুলকে। এবং অন্য অনেকের মতো যথারীতি তাঁর প্রেমে পড়ে গেলাম!’ শুধু বুদ্ধদেব বসু নন, তাঁর স্ত্রী প্রতিভা বসুও নজরুলের প্রেমে পড়েছিলেন। সেই কাহিনি নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘আয়না’ নামে একটি গল্প। কী অবাক কাণ্ড! স্বামী-স্ত্রী দুজনেই একই লেখকের প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছেন!
—কবি নজরুল চলে গেছেন অনেক কাল, কিন্তু তার পদচিহ্ন রেখে গেছেন আমাদের জন্য। যুগে যুগে কালে কালে সকল শ্রেণি পেশার মানুষ ও সাহিত্যপ্রেমীদের নিকট তিনি পুজিত হবেন অবলীলায় অকাতরে।
কালজয়ী এই কবি প্রতীভাকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে জানাই শ্রদ্ধার্ঘ্য!!!
✌ জয় হোক কবির,✌ জয় হোক কবিতার।।