আবু রাইহান
বাংলা সাহিত্যে সত্তর দশকের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি আব্দুস শুকুর খান। বিনম্র উচ্চারণে তাঁর প্রেমের কবিতা গুলিতে আমরা খুঁজে পাই এক স্বর্গীয় বোধের অনুভূতি। যা পাঠকের অন্তরাত্মাকে এবং বিশুদ্ধ করে। আপাত সরল কবিতায় এই বিমোহিত ভাবই কবি আব্দুস শুকুর খানে কবিতার অন্যতম বলিষ্ঠতা। যা পাঠককে তাঁর কবিতার দিকে আকর্ষিত করে। কবি ও সাহিত্যিক আব্দুস শুকুর খানের জন্ম ১৯৫৪ সালে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কুকড়াহাটি কাছে হুগলি নদীর পাড়ে মোহনপুর গ্রামে। যদি ও বর্তমানে তিনি হাওড়া ক্যারি রোড সংলগ্ন এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। ছাত্রাবস্থায় তাঁর লেখালেখির হাতে খড়ি। লেখক জীবনের শুরুতে তিনি গল্প লিখতেন। গ্রামে নিজের চারপাশে দেখা মানুষজনকে নিয়ে মাটির গন্ধমাখা বেশ কয়েকটি গল্প নিয়ে ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয় “পল্লী প্রেমের কাহিনী” নামে একটি গল্প সংকলন। মাঝে একটা সময় তিনি জীবন-জীবিকার টানাপোড়েনে বেশ কিছুদিন লেখা বন্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু কবিতা লেখার প্রতি অমোঘ টান তাঁকে আবার লেখালেখির জগতে টেনে নিয়ে আসে। তারপর থেকে একনাগাড়ে বিরামহীন লিখে চলা। সত্তরের দশকজুড়ে বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতা নিয়ে কবি আব্দুস শুকুর খানের ১৯৮৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নবজন্মে ফিরি মৃত্যুর বিষাদে’। তারপর থেকে প্রায় প্রতি বছর একটি করে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ‘উপেক্ষায় ফিরালে মুখ’, ১৯৯৭ সালে ‘আত্মার পাখি’, ১৯৯৮ সালে ‘নৈ:শব্দের স্বর’, ১৯৯৯ সালে ‘কেউ একজন’, এবং ‘ছায়ার শরীর’, ২০০২ সালে ‘অনৃতভাষণ’, ২০০৪ সালে ‘সম্পর্ক হীনতায় দাঁড়িয়ে’, ২০০৭ সালে ‘কবির ঘরে কেউ আসে না’, ২০১০ সালে ‘সুন্দর আছে চিরসুন্দরে’, ২০১১ সালে ‘প্রেম পদাবলী’, ২০১২ সালে ‘সময়ের যতিচিহ্ন ভেঙে’, ২০১৬ সালে ‘এখন তোমার খেলা’, ২০১৭ সালে ‘ভাবো, হে হন্তারক ভাবো’, ২০১৮ সালে ‘বেজে ওঠে মায়াবী গিটার’, ‘যা বলা হল না’ এবং ‘হাত বাড়িয়ে দাও’। অন্য ভাষাভাষীর কবিতাপ্রেমী মানুষজনের কাছে তাঁর কবিতা পৌঁছে দিতে তাঁর বেশ কিছু কবিতার অনুবাদ হিন্দিতে ও ইংরেজিতে হয়েছে। আব্দুস শুকুর খান কথা সাহিত্যিক হিসেবে খুব জনপ্রিয়। এখনো পর্যন্ত ৫০ টির বেশি উপন্যাস এবং ২০০ টির মতো ছোটগল্প লিখে ফেলেছেন। প্রতিবছরই নিয়ম করে বাংলাদেশের দু-তিনটি নামকরা দৈনিকে ঈদ সংখ্যাতে তাঁর উপন্যাস প্রকাশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন ঈদ সংখ্যা এবং শারদ সংখ্যা গুলিতে ধারাবাহিকভাবে তাঁর উপন্যাস এবং গল্প প্রকাশিত হয়। পুস্তকাকারে দুই বাংলা থেকে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস গুলি হল– ‘শিকড়ের ঘ্রাণ’, ‘অচেনা সম্পর্ক’, ‘ভালোবাসার ঘর বাড়ি’, ‘জাতক’, ‘আত্মজা’, ‘জলপরী’, ‘রাত বারোটার ঘন্টা’, ‘কোকিলের ডাক’, ‘মানুষ রতন’, ‘মানুষের ঈশ্বর’, ‘কাচের পৃথিবী’, ‘ঝিলের জলে বাঁকা চাঁদ’ ইত্যাদি। আব্দুস শুকুর খানের ‘শিকড়ের ঘ্রাণ’ উপন্যাসটি ক্লাসিক ঘরানার। যা সাহিত্য সমালোচকদের দারুণ প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ গুলি হল– ‘পল্লী প্রেমের কাহিনী’, ‘দেবশিশু’ এবং ‘জীবনের গন্ধ’। তাঁর লেখা ছোটগল্প ও উপন্যাস পাঠকপ্রিয়তা লাভ করলেও আব্দুস শুকুর খান মূলত আদ্যোপান্ত কবি। বিনম্র মধুর স্বভাবের প্রচারবিমুখ, আত্মমগ্ন এই কবির একমাত্র আশ্রয় কবিতা ও লেখালেখি। জীবনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জীবনের অসমাপ্ত কবিতা’তে কবি হিসেবে নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন। ভালোবেসে এই কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ একে দিয়ে হাওড়া জেলার আরেক বিখ্যাত কবি পূর্ণেন্দু পত্রী।
কবি আব্দুস শুকুর খান চারপাশের প্রকৃতি পরিবেশ, গাছ ও মানুষের মধ্যে যাপিত জীবনের মিল খুঁজে বেড়ান–
“প্রকৃত কৃষক জানে, বৃষ্টি ও মাটির ভাষা
বপনের রীতি নীতি, কতটা শিল্পসম্মত হলে
শূন্য মাঠ ভরে যাবে সবুজে সবুজে
প্রকাশের লাবণ্য পাবে জীবনের অনৃত ভাষা।”
“আমাদের স্মৃতিগুলি আগুন ও পাতাদের সাথে
কাঠের ও তোমাদের সাথে
গেয়ে ওঠে গান,গীতবিতানের পৃষ্ঠা থেকে
হৃদয়ে মর্মমূলে দু:খে সুখে যন্ত্রণায়।”
“হৃদয়ের গভীরে কোনো নাম সঞ্চিত
থাকে না চিরদিন, বসন্ত পাতার মত–
নিঃশব্দে ঝরে পড়ে
চাঁদের মতো আরও ম্লান হয়ে
ফুটে ওঠে আমাদের মৃত্যুর প্রতিমা।”
“আমাদের কোন শুভেচ্ছা পত্র নেই, চাঁদ ও জ্যোৎস্না নেই
জীবন রয়েছে।
আমাদের ঘর বাড়ি নেই, শান্তির বাগান নেই,
স্বপ্ন রয়েছে।”
গভীর আধ্যাত্বিক বোধে কবি বিশুদ্ধ হৃদয়ে উচ্চারণ করেন–
“পার্থিব যা কিছু তোমার জিম্মায় রেখে,
তোমার অভিমুখে প্রণত, সিজদায় গেলাম।
পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রতিটি সত্তাকে তীব্র শাসনে ও সংযমে বেঁধে
স্থির হয়ে আছি চিত্ত মাঝে।
…সিজদার অভি রূপে তুমি, ধুয়ে দাও সমস্ত সন্তাপ,
তোমার শুভ মুক্তি হবে শিশির বিন্দুর মতো ঘাসের ডগায়।”
“জলতলে ছায়া রেখে ঈশ্বর আছেন বসে
মানবের সুরক্ষা হেতু, আমি তাই জলের কাছে যাই
বসে থাকি মগ্ন, মহিমান্বিতের দেখা পাব বলে
কখনও জল হলে জলে মিশে যাই।”
“জীবনের চারিদিকে খেলা করে অন্ধকার, পরাজয়
তুমি আলো দান করে শস্যবতী মেঘ
তুমি গর্ভদান করো, নবান্নের স্বাদ
অপরিসীম দয়ায় তুমি দান করেছ আমাদের জীবন।”
মায়াময় এই পৃথিবীতে শত যন্ত্রণা নিয়ে ও বেঁচে থাকা কি আনন্দের তা ফুটে ওঠে কবির মৃত্যু কল্পনার বিষাদ ময় উচ্চারণে–
“মৃত্যুর সূক্ষ্ম স্পর্শে অনুস্যুত আঁধার নামে
আত্মার জ্যোৎস্না পড়ে চলমান জীবনে।
ভরা ফুল গাছে হলুদের ছোপ দাগ।
…বোধহীন, সংজ্ঞাহীন আত্ম জ্যোৎস্না নামে চরাচরে
আমার কবর গড়ে ওঠে নীল অক্ষরে অক্ষরে।”
“বাবাকে চির শান্তির ঘুমে রেখে এলাম
মায়ের কবরের পাশে
অনন্তকালের সংসারে নতুন জীবন কাটাবেন–
আজ বহুদিন পর মাঝের সূক্ষ্ম পর্দা সরিয়ে দেখবেন
দুজন দুজনার মুখ
কি পরম তৃপ্তিতে আধার হয়ে থাকবেন
অনন্ত অনন্ত বছর।”
“কোরআন খোলা রেখে বাবা এইমাত্র জ্যোৎস্না হয়েছেন
পালক থেকে জল ঝরাতে ঝরাতে খাঁচার মুনিয়া বলে-
মা, সাদা ভাতের গন্ধে সেজদায় জীবন রেখেছেন
জীবন বদলে যায়, রূপকথার গল্প শেষ হয় না কখনও।”
আব্দুস শুকুর খান তার প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে নিজস্ব অনুভবে যে ভিন্নতর প্রেমের কবিতার মালা গেঁথেছেন, তা পাঠককে নস্টালজিক করে, মনকে বিশুদ্ধ করে–
“কুমারী খোঁপার মতো খুলে যায় সন্ধ্যার আকাশ
মাথার উপর জেগে ওঠে তারা
নক্ষত্র সংগীতে মন এতটাই আত্মহারা
তোমাকে মনে পড়ে, তুমিই যেন
ছেঁড়া কাঁথা রিফু করে– রেখে যাচ্ছ শ্বাস।”
“জানালার সঙ্গে মন খারাপের সম্পর্ক নিবিড়
যেমন একাকিত্বের সঙ্গে অন্ধকার কিংবা
নৈঃশব্দ্যের সঙ্গে নক্ষত্রের আকাশ।”
“তবুও তোমার জানা ভালো
এ পৃথিবীতে কোন শূন্যই শূন্য নয়
মানুষের বোধ জুড়ে থাকে তার চেয়েও অধিক কিছু।
যা অতীব শূন্যের থেকে আরও বিভাময়।”
নিজের যাপিত জীবনে কবিতাকেই করে তুলেছিলেন মহত্তম আমলনামা–
“সত্যি কথা বলা ভালো– আমার আমলনামা প্রায় শূন্য
যেটুকু তলানির মতো আছে
তা দিয়ে চুলের সাঁকোটি কোনভাবেই হবো না পার
যার নিচে দগদগ করছে আগুন অন্য পারে আছে বেহেস্ত।
আমলনামা অপুরন হলে আগুন খাবে শরীর
আজাব ভোগ করতে থাকবো কোটি কোটি বছর–
তবে ভরসা একটাই- আমার আছে কবিতার সুধা
কবিতায় আমার জীবনের মহত্তম ও আমলনামা—”
“কোথাও তোমার ছায়া নেই,শব্দও নেই।
শুধু এক অন্তরঙ্গ প্রবাহ ঠেলে পার করে দিচ্ছে বিষাদভূমি
তাই ধুলো হয়ে যাচ্ছে এ প্রাণ, এ আলো
ভাঙ্গনের ফুৎকারে উড়ে যাচ্ছে আমিত্ব আমার।”
কবি আব্দুস শুকুর খানের কবিতায় রয়েছে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য পংক্তি যা স্মরণে রাখার মত। কবিতার জন্য পেয়েছেন পাঠকদের প্রাণঢালা ভালোবাসা এবং বিদগ্ধ সাহিত্য সমালোচকদের আন্তরিক প্রশংসা। দুই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা এবং সাহিত্য সংস্থাগুলি থেকে কবি ও কথা-সাহিত্যিক হিসেবে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মেলেনি লেখালেখির জন্য সরকারি কোন সাহিত্য পুরস্কারের স্বীকৃতি। এ নিয়ে তাঁর মনে রয়েছে অনুচ্চারিত অভিমান।