টোকন ঠাকুর
হতে পারে ১৯৯২ সালের দিকে, গত শতাব্দিতে আমি খুলনায় ছিলাম। রাজশাহী থেকে কথা সাহিত্যিক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক ছোটগল্প ও গদ্যকাগজ ‘প্রাকৃত’ প্রথম সংখ্যা বের করলেন। আগ্রহী বন্ধুদের কাছে বেচার জন্য হাসান স্যার ১০ কপি ‘প্রাকৃত’ ডাকযোগে পাঠালেন আমার তখনকার ঝিনাইদহের ঠিকানায়। ‘প্রাকৃত’তে হয়তো দুজন লেখককে পেলাম, তারা আমার কাছে নতুন। একজন তরুণী, আনন্দময়ী মজুমদার। পাবলো নেরুদার স্মৃতিকথা অনুবাদ করেছেন খণ্ডাংশ, সেই অনুবাদ ভালো লাগল। আরেকজন একটি গল্প লিখেছেন, তিনি শহীদুল জহির। গল্পের নাম ‘ডুমুর খেকো মানুষ’। গল্পটি পড়েই, তখন, সেই টকটকে বয়সেই টের পাই, আগে পড়িনি তিনি এমন ভঙ্গির লেখক। অসাধারণ।
ঢাকাবাসী জীবন শুরু হলো নব্বুইয়ের দশকের প্রথমভাগেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র নামধারী হয়ে। খুব বই পড়ার অভ্যাস আমার অনেক দিনের। শহীদুল জহিরের উপন্যাস ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ এবং গল্পগ্রন্থ ‘ডুমুর খেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ পড়া শেষ। আরো নিবিড় করে তাঁর গল্পের চরিত্রদের সঙ্গে আমি পুরোনো ঢাকার দক্ষিণ মৈশুন্ডি, পদ্মনিধি লেন, কলতাবাজার, ভূতের গলি, নারিন্দা কিংবা সুহাসিনী, সুরধ্বনি, নলকার গ্রাম এলাকার কুয়াশায়, সবুজে ঢুকে পড়লাম। আগেই তো আমি তুমুল জড়িয়ে গেছি বাংলা কবিতায়, ছোটগল্পে, উপন্যাসে, নানান রচনায়। এবং পুরো নব্বুয়ের দশকে ঢাকার প্রায় বড় বড় সব কবি-সাহিত্যিককেই ঘরে, বাইরে, হাড়িতে, নাড়িতে, পথে, বেপথে, আনন্দ বেদনায়, ঘৃণায়, ভালোবাসায় কাছে থেকে দেখি, ভেতর থেকে কবিকে কিংবা লেখককে দেখার সুযোগ পেতে থাকি। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ থেকে মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, শওকত ওসমান পর্যন্ত — প্রায় সবার সঙ্গেই সাহিত্য নিয়ে চাষবাস করি। আহমদ ছফা ও হুমায়ুন আজাদকে তো প্রায় প্রতিটা দিনই কাছে গিয়ে পেয়েছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা। স্বাধীনতা উদ্যান (সোহরাওয়ার্দি পার্ক), মোল্লার দোকান চারুকলা, কিংবা নব্য প্রতিষ্ঠিত শাহবাগের আজিজ মার্কেটের ছফা ভাই ও হুমায়ুন আজাদ স্যার বা ফরহাদ ভাই (মজহার) কে পেয়েছি। সঙ্গ নিয়েছি। দিয়েছিও, দিনের পর দিন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রিয় হয়ে ওঠা কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরকে কেন বাস্তবে দেখা পাই না — এই প্রশ্ন নিজের মধ্যেই জাগে মাঝেমধ্যে। কিন্তু, ‘কোথায় পাবো তারে?’
একদিন জানলাম, তিনি সচিব বা উপসচিব। ব্রাত্য রাইসু বাংলা দৈনিক প্রথম আলো’র প্রথম দিকের সাময়িকী সম্পাদক। একদিন রাইসুই ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ পড়তে দিল। শহীদুল জহিরকে কাছে থেকে দেখার পিপাসা আরো বাড়ল। একদিন এক মন্ত্রণালয়ের দিকে ইচ্ছা তাক করে আমি উপসচিব শহীদুল হককে ফোন করি। ফোন নম্বরটি আমাকে দিয়েছিলেন আরেক আমলা, আমার প্রিয়জনদের একজন গোলাম শফিক। নাট্যকার। সেটা হয়তো ১৯৯৯ সাল। যাই হোক, আমি সেই প্রায়সচিবকে ফোনে বললাম, ‘হ্যালো?’
‘হ্যালো।’ অপরপ্রান্তের উত্তর।
‘এখানে কি শহীদুল জহিরকে পাওয়া যাবে?’
‘না।’
‘কেন, এই নম্বরেই নাকি তাকে পাওয়া যায়?’
‘না। শহীদুল জহির বলে এখানে কেউ নেই।’
‘আপনি কে?’
‘আমি শহীদুল হক। আর কিছু বলবেন?’
‘না। আমি শহীদুল জহিরকে খুঁজছি। তাঁকে প্রয়োজন।’
‘ঐ নামে তো এখানে কেউ নেই।’
‘আচ্ছা। ঠিক আছে।’
ফোনালাপে কোনো মীমাংসা হয় না। তারপর আবার দিন যায়। শহীদুল জহিরের সঙ্গে আমার আর দেখা হয় না, প্রার্থিত একটা আড্ডাও হয় না।
এরপর, হতে পারে ২০০০ বা ২০০১ সাল। এক ঈদের দিন রাত ১০টার পরই নিঃসঙ্গতার খপ্পরে পড়ে গিয়ে আমার ছোটবেলার বন্ধু হুমায়ুনকে নিয়ে আমি যাই বেইলি রোডের এক সরকারি আবাসনে। নাট্যকার গোলাম শফিকের বাসায়। তার কাছেই বলি, ‘আচ্ছা, শহীদুল জহির এখানে কোন ভবনে থাকেন?’ শফিক ভাই বলে দেন, ‘রাস্তার অপজিটে যে ছয়তলা ভবনের কোয়ার্টারগুলো, তারই এক বিল্ডিংয়ের ছয় তলায় উনি থাকেন। আমাদের সিনিয়র। ’৮১ ব্যাচের ক্যাডার।’
রাত প্রায় সাড়ে দশটা বা তারও পরে ছয়তলা কোয়ার্টারের নিচতলায় আমি যাই এবং খুব সঙ্গত কারণেই একজন দারোয়ানের সঙ্গে কথোপকথন করি –
আমি:এই বিল্ডিংয়ে কি শহীদুল জহির থাকেন?
দারোয়ান: কোন শহীদুল জহির?
আমি: লেখক। লেখালেখি করেন। প্রায়সচিব।
দারোয়ান অবিশ্বাস্য একটি শব্দ ছুড়ে আমাকে প্রশ্ন করেন, আমি তার শব্দে বিস্মিত হই এবং একমত পোষণ করি, দারোয়ান প্রশ্ন করেন, “অকৃতদার শহীদুল জহির?”
আমি ‘হ্যাঁ’ এবং আমি হা। দারোয়ান বললেন, ‘যান, ছয়তলায় যান। স্যার বাসায় আছেন।’
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পথে, প্রত্যেক তলায় দুটো করে দরজা। ঈদের দিন হওয়ায় বেশিরভাগ দরজার সামনেই প্রচুর জুতা-স্যান্ডেল। বাসায় ঈদের মেহমান। বাচ্চা-কাচ্চা থেকে শুরু করে নানা বয়সীদের নতুন জুতা স্যান্ডেল। ছয়তলাতেই অবস্থাটা বেশি চোখে পড়ল। একদিকের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে, সেই ঈদের রাতের প্রায় পৌনে এগারোটায়, বাচ্চা-বড়-বুড়োদের একগাদা নতুন জুতা-স্যান্ডেল, অন্যদিকের দরজাটাও কিছুটা শ্রীহীন, জুতা-স্যান্ডেল কিচ্ছু নেই। পা মোছার পাপোষও নেই। দরজায় কড়া নাড়ি। একবার, দুইবার… তখন আমি হয়তো কড়া নাড়ি আবদুল করিমের দরজায়…
ভেতর থেকে দরজা খুলে, লুঙ্গি পরা-শার্ট গায়ে দেওয়া যিনি বের হলেন, তার মুখ আমি দেখেছি, ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ এবং ‘ডুমুর খেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ (যে বই দুটো কবি আবিদ আজাদের শিল্পতরু থেকে বের হয়েছিল); বই দুটোর ফ্ল্যাপে আমি এই মুখ দেখেছি, একটা ফটোতে গোঁফ আছে, একটাতে গোঁফ নেই। আমার সামনের মানুষটিরও তখন গোঁফ নেই। আমার আর বুঝতে বাকি নেই। তবু ফর্মাল একটা প্রশ্ন করি, ‘আপনি কি শহীদুল জহির?’ শহীদুল জহির মাথা নেড়ে ফের আমাকেও একটা প্রশ্ন করেন, তার প্রশ্নে আমি বিস্মিত হই, খুশি হই, লজ্জাও পাই একধরনের; তার প্রশ্ন, ‘আপনি কি টোকন ঠাকুর?’
আমি হুমায়ুনকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলি, ‘আমার বাল্যবন্ধু, পুলিশে আছে।’ শহীদুল জহির ভেতরে প্রবেশের ইঙ্গিত করেন এবং সেই রাতে প্রায় ঘণ্টাখানেক এবিষয়-সেবিষয় নিয়ে কথা বলি। বলি কী, আমি প্রশ্ন করি, শহীদুল জহির তার এক ভক্তের পিপাসাকে আরো দীর্ঘ করে দেন। বললাম, ‘আপনি আমাকে চিনলেন কী করে?’
প্রিয় লেখক বললেন, ‘কাগজে ছবি ছাপা দেখেছি…।’
টিভিতে ঈদের দিনের প্রোগ্রাম দেখানো হচ্ছিল। একটি চ্যানেলে দেখাচ্ছিল ঈদ উপলক্ষে ঢাকায় জাতীয় মেহেদী উৎসব প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মেয়েরা মেহেদী মাখা হাতে সাজুগুজু করছে। উৎসবের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল এক তরুণ কথা বলছে টিভি সাক্ষাৎকারে — ‘মেহেদী উৎসব এবছর ঢাকায় শুরু হলেও আগামী বছর থেকে এটি জেলায় জেলায়, থানায় থানায় ছড়িয়ে দেওয়া হবে, মেয়েরা সাজবে, ছেলেরা সাজাবে…।’ শহীদুল জহির বললেন, ‘এ কি আপনাদের বন্ধু?’
বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘সেটাই অনুমান হলো।’
ঐ রাতে, টিভির মধ্য থেকে মেহেদী উৎসব নিয়ে সংগ্রামী কথা বলছিল আমাদের বন্ধু আদিত্য কবির। তারপর শহীদুল জহির নিজে হাতে চা কিংবা কফি খাওয়ালেন। তার লেখা নিয়ে কথা বলছিলাম আমি, সে রাতে পূর্ণিমা নিয়ে, ডুমুর খেকো মানুষের গল্প নিয়ে, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে। তিনি তাঁর প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘পারাপার’ এর কথা বললেন, আমি বললাম, তখন পর্যন্ত আমার সেটা পড়া নেই। বললাম, ‘আজিজে আসেন না কেন? মোল্লায় আসেন না কেন? চারুকলায় আসেন না কেন? পিককে আসেন না কেন? সাকুরায় আসেন না কেন? টিএসসি, মধুর কেন্টিন, বেইলি রোড বা শিল্পকলায় আসেন না কেন?’ তার উত্তর ছিল, ‘পোষায় না, তাছাড়া সময়ও তো পাই না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থাকি… চাকরি করি…।’
জানালাম, ‘আপনার কোনো কোনো গল্প আমি বহুবার পড়েছি।’ তাঁর চোখে সকৌতুক হাসি, যেন, পড়তেই হবে। বললাম, ‘সিরাজগঞ্জে ছিলেন কখনো?’
‘ছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে, কয়েকমাস।’
বললাম, ‘আপনার আরো কিছু গল্প-উপন্যাস পড়তে চাই। অনেকেই চায়।’ তিনি জানতে চাইলেন, আমার বন্ধুদের মধ্যে কার কার লেখা আমার ভালো লাগে? কার কার সঙ্গে আমার আমার বন্ধুত্ব… ইত্যাদি। শহীদুল জহিরকে বললাম, ‘এখন তো প্রায় রাত ১২টা, আজ উঠি? আরেকদিন আসব।’ উনি বললেন, ‘ফোন করে আসবেন।’
আমার প্রিয় লেখকের বাসা থেকে, সেই রাত প্রায় ১২টার দিকে, ঈদের রাতে, বেরিয়ে আমার সময়, বিদায় নেবার আগে, আমি আর হুমায়ুন আর শহীদুল জহির, আর রাশি রাশি নিঃসঙ্গতা… আর চারদিকে ঈদের আনন্দ… আমি বললাম, ‘আপনাদের দারোয়ানকে যখন প্রশ্ন করলাম, ‘শহীদুল জহির কি এই বিল্ডিংয়ে থাকেন? দারোয়ান বলল, অকৃতদার শহীদুল জহির?…’ শহীদুল জহির হা হা করে হেসে ফেলেন। হাসি আমরাও।
আর কখনো যাওয়া হয়নি। এরপর ‘ডলু নদীর হাওয়া’… কিংবা ‘মুখের দিকে দেখি’ বেরিয়েছে, তিনি দু দুটা শ্রেষ্ঠ লেখক ধরনের পুরষ্কারও পেয়েছেন… আমি আমার এই প্রিয় লেখকের এক একটি গল্প বহুবার যেমন পড়েছি, এখনো পড়ি। এর মধ্যেই সেদিন, মাত্র ৫৩/৫৪ বছর বয়সে তিনি মারা গেলেন হঠাৎ। এ বয়েসে যাওয়া তাঁর ঠিক হয়নি। আরো কিছু লেখা পেতে পারতাম তাঁর কাছ থেকে, স্বার্থপরের মতো। দীর্ঘকালের এই পৃথিবীতে আমরা শহীদুল জহিরের কাছ থেকে গল্প চেয়েছি, উপন্যাস চেয়েছি, কারণ হয়তো এটা যে, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর শহীদুল জহির মোটা দাগে দাগ হয়ে থাকবেন বাংলা কথাসাহিত্যের শ্রীমুগ্ধ গভীর সংসারে। কিন্তু গল্প-উপন্যাসের বদলে আমরা তাঁকে কী দিয়েছি?
আমরা পাঠক, পাঠক কি খুব বেশি স্বার্থপর, প্রায়শই?
সেই একবার দেখা আমার শহীদুল জহির অমর রহে…।
ঢাকা, ৩০/১০/২০০৮