মতিন বৈরাগী
০১.
আধুনিক কবিতা বাস্তবের দিকের, এই বাস্তব জীবন চেতনার এবং জীবন লগ্নতার এক মেলোডি। বাস্তবতাই তার মূল কিন্তু সেই বাস্তবও উঁচু নিচু দাঁতালো কখনো নয়—সমানুপাতিক । তাই আমরা আধুনিক কবিতায় যতটা মনোজগত ও বর্হিজগতের উপস্থিতি লক্ষ করি রোমান্টিক যুগের কবিতায় তার উপস্থিতি ছিলনা। কেবল এক কল্পনার হৃদয়বৃত্তি বাস্তবের নয়, দায়বোধ ছিল অনুপস্থিত। সংগত কারণে আধুনিক কবিতায় যুক্ত হয়েছে তত্ত্ব, গণিত, বিজ্ঞান, শরীরবিদ্যা, অস্তিত্ববাদ, সংশয়বাদ সহ নানা দার্শনিক প্রজ্ঞা। যুক্ত রয়েছে ইতিহাস ও কালচেতনা। এই বাস্তবতার সন্ধান দৃশ্যমানতায়, ধারণায়, যা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ও কল্পনারূপাশ্রয়ী। কল্পনা প্রজ্ঞায় জারিত হয়ে যে ভাষ্যরূপ তৈরি করে এবং পাঠকের চেতনাজগতকে আলোড়িত করে, সুখসুর অনুভব গড়ে তোলে এবং পাঠক মনে যে নতুন ইমেজ সৃষ্টি করে তা’ তাকে ভাবতে এবং তৃপ্ত হতে অনুপ্রাণিত করে । সে কারণে অতিক্রান্ত নানা যুগের কবিতা থেকে আধুনিক কবিতার রূপ রস গঠনক্রিয়া ভিন্ন এবং ক্রমাগত বদলক্রিয়ায় আরো ভিন্ন হয়ে উঠছে। সন্দেহ নেই যে আধুনিক এই সময়ে যা তাত্ত্বিকদের মনমূলে আধুনিকতাকেও ছাড়িয়ে গেছে এবং একটা সংজ্ঞাও নির্ণিত হয়েছে ‘আধুনিক উত্তর’ এবং তারও পরবর্তি সময়ের দিকের, তার অর্থ আধুনিকতা বদলে যায়নি বা তাতে কম কিছু পড়েনি । বিকাশমান প্রতিটি পর্বের যাত্রার কেন্দ্রবিন্দুটি কিন্তু ঠিকই আছে, যাকে আমরা কবিতা বলি আর যা আদীম কালের তা কিন্তু অন্যকিছু হয়ে যায়নি, যাকে আমরা সভ্যতা বলি তা আজও অগ্রসরমান আছে তাকে আমরা অসভ্য কাল বলি বর্তমানের তুলনায়, হ্যাঁ বর্তমানের তুলনায় তা প্রাগ-আঙ্গিকের কিন্তু সেই বিষয়বিন্দুগুলোই কিন্তু বিকাশ পর্যায়ে শিকার পর্বথেকে পুঁজিতন্ত্র প্রতাবান্বিত সমাজের চাহিদায় বদলেছে, কারণ বদলেছে বিষয়, প্রয়োজন, অনুষঙ্গ কিন্তু ‘কবিতা’ এই নামের গুণের বিষয়ের সুন্দর মনমূর্তিটি রয়েছে অটুট। যুগচাহিদায় আধুনিক কবিতা আজ আর কেবল রূপানন্দ নয় বরং মনোজগতের নানা ক্রিয়াকে ধারণ করে যুক্ত রেখেছে মানব জীবনের অন্তরসত্তার গভীর জ্ঞান ব্যক্তি থেকে বহুতে। জগত ও জীবন অভিজ্ঞতার সার বুনন আধুনিক কবিতা শব্দবন্ধে ভাষ্য হয়ে- হতাশা, ক্লান্তি, আর্তনাদ, দহনদাহ, অস্থিরতা, নিষ্ঠুরতা, রিরংসা, একাকীত্ব, দুঃসহতা, কবির অন্তরচিত্তের বৈরিতায় যে নতুনত্ব তৈরি করে তার লক্ষণ সুপুষ্ট হয় ভাষ্যে এবং ভাষ্যগুলোতে একটা রূপকাঠামো হয়ে সেকালের যা ছিল এবং একালের চিন্তা হয়ে আবার নতুন চিন্তার পরিধিকে যুক্ত করে সৃষ্টি করে চলছে আনন্দপরিমণ্ডল যাতে আমরা তৃপ্তি বলি—প্রশান্তির। কিন্তু এই নান্দনিকতা কেবলই নান্দনিকতা নয় বিনোদনই শুধু নয়; আধুনিক কবিতা মনোবিশ্লেষণধর্মী, সমাজমানুষ ও তাদের অভিজ্ঞতা রূপায়িত করতে চায় কবির মনোভূমির কাঙ্খিত রূপায়নে। ফলে আধুনিক কবিতায় যেমন বিবৃত হয় মনোজগতের বিষয়াবলী তেমনি বাহ্যিক নানা টানাপোড়েন দহনজ্বালা অগ্নিবিস্তারময় দীর্ঘশ্বাস। কবির সময় ও কালের বাস্তবতায় নতুন রূপায়নকে বাস্তবতার অনুগামী করে। যা সত্যের উপলব্ধির দিকে পাঠক মনকে প্রসারিত করে । আধুনিক কবিতা ন্যায়ের, বোধের, আনন্দ ও উজ্জীবনের। জীবন সত্যই তার মৌলিক। জীবন জটিলতার নানা উপসর্গ অঙ্গন হিসেবে গ্রহণ করে কবি রূপদেন তার কাম্য রূপটি ফুটিয়ে তুলতে। গড়ে ওঠে কাব্য শরীর।
০২.
বাংলায় আধুনিক কবিতার যাত্রাকে কালপর্বে নির্ধারন করা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তি এবং রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত ইংরেজি সাহিত্যপ্রভান্বিত কবিতার রূপকাঠামোকে। সে হিসেবে ১৯২০ পরবর্তি কবির কবিতায় আধুনিকতার অনুষঙ্গগুলো স্পষ্ট হয়ে গায়ে শরীরে লাগতে থাকে। আধুনিকতার সব কাজের প্রেক্ষপটে কোনো কারণ থাকে, দর্শন তত্ত্ব থাকে,পরিকল্পনায় ভূমিকা থাকে, নকশা থাকে, ভালোকে মন্দের উপর এক ধরনে আলাদা মর্যাদা দেয়। আধুনিকতা কাঠামো নিয়ে চিন্তা করে বিষয়ের গহিনে গভীরে প্রবেশ করতে এবং অস্তিত্বের প্রতিষ্ঠা চায়। আসলে আধুনিকতা চায় একীভূত করার কোনো এক ক্রিয়া যার মাধ্যমে সমাজে উপস্থিত সকল যৌক্তিক কাণ্ডকে মূল্যায়ন করা যাবে। [সহায়তা মঈন চৌধুরীর প্রবন্ধ ]
কবি তমিজ উদদীন লোদী প্রবাসী বাংলাভাষার কবি। এই কবি প্রবাসে থাকলেও আমাদের কাব্যাঙ্গনে সমান জনপ্রিয় একটি নাম। প্রচুর লিখেছেন তিনি এবং তার জনপ্রিয়তা প্রায় ঈর্ষণীয় । তার নির্বাচিত গ্রন্থটি হাতে এসেছে তাও বছর গড়িয়ে গেছে, আমার পাঠমুগ্ধতার কথাই বলছি আজ।
‘আমাকে মানুষের মুখ আঁকতে বলা হয়েছিল’
অভিব্যক্তিময় মানুষের মুখ চিরকালীন,এই মুখ কবি সাহিত্যিক শিল্পী এমনকী দার্শনিকদেরও নানা ভাবে ভাবিয়েছে, কারণ মানুষের সকল চিন্তা হাইডেগারীয় ভাষায় ‘মৌলিক সত্তা’ এবং ‘পতিত সত্তা’ চিহ্ন সহ সকলের এক ভুগোল খুঁজলেই সন্ধান মেলে। আর কবি বলেন ‘আমাকে মানুষের মুখ আঁকতে বলা হয়েছিল’ কেউ তো আর বলেনি, বলেছে সমাজ নিরীক্ষণ তার মনোজগতে প্রতিম্বিত চিত্রাবলী থেকে উদ্ভুত এক নির্দেশ যে বলতে চায় মানুষের মুখ কোন সত্য বলে, কতরকম মুখ চারপাশে তারা কি সবাই একই রূপ সত্যের সংবেদ কবিকে দেয়, নাকি তার ভিন্নতা আছে না-কি স্পষ্ট করে একসত্য যা হাইডেগারীয় ‘ডাজাইন’ এবং ‘ডাসমানের’ নানা ভার্ষণকে উন্মুক্ত করে। ঘটনার উপর মানুষের মন ক্রিয়া করে এবং এই ক্রিয়া সৎসত্তায় কিংবা পতিত সত্তায় যে প্রভাব বিস্তার করে তার স্পষ্ট লক্ষণগুলো বর্তমান থাকে মানুষের প্রতিবিম্বিত মুখদর্পণে। আর তখনই কবির কাছে মানুষের মুখাঙ্কন কঠিন হয়ে পড়ে। কি আঁকবেন তিনি। দা’ ভিঞ্চি মানুষের মুখ দেখতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা মডেল হিসেবে এবং তারপর সব কিছু আপাতত স্থগিত রেখে ভাবতে বসতেন। কারণ অবশ্যই শিল্পীর ছিল, আর সে কারণ তিনি যে মুখগুলো খুঁজেছেন এবং যে বিষয়টি নির্বাচন করেছেন তার রূপায়ন ওই মুখগুলোর কোন মুখে আছে তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য। প্রেমিকার বা প্রেমিকের মুখ আঁকতে গিয়ে কবিরাও ভাবেন কি অভিব্যক্তি ভাষ্য হয়ে উঠবে তার সৃষ্টিতে। কিন্তু কবি তমিজ উদ্দীন লোদী তার প্রকাশে এই মুখ আঁকতে গিয়ে কিংবা পাঠযোগ্যতার দিকে স্পষ্ট করতে গিয়ে যে দ্বান্দ্বিক সংকটে পতিত হয়েছেন তা হলো চলমান ‘মুখের আড়ালে আরো মুখ আছে’ নানা আকারের নানা প্রকারের নানারূপভাষ্যের। এই আছের আরেক তাৎপর্য রয়েছে কারণ মানুষের মুখ যে ‘দুরধিগম্য টানেল’ এবং বাস্তবতায় সেখানে তিনি ব্যক্তিমানুষের তথা সমাজজমাট মানুষের ভবিষ্যতকে প্রত্যক্ষ করেন এরকম ভাষ্যেঃ ‘আপার অন্ধকার ছাড়া যার সামনে আর কিছুই নেই’ আর তা’ রাজনৈতিক। মানুষ আজকের সমাজ রাজনৈতিক আঁটুনিদ্বারা এমনভাবে সংকুচিত এবং অবদমিত যেখানে তার মানকি সত্তা বা ‘ডাজাইন’ বিকশিত হবার সুযোগই স্তব্ধ। ‘ডাসম্যানের’ আধিক্য প্রবল হয়ে উঠেছে এবং সত্য ন্যায় সুন্দর ক্রমাগত জীবন সংঘর্ষে অপসৃত হয়ে ফুটেছে অসায়ত্ব নানা উপসর্গের। ‘কিন্তু আমি আঁকতে গিয়ে টের পাই পৃথিবীর অন্যতম কঠিন একটি কাজে/ আমার অজান্তেই আমি হাত দিয়ে ফেলেছি’ কারণ কবির সত্তা মঙ্গলে আর আঁকতে চায় মঙ্গলময়তার চিত্রনাট্য। কিন্তু সে দেখে ‘মুখের আড়ালে আরো আরো মুখ আছে’ আর তখনই তার মনোদ্বন্দ্ব প্রবল হয়ে ওঠে কারণ কবিতো মিথ্যে বলতে চায় না। আর তিনি দেখেন ‘টানেলের গভীর অন্ধকার’ সেই অন্ধকার ভেদ করে কিছু আঁকতে পারেন না কবি, যা আঁকেন তা কেবলই একটা ছায়া। মানুষের ছায়া রূপ মানুষ নয়। এলিয়টের ‘হলো ম্যান’ ।
অস্তিত্বের অর্থহীনতা মানুষকে ভরিয়ে তোলে উদ্বেগ ও হতাশায়, আশাহীনতার বোধে ও গভীর বিষন্নতায়। আধুনিক মানুষের জীবনযাপন হতাশার, এবং এমন একজনও নেই যার অস্তিত্বের উদ্বেগ নেই। প্রতিটি মুখেই নিরাশার ছাপ, সন্তাপের। মানবজীবনে এই নিরাশার লক্ষনীয় স্থান আছে। অস্তিত্ব স্বীকৃত হলেই মানুষের জীবনে সত্য অর্জিত হয়। মানুষ সবসময়েই স্বাধীন। স্বাধীনতাই মানুষকে সাহায্য করে সবকিছুকে চিনতে,ভাবতে ও অর্জন করতে। সার্ত্রে তার নানা সাহিত্য কর্মে দেখিয়েছেন একটি সমগ্র বিবেচনাহীনতার কাছে ব্যক্তিমানুষ কতই না অসহায়! তিনি মনে করেন এই মানবতাবাদ পৃথিবীতে অস্তিত্বশীল মানুষের জন্য হতে পারে চূড়ান্তমানবতার। [সহায়তা মিথ অব সিসিফাস] কবি তমিজ উদ্দীনের কবিতায় আমরা সেই মানবতার সুরটিই প্রধান অনুষঙ্গ বলেই টের পাই । যখন তিনি বলেনঃ
একজন বিপ্লবী কমরেডকে নিয়ে কবিতায়
‘তখনো ‘গ্লাসনস্ত’, ‘পেরেস্ত্রেইকার’ ডাক আসেনি। তখনো বিপ্লব চারদিকে। কমরেডের বাণী শোনার জন্য
তখন আলপথ, কাদামাখা, জলমগ্ন জঙ্গলের দঙ্গল মাড়িয়ে সে এসে দাঁড়াতো জীর্ণ কুড়ে ঘরে। তখনো খুব
‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’।
কমরেড তবু শুয়ে আছেন চুইয়ে পড়া রক্ত আর থিথিকে মাংসের ভেতর
খানিকটা বঙ্কিম খানিকটা ঊজু অথচ নির্বিকার এক বিপ্লবীরই বেশে।’
মানুষের মুক্তির বন্দনা চিরকালের, লড়াইও লাগাতার। এই লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে অস্তিত্বের প্রশ্নটি সবসময়ই প্রধান হয়ে আছে। শাসনের নানা পদ্ধতির যা কিছু পরিবর্তন তাও এই লড়াইয়ের মধ্যদিয়েই অর্জিত। কিন্তু তারপরও মানুষের অস্তিত্ব প্রশ্নটি নানাভাবে ক্লেদাক্ত ও ছিনতাই হয়ে আছে। রুশবিপ্লবের পূর্বে প্যারী কমিউনের বিপ্লব তারও পূর্বে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে, চার্চের পাদ্রীতন্ত্রের বিরুদ্ধের লড়াইও মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্নটিকেই সামনে এনেছে। তবে মার্কসবাদী চিন্তাসারে সংগঠিত রুশ বিপ্লব সারা পৃথিবীকে নাড়িয়েছে এবং আজও সে এক আলোক বর্তিকা হয়ে সমাজ বদলে মানুষের [ কমরেডের ] মনে চেতনায় প্রথিত হয়ে আছে। আজও নিপীড়নের বিরুদ্ধে মুক্তির পথ যে ‘বিপ্লব’ এবং বিপ্লব যে একজন বিপ্লবীর ধ্যান জ্ঞান তাও স্পট হয়ে আছে কমরেডের আত্মচিত্তগঠনে। তাই তার ‘ ‘চুইয়ে পড়া রক্ত আর থিকথিকে মাংসের ভেতর/খানিকটা বঙ্কিম খানিকটা ঋজু অথচ নির্বিকার এক বিপ্লবীরই বেশে’ এমন দৃশ্যকল্প একজন সচেতন কবিই আঁকতে পারেন তার কবিতায়।
০৩.
ফ্রয়েড মানুষের কামনা-বাসনার অবদমন শিল্প-সাহিত্যের উপর প্রভাব ফেলে বলে উল্লেখ করেছেন। কামনা-বাসনার অবদমনের মাত্রা প্রকাশমাত্রায় পরিষ্ফুটিত হয়। মানুষের মন অবদমিত হয় সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে। সামাজিক নিয়ম রীতি রিস্তা, পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ এবং রাষ্ট্র শক্তি মানুষের উপর যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে ব্যক্তির স্বাধীনতাকে খর্ব করে এবং মুক্ত প্রকাশ প্রবাহকে রুদ্ধ করে তখন মানুষের মন অবরুদ্ধ হয়ে যায় এবং থাকে খাপবদ্ধ নিয়ন্ত্রিত মন। ভাল মন্দের নিজস্ব বিচার বোধ অবরুদ্ধ হয়ে নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে নিয়ন্ত্রক শক্তির অসৎ নিয়ন্ত্রণে। ফ্রয়েডের মনোস্তত্বের বাইরেও একটা সামাজিক পরিশোধনাগার রয়েছে, যে পরিশোধনাগার প্রতিমুহূর্তে তার নির্ণয়কে পরিমাপ করে এবং মানুষকে সনিয়ন্ত্রণে শক্তি যোগায়। নইলে সভ্যতার নানা জঞ্জাল অতিক্রমণে মানুষ পারঙ্গম হতো না বলতে পারতোনা ‘রাস্তায় রাস্তায় জ্বালিয়ে রেখেছো হায়েনা ও নেকড়ের চোখ। … ঝরের মতো ক্ষিপ্র আগুন উড়বে! ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে পোড়া ছাই।’ কিংবা ‘গায়ে গায়ে লেপ্টে যাচ্ছে নানা গন্ধ, পয়োপ্রণলীর পাঁক/এদিকে ধোঁয়ায় জ্বালা করছে চোখ-আগুন অন্তরালে/যত বেশি আগুনে পুড়ুক ঘরদোর/প্রয়োজনে আমরা নামবো গভীর পাতালে’ এই বোধ সমাজ থেকেই আহরিত এবং এর প্রতীতিই প্রতিমুহূর্তে বদলিয়েছে মানুষ সামনে এনেছে তার অস্তিত্ব। তমিজের বহু কবিতায় এই অস্তিত্ব উদ্ধারের আশাবাদ আছে।
তমিজ উদ্দীন লোদী’র নির্বাচিত গ্রন্থের প্রচ্ছদ ফ্লাপে লেখক হাসান ফেরদৌসের একটা মন্তব্য আছে। তিনি বলেছেন ‘আশ্চর্য সব দৃশ্যচিত্র নির্মাণের ক্ষমতা রয়েছে লোদীর’। ‘দুগ্ধ সরোবর’ জ্যোৎস্নার চিতা’ চমৎকার ব্যাঞ্জনা নিয়েই পাঠকের হৃদয়কে আপ্লুত করে।
০৪
‘সমস্ত অনুযোগ আমি প্রুস্থের মতো প্লতেরোর হাতে তুলে দিয়েছি।’
প্লাতেরো হাতের তৈরি ছোট্ট ডঙ্কি/ঘোড়া যা সুন্দর, যার রয়েছে মসৃণ কেশর তুলতুলে নান্দনিক শরীর এবং অন্তর পূর্ণতার দৃষ্টির নন্দন, ভালোলাগে, তৃপ্ত করে-তার হাতে তুলে দিয়েছি মানে সমর্পন। এই সমর্পন হৃদয়কে সম্পন্ন করে, বেদনার দাগগুলোকে নির্লিপ্ত করে অভয় হয়ে দূর দেখায়। এই যে নিজের হাতের প্রস্তুত সুন্দর নিজের নির্মাণ যা সামাজিক কিন্তু ব্যক্তিক প্রসন্নতায় ছড়িয়ে পড়ে কাঙ্খায়, সত্য হয়, স্থিত হয়, যার অস্তিত্ব দ্বিসত্তায় বিরাজমান। প্লাতেরো ঘোড়া হতে পারে, প্রশান্তির ক্ষুদ্র কোনো অস্তিত্ব হতে পারে,ভাবনার কোন প্রতীক হতে পারে, যদিও নানা দেশে এর নানা রকম অর্থ আছে সে নির্মাণের সংগেই সম্পর্কযুক্ত। আর যে অদৃশ্য ঘোড়াটি বোধি ও ঈপ্সার ভেতর লাফিয়ে চলেছে তাকেও ‘আমি মুঠোবন্দী পাথরের মতো বেদীতে দিয়েছি’ এই ভাষণ কবির অন্তরযন্ত্রনার প্রকাশ করে সুন্দর ভালো লাগাগুলোকে নানা সামাজিক অসহিষ্ণুতায় কিন্তু বিসর্জন দিতে হয়,তুলে দিতে হয় পাথরের বেদীতে। এ হচ্ছে এক মানসিক ক্রিয়ার উর্ধমুখি ও নিম্নগামী ধারা যা নিসৃত অলক্ষ্যে নয় প্রকাশ্যে ইচ্ছেয় নয় পরিস্থিতিতে, প্রজ্ঞায় নয় জবরদস্তিতে আর তখন এই ভাষণ বলে দেয় যে শত প্রলোভন বাঁধার দেয়াল পেরিয়ে গেলেও টানেলের অন্ধকার শেষ হয় সেখানে যেখানে দাঁড়ায় বুকখোলা আকাশের মতো উদার মানুষ যে প্রান্তিক যে নষ্ট হয়ে যেতে জানেনি সে দেবদূত নয়, সে নির্মিত প্লাতেরোও নয়, সে চাষি, সে মানুষ যার হারানোর কিছুই থাকে না, সে হাঁপরের মত ‘গনগনে নেহাইয়ের স্ফূ’লিঙ্গ ইস্পাতকঠিন প্রত্যয়ী তৃষ্ণার জলের মতো পবিত্র- তৃপ্ত করে, প্রশান্ত করে। ‘আমাদের কখনো প্লাতেরো ছিল না’। বাস্তবে আর্তচিৎকার ধ্বনিরই ছিল হিমছায়া প্রাত্যহিক। আমরা হারিয়েছি ‘প্লাতেরো’ কিংবা ছিলইনা কোনো কালে। এই সাদামাটা কথাটি ‘আমাদের কোনো প্লাতেরো ছিল না’ সাধারণ হয়ে থাকেনা, হয়ে যায় একটা গভীর ভাবনা ও উপলব্ধির বিষয়াবলী।‘জুডাস জানেনি। জুডাস জানে না।’
তারা জানবে না কোনো দিন-মৃত্যুও অমরতা এনে দেয় বোধের অধিক
যীশুরা অকুতোভয়. চিরকাল যূপকাষ্ঠে দাঁড়িয়েছে হেসে’ [জুডাসেরা জানে না ]
আমাদের চারিদিকে যুডাস, এই যুডাস বিশ্বাস ঘাতক শুধুমাত্র যীশুর হত্যাকারী নয় বরং চলমান এক মানসিকতা নিষ্ঠুরতার প্রেত লোপাট করছে মানুষের মুক্ত জীবনবোধ স্নেহশীলতা, সে কোলাহল নয় ঘাতক সুস্থকে গ্রহণ করে না, যুদ্ধ-বিগ্রহ-হত্যা-ধ্বংস বিনাশই তার কাজ। মানুষ দাঁড়ায় কবি দাঁড়ায় এবং তারা যীশুর মতো আত্মাহুতি দেয় সুন্দরের জন্য স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য। জুডাসরা প্লাতেরোকে খুন করে কিন্তু সে জানে না‘ ফ্যাসিস্ট টিকেনি কখনো/টিকেনি বোথাও কালো মানুষের দেশে/পৃথিবীতে মলোয়সি ম্যান্ডেলারা আসে-কালোহীন শাদাহীন মানবতা, দেশ ভালবেসে’ এই হলো প্রতিপাদ্য। ‘জুডাসেরা জানে না’ শিরোনামের কবিতাটির এই বিস্তার এক বৃহত অনুসন্ধানের দিকে পাঠককে নিয়ে যায়।
০৫.
কবিতা মানব জীবনের আদিম শিল্প যা ধারাবাহিক ভাবে নতুন আঙ্গিকে নতুন হয়ে চলমান। সেই কাল থেকে মানুষ তার অনুভতি প্রকাশের জন্য প্রকাশ কাব্যাকারে তুলে ধরতো সে প্রমাণ রয়েছে প্রাচীন কালের আইন শাস্ত্র, ইতিহাস, ধর্মানুষঙ্গ থেকে। যদিও আজ তা’ আধুনিক অর্থের কাব্য নয় তার বৈশিষ্ট ছিল আবেগময় ভাষা। শব্দে, ঝঙ্কারে,ছন্দে, অনুপ্রাসে আদিম ভাষা যে মোহ ও আকর্ষণ তৈরি করতো তাই হলো কাব্য যা আজও আমাদের কাব্যে নতুন শরীর নিয়ে বিরাজমান। জীবন যাত্রার পরিবর্তন,বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার সমাজ রাষ্টধারণার পরিবর্তন-এর সাথে কাব্য ভাষার পরিবর্তন ঘটে গেছে। আদিম শব্দ ঝংকার, ছন্দ থেকে উলম্ফন নয় বিবর্তন ধারায় কাব্য শরীরের যে পরিবর্তন তা একদিনেরও নয় বহু সময়ের। আজকের কাব্য প্রথাগত ছন্দের দুলুনির ভিতর আটকে নেই, সামন্তীয় ভাব বিলাসেও নিমগ্ন নয়, আজকের কাব্য ক্রমেই লাভকরছে এক নতুন গদ্যলিরিক এবং নিরেট গদ্যবিস্তারও।
‘সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতে চাইলাম
ইতোমধ্যেই আমরা পদছাপ ও কিছু উচ্ছিষ্টের সন্ধান পেয়েছি
লোমের উতিহাস তো আমাদের জানাই ছিল তবু আমরা কিছু লোমও আবিস্কার
করে ফেলেছি এখন শুধু গন্ধের অপেক্ষা’
… … …
অথচ আমাদের প্রতীক্ষাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে
যারা পাশ কাটিয়ে চলে গেল
তারা বুড়ো-ধাড়ি কয়েকটি শৃগাল ব্যতীত আর কিছুই নয়’ [বাঘ দেখার প্রতীক্ষা ]
কবিতাটিতে রাজনীতির হালচাল পরিবর্তন আকাংখায় কবির আশাচূর্নির আর্তনাদ । তিনি বাঘ দেখতে চেয়েছিলেন এবং সেই জন্য তার অপেক্ষা সারাদিনের তিনি এও জানেন যে কম্বলের লোম ঝাড়লে আর কম্বল থাকে না, কিন্তু তবু একটা আশা সুন্দরের মুগ্ধতা মুক্তি ও স্বাধীনতার অমেয় আস্বাদ পাবার তীব্রবাসনায় যারা হাঁটছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল পড়ন্ত বেলায় দেখা গেলো তারা সব ধাড়ি শৃগাল। যারা চালাকি আর স্বার্থ অন্বেষণ ছাড়া প্রকৃত সুন্দর উদ্ধারে উচ্ছিষ্ট। এই অভিব্যক্তির আশা ব্যক্ত হয়েছে ‘আমাদের কোনো প্লাতেরো ছিল না’ যেখানে টানেলের শেষ প্রান্তে যে উজ্জ্বল আলোর উপস্থিতি ঘোষণা করা হয়েছে সেখানে রয়েছে কৃষক, অর্থাৎ প্রান্তিক মানুষ, যে আশার প্রতীক নতুন যাত্রার। আধুনিক কবিতার আকাঙ্খাই হচ্ছে নতুন শরীর, ‘ঐতিহ্যের নবায়ন’। আর রাজনীতিও তার শরীর কলায় লেপ্টে থাকে। এ কারণে লুস্যুনের মতে সকল শ্রেণির শিল্প রাজনৈতিক ভাবে কোন না কোন শ্রেণির সেবা করে। কবিতায় রাজনীতিই প্রথম।’ ‘ আমরা সর্বোচ্চ ঔৎসুক্যে চোখ সেঁটে রেখেছি’ এই যে বিবৃতি এ কোন সাদামাটা কথা নয়, এর অন্তরালে আছে পরিবর্তন আকাঙ্খা যা তীব্র ভাবে এই কবিতায় উপস্থিত রয়েছে আর শেষ বিবৃতিটুকু হতাশা মনে হলেও এর দ্বারা মধ্যবিত্ত চরিত্রের একটা নিপুঁণ চিত্র আমরা পাই যা চালাক শৃগালের সাথেই তুলণীয়। বাঘের যে দেখা পাওয়া গেল না তা কারা কে সে ঠিকানা আমরা পেয়ে যাই তার অন্যান্য কবিতায় আর ‘প্লাতেরো’ কবিতায় তার আভাষ তো রয়েছেই। কবি তমিজ উদ্দীন লোদীর কবিতায় একটা কি আছে, সেই কি কে শনাক্ত না করতে পারলে তার কবিতার আস্বাদ নেয়ায় খানিকটা অপূর্ণ থেকে যায়,কারণ তার একটা বড়গুণ যে তিনি বিষয়ের অনুভব পাঠকের দিকে ঠেলে রাখেন এবং নিজে বসে থাকেন তার সৃষ্টির সামনে- শিল্পী যখন কোন ব্যক্তির চিত্র চিত্রণে যত্নবান হয় তখন সেই ব্যক্তিটি আবিস্কারের অপেক্ষায় কম্পমান এক অনাবিস্কৃত জগতের মতো। ‘মাইকেল এ্যঞ্জেলো বলেছিলেন শিল্পী তাঁর হাত দিয়ে ছবি আঁকেন না আঁকেন মস্তিষ্ক দিয়ে’। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি তার বিখ্যাত চিত্র লাস্ট সাপারে-র সামনে দিনের পর দিন নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, তুলি দিয়ে রং বা রেখার কোন টানই দিতেন না। লিওনার্দেও এই মানস সক্রিয়তা এবং কায়িক নিস্কিৃয়তা বুঝিয়ে দেয় যে মানুষের মন যখন কোন কিছুতে [সৃজনশীল] কাজে নিমগ্ন থাকে তখন বাহ্যিক হয়ে ওঠে নিস্ক্রিয়। একজন শিল্পী তখনই শিল্পী হয়ে ওঠেন যখন অন্যমানুষের চকিতে অনুভব করা বিষয়কে সৃষ্টিযোগ্য বিষয়রূপে দেখেন।
ক্রিস্টোফার কডওয়েল কবিতাকে জমাটবাঁধা ‘সামাজিক সংগ্রামের ইতিহাস’ বলেছিলেন। এবং তার মত অনুসারে কবিতা যৌথ এবং সামাজিক ক্রিয়াকান্ডের রসায়ন। মানুষের আবেগবাহিত সকল ভাবনা কল্পনার সাথে মিশে যে প্রতিচ্ছায়ার সৃষ্টি করে শিল্পের ছন্দে তাই রূপায়িত হয় যা সামাজিক বস্তুলগ্ন এবং আকাঙ্খার বিশেষ উৎস থেকে বহির্গামী একটা বিশেষে যা পাঠকের পঠন ও আত্মস্তকরণ পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় এবং পাঠকের আগ্রহ থেকে তৈরি হয় আর একটি বিশেষ যা তার আকাঙ্খায় প্রতিফলিত হয় বস্তুর কেন্দ্রে। ভাবনায় বস্তু নয় বস্তুতে ভাবনা। .‘.তুলির টানে তুমি ক্যানভাস ছূঁয়েছিলে /তাই দেখো বিমূর্ত-’ কারণ ছবি শিল্প বা ভাষা শিল্প কোনটাই মানুষের বেদনার পরিমাণ কে তার স্তরিক বিশ্লেষণকে এবং তার শারীরিক ক্রিয়াকে শতভাগ প্রকাশ করতে পারে না। ঈর্ষা হিংসা ক্রোধ-এর পরিমাপক নেই, কেবল একটা অনুমান আর এসব নিয়ে মানুষের মধ্যে যে স্বসপ্ন গড়ে ওঠে তা’ শাসক টের পায় না। যেমন পায়নি ৭১ সালে আর তা যখন বাস্তব হয়ে উঠলো এবং প্রকাশ্য হলো তখন বোঝাগেলো ‘স্বসপ্নের ঘোড়া দৌড়ায়..’ তার একটা ছন্দ আছে।
‘আলোটা এদিকে ফিরাও সুলোচনা
অন্ধকারে ছেয়ে গেছে এ’পাশ।
যে সব কাঁচপোকা, যেসব নক্ষত্র এ যাবত আলো ফেরি করে বেরিয়েছে
তারা হারিয়ে গেছে অরণ্যে ও ব্লাকহোলে’ [‘আনন্দময় নৈরাশ্য ও ইস্পাত মানুষেরা’]
কাব্যের নামকরণ অর্থবোধকতার দ্যোতনা দেবে পাঠককে। সুন্দর এর বহুমুখী কবিতাগুলো। প্রত্যেকটি কবিতা পাঠক-হৃদয়কে স্পর্শ করবে । চমৎকার কাব্যশৈলী আর ভাষ্যবুননে বহুমাত্রিক ভাবনার যোজনা । যেমন ‘আনন্দময় নৈরাশ্য’ খুব সাধারণ ভাবে যে কেউ বলবে নৈরাশ্য আনন্দময় কেন? এরকম এক দ্বিধা শুরুতেই। এই যে কুটাভাষ কবিতার এক বিশেষ গুণ। হ্যাঁ যখন মানুষ অধিকার হারা, সমাজ রাজনীতির শিকার হয়ে বোধ চেতনা লুপ্তিতে পড়ে, নিজেকে যখন আর আবিস্কার করতে পারে না- সে নিজে আর নিজে কিনা, তখন স্পষ্টতই সে যে জীবনকে বহন করে তার কোনো কিছুই যেন তাকে আর স্পর্শ করে না। কোনো কিছু যেন তার নয়, কোনো কিছুর দায়ভাগও তার নয়। এমন এক নৈরাশ্যপূর্ণ জীবন বদ্ধ মানবপ্রাণালী এক অদ্ভুত ধারায় স্থাপিত হয়। সে হয় কোনো শক্তিরই সেবাদাস যাকে সে চিনতে পারে প্রভু রূপে। এতে তার কোন ক্ষোভ দুঃখ হতাশা কোনোটাই তার নেই, জাগ্রতও হয়না। সে সারাটা জীবন-যৌবন এমন এক বোধের ভেতরে স্থাপিত করে যেখানে সে কেবলই একটি প্রাণী । সে বুঝতেই পারে না আসলে কি হারানো গেছে । ঠিক তার সংগে যুক্ত হয়েছে ‘ইস্পাত মানুষেরা’ । তমিজের কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে রয়েছে তারই ইঙ্গীত।
‘ আনন্দময় নৈরাশ্যে ডুবে আছে দিন। রোদের ভেতর হেঁটে যাচ্ছে ইস্পাত মানুষেরা। শিরস্ত্রাণে পালকের স্তুপ। দস্তানায় লেগে আছে শুকিয়ে যাওয়া কালচে রক্তের ধারা’
এমনি এক বুননের মধ্যদিয়ে মৃদু উচ্চারণে সে বুনে গেছে ‘চারাবীজ’ এমন এক পরিপাটি করা কাব্যফসল যেনো আত্মউচ্চারণের শব্দমালায় গোটা বিষয়টি উচ্চারিত হচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে এবং আপন বৈভবে সুর হয়ে উঠছে কানে। ‘ আনন্দময় নৈরাশ্যে যতই ডুবে থাক দিন। গোধুলি শেষে তবু মানুষেরা ঘরে ফেরে’ এই যে নেই এবং আছে, আছে এবং নেই এর অনুসন্ধান তার কবিতাগুলোর প্রায় সবকটিতেই। সে হৈ চৈ করে কোনো কিছু বলেনি, বলেছে ‘কাব্য-শিল্প আনন্দকে’ পূর্ণ মাত্রা দিয়ে। ‘বার বার ঘুরে ঘুরে আসে পাঞ্চালের সামন্ত সমাজ। ঘুরে ঘুরে আসে কুরুক্ষেত্র’। নয় কি? কারণ যতবার মানুষ দখল হয় ততবারই মানুষেরা মুক্তির মহা লড়াইয়ে জাগ্রত হয় লড়ে জীবন দেয়। ‘মার্কেজ এবং কফিরঙ মেয়েটি’ একটি অসাধারণ কবিতা। ‘তার চোখে জল, আনন্দাশ্রু! /-আমি তবে শুধু খুন,গুম আর ড্রাগের দেশের মানুষ নই! আমার রয়েছে মার্কেজ, একজন নোবেল লোরিয়েট, একজন মহান লেখক’ এই পঙক্তি যা কফি রঙের মেয়েটির বোধের মধ্যদিয়ে প্রকাশিত এবং কবি তমিজ উদ্দীন লোদীর কাব্য-বুননের মধ্যদিয়ে। দেশ আর সীমারেখাদ্বারা সীমিত হয়ে থাকেনা, হয়ে যায় সকল দেশের সকল মানুষের স্ব-আত্মার ধ্বনি। খুঁজে পায় দেশমাতৃকার মহত্ম, নিজ পরিচয়। [ এই কাব্যগ্রন্থটি নির্বাচিত গ্রন্থে আসেনি পাঠক চাইলে সংগ্রহ করে নিতে পারেন]
আমি আগে বলেছি তমিজে কবিতায় একটা কী আছে, সেই কী-টা জানতে তাঁর কবিতাগুলো আদ্যপান্ত পাঠের প্রয়োজন। তবে আমার ভাল লাগছে এজন্য যে নির্মাণ কলায় তিনি এমন একটা সম্মোহন তৈরি করতে পেরেছেন সহজ করে বলার মধ্য দিয়ে যা পাঠককে নিয়ে যাচ্ছে নিজের দিকে চোখমুখ খুলে জানবার ও চিনবার দিকে, তার পরিপার্শের দিকে আর অবারিত করছে দুঃখের উৎসগুলোকে কাব্যিক শিল্প চেতনায়। তার কবিতা চেতনার কবিতা, নিছক কবিতার জন্য কবিতা নয় । এক লাবণ্য ছড়িয়ে তিনি সেই কথাগুলোই বলতে চাইছেন- মানুষের দুঃখ বেদনার রাশি রাশি ইতিহাস ।
‘যুবকটি দৌড়াচ্ছে! উর্ধ্বশ্বাসে। পেছনে চাপাতি বাহিনী।’ নিশ্চয়ই কবিকে কবির সচেতনাকে সনাক্ত করা যায় মুহূর্তে।