তাজিমুর রহমান
২০২১ সাল। বছরটি বিশেষ ভাবে আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে স্বাধীনতার ৭৫ বছর,আর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ পূর্তি– যুগপৎ এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে কেন্দ্র করে। এখন প্রশ্ন হতে পারে,এর বাইরে তো আরও অনেক বিষয় আছে,যা এই বছরটিকে আলোকিত করে।এ বিষয়ে কোনরকম দ্বিমত পোষণ না করে আমি বলতে চাইব অন্যান্য বিষয়গুলোর মধ্যেও ওই দুটি বিষয়ই এই বছরটির অন্যতম উজ্জ্বল সোপান। আর, এরকম একটি প্রেক্ষিতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম আলোচ্য বিষয় হলে, খুব স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতা বিষয়টি অনিবার্য ভাবে আলোচনায় যে অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে তার বলার অপেক্ষা রাখে না।কারণ,বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ‘স্বাধীনতা ও নজরুল প্রায়ই একে অপরের পরিপূরক। তাই হয়তো তাত্ত্বিকরা মনে করেছেন–“বাংলা সাহিত্যের কাব্য সৃজনের সংগ্রামীযোদ্ধারা তাঁদের কবিতায় চেতনার স্ফুলিঙ্গে স্বাধীনতাকে অনির্বাণ শিখার সহস্র প্রতীতিতে সাজিয়েছেন পরম নৈপুণ্যে। কবি নজরুল স্বাদেশিকতার দ্রোহ উন্মাদনায় বাঙালিকে টেনে নিয়ে গেছেন যুদ্ধের ময়দানে– কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল বলে। লাথি মার ভাঙরে তালা, যতসব বন্দীশালায় আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি বলে কবিতাকে তিনি শাণিত করেছেন ক্ষুরধার লেখনীর অগ্নিবাণে।” আর প্রাবন্ধিক বীরেন মুখার্জীর মতে,–‘নজরুলই ছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তির সত্যিকারের দূত, যিনি সব সময় দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে জাতির মুক্তির উপায় খুঁজেছেন।’
কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষিত করেছেন বিজ্ঞজনেরা। সে বিষয়ে এখানে কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। অনুসন্ধিৎসু পাঠক প্রয়োজনে তা বিস্তারিত পড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন বলে আমার বিশ্বাস। তবে,কাজী নজরুল ইসলাম যে একজন বিরলতম কবি সে বিষয়ে সকলে অবশ্যই নিঃসংশয়। তাই হয়তো স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘কালের পুতুল’-এ বলেছেন– “আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বড়ো খ্যাতি অন্য কোনো কবি অর্জন করেননি।” আসলে, সমকালীন বুদ্ধদেব বসু হোন বা পরবর্তীতে অন্যান্য গুণীজন–যাঁরাই তাঁর সম্পর্কে মুল্যায়ন করেছেন (প্রতিহিংসা-পরায়ণ হয়ে দু-একজন ছাড়া) প্রায় সকলেই কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টি নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। সর্বপরি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো ছিলেনই।
কাজী নজরুল ইসলামের ‘কবিসত্তা’ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে স্বাভাবিকভাবে ঔপনিবেশিক শাসনের ভারতবর্ষ ও ভারতের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ জোরকদমে এসে পড়ে। কারণ, ভারতের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে যে ক’জন কবির নাম উল্লেখ করতে হয় নিঃসন্দেহে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ‘নজরুলের বিপ্লব: একটি পর্যালোচনা’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক বীরেন মুখার্জী মনে করেছেন,”ভারত উপমহাদেশের বাংলাসাহিত্যে এমনই এক প্রতিবাদী কবি চরিত্র কাজী নজরুল ইসলাম, যিনি তৎকালীন ব্রিটিশ নিপীড়ন থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য লেখনীর মাধ্যমে বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন।”
সেই সঙ্গে তিনি আরও বলেছিলেন,”নজরুলের জীবনী পর্যালোচনায় একটি বিষয় স্পষ্ট, তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী তাকে যতই দমিয়ে রাখার অপকৌশল করেছে তিনি ততই ‘বাঁধনহারা’র মতো অবিরাম ছুটেছেন। ক্ষিপ্র সে গতি। কখনও উল্কার বেগ, কখনওবা প্রলয়ঙ্করী মহাঝড় কিংবা মহাপ্লাবণ হয়ে।” এটা ঠিক যে,তাঁর কবিতার পরতে পরতে এমনভাবে সার্বিক স্বাধীনতার বিষয়টা জড়িয়ে রয়েছে যে, তা শুধু ঔপনিবেশিক তথা বৃটিশ শাসনমুক্তির স্বাধীনতার কথা বলেনি,তার বাইরে একাধিক শাসন থেকে মুক্তি তথা স্বাধীনতার প্রসঙ্গকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। সুতরাং,এই লেখায় সেই বিষয়গুলো ছুঁয়ে ভারতের স্বাধীনতার অনুষঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামকে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে।
কবির জন্ম ১৮৯৯। অর্থাৎ তিনি একজন পরাধীন দেশের নাগরিক। জন্মের পর দুখুমিয়া পর্ব থেকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে তিনি পৌঁচ্ছেছিলেন হাবিলদার কবির পর্বে। পশ্চিমবঙ্গের একটি গরিব পরিবারের অবহেলিত ও অর্ধশিক্ষিত সন্তান ছিলেন তিনি। শুধুমাত্র জীবিকার প্রয়োজনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালে ইংরেজ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এবং হাবিলদারের পদে উন্নীত হয়েছিলেন। আর, এই পর্ব থেকে নজরুলের কবিজীবনের পদচারণা। ফলে,শুরু থেকেই এই সকল ঘটনাগুলো তাকে ক্রমে তৈরি করে দিয়েছিলো এমন একটা মননের যা সবসময় শোষণ,পীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে কথা বলতে চেয়েছে। পাশাপাশি, কবি ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর (১৯১৩-১৪) কাটিয়ে বর্ধমানে ফিরে রাণীগঞ্জের শিয়ারশোল রাজ উচ্চ বিদ্যালয়ে তিন বছর (১৯১৫-১৭) পড়াশোনা করেছিলেন। ওই সময় তিনি ওই স্কুলেরই শিক্ষক নিবারণ চন্দ্র ঘটকের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। তখন বাংলায় ‘অনুশীলন’ ও ‘যুগান্তর’- এই দুটি গোষ্ঠী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা আনার ব্যাপারে দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিল। নিবারণবাবু ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি স্কুল ছেড়ে গেলেও কিশোর নজরুলের ওপর তাঁর স্থায়ী প্রভাব রেখে গেছিলেন। ফলে, নজরুল সারাজীবন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া আর বিকল্প কিছু দেখেননি। এমনকি এটা তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসেও পরিণত হয়েছিল। তাই ‘নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা’ প্রবন্ধে লেখক মোহীত উল আলম মনে করেছেন, “নিজের দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনের সঙ্গে ভারতবাসীর সর্বব্যাপী দারিদ্র্যের জন্য তিনি পরাধীনতাকে সর্বতোভাবে দায়ী করতেন। তাই, তাঁর কৈশোরকালীন শিক্ষক নিবারণ চন্দ্র ঘটক কর্তৃক বপিত বীজ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন থেকে নজরুল কখনও দূরে সরে যাননি।” ফলে কবির এই বিদ্রোহী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তাঁরই লেখায় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে।
যা পরবর্তীতে অবশ্য অকস্মাৎ থেমে গিয়েছিল তাঁর বাকরুদ্ধ হবার পর।সেই হিসেবে কবি কাজী নজরুলের সক্রিয় সৃজনকাল মাত্র ২৩ বছর (১৯১৯-১৯৪১)। সুতরাং, কবির কবিসত্তার বিদ্রোহ বা স্বাধীনচেতা রূপের অন্বেষণে যেতে গেলে ওই ২৩ বছর সময়কালকে আমাদের লক্ষ্য রেখে হাঁটতে হবে।
আমাদের দেশে ১৭৫৭ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর।সিরাজদৌল্লার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতার সূর্য পলাশীর মাঠে ডুবে গিয়েছিল। শুরু হয়েছিল বণিকের ছদ্মবেশধারী ইংরেজের আসলরূপের প্রকাশ। অসহায় ভারতবাসীর উপর নেমে এসেছিল চরম নিষ্ঠুর অত্যাচার। নির্যাতিত,বঞ্চিত, অবহেলিত, উৎপীড়িতদের অক্ষম ক্ষোভ, রোষে বেদনায় জ্বলে উঠেছিল সেদিন। কিন্তু সেই উৎপীড়ন ও অন্যায় আচরণ ও নিষ্ঠুর অবহেলাই বহন করে নিয়ে এসেছিল নতুন এক উত্থানের বীজ। ধুমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটেছিল বিরল প্রতিভার কবি কাজী নজরুল ইসলামের। তাঁর কলমে ঝলসে উঠেছিল পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার, জাতির অদম্য কামনা-বাসনা। পাশাপাশি, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে উপমহাদেশের সকল মানুষের চিত্তের উদ্দীপনাময় আশা-আকাঙ্খাও।কবির কলমেও কথা বলে উঠেছিল সেই অমোঘ বাণী,
“যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত!”
তাই প্রাবন্ধিক গাজী তানজানিয়া ‘নজরুলের কবিতায় স্বাধীনতার আহ্বান’ নামক লেখায় বলেছেন, গ্রামসীয় অর্থে নজরুলকে বলা যায় উপনিবেশবাদ বিরোধিতার অর্গানিক কণ্ঠস্বর, যে কণ্ঠস্বর এখনো আমাদের যেকোনো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে গমগম করে। অর্গানিক বলেই নজরুলের কণ্ঠস্বর মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠস্বর হয়েই গর্জে ওঠে ধূমকেতু পত্রিকার পাতায় পাতায়। উপমহাদেশের স্বাধীনতা যখন ভূলুণ্ঠিত, অপমানে গ্লানিতে ঘৃণায় জাতি যখন নিমজ্জিত, তখন নজরুল গর্জে ওঠেন ‘বিদ্রোহী’ হয়ে।….অসত্য অমঙ্গল অকল্যাণের গ্রাস থেকে তিনি মুক্ত করতে চেয়েছেন স্বদেশের মাটি আর মানুষকে। যুদ্ধোত্তর বিরুদ্ধ প্রতিবেশে দাঁড়িয়েও তিনি গেয়েছেন জীবনের জয়গান, উচ্চারণ করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য বিদ্রোহের বাণী।”
ব্রিটিশরা যে এ দেশে বণিকের বেশে শাসন ও শোষণ করার জন্য এসেছে, নজরুল তা একজন দূরদ্রষ্টার মতো বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে, নজরুলও নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার মতো ব্রিটিশ বেনিয়াদেরকে দু’চক্ষে দেখতে পারেননি। তিনি নবাব পরিবারে জন্মগ্রহণ না করেও বাল্যকালে ইতিহাস থেকে ইংরেজদের চরিত্র ও তার কূটকৌশল সম্পর্কে জেনেছিলেন।আর তাতেই ইংরেজদের প্রতি তাঁর তীব্র ক্রোধের জন্ম হয়েছিল। সেই অনুভূতি থেকে তিনি পলাশীর যুদ্ধে বাঙালির আত্মদান ও পরাজয়ের বেদনার রক্তাক্ত ছবি এঁকেছিলেন তাঁর ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায়,–
“কাণ্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর।
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।’
কতটা দেশপ্রেম ও স্বাধীনতাবোধ তাঁর হদয়ে ছিল তার পরিস্কার ছবি এই উদ্ধৃতির মধ্যে উজ্জ্বল।তাই তো তিনি আশাবাদী হয়ে বলে দিয়েছিলেন পলাশীর প্রান্তরে স্বাধীনতার সূর্য নিভে গেলেও আবার তা উঠবেই । সেই জন্য হয়তো
পরধনলোভী,কূট ইংরেজদের কাছ থেকে নিজের মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে তাঁর কলম বলে উঠেছিল,–
“এ দেশ ছাড়বি কিনা বল, নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল।”
আসলে, নজরুল বুঝতে পেরেছিলেন যে,এই দেশকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত করতে প্রথমে দরকার বৃটিশ দানবদের হঠানোর। সেজন্য দরকার ঐক্যবদ্ধ শক্তি। ভারতের সবশ্রেণীর মানুষের মিলিত শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে নজরুল তাই ডাক দিয়েছিলেন এভাবে,–
‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কাণ্ডারী! আজ দেখিবে তোমার মাতৃমুক্তি-পণ!
হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?
কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!’
সর্বপ্রথম দেশের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর পূর্বে কোনো কবি-সাহিত্যিকই এমন দ্ব্যর্থহীন পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার আকাঙ্খার কথা বলেননি। এমনকি দু’একটি বিছিন্ন ঘটনা ছাড়া রাজনীতিকদের মধ্যেও এ দাবি প্রকটভাবে তোলেনি কেউ। নজরুল গবেষক ও প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদের কথায়,” নজরুল বুঝেছিলেন, মুক্তির একমাত্র পথ এই পরধনলোভী পরদেশিদের কাছ থেকে নিজ দেশের মুক্তি ছিনিয়ে নেয়া।তাই নজরুল পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন।নজরুল পূর্ব ঔপনিবেশিক সমাজের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে কেউই পূর্ণ স্বাধীনতার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেননি।” প্রায় একই কথার প্রতিধ্বনি তাত্ত্বিকদের কথায়ও– ‘যে সময়ে নজরুল ঔপনিবেশিক ভারতের ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’র আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন বা তার জন্য দাবি তুলছিলেন, সে সময়ে ভারতের কোনো রাজনৈতিক নেতা বা কোনো লেখক সে দাবির ধারে-কাছে যাননি। এমনকি মহাত্মা গান্ধীও তখন ‘মহাত্মা’ হয়ে ওঠেননি। আর যেভাবে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলেছেন নজরুল, তার বয়ানই যেন প্রতিধ্বনিত হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন উপনিবেশবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তি লড়াইয়ের ময়দানে ময়দানে।’ প্রসঙ্গত প্রায় সকলেই জানি ১৮৫৭ সালে ঘটেছিল ভারতের প্রথম জাতীয় মুক্তির সশস্ত্র লড়াই আর ১৯২২ সালে নজরুলের কণ্ঠেই প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল ‘ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা’র দাবি।
নজরুল ‘নবযুগ’-র দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন সম্পাদকীয়তে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করেছিলেন। তিনি ‘ধূমকেতু’র ১৩শ সংখ্যায় ১৩ অক্টোবর, ১৯২২ সালে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উল্লেখ করে লিখেছিলেন :“স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেননা, ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশ বিদেশীদের অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতের হাতে। তাতে কোন বিদেশীর মোড়লী অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে এ দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করেছেন, তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুটলি বেঁধে সাগর পাড়ে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তারা শুনবে না। তাঁদের সবটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদের এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকু দূর করতে হবে।”
আর তাঁর সেই ভাবনারই প্রতিধ্বনি যেন গর্জে উঠেছিল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতায়।কবি লিখেছিলেন,
“আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তির আড়ালে?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব-শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?
দেব-সেনা আজ টান্ছে ঘানি তেপান্তরের দীপান্তরে;
রণাঙ্গণে নামবে কে আর তুই না এলে কৃপাণ ধরে?
বিষ্ণু নিজে বন্দী আজি ছয় বছরী ফন্দি কারায়,
চক্র তাঁহার চরকা বুঝি ভণ্ড হাতে শক্তি হারায়।
মহেশ্বর আজ সিন্ধুতীরে যোগাসনে মগ্ন ধ্যানে,
অরবিন্দ চিত্ত তাঁহার ফুটবে কখন কে সে জানে।”
ধূমকেতুর ১২তম সংখ্যায় (২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২) প্রকাশিত হয়েছিল দুর্গা পূজা উপলক্ষে তাঁর কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। যেটি ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্তই করেছিল। এমনকি কবিকে গ্রেফতার করেছিলেন কুমিল্লা থেকে।এ কবিতায় তিনি ব্রিটিশ শাসকদের লক্ষ্য করে বললেন, তারা ‘বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি’ আর তাদের অত্যাচারে “ভূ-ভারত আজ কসাইখানা’ হয়েছে। ইংরেজ বিচারক সুইনহো নজরুলকে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অপরাধে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিলেন। কিন্তু নজরুল নিজের সমর্থনে একটি জবানবন্দি জমা দেন আদালতে, যেটি ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে বিখ্যাত এবং যেটি তিনি রচনা করেছিলেন কারাবাসের সময়, ৭ জানুয়ারি ১৯২৩ সালে। এটি যেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতার গদ্যরূপ। কবি বলেছিলেন-
‘একজন রাজা, হাতে রাজদণ্ড; আর জন সত্য, হাতে ন্যায়দণ্ড।’ আরও বলেছিলেন,
“আমি কবি, অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করবার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তি দানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন। আমার বাণী সত্যের প্রবেশিকা, ভগবানের বাণী। সে-বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে-বাণী ন্যায়-দ্রোহী নয়, সত্য-দ্রোহী নয়। সে-বাণী রাজদ্বারে দণ্ডিত হতে পারে, কিন্তু ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তাহা নিরপরাধ, নিস্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ সত্য-স্বরূপ।”
এখানে তিনি বৃটিশের বিরুদ্ধে নিদ্রিত ভারতবাসীকে জাগাতে আরও জোরালো ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর আহ্বান ছিল,এই ভিনদেশী ইংরেজদের হাত থেকে ভারতের মুক্তির জন্য চাই সমগ্র ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ হওয়া।কারণ, এদেশ কারও একার নয়,এটা তেত্রিশ কোটি ভারতীয়দের দেশ।তাই, যেকোনো মূল্যে এই দেশকে বৃটিশ মুক্ত করতে হবে। এটা আমাদের সকলের কর্তব্য। খুব স্বাভাবিকভাবেই কবির এই বক্তব্য বৃটিশ সরকারের চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছিল।ফলে,কবির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য। কবি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।বিচারে কবির একবছর কারাদণ্ড হয়েছিল। প্রাবন্ধিক এমদাদুল হক চৌধুরীর কথায়,”কবিতা লিখে জেলে যাবার ঘটনা বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম বিরল ঘটনা।যা নজরুলের জীবনে ঘটেছিল।”
এদিকে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন পঞ্চম জর্জের ভারতে আগমন উপলক্ষে ‘ ভারত ভাগ্য বিধাতা’ লিখে স্তুতি করেছিলেন কিংবা মধুসূদন দত্ত নিজের ধর্ম ত্যাগ করে ‘ মাইকেল’ উপাধি পেতে খৃষ্টান হয়েছিলেন, অন্যদিকে তখন কাজী নজরুল ইসলাম জেলে বসেও বৃটিশ অত্যাচারের প্রতিবাদে সোচ্চার থেকেছেন।জেলের জুলুম, অব্যবস্থাপনা,অনিয়মের বিরুদ্ধে তাঁর কলম গর্জে উঠেছিল,–
“শিকল পরার ছল মোদের এ শিকল পরার ছল
এ শিকল পড়ে তোদের করবো রে বিকল’,
তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন জয় দেখিয়ে নয়,
সেই ভয়ের টুঁটি ধরব টিপে করব তারে লয়।
মোরা আপনি মরে মরার দেশে আনব বরাভয়,
মোরা ফাঁসি পরে আনব হাসি, মৃত্যুজয়ের কল।”
বাস্তবিকই, ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা কবি বুঝতে পেরেছিলেন, অশুভ দানব ইংরেজ নামক শক্তির হাত থেকে দেশমাতাকে মুক্ত করতে হলে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে। সকল নিয়ম-কানুন, বাঁধন শৃঙ্খল ও নিষেধের বিরুদ্ধে। আর এই বিদ্রোহ করতে হলে সকলের আগে আপনাকে চিনতে হবে।যা ব্যক্তি-মানুষের সর্বোচ্চ ব্যক্তি-স্বাধীনতার কথা বলবে।তাই সোচ্চারে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ঘোষণা করে বলে উঠেছিলেন,
‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ
আমি দুর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার।’
কিংবা,
‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন।’
আসলে,নজরুলের কবিতায় সেদিন ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল এমন এক বিদ্রোহের সুর, যার সমজাতীয় উচ্চারণ এর আগে কখনও শোনা যায়নি।ফলে,এই কবিতাটি কবির কন্ঠে শুনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন।আর বুদ্ধদেব বসু বলে উঠেছিলেন,” বিদ্রোহী পড়লাম ছাপার অক্ষরে মাসিকপত্রে –মনে হলো–এমন কখনো পড়িনি।অসহযোগের অগ্নিদীক্ষার পরে সমস্ত মনপ্রাণ যা কামনা করেছিলো,এ যেন তা-ই; দেশব্যাপী উদ্দীপনার এ-ই যেন বাণী।”(কালের পুতুল,১৯৪৪)।
সুতরাং বলা যায়,নজরুল তাঁর জ্বালাময়ী কবিতা সহ অন্যান্য সৃষ্টি দিয়ে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জনগণ না জাগলে অবৈধ দখলদার পশুশক্তিকে বিতাড়িত করে স্বাধীনতা আনা সম্ভব নয়। স্বাধীনতার পূর্বশর্ত গণজোয়ার। এ প্রসঙ্গে কাজী আবদুল ওদুদের মন্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, “বাংলা সাহিত্যিকদের মধ্যে একমাত্র তিনি (নজরুল) গণচিত্ত বিশেষভাবে স্পর্শ করতে সমর্থ হয়েছেন। এ-কালে দেশের যে গণশক্তির উত্থান তার মূলে নজরুল প্রতিভা বিশেষভাবে কার্যকরী হয়েছে। এই দিক দিয়ে তাঁর ঐতিহাসিক মর্যাদা অসাধারণ। (সওগাত/আধুনিক বাংলা সাহিত্য)। প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদ-র কথায়, “নজরুল জানতেন এই ভারতবর্ষে সব আছে,কেবল নেই শক্তি ও সাহস। সুতরাং এখানকার মানুষের মনে সাহসের আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারলেই সব সম্ভব।” সেজন্য একটার পর একটা কবিতায় তিনি সাহসের আগুন জ্বালিয়ে গিয়েছিলেন। আর ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত ভারতের স্বপ্ন দেখে লিখেছিলেন ‘ অগ্নিবীণা'(প্রলয়োল্লাস, বিদ্রোহী, ধূমকেতু, কামাল পাশা, আনোয়ার,কোরবানী ইত্যাদি),’বিষের বাঁশী'( বন্দীর বন্দনা,শিকল-পরার গান,বোধন ইত্যাদি),’ভাঙার গান’,’প্রলয়শিখা’, ‘ফণিমনসা’ প্রভৃতি আগুন ঝরানো কাব্যগ্রন্থগুলি। আর, বৃটিশ সরকারের কোপে পড়েছিলেন। ফলস্বরূপ,একটার পর একটা কাব্যগ্রন্থ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়,সারা বিশ্বে এ এক বিরল ঘটনা।এমন আর কোন কবি বিশ্বে দ্বিতীয় কেউ আছেন কিনা জানা নেই, যাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে,আর সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
নজরুল মানে শুধু বৃটিশ তথা ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত দেশ নয়।সেই সঙ্গে একটি অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ দেশ। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি যিনি ব্রিটিশ অধীনতা থেকে ভারতকে মুক্ত করার জন্য স্বরাজের পরিবর্তে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। সকল জাতি, ধর্ম ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সাহসের প্রতীক। সেজন্য তাঁর ‘ আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় স্বরাজকে নিয়ে হেঁয়ালি করতেও ছাড়েননি। কবির কথায়,–
“রবে না কো’ ম্যালেরিয়া মহামারী,/স্বরাজ আসিছে চড়ে জুরি-গাড়ি, চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে!/ মাতা কয়, ওরে চুপ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্ চেয়ে!/ ক্ষুধাতুর শিশু চায়-না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন!/ বেলা বয়ে যায়, খায়নি কো বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন!/ কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়, স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!… আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বর্তাকু এনেছি খাস!/ কত শতকোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাম এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ! /টাকা দিতে নারি ভুখারি সমাজ। / মার বুক হতে ছেলে কেড়ে খায়,/ মোরা বলি বাঘ খাও হে ঘাস!/ হেরিনু জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ। ”
এই স্বরাজের অর্থ কিন্তু দেশের স্বাধীনতা নয়। ফলে, পূর্ণ স্বাধীনতার স্বপ্নে আশাবাদী কবির লড়াইটা ছিল বেশ কঠিন।কারণ,ওই ক্ষুদ্র মানবজীবনে যে পরিমাণ বৈরী পারিপার্শ্বিক সামাজিক প্রেক্ষিতে এক সাংঘর্ষিক পরিবেশে তাঁকে জীবন কাটাতে হয়েছে তা আজ ভাবলে অবাক হতে হয়।স্বাধীনতার এক অদম্য ইচ্ছে বিদেশি শাসকের পীড়নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও অদম্য এই কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল বিদ্রোহের নতুন বাণী। ১৯২১ সালে যখনপ্রিন্স অব ওয়েলস (Prince of Wales) ভারতে এসেছিলেন তখন বিক্ষুদ্ধ ভারতীয়রা পালন করেছিলেন ধর্মঘট আর নজরুল লিখেছিলেন—
“লক্ষ্য যাদের উৎপীড়ন আর অত্যাচার
নর নায়ারণে হানে পদাঘাত
হেনেছে সত্য প্রত্যাশার
অত্যাচার ! অত্যাচার !”
‘ধূমকেতু’ প্রকাশের প্রেক্ষাপট ছিল পুরোটাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা। সঙ্গে ছিল রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ ও মৌলবাদী ইসলামী চিন্তা-চেতনার ওপর আক্রমণ। এমনকি গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনকেও ‘ধূমকেতু’র সম্পাদকীয়ের মাধ্যমে নজরুল আক্রমণ করেছিলেন । এই পত্রিকাটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে নজরুলের বিদ্রোহকে সর্বাত্মক প্রকাশে বড় ভুমিকা পালন করেছিল। এর পঞ্চম সংখ্যায় ‘আমরা লক্ষ্মীছাড়ার দল’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে তিনি বাংলার বিপ্লবী শহীদ যুবাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন।এই আবহে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে,নজরুলের লড়াই শুধু বৃটিশ শাসন থেকে মুক্তির জন্য ছিল না। পাশাপাশি, তাঁর প্রতিবাদ ছিল সাম্প্রদায়িকতা, যাবতীয় রক্ষণশীলতা, সাংস্কৃতিক খবরদারি প্রভৃতির বিরুদ্ধেও। যা তাঁর জগদ্বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’র (১৯২১)১৩৯ পঙ্ক্তির জুড়ে উচ্চারিত হয়েছিল।কবিতাটিতে তিনি ইংরেজ শাসন, হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক ও সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতাসহ সব রকম কূপমণ্ডূতাকে আক্রমণ করেছিলেন। কারণ,নজরুল ছিলেন মানুষের কবি, মানবতার কবি।ফলে, তাঁর লড়াইটা ছিল প্রায় একক। বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ও প্রাবন্ধিক মজিদ মাহমুদ মনে করেছেন, “বাংলা তথা বিশ্ব-সাহিত্যে নজরুল-ই ছিলেন অন্যতম কবি যাকে এসব সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতাহীন কবি-সাহিত্যিকের হয়তো কমতি নেই বিশ্ব সাহিত্যে, কিন্তু ভারতের এই সংকীর্ণ বিষয়কে নিয়ে লড়তে হয়েছে নজরুল ভিন্ন কম কবিকেই। নজরুলকে কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমায়িত করা যায় না।নজরুল হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ খ্রিস্টান সব ধর্মের,সব সমাজের হয়ে তিনি কাজ করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে মানুষের অবস্থান সবার উপরে।ধর্ম শাস্ত্র, মসজিদ-মন্দিরের চেয়ে পবিত্র মানুষ।” কবি কাজী নজরুল ইসলামের সামগ্রিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রটা মাথায় রেখে সে জন্য হয়তো ‘দ্য ডিসেন্ট অব নজরুল ইসলাম :পোয়েট্রি অ্যান্ড হিস্ট্রি'( The decent of Nazrul Islam:Poetry and History) গ্রন্থে প্রীতি কুমার মিত্র কবির সংগ্রামী কবিসত্তা মূল্যায়ন করতে গিয়ে নিচের পাঁচটি গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইকে চিহ্নিত করেছিলেন এভাবে:–ক)ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান;খ) গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদানে অনীহা; গ) মৌলবাদী ইসলামের বিরুদ্ধে, ঘ) হিন্দুদের সামাজিক রক্ষণশীলতা ও সাংস্কৃতিক খবরদারির বিরুদ্ধে এবং ঙ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে সাংস্কৃতিক আতিশয্যের বিরুদ্ধে ছিল কবি নজরুলের প্রতিবাদ।
কবির এই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অন্যতম নিদর্শন ‘ মানুষ’ কবিতা ও ‘ হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধটি। যেখানে তিনি বলেছেন,
‘গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্। নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।-‘
আবার,ধর্মের নামে মানুষকে ইতরায়ন করার বিরুদ্ধে বলছেন,–
“মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’।”
অন্যদিকে ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে মানবতার জয়গানে মুখরিত কবি অসাধারণ এক কথনে বলেছেন, “নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি, একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ-প্রশ্ন করবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান। একজন মানুষ ডুবছে, এইটেই হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। হিন্দু যদি উদ্ধার করে দেখে লোকটা মুসলমান, বা মুসলমান যদি দেখে লোকটা হিন্দু- তার জন্য তো তার আত্মপ্রসাদ এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয় না। তার মন বলে, ‘আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি- আমারই মতো একজন মানুষকে।”
এই প্রেক্ষাপটে কবি কাজী নজরুলের কবিতায় সার্বিক স্বাধীনতার বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। যার প্রতিরূপ ইতোমধ্যে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার উদ্ধৃতি এই লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে।এখন কবির ওই ভাবনার অনুসঙ্গরূপে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আরও দু’ একটি উদ্ধৃতি উদাহরণ হিসেবে রাখতে পারি।–
‘বল বীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহার আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রীর।’
কবির বিদ্রোহী এই সত্তা কবিকে পৌঁছে দিয়েছিল এমন এক উচ্চতায়, যেখানে তিনি নিজেকে ছাড়া কাউকে কুর্নিশ করেন না। কারণ এই বিদ্রোহ তো জাতির কল্যাণের ও দুঃখ মোচনের জন্য। এই জন্যই কবির এক হাতে বাঁশের বাঁশরী অন্য হাতে রণতুর্য। সমাজের স্তরে সব পাপ ও জঞ্জাল ধ্বংস করে প্রচণ্ড আঘাতে মানুষের বেদনার অবসান ঘটাতে তিনি আবির্ভূত।তাই তিনি বলেছিলেন,–
“আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার।
আমি হল বলরাম স্কন্দে
আমি উপাড়ি ফেলিব বিশ্ব অবহেলে
নব সৃষ্টির মহানন্দে।”
কবি উৎপীড়ক শাসকদের ধ্বংস করে নতুন সৃষ্টির তোরণদ্বারে জগৎকে উপনীত করে আপন কাজ সমাধা করবেন।ফলে, রণক্লান্ত কবির বিরাম নেই।
প্রায় একই ভাবনার প্রতিধ্বনি তাঁর ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় স্পষ্ট। কবির কথায়,
‘প্রার্থনা যারা কেড়ে খায় তেত্রিশকোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ৷’
ওই সময় স্বাধীনতা স্বপ্নে বিভোর কবির লেখায় বিদ্রোহ এমনভাবে ধ্বনিত হয়েছিল যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে সঙ্গে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস সহ একাধিক দেশনেতাদের আলোড়িত করেছিল।তাই,কবির ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতাকে জাতীয় সংগীত রূপে ঘোষণা করেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র। তাঁর কথায়, “আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সর্বদাই ঘুরে বেড়াই। প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সংগীত শুনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’র মতো প্রাণ-মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না।” (আবদুল মান্নান সৈয়দ (সম্পা.), কাজী নজরুল ইসলাম জন্মশতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ, ঢাকা : ২০০১)।আবার,১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার তৎকালীন এ্যালবার্ট হলে নজরুল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছিলেন: “আমরা যখন যুদ্ধে যাবো– তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাবো, তখনও তাঁর গান গাইবো।” অন্যদিকে বাঙলার আরেক বিশিষ্ট নেতা বিপিনচন্দ্র পাল, যিনি নজরুলের কবিতায় মাটির গন্ধ খুঁজে পেয়েছিলেন; বলেছিলেন, “এ খাঁটি মাটি হইতে উঠিয়াছে”। নজরুলকে বিপিন পাল ‘নতুন যুগের কবি’ এবং তাঁর কবিতায় ‘দেশে যে নতুন ভাব জন্মেছে তার সুর’ পাওয়ার কথা বলেছিলেন। (আবদুল মান্নান সৈয়দ (সম্পা.), কাজী নজরুল ইসলাম জন্মশতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ, ঢাকা : ২০০১)। কবি জীবনানন্দ দাশের মন্তব্যও ছিল প্রায় একই,–‘আধুনিক বাংলাদেশে তিনি (নজরুল) বাংলার মাটিরই বিশেষ স্বায়ত্ত সন্তান।’ এদিকে, প্রাবন্ধিক নিতাই চন্দ্র রায়ের লেখা ‘স্বাধীনতা ও সাম্যের কবি নজরুল’ প্রবন্ধে যেন সেই ভাবনার প্রতিরূপ, –“বাঙালির প্রাণের কথা, আত্মার অগ্নুৎপাতের কথা, নিভৃত হৃদয়ের কথা নজরুলের আগে আর কোনো বাঙালি কবি এত সহজ সাবলীল ভাষায় প্রকাশ করতে পারেননি। তাই নজরুল আমাদের প্রাণের কবি, ভালোবাসার কবি। সব বৈষম্য বিনাশের কবি। নজরুলের মধ্যেই খুঁজে পায় বাঙালি তার জীবন সংগ্রাম, প্রেম ও ভালোবাসার প্রতীতি। খুঁজে পায় তার স্বপ্নের সংগীত। বেঁচে থাকার আশা ও সংগ্রামের সঞ্জীবনী সুধা।”
সুতরাং, সবদিক থেকে মূল্যায়নে যে বিষয়টি বড়ো হয়ে ওঠে তা হল, নজরুল ছিলেন মানুষের সার্বিক স্বাধীনতার পক্ষে এক সংগ্রামী চেতনার বিদ্রোহী কবি। যিনি শুধু ছদ্মবেশী বনিক ইংরেজ শাসনমুক্ত তথা ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত দেশের স্বপ্ন দেখেননি। তিনি, স্বপ্ন দেখেছিলেন বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় স্পন্দিত স্বায়ত্তশাসন মুক্ত একটি স্বদেশ।আজ, দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর ছাড়িয়ে কবি কাজী নজরুলের মূল্যায়নে এসে দেশের বিভিন্ন বিষয়ে গভীরভাবে লক্ষ্য করলে হতাশ হতে হয়। কোথায় কবির সেই স্বপ্নের দেশ!এত প্রাণ বলিদানের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীনতা পাওয়া গেল সেখানে আজ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ক্রমে ঢেউ তুলেছে।বৈষম্যের ব্যারিকেড ক্রমশঃ চওড়া হচ্ছে। ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত দেশে এ কোন শাসন! সবদিক থেকে দেখলে লজ্জায় নত হওয়া ছাড়া আমাদের সত্যি কী কোন উপায় আছে! অথচ, সকলেই বুঝি হাল ছাড়লে হবে না। কারণ, দেশবাসীর সঠিক চেতনা-ই পারে এই অন্ধকার দূর করতে। আমরাও আশাবাদী। পারবই….।আর এক্ষেত্রে আমাদের কাছে আজও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় কাজী নজরুল ইসলাম ও তাঁর মননজাত দর্শন।তাই হয়তো, প্রাবন্ধিক মো. মোস্তফা কামাল তাঁর ‘বিদ্রোহী কবি’ প্রবন্ধে বলেছেন, “কবি নজরুল আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তিনি আমাদের কাছে রেখে গেছেন তাঁর বিদ্রোহী চেতনা, দেশপ্রেম, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্যের জয়গান, উদারনৈতিক রাজনৈতিক মতাদর্শ। যার মাধ্যমে আমরা প্রগতিশীল শান্তির উত্থান, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিনাশ, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন রোধ, উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দর্শন প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। যেখানে নজরুলের সেই ক্ষুধিত মানুষের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হবে না।”
#
তথ্যসূত্র
১)বুদ্ধদেব বসু, প্রবন্ধ-সংকলন, কলকাতা।
২) নজরুল রচনাবলী; জন্মশতবর্ষ সংস্করণ, প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমি।
৩) ইংরেজ শাসনে বাজেয়াপ্ত বই; সম্পাদনা: বিষ্ণু বসু, অশোক কুমার মিত্র।
৪)নিষিদ্ধ নজরুল; শিশির কর
৫)নজরুল তৃতীয় বিশ্বের মুখপাত্র:-মজিদ মাহমুদ
৬)আবদুল মান্নান সৈয়দ (সম্পা.), কাজী নজরুল ইসলাম জন্মশতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ, ঢাকা : ২০০১
বুদ্ধদেব বসু, প্রবন্ধ-সংকলন, কলকাতা : ১৯৬৬
লেখক: গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।
৬) বিভিন্ন অনলাইন পত্র-পত্রিকা।
কোলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।