মনজু রহমান
…হাসছো?/ তুমি হাসলেই এমন হয়,/তুমি হাসলেই দাগী আসামিও বাইবেল পড়তে শুরু করে/তুমি হাসলেই ঘাতকের বিষমাখা ছুরি খসে পড়ে হাত থেকে/তুমি হাসলেই দগ্ধ হৃদয়…মিঠা নদী হয়ে যায়/…হাসলেই, পৃথিবী নুয়ে পড়ে তোমার পায়ের কাছে, [তোমার হাসি এত নিষ্পাপ কেন]। আলোচনা শুরুর উল্লেখিত কাব্য পঙক্তিগুলো চলতি সময়ের তরুণ কবি মাহবুবা করিমের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘জ্যোৎস্নাপথের হলুদ মিনার’ থেকে নেয়া। তিনি তাঁর হাসিটাকে রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন সন্দেহ নেই। এই হাসি তিনি কী অর্থে ব্যবহার করেছেন পাঠককে তাঁর কবিতা পড়বার পর অনুধাবন করতে বা বুঝতে দু-বার ভাবতে হয় না। বর্তমান সময়ের ভয়ঙ্কর অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও ঘোলাটে পরিবেশের মধ্যে আন্দেলন নয়, সভাসমাবেশ মিছিল নয়, শুধু ভালোবাসার পঙক্তি দিয়ে জয় করা যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর হৃদয়। যদি সেই হাসির মধ্যে নিখাঁদ সততা ও আনুগত্য সমর্পণের কথা তিনি বলতে পারেন।
কবি মাহবুবা করিম, ধারণা করি এভাবেই অশান্ত পরিবেশে শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছেন সকলের মাঝে। কবিদের নির্ভার অস্ত্রই হলো শব্দ। কবির একটি পঙক্তি সহস্র মিছিলের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে যায় যখন সেই শব্দ পাঠকের মনের কথার সাথে একীভূত হয়ে যায়। এ জন্যই বলা হয় কবিরা অন্তর্যামী। তাঁদের তৃতীয় অঅন্তর্দৃষ্টি অতীব ধারালো যা একটি চরণেই রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বদলিয়ে দিতে পারে। বদলিয়ে দেয়।
মাহবুবা করিম এসময়ের সাহসী কবিদের অন্যতম। তিনি প্রেমকে অস্ত্র বা ঢাল মান্য করে নানামুখি শব্দে ব্যবহার করেন। সে শব্দ কখনো পেলবতা আশ্রিত, কখনো দ্রোহের আবহে নিজেকে সমর্পণ করেন নিটল প্রেমাশ্রয়ে। তিনি চলতি সময়ে এলোমেলো প্রেমের আবরণকে ছুঁড়ে ফেলে প্রকৃত শুদ্ধ প্রেমের অনুসন্ধানে নিজেকে, নিজের চেতনাকে ব্যাপ্ত করেছেন। কবি বলেন–আমার নারী জন্মের প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ড/ ছেলেবেলা/ গুপ্ত প্রেম/ গুপ্ত চুমুর বাক্স/ আমার মৃত্যুর সমস্ত শিরোনাম আমি তোমাকে দিতে চাই অরণ্য/…আমাকে নিবে অরণ্য?/ অনেকেই নেয় না ফেলে যায়, সরল স্বীকারোক্তিকে করে তুচ্ছ জ্ঞান, অবজ্ঞা।/ অনেকেই আবরণ হতে চেয়ে ফেলে রাখে নারীর জীবন। [অরণ্যকে-১]।…শালার জীবন খেল দেখাচ্ছে মাইরি–/ কপালে জুতা ঘষে ঘষে বেশ্যা পুরুষ জুটছে; একদলা মৃত্যু সেইসব পুরুষের/ ঠোঁট থেকে হিড়হিড় এগিয়ে আসছে লিপস্টিক মুছে দিতে অথচ এই ঠোঁট/ রঞ্জিত করি শুধু তোমার জন্য / অরণ্য/…কত সেলসিয়াস উত্তাপে পৃথিবী থেকে মরে যায় অবহেলার ভাইরাস বলতে পারো/ আমি ততটা উত্তাপে ফুটাতে চাই/ যতটা উত্তাপে ভালোবাসা ফুটালে অবহেলার মৃত্যু ঘটে চিরতরে। [ অরণ্যকে -২]…অরণ্য নামের সেফটিফিন/ওষ্ঠ আঙুলে তুলে রাখি/ অনিদ্রায় চোখে মাখি/ শোকে-অসুখে মাখি/ অরণ্যের পানিপড়া গিলে আমার যৌবন ঝলমল ঝলমল করে [অরণ্যকে -৩]। কবি তাঁর জীবনকে দেখেন নানাভাবে। প্রেমের জলাধারে ফুটান পদ্ম। অস্থির জীবনে বাঁধতে চান তাঁর বৈষয়িক আধার।
কবিতা হলো এক রহস্যময় অধ্যায়। তাকে যিনি মন ও মেধার রসায়নে বাঁধতে পারেন তিনিই প্রকৃত কবি। কবিতায় নানা মাধ্যমে, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলা যায় নিজের তথা বহুজনের মনোবিকারের কথা। এই মনোবিকার পাঠকদের মনের কথার সাথে যখন একীভূত হয়ে যায় তখন কবি সার্থক বলে বিবেচিত হতে পারেন। সব কবির ধ্যান জ্ঞান একই হবে, এরকম ধারণা করা অবান্তর। প্রত্যেক কবির ভাব-ভাষায় নিজস্ব স্বকীয়তা থাকবে। থাকেও। ভাষা ব্যবহারের কূটকৌশল, উপমা, চিত্রকল্প আলাদা হবে এটাই স্বাভাবিক। মাহবুবা করিমের ভাষাও সেরকম। তিনি সোজা কথা সোজাসুজিভাবে বলতে পছন্দ করেন। বলেন–আমি সেই যমালয়কে ভালোবাসি যেখানে মৃত্যুর হাট-ঘাট তোমার আঙুল বেঁধে/ টেনে নিয়ে যাবে শ্মশানালয়ে, যেখানে/ তুমি আছো;/ তুমি নেই এইরূপ চুতিয়া পৃথিবীকে ভোগে পাঠিয়ে আমি জন্মাবো না আর,/তুমি নেই মৃত্যুর পরের জীবনে এইরূপ স্বর্গযাত্রার মিছিলে দাঁড়াবো না আর। [স্বর্গের দিকে যাচ্ছি না]। অথবা– …আমাকে ওষ্ঠে রোপণ করো– কাঁচের দেবী;/ নিদ্রা ভাঙে না যেন– আলগোছে রোদের চুহা/ তোমার ভেতরে ঢুকে পড়ি। [ ঘুম-২]
প্রেম এবং দ্রোহ দু’য়ের সম্মিলিত মিলন ও বিচ্ছেদ, সামাজিক আধাসামাজিক, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভঙ্গুর, ধ্বস, এসবই কবিদের ষষ্ঠইন্দ্রিয়কে সর্বদাই তাড়িত করে। ধ্যান-মগ্নে আছন্ন করে রাখে। তখন কবি আর নিজের ভেতরে থাকেন না; দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর নিজেকে অস্থির করে তোলেন– তোমার যাবতীয় প্রেম নিয়ে হিম বুনে যাও/ সব পাঁজরে বোকা প্রেম থাকে না মায়া,/ সব গ্রীবাই নির্ভরতার নয়./….সব হাত অনলের নয়/ সব পা পলাতক নয়। [প্রেমের উৎপাত]। এই যে দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের উপাখ্যান এসবই বর্তমান সময়ের চিত্রপট, যে চিত্রপট কবিই পারেন অনায়াসে তুলে ধরতে। না হলে কীভাবে বলতে পারেন–…এবার হলো ? হলো তবে হাসো,/ হেসে হেসে পৃথিবীর অসুখ সারিয়ে তোল [বুকে ভাসছে সুখী কাগজের নৌকা]।
আগেই বলেছি কবি প্রেমের দোলাচলে ঢেউ ভাঙার মতো মনের বালুতটে আছড়ে পড়ছে, আবার ফিরে যাছে সাগরের অসীম জলে। তিনি প্রেমকে কখনো করায়ত্ব করতে পারছেন কি? কোনো কবিই তাঁর মনোজগতের গতিপথ একমুখি করতে পারেন কি? কবিরা অবিশ্বাসের দোলনায় দুলে পুনর্বার গড়তে চান তাঁর গতিপথ। তিনি বলছেন…তোমাকে দেখার পর আমি আর পিপাসার্ত নই?/ সত্যি বলছি/ তোমাকে স্পর্শের পর আমার ভেতরের মৃত নগরীতে পড়েছে সোনালী আভা,/ জেনেছি আমারও আছে আশ্চর্য মনোহর সেন্টমার্টিন। তোমাকে স্পর্শের পর..[ ছিলে না যখন]।
কবি মাহবুবা করিম-এর বাবা সিরিজ-এর কবিতাগুলো তাঁকে ভিন্ন মাত্রায় পরিচয় করিয়ে দেয়। বলা যায় কবিতাগুলো বাবার মৃত্যুর পর রচিত। –ঘুমাবার পূর্বক্ষণে কপালে শিশির জমেছিল,/ বাবা বলেছিল/ তলাচ্ছি,/ নবাবী লক্ষণ স্বর্গযাত্রার; শরীরে জমেছিল মাঘের শীত/…ঘুমাতে ঘুমাতে গোলাপ জল/ ঘুমাতে ঘুমাতে– চোখে সুরমার ঢল/বাবা চুপিসারে বলেছিল / পালাচ্ছি,/ হে ঘুম তুমি সকাল হও/ হে ঘুম তুমি বাবাকে ফিরিয়ে দাও [বাবা সিরিজ-২]।
মাহবুবা করিম বাস্তবতা এবং রোমান্টিকতা আশ্রিত সমন্বয়ে তাঁর কবিতা ভুবনে বিচরণ করেন। তাঁর কবিতার ভাষা সহজ সরল হলেও শব্দের গভীরতায় তা প্রকট। কিন্তু পরিণত কবিদের থেকে শব্দের ব্যবহার ব্যঞ্জনা-ধ্বনি, সুর তাল লয় বিষয়বস্তু, প্রেক্ষাপট তদুপরি সাহসিক শব্দ ব্যবহারে তিনি সম্পূর্ণ আলাদা। আমি বিশ্বাস করি এই নির্ভিক কবি মাহবুবা করিমের কবিতা দ্রুতই পাঠকপ্রিয়তা পাবে। অভিনন্দন কবি মাহবুবা করিম।
জ্যোৎস্নাপথের হলুদ মিনার। মাহবুবা করিম। প্রচ্ছদ : রাজিব রায়। প্রকাশক : হরকরা, ভিক্টোরিয়া রোড টাঙ্গাইল
কৃতজ্ঞ