মুসা আল হাফিজ
এক.
নেপোলিয়ন বোনাপার্টকে (১৭৬৯-১৮২১) দিয়ে শুরু করা যাক । তার মিসর আক্রমণ ইসলামের ইতিহাসে একটি নতুন ও ভয়াবহ যুগের সুচনা ঘটায় । এর আগেও মুসলমানরা খ্রিস্টানদের হাতে বহু যুদ্ধে হেরেছেন । কিছু দিন পরে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন ।কিন্তু ১৭৯৮ সালে উত্তর কায়রোর আমবাবাহ যুদ্ধক্ষেত্রে নেপোলিয়নের সেনাদের কাছে মিসরিয় মুসলিমদের পরাজয় কেবল সামরিক পরাজয় ছিলো না । এটা ছিলো ইসলামের একটি যুগের পরিসমাপ্তি এবং ব্যাপকতর পরাজয় ।
এর পরই মুসলিমরা নিজেদেরকে পরাজিত ও শাসিত জাতি হিসেবে ভাবতে শুরু করলো ।পশ্চিমারা নিজেদেরকে বিজয়ী ও শাসক শক্তি হিসেবে দাঁড় করালো ।মুসলিম জীবনের তখন ঘোর দু:সময় ।মুসলমানদের আভ্যন্তরীণ শক্তি লুপ্তির দিকে ধাবমান । মুসলিম সভ্যতা হারিয়ে ফেলেছে গতি ও উদ্যম, প্রাণের সাড়া ও তরঙ্গ ।বৃহত্তর সমাজ হয়ে উঠেছে জীবনের পড়োভূমি ।শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তা, রাজনীতি, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, জাতিগত আত্মপরিচয়, ঐকবোধসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই এসেছে অবক্ষয়, গতিরিক্ততা। মানসিক পরাজয় সঙ্কীর্ণ করে দিচ্ছিলো মুসলিম সভ্যতার বোধের জমি ।ধর্ম হয়ে উঠছিলো আচরিত প্রথা ও পদ্ধতির নাম ।পশ্চিমা জীবনের যে সব প্রবণতা দু’দিন আগেও মুসলিমদের চোখে ছিলো হেয়তর,বানের পানির মতো তা ঢুকতে শুরু করলো মুসলিম জীবনে । এই যখন পরিস্থিতি,নবজাগরণের তরঙ্গে উদ্দাম ফরাসিদের কাছে মিসর বিজয় হয়ে উঠলো সহজ ব্যাপার। দেশ দখলের পর দেশ শাসনের প্রশ্ন এলো। এখানকার মানুষ মুসলিম। তারা পরাধীন হয়েছে। তাদের জীবনাদর্শ ইসলাম। সে কি কোনো শক্তি ? কোনো প্রতিরোধ? কোনো হুমকি? সে কি মৃত কোনো অতীত? প্রাণহীন স্মৃতিচিহ্ন? কিংবা কোনো অসুখি ব্যবস্থা, যার মৃত্যু খুবই বাস্তব? নেপোলিয়ন এ প্রশ্নের জবাব খুঁজলেন কনস্টান্টাইন ফ্রান্সিসকো কোঁতে ডি ভোলনির (১৭৫৭-১৮২০) কাছে ।
ভোলনির রচনায় নেপোলিয়ান দেখলেন এক গোয়েন্দারিপোর্ট। মুসলিম সংস্কৃতির অন্তরতলে ঢুকে পড়া এক দৃষ্টিবান প্রতিবেদকের বয়ান। ভোলনি থেকে নেপোলিয়ন লাভ করেন ক্রমানুসারে সাজানো সমস্যা এবং ফরাসী দখলাভিযানে সেনাবাহিনীকে যে সব বাঁধার মোকাবেলা করতে হবে, তার তালিকা। বলাবাহুল্য সেইসব বাঁধার প্রথমটিই হচ্ছে ইসলাম।
নেপোলিয়ন ইসলামকে জানতেন গভীর অর্থে। কৈশোর থেকে তিনি পাঠ করছিলেন ইসলামকে।তরুণ বয়সে লিখেছিলেন ম্যারিনির ইস্তওয়ার দ্যা এরাবস এর একটি সারসংক্ষেপ। তার আস্থা ছিলো ভোলনির ইসলাম বিশ্লেষণে।ফরাসী এই প্রাচ্যবিদ ১৭৭২ সালে ভ্রমণ করেন মিসর ও সিরিয়া।ভ্রমণ কাহিনী লিখেন ফরাসী ভাষায় ‘ভয়েজ আঁ মিসর আঁ সিরিয়া’ । যার ইংরেজি অনুবাদ দুই খণ্ডে, Travels in Syria and Egypt নামে বিশ্বময় পঠিত। এ রচনা ছিলো সফরনামার চেয়ে অধিক কিছু। এ ছিলো এক গাইড বুক, প্রাচ্যবিজেতার জন্য।যে প্রাচ্যে অনাগ্রহী, এ ছিলো তার জন্য আগ্রহের নতুন এক হাতছানি।ভোলনি জানতেন তার রচনা পশ্চিমা যুবকদের করবে প্রাচ্য দখলে আগ্রহী।অভিযাত্রী আর রাজাদের উদ্বুদ্ধ করবে অভিযান পরিচালনায়।
তার বই চলে গেলো পশ্চিমা শাসকদের হাতে।রাশিয়ার জার কাতরিনের হাতে।ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়নের হাতে।কাজ হলো দ্রুত।
বিচক্ষণ ও সতর্ক ভোলনি ইসলামকে জানতেন একটি জীবন্ত শক্তি হিসেবে। ওসমানী সালতানাতের মোকাবেলা তার বিবেচনায় ছিলো সাধারণ বিষয়।কিন্তু ‘ ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ছিলো সবচেয়ে কঠিন ও গভীর।
একজন পশ্চিমা দখলদার মুসলিম জগতের মুখোমুখি কীভবে হবেন, ভোলনির রচনায় এর প্রতিটি ধাপ পরিষ্কার।তার সফরবিবরণকে ভাবা হতো পাখির চোখে দেখা মুসলিম জীবন ও ভূগোলের চিত্র হিসেবে।যা প্রাচ্যে পাশ্চাত্যের দখলদারিকে স্বাভাবিক করে তুলে।কিন্তু গ্রন্থটির আবেদন ছিলো আরো বেশি।কারণ দখলদারির পরে দেখা গেলো তার আসল উপযোগিতা। সে উপদেষ্টার কাজ করলো এবং বললো, এবার লড়াই অন্যরকম, এবার প্রতিপক্ষ ইসলাম।
অতএব, ইসলামের বিরুদ্ধে নির্বাচিত ও দৃষ্টান্তহীন একটি যুদ্ধ শুরু করার গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে নেপোলিয়ান সকলের জন্য সমান সুযোগের বিপ্লবাত্মক ভাবাদর্শের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। মুসলিমদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য নিয়োগ দেন একদল পণ্ডিত আর চিন্তার চর্চার জন্য গড়ে তুলেন আধুনিক ইউরোপীয় বুদ্ধজীবিদের একটি প্রতিষ্ঠান।
এ ছিলো এক অভিযান, ইসলামের বিরুদ্ধে; কিন্তু নেপোলিয়ন সর্বত্র প্রমাণের চেষ্ঠা করেন এ প্রয়াস ইসলামের জন্যই। তিনি যা বলতেন, তার সবই কুরআনের ব্যবহৃত আরবীতে অনূদিত হতো। ফরাসী সেনাবাহিনীর উপরস্থ কামান্ডারদের উপর নির্দেশ ছিলো যেনো সকল সময় ইসলামের ধর্মীয় আবেগের কথা মনে রাখা হয়। নেপোলিয়নের বক্তব্য থেকে ইসলামের প্রতি ঝরে পড়তো শ্রদ্ধা ও অনুরক্তি।
কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি দিতেন এবং পৃথিবীকে ইসলামের পরিবার বানাবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করতেন। জামে আল আজহারের প্রধান আলেমদের আমন্ত্রন জানাতেন আপন ডেরায় এবং তাদের প্রতি জ্ঞাপন করা হতো সামরিক সম্মান। যখন নেপোলিয়ন পরিষ্কার উপলব্দি করলেন মিশরীয়দের উপর দখলদারিত্ব বজায় রাখার জন্যে তার সেনাবাহিনী খুবই অপ্রতুল, তখন তিনি স্থানীয় ইমাম, কাজি, মুফতি ও আলেমদের দ্বা্রা কুরআনের এমন ব্যাখ্যা প্রচার করালেন, যাতে মনে হয় তার সেনাবাহিনী ইসলামের পক্ষের শক্তি। অচিরেই দখলদারের প্রতি ঘোরতর অবিশ্বাসের কথা ভুলে গেলো মিসরের মানুষ। নেপোলিয়ন যখন মিসর ছাড়বেন, তখন তার ডেপুটি জন ব্যাপ্টিস্ট ক্লেবারকে (১৭৫৩-১৮০০) কড়া নির্দেশ দিলেন তার এই কর্মপদ্ধতি অবলম্বনের জন্য। কারণ অন্য যে কোনো রাজনীতি খুবই ব্যয়সাপেক্ষ মূর্খতা।
ফরাসী কবি ভিক্টর মেরি হুগো (১৮০২-১৮৮৫) নেপোলিয়নের এই কৌশলী যুদ্ধজয়কে অভিনন্দিত করেছেন তার কবিতায়। তাকে সকৌতুকে অভিহিত করেছেন পশ্চিমের মেহমুত (মুহাম্মদ) হিসেবে! মুসলিমরা সরল বিশ্বাসে তাকে মুসলিম হিসেবে ভাবতে চেয়েছে। আজো বহু মুসলিম নেপোলিয়নকে ইসলামের একজন হিসেবে ভেবে তৃপ্তি পায়।লেখালেখি করেন, নেপোলিয়ন কীভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বা ইসলামের প্রেমে পড়েছিলেন?নেপোলিয়নের চারপাশের মুসলিমরা ছিলেন অধিকতরো বাহ্যিকতায় বিশ্বাসী। পোশাকী উপস্থাপন তাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিলো এবং তারা হেরে গেলেন।
জয়ী হলেন নেপোলিয়ন। তার জয় কেবল যুদ্ধ ও শাসনে সীমিত থাকলো না। মিসরে সংক্ষিপ্ত সময়ের অবস্থানকালে তিনি পাল্টে দিলেন মুসলিম আইন। রাষ্ট্রীয়ভাবে জারি করা হলো ফরাসী আইন ও বিচারব্যবস্থা। ইসলামি আইনকে আবদ্ধ করা হলো বিবাহ, তালাক ও উত্তরাধিকারের আওতায়। এ হয়ে উঠলো কেবল ব্যক্তিগত রীতি। মুসলমানদের গোটা ইতিহাসে এ ছিলো প্রথম ঘটনা। ব্রিটিশ, ডাচ ও পর্তুগিজরা এতো সহজে এটা ভাবতেই পারছিলো না। তারা জানতে চাচ্ছিলো, কীভাবে এটা সম্ভব হলো ফরাসীদের দ্বারা? কিন্তু যা ঘটার, ঘটে গিয়েছিলো। মুসলমানরা মোহগ্রস্থ তখন নেপোলিয়নের আলেম ও প্রাচ্যবিদদের পরিবেশিত ইসলামে।
সেন্ট হেলেনায় জেনারেল হেনরি জেন্টেইন বার্টান্ডকে (১৭৭৩-১৮৪৪) শুনানো স্মৃতিচারণে নেপোলিয়ন মিসর ও সিরিয়ায় তার সাফল্যের জন্যে প্রাচ্যবিদ ভোলনির রচনাবলীর ঋন স্বীকার করেছেন। ভোলনি তাকে বলে দিচ্ছিলেন, কী করতে হবে এবং কী না করা উচিত। প্রাচ্য তার কাছে ছিলো দুর্বোধ্য এক জটিল জগত, কিন্তু ভোলনি প্রাচ্যের অজ্ঞাত অংশগুলোকে নেপোলিয়নের হাতে তুলে দিলেন মটরের দানার মতো। তিনি বাতলে দিলেন দখল ও শাসনের ক্ষে্ত্রে সমস্যা ও তার সমাধান।
অরিয়েন্ট নামক ফ্লাগশিপে বসে মিশরীয়দের উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন যখন ঐতিহাসিক বক্তৃতা দেন, তখন তার চারপাশে ছিলেন একদল প্রাচ্যবিদ। মিসর শাসনের জটিল মুহূর্তগুলোতে তিনি যখন বিশেষ কক্ষে অস্থির পায়চারি করতেন, তখনও তার পাশে থাকতেন কিছু প্রাচ্যবিদ। মিসর আক্রমনের আগ থেকেই তিন ব্যবস্থা করে রাখছিলেন যথেষ্ট সংখ্যক সৈন্যের আর যথেষ্ট সংখ্যক প্রাচ্যবিদের। যার প্রমান মিলে ১৭৯৩ এর ৩০ মার্চ আরবি, ফারসি ও তুর্কি ভাষা শিক্ষা দেয়ার জন্য ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে ইকোল পাবলিক প্রতিষ্ঠার ঘোষণায়।
ইকোল পাবলিকের প্রথম আরবি শিক্ষক ছিলেন সিলভেস্ত্র দে সেসি (১৭৫৮-১৮৩৮) । তার বহু ছাত্র ছিলেন মিসর আক্রমনে নিপোলিয়নের সঙ্গী। তারা কেউ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি। কিন্তু তারা ছিলেন নেপোলিয়নের সবচেয়ে মূল্যবান যোদ্ধা। বোনাপার্ট তাদেরকে দক্ষ হাতে ব্যবহার করেছেন। কিন্ত এ ব্যবহারের কৃতিত্ব তার একার নয়। কারণ তার আগে ও পরে ইউরোপ প্রাচ্যবিদদের কাজে লাগিয়েছে গোপন, প্রবল অস্ত্র হিসেবে।
দুই।
Orientalist বলে প্রাচ্যবিদরা বিশেষ অভিধা নিয়ে বিকশিত হতে থাকেন এই সময়কালে। শব্দটির প্রথম ব্যবহার ঘটে ১৬৩০ সালে, প্রাচ্যের এক চার্চ্ সদস্যের ক্ষেত্রে। পশ্চিমা কারো ক্ষেত্রে এর প্রথম ব্যবহার ১৬৯০ সালে। ব্রিটিশ দার্শনিক ও প্রাচ্যভাষাবিশারদ স্যামুয়েল ক্লার্কের (১৬৭৫-১৭২৯) পরিচয়ে শব্দটির প্রয়োগ হয় বিশেষ মাত্রায়। এরপর এটি স্বতন্ত্র স্বভাব লাভ করতে থাকে। ইংরেজি ভাষায় এ শব্দের প্রথম ব্যবহার হয় ১৭৭৯ সালে, ফরাসী ভাষায় ১৭৯৯ সালে, ১৮৩৮ সালে ফরাসী অভিধানে শব্দটি জায়গা করে নেয়। প্রাচ্যদেশীয় সংস্কৃতির প্রতি যা কিছু নিবদ্ধ, তার পশ্চিমা চর্চা ও পাঠকে তখনই অভিধা দেয়া হয় orientalism নামে। বিশেষ অর্থে মুসলিম প্রাচ্যের ভাষা, ধর্ম, সমাজ, শিল্প, সংস্কৃতি, সভ্যতা ইত্যাদি বিষয়ে পশ্চিমাদের জ্ঞানচর্চা ও গবেষণাকেন্দ্রীক চিন্তাধারা orientalism নামে চিহ্নিত হতে থাকে। এ চিন্তাধারার লালন ও বিকাশে যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণাকর্মে নিয়োজিত ছিলেন, তারা মূখ্যত প্রাচ্যবিদ বলে পরিচিতি পেতে থাকেন। অষ্টাদশ শতকে প্রাচ্যবিদ বলতে একটি সর্বজনীন সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিত্ব বুঝানো হতো। এ বুঝানোর মধ্যে থাকতো এক প্রভুত্ব। প্রাচ্যের প্রতিনিধিত্ব করছেন পাশ্চাত্যের কেউ, এ সেই প্রভুত্বের একটি দিক। এই শ্রেণীর মধ্যে ছিলেন প্রাচ্য সংস্কৃতির বিচার, অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ ও ‘পরিশোধনে’ লিপ্ত বিশেষজ্ঞ, যারা চিত্রকর, সংবাদবাহক বা গ্রন্থকার হয়েও ছিলেন এর অধিক কিছু। তারা মূলত বিস্তৃততর মাত্রার পণ্ডিতকূল, যাদের অনেকেই প্রাচ্যদেশীয় একাধিক সংস্কৃতিতে গভীর জ্ঞান রাখতেন এবং একই সঙ্গে ধারণ করতেন মানবতাবাদী পরিচয়। অতীত ও বর্তমানকালের প্রাচ্যদেশীয় ভাষা ও সাহিত্য, কলা ও পূরাতত্ত্ব ছিলো তাদের প্রধান বিষয়। তারা ছিলেন সবকিছু নিয়ে সক্রিয় কিংবা মূলত সক্রিয় ছিলেন প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক স্মারক নিয়ে; গবেষণা ও অধ্যয়নে। এ অধ্যয়ন তাদেরকে নিয়ে যায় এমন কোথাও, যেখানে রয়েছে প্রাচ্যের হৃদস্পন্দন। প্রাচ্যবিদ সেখানেও হাত রাখতে পারেন।
কিন্তু প্রাচ্যের যে মানচিত্রে তাদের চোখ ছিলো, সে কোন প্রাচ্য? উনিশ শতক পর্যন্ত সে ছিলো নিকট প্রাচ্য। প্রাচ্য মানেই বিশাল ভূভাগ। কিন্তু প্রাচ্যচর্চার এলাকা মানেই ছিলো ওসমানী সালতানাতের অধিনস্ত অঞ্চলসমূহ। ফরাসী ব্যবহাররীতি তাতে যুক্ত করলো উত্তর আফ্রিকাকে। উনিশ শতকের সমাপ্তি ও বিশ শতকের প্রথম প্রহরে প্রাচ্যচর্চা গোটা এশিয়া মহাদেশে নিজেকে প্রসারিত করলো। প্রাচ্যবাদ তখন ভাঙ্গা-গড়া করছে সংস্কৃতিসমূহের ইতিহাস। আবিষ্কার করছে কিংবা হত্যা করছে অব্যাহতভাবে। পাশ্চাত্য মানসকে উদ্দীপিত করছে, প্রাচ্যকে লাগাম পরাচ্ছে। সে নিজেই হয়ে উঠছে এক সংস্কৃতি। ইউরোপ ও আমেরিকার সাংস্কৃতিক প্রবণতার এক অংশ।
১৮৭৩ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হলো প্রথম ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব অরিয়েন্টালিস্ট। ১৯৫১ সালে গঠিত হলো ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব ওরিয়েন্টালিস্ট। ১৯৬০ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত হলো প্রাচ্যবিদদের বৈশ্বিক কংগ্রেস। ১৯৭৩ সালে সেটা হলো প্যারিসে। এরপর যতো কংগ্রেস হয়েছে, প্রাচ্যবিদদের নাম নিয়ে হয়নি। বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন ব্যানারে। প্রাচ্যবাদ ততদিনে আরো পরিশীলিত, আরো কৌশলী। সে দাবি করলো, প্রাচ্যের মানবিক বিভাগসমূহ নিয়েই তার কাজ। বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, ইতিহাস, কলা, ধর্ম, রাজনীতি, সর্বত্রই সে ডালপালা ছড়ালো। সে নিজেকে প্রচ্ছন্ন করলো আরো বেশি ছড়িয়ে দেবার জন্য। সে গলিত বরফের মতো মিশে গেলো এশিয়াটিক সোসাইটি, বিজ্ঞানকেন্দ্র, ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ, মিডিয়াগোষ্ঠী, মিশনারী কার্যক্রম, গীর্জা ইত্যাদিতে। প্রাচ্যবিদরা সেসব অঙ্গণে দিকনির্দেশক অবস্থান গ্রহণ করলেন। এমনকি, খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য ১৭০১ সালে গঠিত সোসাইটি ফর দি প্রপোগেশন অব দি গসপেল ইন ফরেইন পার্টস থেকে নিয়ে ১৭৯২ সালে দ্য ব্যাপ্টিস্ট মিশনারী সোসাইটি, ১৭৯৯ সালের চার্চ মিশনারী সোসাইটি, ১৮০৪ সালের দ্য ব্রিটিশ এন্ড ফরেন বাইবেল সোসাইটি, ১৮০৮ সালের দি লন্ডন সেমাসাইটি ফর প্রমোটিং খ্রিস্টিয়ানিটি সাফল্য লাভ করে প্রাচ্যবিদদের প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণের ফলেই। তারা বিচিত্র ধারায় কাজ করছিলেন। কিন্তু তাদের অভিন্ন লক্ষ্য ছিলো, পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ সীমানা সম্প্রসারণ। সেটা কী মনে ও ভাষায়, কী আচারে ও ধর্মে! কী শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে, কী রাজনীতি ও অর্থনীতিতে!
[ চলবে…]
মুসা আল হাফিজের ‘‘ ইসলাম প্রশ্নে ঔপনিবেশিক পাণ্ডিত্যের রাজনৈতিক চেহারা ’’ প্রবন্ধটির সূচনাপর্ব বা পর্ব–এক পড়লাম । সঠিক তথ্যসমৃদ্ধ, সুবিশ্লেষিত , সুবিবেচিত ও সুন্দরভাবে উপস্থাপিত। আমি এ সংক্রান্ত কিছু বই আগেই পড়েছি, এখনও পড়ি। আমাদের সকলেরই প্রাচ্যবাদ বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করা সমীচীন। আমি প্রবন্ধটির পরবর্তী পর্ব পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।
প্রাচ্যবিদ ও তাদের রাজনৈতিক যুদ্ধ সম্পর্কিত এই রচনা ভালো লাগলো। বাকি অংশ পড়তে চাই।