কাজী জহিরুল ইসলাম
বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে প্রচুর শব্দের ভুল অর্থ আছে, অপ্রয়োজনীয় শব্দ আছে এবং ভুল বা অপব্যাখ্যা আছে। আজ ৪টি শব্দ নিয়ে আলোচনা করবো। এই রচনাটি যারা পড়বেন তাদের প্রতি একটি বিশেষ অনুরোধ, কোনো ধরণের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোন থেকে লেখাটিকে বিবেচনা করবেন না। একজন মুক্তমনা বাঙালি হয়ে লেখাটি পড়বেন এবং আপনার মতামত তুলে ধরবেন।
দুদিন আগে আমাকে হঠাৎ টেলিফোন করেন যুক্তরাষ্ট্র নজরুল একাডেমির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম। ফোন করে বলেন, এই একুশে আমার মধ্যে একটা উপলব্ধি তৈরি হয়েছে। বিদেশ বিভুঁইয়ে থেকে বাংলা ভাষার প্রকৃত চর্চা হচ্ছে না, অনেক শব্দ ভুলে যাচ্ছি, আপনাদের সঙ্গে চলাফেরা করি, কবিতার সঙ্গে থাকি, ঠিক করেছি এখন থেকে বাংলা ভাষাটা আরো ভালো করে শিখবো। গতকাল জ্যাকসন হাইটসে গিয়ে একটি ঢাউস সাইজের অভিধান কিনে এনেছি। কোনো কিছু খোঁজার জন্য না, এমনিই পৃষ্ঠা উল্টালাম, দেখি, সেখানে একটি শব্দ লেখা, নেড়ে। এর অর্থ লেখা আছে, অশ্রদ্ধাজনিত আক্রমণাত্বক উক্তিতে নিচু শ্রেণির মুসলমান।
এরপর একটু থামেন নজরুল ইসলাম। তার উদ্দেশ্য আমার কাছ থেকে কিছু শোনা। আমিও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি। আমি কিছু বলছি না দেখে তিনিই মুখ খোলেন। জহির ভাই, আপনি তো লেখক মানুষ, বাংলা ভাষা সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান, আপনিই বলুন, নিচু শ্রেণির মুসলমান বলে কি কিছু আছে? আমি বলি, প্রথমত, নেড়ে শব্দটি সম্পর্কে আমার ভালো ধারণা নেই। এর প্রকৃত অর্থ কি, কখন কীভাবে এই শব্দের উৎপত্তি হয়, এসব জেনে আমাকে মন্তব্য করতে হবে। তবে একথা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, বিত্তের বিচারে, দম্ভের তাড়নায়, ধনীরা দরিদ্রদের, খেটে খাওয়া মানুষদের, ছোটোলোক ইত্যাদি বলে গালি দিলেও মুসলমানদের মধ্যে স্বীকৃত উঁচু নীচু জাত নেই। সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম হিন্দু, যাদের মধ্যে কাস্ট বা বড়ো-ছোটো স্বীকৃত জাত প্রথা আছে, অন্য কোনো ধর্মে নেই। কাজেই অভিধানে ‘নিচু শ্রেণির মুসলমান’ কথাটা বাহুল্য এবং অপব্যাখ্যাও।
আমাদের আলোচনা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত, আমি দেখলাম, নজরুল ইসলাম এই বিষয়ে অভিধানের স্ক্রিনশটসহ একটি পোস্ট দিয়েছেন। তখন বিষটি ভালো করে জানার জন্য আমার আগ্রহ তৈরি হলো। ফোন করি বর্ষিয়ান সাংবাদিক ও লেখক মনজুর আহমদকে। মনজুর ভাই জানান, দেশভাগের আগে-পরে হিন্দুরা মুসলমানদের অবজ্ঞা করে “নেড়ে” বলত, মূলত এটি একটি গালি। শুধু নেড়ে না, অবজ্ঞা অর্থে তারা মুসলমানদের যবন বলেও গালি দিত। তখন মনে পড়তে লাগলো বিভিন্ন লেখকের লেখায় এই শব্দগুলোর ব্যবহার। আমার কাছে “নেড়ে” গালি হলেও “যবন” শব্দটিকে মোটেও গালি মনে হচ্ছিল না। কারণ শওকত আলীর “প্রদোষে প্রাকৃতজন” উপন্যাসে এবং কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় যবন শব্দটি মুসলমান বোঝাতে সরলার্থে ব্যবহার করা হয়েছে, গালি বা অবজ্ঞা অর্থে আসেনি। মনজুর ভাই বর্ষিয়ান মানুষ, দেশভাগের আগে তার জন্ম, তিনি নিজের চোখে দেখেছেন বহু রায়ট, উপমহাদেশের বহু চড়াই-উৎরাই, কাজেই তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে ফেলে দেয়াও যায় না।
আমি বলি, খ্রিস্টানদের, বিশেষ করে গোরা খ্রিস্টানদের “ম্লেচ্ছ” বলে কারা গালি দিত? উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান সকলেই, নাকি শুধু হিন্দুরা? মনজুর ভাই জানান, শুধু হিন্দুরাই খ্রিস্টানদের ম্লেচ্ছ বলে গালি দিত। তিনি সঙ্গে সঙ্গে এও বলেন, মুসলমানেরাও হিন্দুদের সম্পর্কে অবজ্ঞা অর্থে একটি শব্দ বলত, শব্দটা ঠিক এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। আমি বলি, আমি যতদূর জানি মুসলমানেরা হিন্দুদের অবজ্ঞা অর্থে “মালাউন” বলে গালি দিত, এ ছাড়া আপনি আর কিছু জানেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ ঠিক, এটাই, মালাউনই বলত।
ভারতবর্ষে বিভিন্ন ধর্মের মানুষেরা বহু বছর ধরে এই রকম হিংসা ও অসহিষ্ণু পরিবেশে বসবাস করে আসছে। দেশভাগের আগে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ছোটো বড়ো ২৭টি রায়ট হয়। এগুলোর মধ্যে ১৯৪৬ সালে কলকাতা এবং নোয়াখালীতে বড়ো দুটি রায়ট হয়, এতে ৯ হাজার মানুষ প্রাণ হারায় এবং দেড় লক্ষ মানুষ গৃহহারা হয়। দেশভাগের পরে হিন্দু-মুসলমান এবং হিন্দু-শিখ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে হয় ৮৮টি রায়ট। ১৯৯৩ সালে মুম্বাই রায়টে বাবরী মসজিদ ইস্যুতে প্রাণ হারায় সাড়ে ৪ হাজার মানুষ। ২০০২ সালে গুজরাট রায়টে প্রাণ হারায় ২ হাজার মানুষ, ১৯৮৪ সালে হিন্দু এবং শিখ রায়টে প্রাণ হারায় ১৭ হাজার মানুষ, ১৯৬৪ সালের কলকাতা রায়টে ৭০ হাজারেরও অধিক মুসলমান তাদের বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যেহেতু ভারত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ কাজেই প্রতিটি রায়টেই অন্য ধর্মের মানুষেরাই অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। এইরকম হিংসাত্মক পরিবেশে বসবাসকারী মানুষেরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের গালি দিবে এটিই স্বাভাবিক।
কিন্তু এখন সময় এসেছে এইসব অবজ্ঞাসূচক আক্রমণাত্মক শব্দ ভুলে যাবার। আমাদের একটি পরমত ও পরধর্ম সহিষ্ণু পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ভারতবর্ষের একটি বড়ো এথনিক গ্রুপ বাঙালি, তারা বিভিন্ন ধর্মে বিভক্ত। ধর্মচর্চার দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান, এর পরেই আছে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ, অল্প কিছু খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীও রয়েছে। প্রত্যেকেই তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকে কিছু আচার যুক্ত করে তৈরি করেছে একটি মিশ্র বাঙালি সংস্কৃতি। এই বাস্তবতাকে আমাদের মেনে নিতে হবে। বুদ্ধ পূর্ণিমা, শবে বরাত, ঈদ, রমজান, দূর্গা পুজা, চৈত্র সংক্রান্তি সবই আমাদের সংস্কৃতি। কোনোটাই বিজাতীয় নয়।
ফিরে আসি বাংলা একাডেমির অভিধানে। দেখা যাক, নেড়ে, ম্লেচ্ছ, যবন এবং মালাউন, এই শব্দগুলো কীভাবে অভিধানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। নেড়ে সম্পর্কে তো আগেই বলেছি, নিচু শ্রেণির মুসলমান, ম্লেচ্ছ শব্দের অর্থ হিসেবে লেখা আছে “তুচ্ছার্থে অনার্য জাতি। অহিন্দু”। এই অর্থটি আসলে ভুল। আমরা দীনবন্ধু মিত্রের “নীলকর” গল্পে পড়েছি, ইংরেজ সাহেব আক্ষেপ করে বলছেন, “ম্লেচ্ছ বলিয়া তোমরা তো আমাদের ভাত খাও না”। ইংরেজরা তো অনার্য নয়, তারা আর্য। এবং শুধু অহিন্দু হলেই ম্লেচ্ছ বলা হতো না,ম্লেচ্ছ বলা হত খ্রিস্টানদের। অভিধানের এই ব্যাখ্যার একটি ইতিবাচক দিক আছে৷ সেটি হচ্ছে, হিন্দুরা যে অবজ্ঞা অর্থে এই গালিটি খ্রিস্টানদের দিত তার কোনো উল্লেখ নেই। আমরা আসলে এই হিংসাত্মক বিষয়টি, মানে কে কাকে গালি দিত তা ভুলেই যেতে চাই।
যবন শব্দের অর্থ লেখা আছে, “প্রাচীন গ্রিক জাতি। ম্লেচ্ছ। বিধর্মী। অহিন্দু। বিদেশি। মুসলিম।” প্রকৃতপক্ষে যবন বলতে শুধু মুসলমানদেরই বোঝানো হত। প্রাচীন গ্রিক জাতি, বিদেশি, অহিন্দু, বিধর্মী ইত্যাদি অর্থ শব্দটিকে বিভ্রান্তই করে। এখানে একটি শব্দ খুব আপত্তিকর, তা হচ্ছে বিধর্মী। বিধর্মী মানে হচ্ছে যিনি আমার ধর্মের মানুষ নন। এই অভিধান যবন বা মুসলমানকে বিধর্মী বলছে, তাহলে এই অভিধান কোন ধর্মের? হিন্দুর? অভিধান তো বাঙালির, কোনো ধর্মের নয়, এটি তো হিন্দু শব্দকোষ নয়, ব্যবহারিক বাংলা অভিধান। শব্দের ব্যাখ্যা-ধরণ দেখে মনে হওয়ার অবকাশ তৈরি হয় যে অভিধানটি সর্ব-বাঙালির নয়, শুধুমাত্র হিন্দু-বাঙালির, যা খুবই দুঃখজনক।
আসুন এবার দেখা যাক “মালাউন” শব্দের কী ব্যাখ্যা দিয়েছে ব্যাবহারিক বাংলা অভিধান। “১। লানতপ্রাপ্ত, অভিশপ্ত, বিতাড়িত, কাফের, ২। শয়তান ৩। মুসলমান কর্তৃক ভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের লোককে দেয় গালিবিশেষ।”
তিনটি অর্থ দেয়া আছে। প্রথম ও দ্বিতীয়টি নিয়ে আমার কোনো কথা নেই কিন্তু তৃতীয় অর্থ, যেটি আসলে শব্দটির ব্যাখ্যা, তা নিয়ে কিছু কথা আছে। যবন, ম্লেচ্ছ কিংবা নেড়ে শব্দের বেলায় কোথাও উল্লেখ নেই যে হিন্দু কর্তৃক দেয় গালিবিশেষ শুধুমাত্র মালাউনের ক্ষেত্রে “মুসলমান কর্তৃক দেয় গালিবিশেষ” কথাটি কেন লেখা হলো? এটি কি শুধুই ভুল নাকি উদ্দেশ্যমূলক ভুল বা সুদুরপ্রসারি কোনো পরিকল্পনার অংশ? আর এ কারণেই কি এই অভিধান যবন বা মুসলমানকে বলছে “বিধর্মী”?
বাংলা একাডেমির এই ঢাউস সাইজের ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে দেয় ৪টি শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করলে খুব সহজেই নগ্ন সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তোলা যায় কিন্তু আসুন আমরা সেই অভিযোগ না তুলে বেনিফিট অব ডাউট দিই এবং ধরে নিই এগুলো শুধুই ভুল। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা করি যত দ্রুত সম্ভব তারা যেন এই ভুলগুলো সংশোধন করে অভিধানের নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেন।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৮ মার্চ ২০২৪