spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যনজরুল সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা

লিখেছেন : মজিদ মাহমুদ

নজরুল সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা


মজিদ মাহমুদ

ঔপনিবেশিক শাসনের কূটকৌশলের মধ্যে একটি হল স্বদেশীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। একটি জাতি যখন নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাস এবং সংঘাত পাকিয়ে তোলে যখন সেই জাতি তার মহৎ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ঐকমত্যে আসতে পারে না। বহু শতাব্দী ধরে ভারতবর্ষে ছিল বহু জাতির বসবাস। বছরের পর বছর তারা পাশাপাশি বসবাস করে এসেছে। অন্যের সংস্কৃতি এবং ধর্মের প্রতি এদেশের মানুষের ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। মসজিদে আজানের শব্দে পূজারীর পূজার ব্যাঘাত ঘটেনি। আবার শঙ্খের শব্দ ভেসে এসেছে পূজারীর নিবেদনের সময় মত। মুসলমানরা ভারতবর্ষে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করার পর এমন একটি শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায় রাজার কাছে সমান মর্যাদায় ছিল।
মুসলমান শাসকদের কাছ থেকে ইংরেজ একদিন রাজ্য ছিনিয়ে নিল। কায়েম করল বিদেশী শাসন ব্যবস্থা। মুসলমান শাসকরা শুরুতে বিদেশ থেকে আসলেও কালক্রমে এ দেশই তাদের জন্মভূমি ও নিজের দেশ হয়ে উঠেছিল। একজন সম্রাট যিনি প্রথমে জয় করেছিলেন ভারতবর্ষ, ভারতবর্ষই হয়ে উঠেছিল তারপর তাদের সুখ-দুঃখের আবাসস্থল। এবং পরবর্তী শাসকরা এদেশেই জন্মগ্রহণ করেছে; এমন কি সম্রাটের হিন্দু সম্রাজ্ঞীর গর্ভে। রবীন্দ্রনাথ তার ‘মুসলমানী’র গল্পে বলেছেন–
‘এই মহলকে লোকে বলত রাজপুতানীর মহল। পূর্বকালের নবাব এনেছিলেন রাজপুতের মেয়েকে কিন্তু তাকে তার জাত বাঁচিয়ে আলাদা করে রেখেছিলেন। সে শিব পূজা করত, মাঝে মাঝে তীর্থ ভ্রমণেও যেত। সেই রাজপুতানী এই মহল থেকে যত হিন্দু বেগমদের আশ্রয় দিত, তাদের আচার-বিচার ছিল অক্ষুণ্ণ। শোনা যায়, এই হবির খাঁ সেই রাজপুতানীর পুত্র। যদিও সে মায়ের ধর্ম নেয় নি, কিন্তু সে মাকে পূজা করত অন্তরে।’
হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ছিল এমনই। হিন্দু ও মুসলমান ছিল ভারতবর্ষের দু’টি নয়ন। কিন্তু ইংরেজ এসে সে দু’ নয়নের একই বস্তু দেখবার ক্ষমতা রহিত করে দিল। দেখার মাঝখানে গড়ে তুলল দেয়াল। মুসলমান যেহেতু রাজ্যহারা শাসক শ্রেণির দলে। সেহেতু ইংরেজ প্রাথমিকভাবে পক্ষটি বেছে নিল উচ্চবর্ণের হিন্দুকে। এবং তাদের বোঝানোর প্রয়াস পেল মুসলমান শাসকরাও ভিনদেশী; তাছাড়া যেহেতু হিন্দু রাজ ক্ষমতায় ছিল না সেহেতু হিন্দু পক্ষে ইংরেজের বন্ধু হওয়ার কোনো বাধা নেই। হিন্দু-মুসলমানের স্থলে ইংরেজকে তাদের প্রভুর আসনে বসিয়ে দিল। কিন্তু সমস্যাটি রইল অন্য জায়গায়। ইংরেজ শাসনের মূল লক্ষ্য ছিল শাসন শোষণ আর লুণ্ঠন।
মুসলমানদের কাছ থেকে যেহেতু ইংরেজ ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন, সেহেতু মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের নতুন ইতিহাস রচনা করতে হয়েছে। যা ছিল ভুল এবং মিথ্যা তথ্যে ভরপুর। এতে তাদের উদ্দেশ্য সাধনে যথাযথভাবেই হয়েছিল মার্কস ঠিকই বলেছিলেন, ‘ইংরেজ বক ধার্মিকদের কেচ্ছার শেষ এখনো হয়নি।’
‘মীরজাফর ইংরেজ বণিকের মানদণ্ডকে রাজদণ্ডে পরিণত করতে সাহায্য করেছিলেন আর রামমোহন সেই রাজদণ্ডকে দীর্ঘস্থায়ী করবার জন্য বিদেশী বণিক-রাজের সঙ্গে কোলাবোরেশন করেছেন। ১৮৩২ সালে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন সংস্কারের যে ব্যবস্থা হয়, রামমোহন সেই সংস্কারের পক্ষে মত প্রকাশ করেন।’
রামমোহন ভারতের হিন্দুদের উপনিষদের শিক্ষাতে আলোকিত করে তুলতে চেয়েছিলেন। উপনিষদকে তিনি প্রগতিশীল দর্শন বলে চালানর প্রয়াস পেয়েছিলেন। রামমোহনের পথ ধরেই বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমের আবির্ভাব ঘটল। গোপাল হালদার বলতে চেয়েছেন- ‘জাতীয় ইতিহাসে বঙ্কিমের আত্মপ্রকাশ যেমন জাতির আত্মপ্রত্যয় লাভ ঘটেছে, জাতীয় বিভ্রান্তিতেও তেমন বঙ্কিম ঘটিয়েছেন ভ্রান্তি। বঙ্কিম হিন্দু জাতীয়তাবাদের বল বৃদ্ধি করেছেন।’
নজরুলের আগে বাংলা সাহিত্য ছিল মূলত সাম্প্রদায়িক সাহিত্য। নিজ সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ববোধ তখনকার লেখকদের ছিল সাধারণ মানসিকতা। নজরুল ভিন্ন বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের শক্তিশালী কোন প্রতিনিধি ছিলেন না। তবে সাহিত্যের শক্তি কম হলেও সেই সব নির্মাতার মনের ঔদার্য কম ছিল না।
নজরুল ইসলাম তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে ‘অগ্নি-বীণা’তেই প্রমাণ করলেন, তিনি মুসলমানের নন, তিনি হিন্দুর নন– তিনি সকল মানুষের, সকল ধর্মের। বঙ্কিম যে হিন্দু জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছিলেন, নজরুল ইসলাম তা দুমড়ে মুচড়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের রূপান্তর করেন। ঔপনিবেশিক শাসনপূর্ব ভারতবর্ষে যে সেক্যুলার পরিবেশের জন্ম হয়েছিল, মুসলমান শাসনের ফলশ্রুতিতে যে সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত গড়ে উঠেছিল নজরুল তার পুনর্জাগারণ ঘটাতে চেষ্টা করলেন। গোপাল হালদার বলেছেন– ‘বঙ্কিমের সাহিত্য সৃষ্টির ফল এই, শতকরা ৫৪ জন বাঙালি-মুসলমান তাতে ক্ষুব্ধ, তাই বঙ্কিম বাঙালি জাতীয়তাবাদের সর্বস্বীকৃত স্রষ্টা নন, যেমন স্রষ্টা নজরুল।’ অগ্নিবীণা’ কাব্যে হিন্দু-মুসলমান ঐতিহ্য এমন একাকার হয়ে মিশে গেছে যে, কাউকে পৃথক করবার কোন উপায় নেই। তাজি বোররাক আর উচ্চৈশ্রবা বাহন’ একই সঙ্গে ধাবমান হল তর কবিতায়। নজরুল তাঁর কবিতাতে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দুইভাবে লড়াই করে এসছেন।
এক. কবিতার আঙ্গিক এবং বিষয় নির্বাচনে তিনি সংকীর্ণ গোষ্ঠীচিন্তা পরিহার করেছেন।

দুই. সরাসরি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা লিখেছেন।
প্রথম বিষয়টি প্রতিবাদ্য করবার জন্য আমরা যদি শুধুমাত্র ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যটাই বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে শ্রী বারীন্দ্র কুমার ঘোষকে। শ্রী বারীন্দ্র কুমার হিন্দু কি মুসলমান– এটা নজরুলের দ্রষ্টব্য ছিল না। নজরুল একজন বীরকে এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন। যিনি যে কোন উপায়েই হোক স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। সুতরাং নজরুলের এই উৎসর্গের মধ্যে তাঁর মানস প্রতিফলন ঘটেছে। তেমনি তিনি এই কাব্যগ্রন্থে কামাল পাশা এবং আনোয়ার পাশার মত বীরের জয় এবং সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। পাশাপাশি প্রলয়োল্লাস, বিদ্রোহী, ‘ধূমকেতু’ প্রভৃতি কবিতায় সমানভাবে ভারতীয় ঐতিহ্য এবং পুরাণের ব্যবহার হয়েছে। এই কবিতাগুলিতে সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়েছে ভারতীয় হিন্দু পুরাণ। বিষয়ের সঙ্গে ইসলাম ঐতিহ্যবাদী শব্দের সমন্বয় ঘটেনি। ভারতবর্ষে সকল সংস্কৃতি এখানকার মানুষের। এই কাব্যে নজরুল ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ নামে কবিতা রচনা করেছেন। পাশাপাশি তিনি লিখেছেন, ‘খেয়াপারের তরণী’ ও ‘মোহররমে’র মত কবিতা।
নজরুলের মধ্যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা কাজ করেনি। যে বালগঙ্গাধর তিলক ‘গণপতি’ এবং ‘শিবাজী’ উৎসবের মত হিন্দু সাম্প্রদায়িক উৎসবের প্রচলন করেছিলেন। মুসলমান শাসক আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে কুৎসা এবং শিবাজীর বীরত্ব প্রমাণই যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল। সেই জাতীয়তাবাদী নেতা তিলকের মৃত্যুতেও নজরুল ইসলাম অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানিয়ে সম্পাদকীয় লিখেছেন। নজরুলের কাছে এটিই বড় ঘটনা যে তিলক স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। নজরুল বলেছেন, ‘আমাদের জননী জন্মভূমির বীরবাহু, বড় স্নেহের সন্তান–‘তিলক আর নাই।’
নজরুল মানুষের বিচার কেবল ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে করেননি। নজরুল বলছেন, শাস্ত্র মানুষ আনেনি পৃথিবীতে মানুষই শাস্ত্র এনেছে। নজরুল বলছেন, হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির-মসজিদ নেই। নজরুল ভারতবর্ষের সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার এক চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন–
‘মারো শালা যবনদের! মারো শালা কাফেরদের।’
–‘আবার হিন্দু-মুসলমানী কাণ্ড বাধিয়া গিয়াছে। প্রথমে কথাকাটাকাটি, তারপর মাথা ফাটাফাটি আরম্ভ হইয়া গেল। আল্লাহ এবং মা কালীর প্রেস্টিজ রক্ষার জন্য যাহারা এতক্ষণ মাতাল হইয়া চিৎকার করিতেছিল তাহারাই যখন মার খাইয়া পড়িয়া যাইতে লাগিল, দেখিলাম-তখন আর তাহারা আল্লাহ মিয়া বা কালী ঠাকুরানীর নাম লইতেছে না। হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি পড়িয়া থাকিয়া এক ভাষায় আর্তনাদ করিতেছে–‘বাবা গো, মাগো। মাতৃ পরিত্যক্ত দু’টি বিভিন্ন ধর্মের শিশু যেমন করিয়া একস্বরে কাঁদিয়া তাহাদের মাকে ডাকে।…
সেই রুদ্র আসিতেছেন, যিনি ধর্ম মাতালদের আসা ঐ মন্দির-মসজিদ-গীর্জা ভাঙ্গিয়া সকল মানুষকে এক আকাশের গম্বুজ-তলে লইয়া আসিবেন।
জানি, স্রষ্টার আপনি-মোড়ল ‘প্রাইভেট সেক্রেটারিয়া হ্যাট খুলিয়া, টুপি তুলিয়া, টিকি নাচাইয়া আমায় তাড়না করিবে, তবু ইহাদেরই পতন হইবে। ইহারা ধর্ম-মাতাল। ইহারা সত্যের আলো পান করে নাই, শাস্ত্রের এলকোহল পান করিয়াছে।
মুহম্মদকে যাহারা মারিয়াছে, ঈসা-মুসাকে যে সব ধর্ম মাতাল প্রহার করিয়াছি, তাহাদেরই বংশধর আবার মারিতেছে মানুষকে–ঈসা-মুসা-মুহম্মদের মত মানুষকে।
যে সব অবতার-পয়গম্বর মানুষের মার হইতে মানুষকে বাঁচাইতে আসিয়া মানুষের মার খাইয়া গেলেন, তাহারা আজ কোথায়? মানুষের কল্যাণে আসিয়াছিলেন যাহারা, তাহাদেরই মাতাল পশু শিষ্যেরা আজ মানুষের সর্ব অকল্যাণের হেতু হইয়া উঠিল।…
উহাদের দুই দলেরই নেতা একজন, তাহার আসল নাম শয়তান। সে নাম ভাড়াইয়া, কখনো টুপি পরিয়া পরদাঁড়ি লাগাইয়া মুসলমানদের ক্ষেপাইয়া আসিতেছে, কখনো পরটিকি বাঁধিয়া হিন্দুদের লেলাইয়া দিতেছে, সেই আবার গোরা সিপাই লইয়া হিন্দু-মুসলমানদের গুলি মারিতেছে। উহার ল্যাজ সমুদ্র পার গিয়া ঠেকিয়াছে। উহার মুখ ‘সমুদ্রপারে বুনো বাঁদরের মত লাল?’
বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যে নজরুল-ই অন্যতম প্রধান কবি যাকে এই সব সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতাহীন কবি-সাহিত্যিকের হয়ত কমতি নেই বিশ্ব সাহিত্যে, কিন্তু ভারতের এই সংকীর্ণ বিষয়কে নিয়ে লড়তে হয়েছে নজরুল ভিন্ন খুব কম কবিকেই। নজরুল কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমায়িত করা যায় না। নজরুল হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সব ধর্মের, সব সমাজের হয়ে তিনি কাজ করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে মানুষের অবস্থান সবার উপরে। ধর্ম শাস্ত্র, মসজিদ-মন্দিরের চেয়ে পবিত্র মানুষ।
যে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে নজরুলের অভিযাত্রা, সেই ঔপনিবেশিক শাসন দূর করবার জন্য হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য ছিল সর্বাগ্রে। মুসলমানকে বাদ দিয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীনতার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তা-কার্যকরী হয়নি। নজরুল ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় বলেছেন–
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ।
‘হিন্দু না ওর মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসা কোন জন?
কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!…
নজরুল বলেছেন, ‘ভারত আজ পরাধীন এবং আজো যে স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা শুরু হয় নি, শুধু আয়োজনেরই ঘটা চলছে, এবং ঘটও ভাঙছে–তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা। আমরা আমাদের প্রতিবেশী হিন্দুর উন্নতি দেখে হিংসা করি, আর হিন্দুরা আমাদের অবনতি দেখে অশ্রদ্ধা করে।’
নজরুলের কবিতায়-গানে, গল্প উপন্যাসে হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য একাকার হয়ে মিশে গেছে। দুর্গা পূজা, কালী পূজা, সরস্বতী পূজা, কোরবানী, মহররম, ঈদ এসবই তার কবিতায় সম-মাত্রিকতা পেয়েছে। তিনি কোরবানী নিয়ে কবিতা লিখেছেন। কিন্তু সেই কবিতা ধর্মের মুদ্রা নয়। সেই কবিতা সমকালীনতা ধারণ করেছে। কোরবানীর যে মূল অনুপ্রেরণা, নজরুল সেই মূল অনুপ্রেরণাকে কাজে লাগিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে জোরদার ভ‚মিকা পালনের কথা বলেন। কবি কোরবানী কবিতা লিখেছেন, অথচ ইসলামী শব্দকে সর্বাংশে ব্যবহার করেন নি। তিনি কোরবানীর বাণীকে আজকের সত্যগ্রহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আজ জল্লাদ নয়, প্রহলাদ-সম মাল্লা খুন-বদন!’ তাই আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা রচনা করবার জন্য নজরুল জেল খাটতে হয়েছে। সুতরাং এতে বোঝা যায়, এই কবিতাটি হিন্দুর কোন দেবী নয়। কিংবা দেবীকে বোঝান নজরুলের লক্ষ্য নয়। নজরুল আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতায় ভারতবাসীকে ইংরেজ শাসন না খেদানোর জন্য নির্মম কষাঘাত করেছেন। মাটির মূর্তির প্রতি নজরুলের কোন আকর্ষণ ছিল না। তিনি ধর্মের অক্ষরকে বিশ্বাস করেন না। তিনি বিশ্বাস করেন ধর্মের অনুপ্রেরণাকে। যে মহান বাণী দিয়ে ধর্মের আবির্ভাব হয়েছিল, সেই বাণীকে সময়ের প্রয়োজনে সাম্প্রদায়িকতার প্রয়োজনে ব্যবহার করা। ‘অগ্নি-বীণা’ প্রকাশের পরে নজরুলকে আটকাবার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ফন্দি এঁটেছিল, কিন্তু এত বেশি পুরাণ প্রসঙ্গ ব্যবহার হয়েছে এবং পুরানের আড়ালে নজরুল তার আসল উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ পুরাণ প্রসঙ্গ আনার পরেও ব্রিটিশ সরকার রেহাই দেয়নি। কেননা তার এই কবিতার বাণীতে ভিন দেশী সরকার ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল।
ভারতের হিন্দুরা মুসলিম ঐতিহ্যকে নিজের বলে খুব একটা ভাবতে পারেনি, তেমনি মুসলমানরাও হিন্দু সংস্কৃতিকে বেগানা সংস্কৃতি বলে জেনেছে। এই বিদ্বেষাকীর্ণ সমাজে নজরুল মিলনের এক সুস্থ বাতাস বইয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ-ভগবান, মসজিদ-মন্দির-গির্জা-ঈসা-মুসা, কৃষ্ণ, বৃদ্ধ-মুহম্মদ প্রভৃতি ধর্মীয় শব্দ ঐতিহ্য প্রাণপুরুষ এবং প্রধান ব্যক্তিবর্গকে তিনি সমান মাত্রায় ব্যবহার করে বাঙালি পাঠকের মানসিক সংকীর্ণতা দূর করেছেন। আরবী ফারসী শব্দ প্রয়োগে হিন্দুদের যে অনীহা ছিল নজরুল এসে পুনরায় তা দক্ষতার সঙ্গে দূর করেছেন। অথচ বৃটিশ আসার আগেও, এমন কি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রথম সংস্কৃত বাংলা পণ্ডিতদের গদ্য রচনাতেও তার প্রমাণ ছিল। রাম রামবসু প্রতাপাদিত্য চরিত লিখতে যেয়েও ফারসী শব্দের যথাযথ প্রয়োগ করেছেন। অর্থাৎ বাংলা শব্দে শুচিবায়ুগ্রস্ততা, মুসলমানি শব্দ-শুদ্ধিকরণ অভিযান-এসবই ঘটেছিল ইংরেজের বিভক্তি নীতির কারণে।
নজরুল মুসলমানের সংকীর্ণতাকে আঘাতের পাশাপাশি হিন্দিু ধর্মের বর্ণ বৈষম্য ছোঁয়া ছুয়ির বিষয়কেও তীব্রভাবে কটাক্ষ করেছেন। ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ গান সম্বন্ধে ডক্টর নলিনাক্ষ সান্যাল বলেছেন’, ‘১৩৩১ সালের ৩ বৈশাখ তারিখে বহরমপুরে তার বিয়ে হয়েছিল। কবির সাহিত্য ও সঙ্গীতের বন্ধু উমাপাদ ভট্টাচার্য্যরে কাকার বাড়ি ছিল ডক্টর সান্যালের শ্বশুর বাড়ি। পরিবেশটি ছিল গোঁড়া হিন্দুয়ানি। সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে এ বাড়ির নিমন্ত্রণে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থকেও আলাদা আলাদা পঙ্ক্তিতে খেতে বসতে হত। মুসলমানদের তো তার ত্রিসীমায়ও ঢোকার উপায় ছিল না। শ্বশুর বাড়ির সঙ্গে ডক্টর সান্যালের শর্ত ছিল, জাতিভেদ মেনে তার নিমন্ত্রিতদের অপমান করা চলবে না। এমনিতে সঙ্গীত চর্চার জন্য নজরুল ইসলাম উমাপদ ভট্টাচার্যের বাড়িতে যেতেন। কিন্তু সে দিন নজরুল পবিত্র কুমার গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে ডক্টর সান্যালের বিবাহ আসরে উপস্থিত হলেন। কয়েদী নজরুলের বহরমপুর জেলের সুপারিনটেন্ডেন্ট ও মুর্শিদাবাদের সিভিল সার্জন পৈতাধারী কায়স্থ নেতা ডাক্তার বসন্ত কুমার ভৌমিকও এই আসরে উপস্থিত ছিলেন। বরযাত্রীরা সমবেত নিমন্ত্রিতদের সঙ্গে বসতে যাচ্ছেন দেখতে পেয়ে গোঁড়া হিন্দুর দল উঠে চলে গেলেন। তখন নজরুল ইসলাম উমাপদ ভট্টাচার্যের বাড়িতে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসরে ফিরে এলেন। সঙ্গে ‘জাতের বজ্জাতি’ গানটি। তিনি সমবেত বরযাত্রীদের মাঝে গানটি গাইলেন।’
জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় মোয়া\
হুঁকোর জল আর ভাতের হাড়ি, ভাবলি এতেই জাতির জান,
তাই ত বেকুব, করলি তোর এক জাতিকে এক শ’খান।’
বাংলা সাহিত্যে নজরুল ভিন্ন আদ্যান্ত এমন অসা¤প্রদায়িক কবি ব্যক্তি নেই। তিনি মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তার জন্য কবিতা আর সংগ্রাম একই অর্থবোধক। হিন্দুর মুক্তি কাকে বলে, মুসলমানের মুক্তি কাকে বলে সে সব তিনি বুঝতেন না। তিনি বুঝতের, এদেশ স্বাধীন হবে, মাটির পৃথিবীর মানুষের মধ্যে বৈষম্য কমে যাবে। মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করবে। নজরুল ‘হিন্দু-মুসলিম’ কবিতায় বলেছেন–
মাভৈঃ। এতদিনে বুঝি জাগিল ভারতে প্রাণ,
সজীব হইয়া উঠিয়াছে আজ শ্মশান-গোরস্থান।
খালেদ আবার ধরিয়াছে অসি, ‘অর্জুন’ ছোড়ে বাণ।
জেগেছে ভারত, ধরিয়াছে লাঠি হিন্দু-মুসলমান!’
‘স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন–
‘ভারতে যে দিন হইতে এই ম্লেচ্ছ’ শব্দটির উৎপত্তি সেদিন হইতে ভারতের পতন; মুসলমান আগমনে নয়। মানুষকে ঘৃণা করতে শেখায় যে ধর্ম, তাহা আর যাহাই হউক ধর্ম নয়।১৩৩
নজরুলের সবচেয়ে বড় সাধনা ছিল মানুষ হওয়া। ‘শাস্ত্র শকুন’ নির্দেশিত সাম্প্রদায়িক মানুষ হওয়া নয়। নজরুল বলেছেন–
‘হিন্দু হিন্দু থাক, মুসলমান মুসলমান থাক, শুধু একবার এই মহা গগনতলের সীমাহারা মুক্তির মাঝে দাঁড়াইয়া… মানব!! তোমার কণ্ঠের সেই সৃষ্টির আদিম বাণী ফুটাও দেখি; বল দেখি, ‘আমার মানুষ ধর্ম’ দেখিবে, দশদিকে সার্বভৌম সাড়ার আকুল স্পন্দন কাঁদিয়া উঠিতেছে। মানবতার এই মহাযুগে একবার গণ্ডী কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বলো, যে তুমি ব্রাহ্মণ নও, শুদ্র নও, মুসলমান নও, তুমি মানুষ তুমি সত্য!”
অন্যত্র বলেছেন :
‘এস ভাই হিন্দু! এস মুসলমান! এস বৌদ্ধ! এস ক্রিশ্চিয়ান! আজ আমরা সর্বগণ্ডী কাটাইয়া সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা সর্ব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি। আজ আমরা আর কলহ করিব না।’
মানবতার মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য ভাবনার ধারনা এক বিশাল অংশ জুড়ে আছে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি কামনা। সমগ্র আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলামই একমাত্র কবি যিনি সমান দক্ষতার সঙ্গে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ঐতিহ্যকে আপন কাব্যে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছেন। উভয় ঐতিহ্য থেকে অবলীলাক্রমে তিনি বিষয়, উপমা রূপক, বাকভঙ্গি প্রকৃতি আহরণ করেছেন।
নজরুল ইসলাম সমান দক্ষতার সঙ্গে ইসলামী গান এবং শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেছেন। আধুুনিক বাংলা কাব্যে এর আর কোন উদাহরণ নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কালী বিষয়ক এবং পূজা সংক্রান্ত বহু গান রচনা করলেও ইসলামের ঐতিহ্য নিয়ে গান রচনা করেননি। শাক্ত পদাবলীর ইতিহাসে নজরুল নিজের জন্য একটি আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে নজরুলের উদাহরণ কেবল নজরুলই। ইসলামি সঙ্গীতে নিবেদিত এই কবি শক্তি উপাসনার এত ভক্তি কোথায় পেয়েছিলেন ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে। নজরুল না এলে আল্লাহভক্ত বাঙালি এবং কালীভক্ত বাঙালি তাদের প্রাণের ভাষা খুঁজে পেতেন অল্প। একই সঙ্গে তিনি লিখছেন–
১. বলরে জবা বল্
কোন সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণতল\
২. মোহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে
তাই কি রে তোর কণ্ঠেরই গান এতই মধুর লাগে।
নজরুল বলেন, ‘আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাদের সংস্কারে আঘাত হানার জন্য মুসলমানি শব্দ ব্যবহার করি বা হিন্দুদের দেবদেবীর নাম নিই।”
নজরুল কবিতা ছাড়াও নিজের জীবন থেকে শুরু করে অন্যান্য সাহিত্য কর্মেও হিন্দু-মুসলমান এবং অন্যান্য স¤প্রদায়কে সমন্বিত করার চেষ্টা হয়েছে। তিনি তার গল্প উপন্যাসে উভয় স¤প্রদায়ের পাত্রপাত্রীকে নায়ক-নায়িকা এবং অন্যান্য চরিত্রে উপস্থাপন করেছেন। তার ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসে জটিল প্রেমকাহিনি হিন্দু-মুসলমান নায়ক-নায়িকাদের ঘিরে গড়ে উঠেছে। জাহাঙ্গীর প্রমত্ত বজ্রপাণি একই সঙ্গে স্বাধীনতার সংগ্রামে জড়িত। যদিও সন্ত্রাসী আন্দোলনে তৎকালে মুসলমান যুবকদের প্রবেশাধিকার ছিল না। কিন্তু নজরুল তার উপন্যাসে সেই গণ্ডী ভেঙে দিয়েছেন। এই উপন্যাসে প্রমত্ত বলেন ‘আমার ভারতবর্ষ-ভারতের এই মূক, দরিদ্র, নিরন্ন পর পদদলিত তেত্রিশ কোটি মানুষের ভারতবর্ষ।–আমার ভারতবর্ষ ইণ্ডিয়া নয়, হিন্দুস্তান নয়, গাছপালার ভারতবর্ষ নয়, আমার ভারতবর্ষ। আমার ভারতবর্ষ যুগে যুগে পীড়িত মানবাত্মার ক্রন্দন তীর্থ কত অশ্রু-সাগরে চড়া পড়ে গড়ে উঠল আমর এই বেদনার ভারতবর্ষ। ওরে, এ ভারতবর্ষ তোদের মন্দিরের ভারতবর্ষ নয়, মুসলমানের মসজিদের ভারতবর্ষ নয়, এ আমার মানুষের মহাভারত।’
নজরুল জানতেন নির্যাতিতের জাতি নেই, সে হিন্দু হোক, কিংবা মুসলমান হোক। নিপীড়িত হিন্দু এবং নিপীড়িত মুসলমানের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। গরিব মুসলমান এবং গরিব হিন্দুর দুঃখ-বেদনা এবং শিল্পবোধ প্রায় একই মাত্রায়। আবার ধনী হিন্দু এবং ধনী মুসলমান উভয়ের বাড়িতেই দামী আসবাবপত্র, অমূল্য সব পেইন্টিং ভরা। নজরুল তাই ধর্মনিরপেক্ষ সেই নির্যাতিত মানুষকে সমগ্র অন্তর দিয়ে অঙ্কিত করেছেন। মানবের এমন সাম্যের দার্শনিক চেতনা আমাদের মধ্যযুগের বাউল দার্শনিকগণের ছাড়া আর কারো ছিল না। যে মানবতা প্রচার করেছিলেন লালন; নজরুলের মনের সমৃদ্ধি লালনেরই অনুরূপ। কিন্তু লালন শারীরিক সংঘর্ষ এবং সংগ্রামকে এড়িয়ে গেছেন। নজরুল মানুষের কল্যাণ আর মুক্তির জন্য সেই পথকেও বেছে নিয়েছেন। নজরুলের মানবতা তাই আর সবার থেকে শ্রেষ্ঠতর। এমনকি আমাদের মধ্যযুগের মানবতাবাদী বাউল দার্শনিকদের চেয়েও।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজমান। এই দাঙ্গা মূলত দারিদ্র্যের সমার্থক তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সর্বত্র। প্রকৃতপক্ষে এই দাঙ্গার কারণও প্রধানত অর্থনৈতিক এবং ক্ষমতা দখরের কূটকৌশল। এই সব অঞ্চলে নিজেদের জন্যই পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য নেই। তদুপরি অন্য স¤প্রদায়কে খাদ্যশস্য যোগানো সম্ভব নয়। এখনো সর্বত্র সভ্যের বর্বর লোভের কাছে পরাস্ত শুভবুদ্ধি। যুদ্ধ চলছে দেশে দেশে। নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক ছিলেন। তখনকার মতো এখনো তথাকথিত সভ্য ইউরোপ এখনো যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে।
নজরুলের মত একজন কবির উপযোগিতা তাই কখনো ফুরিয়ে যায় না। যখনই পরাধীনতা, যখনই নির্যাতন আর সাম্প্রদায়িক কূপমন্ডুকতা মানুষের বিবেককে দখল করে নেয়; তখনই নজরুল ফিরে ফিরে আসেন। সে নজরুল কখনো বাংলা ভাষায়, কখনো নির্যাতিত মানুষের মুখের ভাষায় কবিতা রচনা করেন। তৃতীয় বিশ্বের এই সব ভাষার কবিতার সঙ্গে আমাদের এখনো সম্যক পরিচয় ঘটেনি। হয়ত সেই সেই ভাষার কবিতা পাঠ করলে আমরা সেখানেও কোন নজরুলকে আবিষ্কার করতে পারি।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ