আবু তাহের সরফরাজ
কবিতা কোনো কালখণ্ডে বন্দি নয়। নদীর স্রোতের মতো কবিতা বহমান। এরপরও সময়ের এক একটি খণ্ডে কবিতার চেহারা ও বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতেই দশকভিত্তিক কালবিভাজন করা হয়। এর সুবিধে হচ্ছে, কবিতার ধারাবাহিক যাত্রাটি সহজে বুঝতে পারা যায়। কখন, কীভাবে চলমান ধারা থেকে কবিতা ভিন্ন আঙ্গিকে বাঁক পরিবর্তন করলো, সেই সূত্রটিও এর মধ্যে দিয়ে আবিষ্কার করা সম্ভব হয়। নব্বইয়ের দশক পেরিয়ে ২০২৪ সালে এসে পেছনে ফিরে তাকালে এখন বুঝতে পারি, বাংলা কবিতার ধারাবাহিক স্রোতধারা থেকে নব্বইয়ের কবিতা খুব একটা বাঁক নিতে পারেনি। মানে, নতুন কোনো প্রকরণ কিংবা ভাষাশৈলী নির্মাণ করতে পারেনি। তবে সেই চেষ্টা নব্বইয়ের কবিদের ছিল, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই চেষ্টার ফলেই কেউ কেউ খুঁজে নিতে পেরেছেন নিজস্ব শিল্পশৈলী। পূর্বজদের কবিতার ধরণ ও প্রকরণ থেকে কিছু হলেও আলাদা কবিতা কারো কারো কাছ থেকে আমরা পেয়েছি। আলাদা এই অর্থে যে, সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি। সমাজ ও রাষ্ট্র বাস্তবতাও সময়ের ঢেউয়ে বদলে যায়। এই বদলের চিহ্নই তাদের কবিতায় পাঠকের চোখে পড়ে। আর তাই, নব্বইয়ের কবিতা পড়তে গেলে ঘুরেফিরে এখন হাতেগোণা কয়েকজন কবির কবিতাই পাঠক পড়ে। বাকিদের কবিতা পড়া না হলেও একেবারে খারিজ করে দেয়ার মতো সক্ষমতা উত্তরসূরি হিসেবে এখনো আমাদের তৈরি হয়নি।
বাংলা কবিতার ইতিহাসে দেখা যায়, সহজ ও পরিচিত শব্দে লেখা গীতল কবিতাই পাঠক মনে রাখে। এবং পড়েও। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের কয়েকজন কবির কবিতা ছাড়া বাকিদের কবিতায় এই গুণটি উধাও। সত্যি যে, কবিতা নানা রকম। কেবল গীতল হলেই যে কবিতা, অন্যরকম হলে কবিতা নয়, বিষয়টি তা কিন্তু নয়। নব্বইয়ের কারো কারো কবিতার অবয়বে প্রচুর অপ্রচলিত শব্দ ও গদ্যের মতো কাঠিন্য রয়েছে। এরপরও সেসব কবিতা সুখপাঠ্য। পড়তে পাঠকের ভালো লাগে। অনুভূতির নতুন কোনো আস্বাদ টের পাওয়া যায়। তবে এ জাতীয় কবির সংখ্যাও কয়েকজন।
মনে রাখতে হবে, নব্বইয়ের দশক বৈশ্বিক ও স্বদেশি বিভিন্ন পরিমণ্ডলে ভাঙনের একটি সময় পার করেছে। সদ্য কৈশোর পেরোনো একদল তরুণ কবিতার বীজ মাথায় নিয়ে জীবিকার খোঁজে সেই সময় ঢাকায় একত্রিত হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে তখন বের হচ্ছে সাহিত্যের ছোটকাগজ। সেইসব কাগজে লিখছেন তারা। আড্ডা দিচ্ছেন। একজন আরেকজনকে বলছেন কবিতা নিয়ে তার ভাবনার কথা। এইভাবে বাংলা কবিতার উত্তুঙ্গ একটি সময়ের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন নব্বই দশকের কবিরা। এরপর প্রথম দশকের কবিদের আবির্ভাব। তারাও কয়েক বছর ছোটকাগজ কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার সুযোগ পেয়েছিল। এরপর চলে এলো অনলাইন প্রযুক্তির যুগ। আস্তে-ধীরে কমে যেতে লাগল ছোটকাগজের প্রকাশনা। বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করলো কবিরা। কমে যেতে লাগলো আড্ডা। তো, এইসব হিসাব বিবেচনা করলে নব্বইয়ের কবিদের কাছ থেকে আমরা আরও শিল্পমান সম্পন্ন কবিতা আশা করতেই পারি। কিন্তু আমাদের সেই আশা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছেন ওই দশকের কবিরা?
নব্বইয়ের দশকটিতে নানা রকমের অসংখ্য কবিতা লেখা হয়েছে। একজন কবি শিল্পের নানা আঙ্গিকে কবিতার শরীর নির্মাণ করেছেন। চালিয়েছেন পরীক্ষা-নীরিক্ষা। কারো কবিতায় তৈরি হয়েছে নিজস্ব স্বর, কারো কবিতা পৌনঃপুনিক। নব্বইয়ের দশকের কবিদের ঝাঁক থেকে কেউ কেউ বেরিয়ে গেছেন। মানে, তারা এখন আর কবিতা লেখেন না। আবার, কবিতার ভূত এখনো কারো কারো ঘাড়ের ওপর বেতালের মতো চেপে বসে আছে। যেমন বসে থাকতো রাজা বিক্রমাদিত্যের ঘাড়ে। এই কবিতার ভূতকে কাঁধে নিয়েই এই দশকের বেশির ভাগ কবি কংক্রিটের শহর ঢাকায় জড়ো হয়। এরপর শুরু হয় লড়াই। একদিকে জীবিকার তাড়না, আরদিকে কবিতার ভূতকে সামাল দেয়া। এই দুই পাল্লায় ভারসাম্য রাখতে পেরেছেন খুবই কম কবি। কেননা,
শোনো বন্ধু শোনো,
প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা
ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায়
দারুণ মর্মব্যথা।
অন্ধগলির নরকে মুক্তির আকুলতা নিয়ে শহরে একজন জাদুকর এসেছেন। ব্যস্ত শহর। চারদিকে উঁচু-উঁচু দালানকোঠা। রাস্তায় যানাহনের ঠেলাঠেলি। আর আছে মানুষের স্রোত। কর্মব্যস্ত মানুষ। বেকার মানুষ। ভিখিরি মানুষ। যে যার ধান্দায় ফাঁদ পাতা শহরের বুকে ছুটছে। প্রতিমুহূর্তেই কেউ না কেউ ফাঁদে পড়ে কপাল চাপড়াচ্ছে। আর, ফাঁদের পাশ দিয়ে ছুটে চলা মানুষ ভাবছে, সে তো এখনো ফাঁদে পড়েনি! বহুত বাঁচা বেঁচে গেছে। পরমুহূর্তেই তাদেরই কেউ না কেউ শহরের চক্রব্যূহর ফাঁদে পড়ে হাঁসফাঁস করছে। আর ওপরে চেয়ে দেখছে, মানুষ ছুটছে। ছুটতে থাকা এই শহরে এসে জাদুকর ভাবলেন, মানুষ তো বড় বেকায়দায় পড়ে গেছে হে! কিছু একটা করতে হবে। এই ভাবনা থেকে তিনি বুনতে আরম্ভ করলেন শব্দের ঐন্দ্রজাল। কারণ তিনি জানেন, শব্দই ব্রহ্ম। শহরবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি বললেন,
জঙ্গল দেখলেই মনে হয়, ওই জঙ্গলের একদম ভেতরে একটা জাদুঘর আছে। অসংখ্য গাছে গাছে ভরা অবিরাম পাতায় পাতায় হাওয়া-বাতাসের অর্কেস্ট্রা আর অগণন পাখিতে পাখিতে নরম পালকে পালকে ডিসপ্লে করা গ্রিনমিউজিয়াম।
কী যন্ত্রণা! শহরবাসী তার কথায় বিরক্ত হয়। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে যে যার গন্তব্যে ছুটতে থাকে। যান্ত্রিক নগরজীবনে জাদুকর জঙ্গলের প্রলোভন দেখাচ্ছেন। জঙ্গল কেন? কারণ, জঙ্গলে সবুজ জাদুঘর আছে। আহা, সবুজ! শহরবাসী কতদিন সবুজ বনানী দেখেনি! সবুজ টিয়ে দেখেনি। পাখির কলকাকলি শোনেনি! জাদুকর তাদেরকে আহ্বান করছেন, সেই সবুজ মিউজিয়ামটি একটিবার ঘুরে আসতে। তিনি আরও প্রলোভন দেখাচ্ছেন, জাদুঘরে, গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে মরচেধরা অনেকদিন আগের একটা বাইসাইকেল। সেই সাইকেলটা কার গো, কার? তার এই শব্দবন্ধনিতে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে শহরময়। এরপরও কেউ ফিরে যেতে চায় না শৈশবে। অথচ জাদুকর তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছেন, কৈশোরিক স্মৃতি। দুরন্ত এক কিশোর। বাবার মরচেধরা পুরনো সাইকেলটি নিয়ে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে পড়লো। ছুটতে ছুটতে চলে এলো জঙ্গলে। এরপর একটি গাছের সঙ্গে সাইকেলটি হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে গভীর বিস্ময়ে সে হাঁটতে লাগলো জঙ্গলের পথ ধরে। এই রকম একটা জীবন ছিল প্রত্যেকের। জীবিকার অন্বেষণে ছুটতে ছুটতে শহরবাসী আজ ভুলে গেছে সেইসব বিস্ময়ের দিনগুলো। কর্মস্থল থেকে ক্লান্ত হয়ে তারা সন্ধের পর ফিরে আসে মুরগির খোপের মতো ফ্ল্যাটে। এরপর সারা দিনের অবসাদে এলিয়ে পড়ে বিছনায়। ভোরবেলা আবার ছুটতে হবে, এই তাড়না নিয়ে। জাদুকরের জাদুকরি শব্দের বিন্যাস তাদের কাছে বিরক্তিকর ঘ্যানঘ্যানানি মনে হয়। এসব বকবকানি তারা শুনতে চায় না। আর তাই, তারা কেউ কবিতাও পড়ে না। পড়বেই বা কেন? কবিতা তো চাল-ডালের মতো জরুরি নয়। কবিতা দিয়ে প্রতি মাসের বাড়ি ভাড়াও দেয়া যায় না। ফলে, জাদুকরের উদাত্ত শব্দের আহ্বান তাদের কাছে এক রকম প্রলাপ।
তা-হলে কী হবে, জাদুকর তো আর তার শব্দের জাদু বাকসোবন্দি করে রাখতে পারেন না। তাই তো তিনি লিখে চলেন কবিতা। শব্দের আশ্চর্য কেরামতি প্রকাশ করেন তিনি ব্যস্ত শহরের বুকে। জাদুকর আর কেউ নন, টোকন ঠাকুর। নব্বই দশকের মেধাবী একজন কবি। তার সময়ের আরসব কবিদের কাব্যভাষা থেকে আলাদা ভাষা নির্মাণে যার কবিতা হয়ে ওঠে জাদুর বাঁশি। সেই বাঁশিতে ফুঁ দিলে যে সুর বের হয়ে আসে, সেই সুর আর কারো কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় না। সত্যি বলতে কি, নব্বই দশকের বেশিরভাগ কবি খুঁজে-খুঁজে শব্দ ধরে এনে বসিয়ে দেন কবিতার শরীরে। তাতে কবিতা একটি আকার ঠিকই পায়, কিন্তু বোধের অনুরণন সেখানে স্ফুরণ ঘটায় না। খটোমটো শব্দ। খটখট শব্দ। ঠকঠক শব্দ। কংক্রিটের মতো প্রাণহীন শব্দ। যা কানে বিরক্তিকর শোনায়। জীবনের নির্যাস সেসব শব্দ বহন করে না। এরই ফলে, নব্বই দশকের কবিতা বহুলভাবে এখন আর পড়া হয় না। সেই সময়ের যে কয়েকজন কবির কবিতা এই সময়ের পাঠক নিবিড় মনোযোগ ও আনন্দ নিয়ে পাঠ করে, টোকন ঠাকুর তাদের একজন। শব্দ যে জাদুর মতো সম্মোহন ছড়িয়ে দিতে পারে, টোকন এটা জানেন। আর তাই তার কবিতা যে যে শব্দ নিয়ে নির্মিতি পায়, সেসব শব্দ যেন বের হয়ে আসে জাদুর বাকসো খুলে। যেহেতু শব্দের কলাকৌশল টোকনের আয়ত্বে, সেহেতু টোকন অনায়াসে তার কবিতায় নানা বিষয় ও প্রকরণ সংযোজন করতে পারেন কুশলী জাদুকরের মতো। ‘সব কবিতার শিরোনাম লাগে না’ কবিতায় টোকন লিখছেন:
রোদ তুই ছন্দ জানিস? মাত্রা মানিস?
সামান্য ফাঁক-ফুঁটো পেলেই ঢুকে পড়িস?
রোদ তোর আসার পথে দেখা হয়েছে কার কার সঙ্গে, বল?
মেঘরা ছিল কোন বৃত্তে, কথা হয়নি আমাকে নিয়ে?
তিরিশটি খুবই সাধারণ শব্দ নিয়ে চারটে মোটে বাক্য। পড়তে পড়তে ছন্দের একটা ঢেউ যেন পাঠকের ভেতরটা দুলিয়ে দিয়ে যায়। পড়া শেষ হলে মনে হয়, নাহ, সাধারণ হয়েও শব্দগুলো অসাধারণ দ্যোতনা ছড়িয়ে দিয়েছে। কাঠখোট্টা হয়ে ওঠেনি। কেন হয়ে ওঠেনি? কারণ, টোকন জানেন শব্দের জাদুময়ী ক্ষমতা। তিনি শব্দতে ধরে এনে কবিতার শরীরে বসিয়ে দেন না। শব্দেরাই এসে ধরা দেয় তার কবিতায়। একজন কবির শিল্পনৈপুণ্য এরচেয়ে আর কী থাকতে পারে! ‘বাক্যবিস্তার’ কবিতায় টোকন লিখছেন:
বাক্য বহো বাক্য বহো বাক্য বহো ধীরে
বাক্য ব্যাকুল জলাঙ্গিনী, আছড়ে পড়ে তীরে।
ফলে, একদিন শুনতেই হলো—
‘বাক্য বলতে কি বোঝো?’
আমি সাফ জানিয়েছি, বাক্য বলতে খুঁজে পাওয়া
এবং নিখোঁজও
আমরা জানি, কতগুলো শব্দ একসাথে মিলিত হয়ে তৈরি হয় বাক্য। কিন্তু টোকন আরেকভাবে বাক্যের সংজ্ঞা আমাদেরকে জানাচ্ছেন। তিনি বলছেন, বাক্য বলতে খুঁজে পাওয়া এবং নিখোঁজও। ঠিক কবিতার মতো। যদি বলা হয়, কবিতা বলতে কী বোঝো? এর সঠিক কোনো জবাব আমাদের কেউ-ই দিতে পারবে না। তবে এক ধরনের রহস্য কিংবা জাদুর বাকসো খুলে যে কবিতা বের হয়ে আসে, এ বিষয়ে সকলেই একমত হবেন। কবিতার অবয়ব তৈরি হয় বাক্য দিয়ে। সেই বাক্যই খুঁজে পাওয়া আর না-পাওয়ার মাঝামাঝি কোনো একটি জায়গা নির্দেশ করছে। প্রকৃত কবির অনুধ্যান, রহস্যময় ওই জায়গাটিতে বসে বাক্যের শরীরী বিস্তার দেখে যাওয়া। টোকন ঠাকুর তার বেশিরভাগ কবিতায় মূলত এই দেখে যাওয়ার কাজটি করেন। আর, বাক্য ধীরে-ধীরে নিজেকে বিস্তার ঘটিয়ে কবিতার শরীর নির্মাণ করে নেয়। এখানে টোকন নিমিত্ত মাত্র। অথবা দর্শক। দেখে যাওয়া ছাড়া তার যেন আর কোনো কর্তব্য নেই।
টোকন যখন গল্প কিংবা উপন্যাস লেখেন, তখনো শব্দ ও বাক্যের এই লীলা তার শিল্পনির্মাণে লক্ষ্য করা যায়। আসলে বলতে কি, টোকন শব্দ নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসেন। শিশু যেমন তার খেলনাপাতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নিয়ে খেলতে থাকে, টোকনও অনেকটা তেমন। টোকন যখন লিখতে বসেন তখন জাদুর বাকসো খুলে শব্দেরা তার চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। শিল্পনির্মাণে যখন যে শব্দ নিয়ে খেলতে ইচ্ছে করে, টোকন সেই শব্দ অনায়াসে তার উপলব্ধির বয়ানে বসিয়ে দেন। ঠিক যেন জাদুকর। টোকনের জাদুর এই কেরামতি প্রজ্ঞাবান যে কোনো পাঠক টের পাবেন তার কবিতা কিংবা কথাসাহিত্য পড়লে। তবে সাধারণ পাঠকের বুঝতে একটু অসুবিধে হতে পারে। আমরা জানি, টোকন একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। চলচ্চিত্র শব্দের দৃশ্যরূপ। ফলে, শব্দ ও দৃশ্যের একীভূত সত্তায় গড়ে উঠেছে টোকনের শিল্পবোধ। আর তাই, টোকন ইচ্ছেমতো শব্দ নিয়ে খেলতে পারেন। যা তার সময়ের বেশিরভাগ কবিই পারেন না। এরই ফলে তাদের কবিতা নির্মাণে দেখা যায় অদরকারি শব্দের ব্যবহার।
এখনো কবিতা পড়ো মানে তুমি মনে মনে ভাবো
আচমকা এক ফুরফুরে বিকেলে প্রজাপতি সম্মেলন হবে।
সেই সম্মেলনে তুমি স্বাগতিক, তোমার ব্যস্ততা থাকবে।
তুমি ফুলদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে করতে
ঘাসের বক্তব্য শুনতে শুনতে, হয়তো বা ভুলে যাবে—
একজন কবি এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দেখছে,
পোকা থেকে তুমি প্রজাপতি হয়ে কতটা বদলে গেলে?
এখনো কবিতা লেখা হয় মানে সেই লোকটিই কবি—
যে কীনা পোকা হতে পারেনি বলে প্রজাপতি হতে পারছে না
টোকন ঠাকুরের এই কবিতায় সত্তরের দশকের প্রধান কবি আবিদ আজাদের কবিতার আবছায়া চোখে পড়ছে। আবিদ আজাদ কেবল সত্তরের দশকের নন, বাংলা কবিতায় সর্বকালের একজন স্নিগ্ধ কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যাবেন। আবিদের কবিতা মানেই সহজ-সরল কথার জাদুকরী ঐন্দ্রজাল। নাগরিক জীবনের বিষাদ, হতাশা ও একাকিত্ব তার কবিতায় যে আবহ তৈরি করে, সেই আবহ আর কোনো কবির কবিতায় আমাদের চোখে পড়ে না। নগরজীবনের দিনযাপনের ছোট ছোট মূহুর্ত ছবির মতো শব্দছাপে আঁকা থাকে আবিদের কবিতায়। এই অনুভূতি পাঠককে ফুরফুরে আনন্দ দেয়। বুকের ভেতর হাহাকার জাগিয়ে তোলে। কবিতার ভেতর দিয়ে পাঠক আসলে নিজের অনুভূতিকেই ছুঁয়ে যেতে পারে। ষাটের দশকের কবি আবুল হাসানের বেশির ভাগ কবিতা এই রকম। যে কবির ক্ষমতা এই রকম, সেই কবির কবিতার মতো কবিতা উত্তরসূরীদের ওপর প্রভাব ফেলবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে নবীন কবির কৌশল হতে হবে কবিতায় স্বকীয় ভঙ্গি স্পষ্ট কোরে তোলা। নব্বইয়ের দশকের মেধাবী কবি টোকন ঠাকুর সেই কৌশল জানেন। যাপিতজীবনের দীর্ঘশ্বাস ও নাগরিক একাকিত্ব তার কবিতায় থাকলেও তা আবিদ আজাদের মতো নয়। আবিদের কবিতা যেমন নয় আবুল হাসানের কবিতার মতো। আবিদের কবিতা থেকে টোকনের কবিতা আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায় বিষয়বৈচিত্র্য, ভাষাশৈলী ও আঙ্গিকে। অবশ্যি এ ধরনের কবিতা কমই লিখেছেন টোকন। নব্বইয়ের দশকের অনেক কবির মতোই টোকনও কবিতায় পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছেন। কখনো ছন্দ, তাল ও লয় মেনে সিম্ফনির ওপর শব্দকে বসিয়েছেন। কখনো গদ্যের নিপাট শব্দে বুনে চলেন অনুভূতি। আবার কখনো তার কবিতা বর্ণনাধর্মী। কবিতার ধরণ ও আঙ্গিক যে রকমেরই হোক, টোকনের সকল কবিতাই সুখপাঠ্য। পড়তে পাঠক আরাম পায়। কথাগুলো সহজ ও পরিচিত। ‘চরাচরের ঘর’ কবিতায় টোকন ঠাকুর লিখছেন:
এভাবে কবিতা হয় না, লেখাপড়া শিখে
নিরক্ষর ভাটফুলও জানে…
ফুল ফুটবে বনে, ঘ্রাণ তো ছাপাই হবে না
পাঠ্যবইয়ের বাইরে যাদের পাঠ্যবই বেশি
তারাই উৎসাহিত হবে বা উৎকীর্ণ হবে:
সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের ভেতর থেকে
উড়ন্ত শালিখের ডাক শোনা যায় কিনা!
টোকনের কবিতার মজাটা ধরা যাচ্ছে তো? খুবই সহজ কথা। সহজ ইঙ্গিত। কবিতার বইয়ের ভেতর থেকে শালিখের ডাক শোনার অভিজ্ঞতা প্রচলিত কোনো অভিজ্ঞতা নয়। এ অভিজ্ঞতা পেতে হলে শিল্পরুচি থাকতে হয়। যা তৈরি হয় পাঠ্যবইয়ের বাইরের পাঠ্যবই পড়ে। নিজের ভেতরটা আকাশের মতো খোলামেলা আর বিস্তৃত করতে পারলে কবিতায় লেখা চাঁদকেও পাঠক নিজের মনের চোখে দেখতে পায়। কবিতার সাথে এইভাবে লতায় পাতায় পাঠকের আত্মিক সম্পর্কের সাঁকো তৈরি করে দেন টোকন ঠাকুর। টোকন জানিয়ে দেন, কবিতার মতো ফুলের ঘ্রাণ চেপে রাখার উপায় মানুষ জানে না। অথচ ফুল কিন্তু ঠিকই ফোটে, ঝরেও যায়। কেবল সেই ঘ্রাণের স্বরূপ মানুষের কখনোই জানা হবে না। তবে ঘ্রাণের উপলব্ধি মানুষ করতে পারে। এই উপলব্ধির ধরণ পাঠ্যবই পড়াদের বেলায় এক রকম, পাঠ্যবইয়ের বাইরের পাঠ্যবই পড়া মানুষের বেলায় আরেক রকম। খেয়াল করে দেখার বিষয়, টোকন বলছেন, পাঠ্যবইয়ের বাইরের পাঠ্যবই। এ বই আবার কী রকম! এখানে টোকনের দৃষ্টি শিক্ষাবিদের মতো। তিনি বলতে চান, প্রচলিত পাঠ্যবই যথেষ্ট পাঠ্য নয়। প্রকৃত পাঠ্যবই বাজারের হাজার হাজার বইয়ের ভেতর থেকে খুঁজে বের করতে হয়। এরপর পড়তে হয়। খুঁজে নেয়ার মতো মেধাবী চোখ যার আছে, সেই কেবল ঘ্রাণের উপলব্ধি করতে পারবে। ঘ্রাণের ভেতর ডুবে গিয়ে কল্পনাকে আরও বিস্তৃত করতে পারেন। অনুভূতিকে রাঙাতে পারেন আনন্দের নানা রঙে। নানা রঙের এই জীবনবোধে টোকনের কবিতা নাগরিক জীবনের টুকরো টুকরো ছবি। কখনো ফেলে আসা গ্রামের মেঠোপথ আর জঙ্গলের স্মৃতি-কাতরতা। টোকনের কবিতা আসলে একই অঙ্গে বহুমাত্রিক। জাদুর মতো ঐন্দ্রজালিক।